#কুয়াশায়_ঘেরা
#পর্ব_০৫
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
সকাল হতেই ব্যস্ততা চেপে বসেছে। দু’দন্ড শরীরকে বিশ্রাম দেওয়ার সময় নেই, কেউ কারো দিকে তাকানোর সময় নেই। সকালে একটু নাস্তা মুখে তুলেই ইলানকে অফিসে ছুটতে হয়েছে।
-“স্যার! মনি মেয়েটার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এসেছে।”
ইলান জিজ্ঞেস করলো,
-“কি এসেছে রিপোর্টে? নিশ্চয়ই সেও নন-ভার্জিন।”
শিহাব ডানে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলল,
-“না স্যার, মনি ভার্জিন। তার সাথে এরকম কিছুই হয়নি। তবে দুটো খু’নের বিবরণ বলছে খু’নি একই ব্যক্তি।”
আশ্চর্য হলো ইলান। চোখদুটো ছোট করে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
-“তবে কি মনি তুর্শির মা’র্ডারের ব্যাপারে সব জানতো? আর সেইজন্যেই কি মনিকে মা’র্ডার করা হয়েছে?”
-“হতে পারে স্যার।”
শিহাবের কথা শেষ হতেই ইলান প্রশ্ন করলো,
-“গতকাল যে তোমাদের তুর্শির বাড়িতে পাঠিয়েছি। কিছু বলাতে পেরেছো সারভেন্টের মুখ দিয়ে?”
তনুশ্রী বলল,
-“না স্যার, মেয়েটা কিছুই বলছেনা। সে নাকি তুর্শির সাথে মাঝেমধ্যে গল্প করতো। এর বেশি তুর্শির সাথে তার ভাব ছিলোনা। কিন্তু মেয়েটাকে আমার যথেষ্ট সন্দেহ হয়েছে স্যার। আমার মনে হচ্ছে মেয়েটা কিছুতো একটা জানে।”
ইলান বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো। মুনিরকে বলল,
-“গাড়ি বের করো। সোজা তুর্শির বাড়ি।”
ইলান সহ বাঁকি চারজন তুর্শির বাড়িতে পৌঁছে গেলো। স্বপন মির্জা ইলানকে দেখেই বসতে বললেন। মেয়ের কথা তুলে দুঃখী দুঃখী ভাবে বসে রইলেন।
ইলান বলল,
-“আমরা তুর্শির ঘর সার্চ করবো। মুনির, নাজমুল, শিহাব, তনুশ্রী কুইক।”
স্বপন মির্জা ভড়কে গেলেন।
-“তুর্শির ঘর কেনো সার্চ করবেন? খু’ন কি বাড়িতে হয়েছে? নাকি আপনারা বাড়ির লোককে সন্দেহ করছেন?”
ইলান ঈগল চোখে তাকালো। ধারালো নজরে স্বপন মির্জাকে পরোখ করে বলল,
-“আপনারতো নিজের মেয়ের খু’নিকে পাওয়া দরকার। এখন সে তো আপনার বাড়িতেও লুকিয়ে থাকতে পারে। এমনকি সে ব্যক্তি আপনিও হতে পারেন।”
হিং’স্র বাঘের মতো গর্জে উঠলেন স্বপন মির্জা।
-“আপনারা এখানে তদন্ত করতে এসেছেন, নাকি তামাশা? আমি কেনো নিজের মেয়েকে খু’ন করতে যাবো?”
ইলান শান্ত রইলো। বিশেষ প্রতিক্রিয়া তার মাঝে দেখা গেলোনা। স্বচ্ছ, পরিষ্কার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-“রে’গে গেলেন তো হেরে গেলেন। আমাদের কাজই হলো অনুমান করে সঠিক তথ্য বের করা।”
-“তাই বলে আমাকেই নিজের মেয়ের খু’নি বানিয়ে দেবেন? এতে আমার ফায়দা কি? তার সম্পত্তি আমি মে’রে খাবো?”
ইলান বলল,
-“আপনার মেয়েকে আপনি দিলে তবেই সে সম্পত্তি পাবে। তাই এখানে সম্পত্তি মে’রে খাওয়ার প্রশ্ন আসছেনা।”
স্বপ্ন মির্জা নিজেকে শান্ত রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করে বললেন,
-“কিন্তু আপনার কথাতে তো এটাই প্রমাণ হয় মিস্টার ইলান মুনতাসীর।”
———————
হাতে গ্লাভস পরে চারজনে ত’ল্লাশিতে নেমে পড়লো। ওয়ারড্রব, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, বুক শেল্ফ সব কিছু ওলট পালট করা হয়ে গেলো। সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া গেলোনা। বেডরুমের ভেতরেই আরও একটা রুম আছে। সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে ড্রয়িং এর জন্য রুমটা করা হয়েছে। চারদিকে রং এর ছড়া’ছড়ি, বিভিন্ন আর্ট।
নাজমুল ওয়াশরুমের ভেতর চেইক করলো। হঠাৎ ওয়াশরুম থেকে নাজমুলের ডাকে মুনির, শিহাব দৌঁড়ে সেদিকে আসলো। নাজমুল তর্জনী তাক করে দেখিয়ে দিলো দেয়ালে র’ক্তের ফোঁটা। একটা নয়, দুইটা নয় চারফোঁটা র’ক্তের দাগ দেয়ালে লেপ্টে শুকিয়ে আছে ওয়াশরমের এককোনায়। হঠাৎ করেই কারো নজরে পড়ার কথা নয়।
তনুশ্রী বিছানার চাদর, বালিশ, জাজিম সব ওলটপালট করে একটা জিনিস দেখতে পেলো। যা এখানে থাকা একটা অভাবনীয় ব্যাপার। জিনিস দেখতেই ঝটপট হাতে নিলো তনুশ্রী।
-“স্যার!”
তনুশ্রীর ডাকে ওয়াশরুম থেকে তিনজনই বেরিয়ে এলো। তনুশ্রী হাতে থাকা জিনিসটি উপরে তুলে ধরতেই বিস্ময়ে সবার চোখ বড় হয়ে এলো। নাজমুল অস্পষ্ট সুরে উচ্চারণ করলো,
-“প্রোটেকশন?”
তনুশ্রী মাথা নেড়ে সায় জানাতেই মুনির বলল,
-“১৬ বছরের একজন কিশোরীর রুমে জন্ম নিরোধক? তারমানে মেয়েটা মা’র্ডারের পূর্বেই ভার্জিনিটি হারিয়েছে?”
শিহাব বলল,
-“হতে পারে। এটা যদি মা’র্ডারের কাজ হতো তাহলে মনিকেও ছেড়ে দিতোনা। মনি মেয়েটাও কম সুন্দরী নয়। হয়তো তুর্শির এফেয়ার ছিলো।”
সবকিছু একসাথে জটলা পাকিয়ে আছে।
তনুশ্রী, মুনির, শিহাব, নাজমুল নিচে নেমে যা যা তথ্য পেলো সবই ইলানকে জানালো। স্বপন মির্জা চমকে উঠলেন সব শুনে। উনার মেয়ের ঘরে প্রোটেকশন কোথা থেকে আসবে?
ইলান স্বপন মির্জাকে বলল,
-“ওয়াশরুমের দেয়ালে এগুলো কিসের র’ক্ত?”
স্বপন মির্জা জানালেন,
-“এ ব্যাপারে তিনি কিছুই বলতে পারছেননা।”
-“মেয়ে জন্ম দিয়েছেন। অথচ তার খোঁজ খবরে বিশেষ খেয়াল নেই। হতেও তো পারে কেউ আপনার মেয়েকে ট’র্চার করতো।”
ইলানের কথায় মাথা নিচু করে রাখলেন স্বপন মির্জা। শুধু টাকা দিলেই বাবার দায়িত্ব পালন হয়ে যায়না। সন্তানের খোঁজ ও নিতে হয়।
মুনির বলল,
-“দেখলাম ঘরে পেইন্টিং এর যাবতীয় জিনিস রয়েছে। তুর্শি কি পেইন্টিং জানে?”
স্বপন মির্জা সায় জানিয়ে বললেন,
-“হ্যাঁ! অনেক ভালো পেইন্টিং করতো তুর্শি। পুরস্কার ও পেয়েছে।”
তনুশ্রী বলল,
-“তুর্শির কি কোনো এফেয়ার ছিলো?”
-“এটা তো জাকিয়া বলতে পারবে।”
-“কে? তুর্শির সারভেন্ট?”
তনুশ্রীর প্রশ্নে স্বপন মির্জা হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো।
তনুশ্রী ইলানের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“দেখেছেন স্যার! বলেছিলাম না মেয়েটাকে স’ন্দেহজনক মনে হয়, কিন্তু সে গতকাল বলল কিছুই জানেনা।”
ইলান স্বপন মির্জাকে সরাসরি বলল,
-“মিস জাকিয়াকে ডাকুন।”
-“সে একটা কাজে বাইরে গিয়েছে। কাজ সারতে দেরি হবে।”
আমরা প্রয়োজনে আবার আসবো বলে ইলান উঠে পড়লো।
——————
দুপুরের উত্তপ্ত দাবানলের তেজ কমে আসতেই আশরাফুল অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে। সাইফাকে দেখতে ওর বাবার বাড়ি যায়। প্রভাতির ব্যাপার উঠতেই সাইফা প্রভাতিকে দেখতে আসার জন্য আবদার করে বসে। আশরাফুলের কোনো বারণ সে শুনতে রাজি নয়। প্রভাতি, তার একমাত্র আদুরে ননদ অসুস্থ, আর সে কিনা দেখতে যাবেনা?
আশরাফুল বলল,
-“মা এখনো পুরোপুরি শান্ত হননি। তোমাকে দেখলে রিয়েক্ট করতে পারে। শান্ত হলে আমি নিজেই তোমাকে বাসায় নিয়ে যাবো। এভাবে থাকতে আমার ও ভালোলাগছেনা। তুমি বরং প্রভার সাথে ভিডিয়ো কলে কথা বলো।”
সাইফা জে’দ ধরে বলল,
-“আমি বোরকা পরে দেখতে যাবো। বলবো আমি প্রভার বান্ধুবী।”
আশরাফুল রাম ধমক দিলো। আচমকা ধমকে কেঁপে ওঠে সাইফা। যথেষ্ট ভ’য় পেয়েছে। শরীরের কম্পন সামনে দাঁড়িয়ে ঠিকই দেখতে পাচ্ছে আশরাফুল।
একহাতে সাইফাকে বুকের সাথে আগলে নিয়ে আদুরে স্বরে বলল,
-“অবুঝের মতো কাজ করলে হয়? আমি সরি! আর ধমক দেবোনা।”
ভ’য় আর অতিরিক্ত আহ্লাদে আশরাফুলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো সাইফা। আশরাফুল কোনোভাবে তাকে বুঝিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।
———
ঘড়ির কা’টা যখন দশ ঘরে অতিক্রম করে মিনিটের কা’টায় আটাশের ঘরে তখন বাসায় ফিরলো ইলান। সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। গোসল দেওয়া জরুরি। এতে ক্লান্তি কিছুটা হলেও কমবে।
গোসল সেরে বের হয়ে ডাইনিং এ আসতেই ইরতিজা বললেন,
-“প্রভাতির প্রচন্ড জ্বর এসেছে। খেয়ে একবার দেখে আসিস। একদিনেই মুখটা একটুখানি হয়ে গিয়েছে। সুস্থ থাকলে আমার সাথে এসে গল্প করতো।”
ইলান খাওয়া শেষ করে দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলল,
-“তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবেনা। প্রভাকে দেখে আসছি আমি।”
ইরতিজা দরজা চেপে ঘুমোতে চলে গেলেন। খাটের একপাশে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে ইলানের বাবা। অপর পাশে তিনি শুয়ে পড়লেন।
শরীরের তাপমাত্রা এখন অনেকটাই কম। তবে মুখটা তেঁতো হয়ে আছে। কিছুই মুখে তোলা যাচ্ছেনা। আনোয়ারা বেগম লাগাতার মাথায় পানি দিয়ে গিয়েছেন। বিকেলে যখন আশরাফুল বলল,
-“এভাবে কেনো আমাকে জ্বালিয়ে মা’রছিস? আমার একটুও কথা শুনিসনা।”
প্রভাতি ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী স্বরে বলল,
-“আর কে আছে তোমাকে জ্বালানোর মতো?”
এই কথার বিপরীতে আশরাফুল সূঁচালো চোখে তাকিয়ে হেসে দিলো।
-“আমাকে জব্দ করার ট্রিকস ভালোই রপ্ত করেছিস।”
কারো পায়ের শব্দ কর্ণধারে পৌঁছাতেই ভাবনার ঘোর থেকে বের হলো প্রভাতি।
রুমে আশরাফুল প্রবেশ করেছে। তার পিছু পিছু ইলান প্রবেশ করলো। প্রভাতি বালিশের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসলো। ইলান বলল,
-“এখন কেমন আছো?”
-“ভালো”
-“আমি তো দেখতে পাচ্ছি একদিনের জ্বরে তোমাকে ভঙ্গুর দেখাচ্ছে। চোখ দুটো বিলের জলে ডুবি ডুবি।”
প্রভাতি ইলানের কথায় পাত্তা দিলোনা।
আশরাফুলকে ইশারা করে ইলান বলল,
-“কফি নিয়ে আয়।”
আশরাফুল উঠে চলে গেলো।
ইলান ঝট করে প্রভাতির কপালে হাত দিয়ে জ্বর চেইক করলো।
-“এখনো তো জ্বর কমেনি।”
প্রভাতির নড়চড় দেখা গেলোনা। তবে মুখ চললো,
-“ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা বাদ দাও। আমি তোমার বউ লাগি,যে যখন তখন এভাবে ছুঁয়ে দাও?”
ইলান চোখ ছোট করে বলল,
-” আমার বউ হওয়ার শখ বলে দিলেই পারো। ইনিয়েবিনিয়ে বলার কি আছে? অবশ্য আমার এখন আর ইন্টারেস্ট নেই?”
প্রভাতি নেত্রপল্লব ছোট করে বাঁকা চোখে তাকালো।
-“আমি কি কোনো ইন্টারেস্টের বস্তু? আমার প্রতি কিছুদিন ইন্টারেস্ট থাকবে আবার ইন্টারেস্ট হারিয়ে যাবে?”
ইলানের অধর কোনে বক্র হাসির রেখা। উপর ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে ধরে বলল,
-“তুমি চাইছো তোমার প্রতি আমার ইন্টারেস্ট সারাজীবন থাকুক? ভেবে দেখো, তাহলে কিন্তু তোমারই বি’পদ। এমন হুটহাট ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে পারি।”
প্রচন্ড লজ্জা আর রাগের সংমিশ্রণে প্রভাতি এক বেফাঁস কথা বলে ফেললো।
-“এমন অ’সভ্য কথা বলার জন্য কখন তোমাকে কা’মড়ে দেই।”
ইলান যেনো আরও সুযোগ পেলো। মিটিমিটি হেসে বলল,
-“উমম! কোথায় কামড়াতে চাও?”
নিচের ঠোঁটে হাত বুলিয়ে ইশারা করে বোঝালে ‘এখানে?’
প্রভাতি দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল,
-“সত্যিই তুমি একটা হাই লেভেলের অস’ভ্য।”
ইলান হো হো করে হেসে উঠলো।
আশরাফুল তিন মগ কফি নিয়ে এসে বলল,
-“এমন গরুর মতো হাসছিস কেনো?”
ইলান বাঁ ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
-“গরু হাসতে জানে? তুই শুনেছিস? তাহলে নিশ্চয়ই তুই গরুদের সঙ্গী সাথী।”
আশরাফুল কফির কাপে টুকরো চুমুক বসিয়ে ইলানকে ইশারায় বলল ‘এখনই প্রভাতিকে গতকালের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করবে কিনা?’
ইলান না করে বোঝালো ‘আপাতত না। প্রভাতি আরেকটু সুস্থ হোক। হয়তো ব্যাপারটা নিয়ে মস্তিস্কে চাপ দিলে মেয়েটা আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে।’
কফি শেষ করতে করতেই তিনজনে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলো। হাতঘড়িতে সময় দেখে বাসায় ফিরলো ইলান।
সকাল সকাল অফিসের জন্য বেরোনোর সময়ই শুনতে পেলো মা বলছে তার ভাই মিহান আজ বাসায় ফিরবে।
ইলান ভেবে পেলোনা হুট করে আজ কেনো মিহান বাসায় আসছে? মিহানের তো এখন আসার কথা নয়! তবে কি কোনো গুরুতর কারণ আছে?
#চলবে…….