#দলছুট ২

এভাবেই আমার আলাপ শুরু হয়েছিল লোরার সাথে। সেই আলাপ দিনকে দিন গাঢ় হয়েছে। সামান্য চেনা জানা থেকে বেষ্ট ফ্রেন্ড হতে সময় লাগেনি আমাদের। আমার মাঝে মাঝে বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো যে ইলোরা আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড। কারণ ও আর আমি একেবারে বিপরীত স্বভাবের। ইলোরা মিশুক, আমুদে, চঞ্চল এক কথায় আসর জমানো ম্যাটেরিয়াল। আর আমি চুপচাপ, কোলাহল এড়িয়ে চলি, লোকজনের ভীড় অপচ্ছন্দ এককথায় অসামাজিক। আমরা দুই বিপরীতধর্মী মানুষ এতো মনের মিল কি করে হলো? সবচেয়ে আজব লাগতো এটা ভেবে, যে লোরা কেন আমাকে বন্ধু হিসেবে সিলেক্ট করলো? ও খুব অল্পদিনের মধ্যে ক্যাম্পাসে পপুলার হয়ে উঠলো, কাজেই ওর বন্ধুর অভাব ছিলোনা। কিন্তু তবুও ও নিয়ম করে আমার সাথে সময় কাটাতো। ওর যত গোপন কথা সব আমার কাছে এসে ফাঁস করে দিতো। বাসায় ও কি করতো, ফোনে কার সাথে বাঁদরামি করেছে, কাকে বোকা বানিয়ে পকেট ফাঁকা করেছে, ওর বয়ফ্রেন্ড এর সাথে কি কি করেছে এইসব নিষিদ্ধ গল্পগুলোও ও আমাকে বলে ফেলতো নির্দ্বিধায়। হ্যা বয়ফ্রেন্ড, নাবিল ওর বয়ফ্রেন্ড ছিলো। সেই ক্লাস নাইন থেকে নাকি নাবিলের সাথে ওর সম্পর্ক। একেবারে বাল্যপ্রেম যাকে বলে। সত্যি বলতে কি, আমার না খুব ভালো লাগতো লোরার গল্প। খুব ছোটবেলা থেকেই আমার জগৎটা ছোট। মিশুক না বলে বন্ধুর সংখ্যা হাতে গোনা। কনজারভেটিভ ফ্যামিলি হওয়ার কারণে বাসা আর ভার্সিটি ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার সুযোগ ছিলো না। কাজেই লোরার গল্পগুলো আমার কাছে একপ্রকার টনিকের মতো ছিলো। আমার পরিচিত গন্ডির বাইরের পৃথিবীটা কেমন সেটা আমি লোরার গল্প শুনে কল্পনা করতাম। মাঝে মাঝে ওর গল্প শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরতাম ওর গায়ে। একদিন আমি হাসছিলাম আর ইলোরা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো বেশ অনেকটা সময়। আমি জিজ্ঞেস করলাম-
“কি দেখছিস এমন করে?”
“তোকে হাসলে কি দারুণ লাগে জানিস? সবসময় হাসিস না কেন বলতো?”
আমি একটু চুপসে গিয়ে বলি-
“দারুণ লাগে বলেইতো হাসি না। ভালো জিনিস কম পাওয়া ভালো। বেশি পেলে কদর থাকবে না।”
ইলোরা কপট রাগ দেখিয়ে বললো-
“আমি এতো কথা শুনতে চাই না। তুই এখন থেকে এরকম গোমরা মুখে থাকবি না ব্যাস। যেভাবে মুখ করে বসে থাকিস ভয়ে কেউ তোর কাছে ভীরে না।”
“কেউ না ভীড়লে সমস্যা নেই তুই আছিস তো? আমার তুই থাকলেই হবে।”
আমার জবাবে লোরা খুশি হয়েছিলো কিনা জানিনা তবে ওর চেহারায় সেদিন এক অন্যরকম গ্লো দেখেছিলাম। ও কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মায়াবী কন্ঠে বলে-
“এইজন্যই তোকে ভালোলাগে। তুই আমাতেই খুশি, আমার বিকল্প খুঁজিস না।”
আসলেও আর কাউকে খুঁজি না আমি। ক্লাস পড়াশোনা আর কোনো এক ফাঁকে লোরার গল্প এভাবেই জীবন কেটে যাচ্ছিলো ভালোই। লোরার বয়ফ্রেন্ড নাবিল প্রায়ই ভার্সিটির গেটে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো। কখনো ভোরে কখনো ক্লাস শেষে। তবে যেদিন বিকেলে আসতো সেদিন বুঝতাম লোরাকে নিতে এসেছেন। নাবিলের সাথে আমি কখনো আগ বাড়িয়ে কথা বলিনি। লোরা অনেকবার জোর করার পরেও না। কথা না বলার দুটো কারন ছিলো। এক. ছেলেদের সাথে কথা বলাটা আমার জন্য অনেক কঠিন আর দ্বিতীয়ত নাবিলের চাহনি। অনেকবার নাবিলের সাথে দেখা হয়েছে আমার, প্রতিবারই কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকতো আমার দিকে। চোখে চোখ পড়লেও সরিয়ে নিতেন না। আমি অবশ্য এসব কথা কখনো লোরাকে বলিনি। গাট ফিলিং ছিলো, কথাগুলো জানলো লোরা খুশি হবে না। একদিন লোরা হাসতে হাসতে আমার কাছে এলো-
“আজ নাবিল তোকে দেখে সুন্দর বলেছে। এই ড্রেসটা তোকে মানিয়েছে দারুণ।”
প্রশংসাবানী শুনে আমার অসস্তি প্রকট হলো। সেদিন আমি লাল কালোর মধ্যে একটা জামা পরেছিলাম আর দূর্ভাগ্যক্রমে সেদিন ছিলো ভ্যালেন্টাইন্স ডে। সেদিনের পর থেকে আমি বেশ সতর্ক হয়ে গেলাম, পারতপক্ষে নাবিলের সামনে পড়তাম না।

লোরা আর নাবিলের সম্পর্কটাও বেশ অদ্ভুত। লোরার মুখ থেকে যতটুকু শুনতাম তাতে ওদের সম্পর্কটা ভালোবাসা কম লেনদেনের সম্পর্ক বেশি মনে হতো। লোরার পারিবারিক অবস্থা একদম খারাপ ছিলোনা কিন্তু ওর চলন বলন ছিলো ভীষণ বড়লোকি। ওর এই বড়লোকি ব্যাপারটা আমার ভালো লাগতোনা। কারন ওর বাবা তো এতোটা এফোর্ড করতে পারতোনা তাহলে এই খরচ গুলো করতো কোত্থেকে? বলাই বাহুল্য ওর সমস্ত খরচ দিতো নাবিল। নাবিলের বাবা ছিল না বাট বাবার বিজনেস ছিলো যেটা নাবিলের মা চালাতেন। একটা বোন ছিলো নাবিলের যার বিয়ে হয়ে গেছিলো। লোরা কারণে অকারণে নাবিলের কাছ থেকে টাকা চাইতো। ব্যাপারটা আমার অপচ্ছন্দের হলেও কখনো ওকে কিছু বলিনি। অবশ্য বললেও ও সেটা শুনতো বলে মনে হয়না। মাঝে মাঝে বলতে চাইলেও আমার কথা ও হাত নেড়ে বাতাসে উড়িয়ে দিত।

সেকেন্ড সেমিস্টারের মাঝামাঝি আমি সিভিয়ার অসুখে পড়লাম। টেস্ট করে টাইফয়েড ধরা পরে। জমে মানুষে টানাটানি করে আমি কোনো মতে বেঁচে ফিরলাম। আমি ইয়ার ফাইনাল মিস করে আবার ফাস্ট ইয়ারে পরে রইলাম লোরা সেকেন্ড ইয়ারে উঠে গেলো। ছয়মাস পরে সুস্থ হয়ে আবার সেকেন্ড সেমিস্টারের ক্লাস শুরু করলাম। মাঝে মাঝে লোরা আমার খোঁজ খবর নিতে আসতো। দু’জনে কিছু সময় গল্প করতাম তবে আগের মতো সেই আন্তরিকতাটা আর ছিলো না। দু’জনার ক্লাস সিডিউল মিলতো না, পড়ালেখার ব্যস্ততা সবমিলিয়ে দূরত্ব বাড়তে লাগলো। আমিও আর মাথা ঘামালাম না। আসলে মাথা ঘামানোর মতো অবস্থা ছিলোনা। টাইফয়েডের কারনে আমার স্মৃতি দূর্বল হয়ে গেছিলো। পড়ালেখায় আগের চাইতে তিনগুণ বেশি ইফোর্ট দিতে হতো। তাই অন্য কোনো দিকে মন দেওয়ার সময় আমার ছিলো না। একসময় লোরার সাথে আমার যোগাযোগ হাই হ্যালো পর্যন্ত হয়ে গেলো। আর পাস করে বেড়িয়ে যাওয়ার পর ওই ক্ষীন যোগাযোগটুকুও আর থাকলো না। তারপর, তারপর একদিন আচমকা…

“নোরা, কিরে কখন থেকে তোকে ডাকছি। কি ভাবছিস বলতো? খেতে আয় তোর বাবা অপেক্ষা করছে তোর জন্য।”
আমার ভাবনার জাল ছিন্ন হয়। সামনে মা দাঁড়িয়ে আছে, অবাক হয়ে আমাকে দেখছেন। আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম-
“কি দেখছো এভাবে?”
“তোকে এতো চিন্তিত লাগছে কেন? অফিসে কিছু হয়েছে?”
“তেমন কিছু না, আমি ঠিক আছি।”
মায়ের প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেও চুপচাপ ভাবছি, মা কি অন্তর্যামি নাকি? মনের ভাব বুঝলো কি করে?

★★★

ঘটনার ভেতরে ঘটনা থাকে আর তারমধ্যে থাকে গোপনীয়তা। অনেকটা তাল চিপলে আঁটি আর আঁটি কিছুদিন ফেলে রাখলে ভেতরে শাস হয় যা খেতে অনেক সুস্বাদু। নাবিলের বলা কথায় আমি ছটফট করছিলাম ভেতর ভেতর, গোপনীয়তার গন্ধ পাচ্ছিলাম। আজকাল আমি নাবিলকে দেখলে লুকিয়ে পড়িনা। হেসে দু’চারটা কথা বলি। তবে ভুলেও লোরার কথা জানতে চাই না। জানার সময় তো আর শেষ হয়ে যায়নি? জানবো ধীরে সুস্থে, জানতে তো হবেই।

উপরওয়ালার হস্তক্ষেপে আমার অপেক্ষার পালা ফুরায়। হঠাৎ করে নাবিলের সাথে কাজ করার সুযোগ এলো। ছোট্ট একটা রেনডম প্রজেক্ট, দিন কয়েকের কাজ। আমি সানন্দে রাজি হলাম তবে নাবিল অবাক হলো বৈকি। যদিও সে মুখে কিছুই বলেনি। কাজের জন্য আমাদের সারাদিনই টুকটাক কথা হতে থাকে। কথা বলতে বলতে হঠাৎ দেখতাল নাবিল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি তুড়ি মেরে ওর ঘোর ভাঙাতেই সে ভীষণ লজ্জা পেলো। মুচকি হেসে কাজের কথায় চলে গেলাম যাতে নাবিল আর বেশি লজ্জা না পায়।

ঘটনা ঘটলো প্রজেক্ট শেষ হওয়ার দিন। নির্ধারিত ডেটের একদিন আগেই আমাদের কাজ শেষ। ডেলিভারি দিয়ে সেলিব্রেট করতে বাইরে খাওয়া দাওয়া করে এলাম নাবিলের বাসায়। আমি নিজ থেকে ওর বাসায় আসতে চেয়েছি দেখে নাবিল এতো বেশি বিস্মিত হয়েছে যে আমাকে পাঁচবার জিজ্ঞেস করে কনফার্ম হয়েছে। খুশিতে পাগল হওয়ার দশা ওর। আমি ওর পাগলামি দেখে মুচকি মুচকি হাসছি আর ভাবছি-আহা! বেচারা!

চলবে—

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here