#স্বপ্ন_কেনার_দামে
#পর্ব৭
রিদমের বাসা বসিলায়, বেড়িবাঁধের তিন রাস্তার মোড়ের কাছে। বাড়িটা ওদের নিজস্ব বলা যায়, অবশ্য পুরো বাড়ি না, চারতলা বিল্ডিং এর তিনটি ফ্ল্যাট রিদমদের। রিদমের বাবা আফজাল হোসেন এখন কিছু করেন না। অবশ্য একসময় প্রবাসী ছিলেন। আফজাল হোসেনের বাউন্ডুলে স্বভাবের কারণে রিদমের দাদা ভেবেছিলেন ছেলের বিয়ে দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দিলে ভালো হবে। সংসারী হয়ে গেলে কাজকর্মে মন থাকবে। যতদিন দাদা বেঁচে ছিলেন আফজাল হোসেন দুবাই আর ঢাকায় আসা যাওয়ার ভেতর থাকতেন। দাদার মৃত্যুর পর রিদমের বয়স যখন সাত বছর তখন আফজাল হোসেন পাকাপাকি ভাবে দেশে চলে আসেন। হাতে করে কিছু কাঁচা টাকা নিয়ে এসেছিলেন। কিছু টাকা ব্যবসা খাটানোর চেষ্টা করে ধরা খেলেন, যেহেতু নিজের পরিশ্রম করার আগ্রহ ছিল না, অন্যকে দিয়ে কাজ করাতে গেলে ধরা তো খেতেই হয়। বাকি টাকা দিয়ে বসে বসে খেতে খেতে এখন প্রায় সব শেষ। এখন পৈতৃক সূত্রে পাওয়া তিনটি ফ্ল্যাটের একটায় রিদমের পরিবার থাকে, আর দুটোর ভাড়ার টাকায় সংসার চলে টেনেটুনে। একটু পুরানো ধাঁচের বাড়ি বলে ভাড়াও বেশি নয়, এ এলাকায় এমনিতেও ভাড়া খুব একটা না, তার উপর এত পুরানো বাসায় ভালো অবস্থার কেউ ভাড়া নিতে চায় না।
বসিলায় যখন রিদমের দাদা এই বাড়ি করেছিলেন, তখন এই এলাকা ঢাকার ভেতর গ্রামই ছিল বলা যায়। তাই সস্তায়ই জমি পেয়েছিলেন। এখন আস্তে আস্তে বসিলা উন্নত হচ্ছে, চওড়া রাস্তা হয়েছে, জমির দাম বাড়ছে। রিদমের বাকি দুই চাচা আর বড়ো ফুপু চাইছেন এই পুরানো বাড়ি ভেঙে নতুন আধুনিক বাড়ি করে ফ্ল্যাট ভাগ করে নিতে। আফজাল হোসেন ছাড়া বাকি ভাইবোন সবার অবস্থা ভালো, তাদের পক্ষে নতুন বাড়ির জন্য বিনিয়োগ করা সম্ভব হলেও আফজাল হোসেনের পক্ষে সম্ভব না, তাই রিদমের মা বাড়ি ভাঙার পক্ষে না। এই নিয়ে নিত্য ঝামেলা চলছে। বড়ো ফুপু রিদমদের পক্ষ থেকে টাকা দিতে রাজি আছেন, তবে সেক্ষেত্রে ভাই আফজাল হোসেনকে সমপরিমাণ ফ্ল্যাটের ভাগ ছাড়তে হবে, নতুন বহুতল ভবনে বাকিরা তিনটে করে ফ্ল্যাট পেলেও তিনি পাবেন একটা, কিছু টাকা ক্যাশও দিবেন। এতে রিদমের বাবা রাজি হলেও মা লাকি আক্তার মানতে রাজি নন। তাই কেউ কোন সমাধানেও আসতে পারছে না।
ক্লান্ত রিদম রাতে যখন তিনতলার সিঁড়ি ভেঙে উঠছিল তখন মায়ের চিল কণ্ঠ কানে আসে। সংসারের যাঁতাকলে পিষ্ট লাকি আক্তার আগে ভীষণ শান্তশিষ্ট থাকলেও ইদানীং আফজাল হোসেনের সাথে সমানে সমান তাল মিলিয়ে ঝগড়া করেন। রিদমের বিরক্ত লাগছিল, সারাদিন বহু চেষ্টা করেও অরণীর সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। প্রচন্ড অভিমান, হতাশা আর রাগে এমনি মাথা দপদপ করছিল, এখন বাবা মায়ের ঝগড়ায় আরও বিরক্ত লাগে। লাকি আক্তার একাই চিল্লাছেন বোঝা যাচ্ছে, রিদম সিঁড়িতে বসে থাকে, চিত্কার থামলে দরজা নক করবে ঠিক করে। একটু পর শব্দ থামলে দরজায় নক করে রিদম।
“ভাইয়া, আজ এত দেরি হয়েছে যে?”
“কাজ ছিল। আম্মুর কী হইছে তিথি, এত চিল্লাছে কেন? রাস্তা থেকে গলা শোনা যায়।”
“ঐ যা হয়, আব্বুর সাথে লাগছে। আব্বু বড় ফুপির কাছ থেকে কবে একলাখ টাকা নিয়েছে। ফুপি ফেরত চাইছে।”
“এতে আম্মা চিল্লায় কেন আব্বুর সাথে? আব্বু টাকা নিয়েছে, আব্বু শোধ করবে।”
“ঐ টাই কারণ। আব্বু মনে হয় আম্মুর কোন হাতের বালা টালা বিক্রি করতে চাইছে, জোর করে নিয়ে গেল।”
“আম্মুর গয়না আছে এখনো? আম্মু আব্বু কই”
“গয়না আছে মনে হয় কিছু। আম্মু তো গয়নাগাটি নিয়ে কথা বলে না, আজ আব্বু বালা বিক্রির কথা বলায় জানলাম যে বালা এখনো আছে। আমি তো ভাবছি আগেই বিক্রি করে দিয়েছে। এতক্ষণ আম্মু একা একা কতক্ষণ ভাগ্যকে শাপশাপান্ত করলেন, এখন বাথরুমে ঢুকেছে। আব্বু বারান্দায়।”
“তিথি, মুখ হাত ধুয়ে আসি। খাবার দে তো।”
লাকি আক্তার চোখমুখ ধুয়ে এসে আলমারি খোলেন। গয়না বলতে আর সামান্য কিছু আছে, এগুলো বিক্রি করার কোন ইচ্ছে ওনার নেই। বালা জোড়া ঘুরে দেখে আবার আলমারিতে রেখে দেন। রিদমের গলার আওয়াজ শুনছেন, ছেলে ফিরে এসেছে বুঝতে পারছেন। মুখ মুছে খাওয়ার টেবিলের দিকে যান।
রিদম খেতে বসেছে, আয়োজন তেমন কিছু বা, পাট শাক ভাজি, শুকনো মরিচ আর মশুরের ডাল দিয়ে পেঁপে।
“রিদম এত দেরি করছিস যে?”
“কাজ ছিল আম্মু। আম্মু একটা ডিম পোচ দাও তো, তরকারি ভালো লাগছে না।”
“তিথি একটা ডিম দে ভাইকে। কী কাজ ছিলরে? কারও চেম্বারে ঢুকেছিস? না টিউশনি ছিল?”
“নাহ্ অন্য কাজ। টিউশনি ছেড়ে দিয়েছি বললাম না। পড়ার সময় পাই না। পোস্ট গ্রাজুয়েশনের পরীক্ষা দিতে পড়া লাগে তো আম্মু।আপাততঃ কারও চেম্বারে ঢুকবো না, বেতন দিবে নামমাত্র, সময় নষ্ট শুধু।”
“কই পড়িস? এত কষ্ট করে ছেলেকে ডাক্তার বানালাম শেষ পর্যন্ত একটু শান্তির মুখ দেখবো বলে। আবার কী সব পড়ার কথা বলিস? পাশ তো শেষ। তুইও তোর বাবার মতো বসে খাওয়ার কথা ভাবিস না, হাত পা চালা।”
“আমি ইন্টার্নির ভাতা তো দেই তোমাকে, দেই না? ডিউটি শেষে লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়তে হয়। তোমার কী মনে হয় শুধু ডাক্তার হলেই ইনকাম করা যায়? আমি এখনো ইন্টার্নিও শেষ করি নাই, নিজে চেম্বার দিতে হলে অনেক প্রস্তুতি লাগবে। আমাদের পড়ার কোন শেষ নাই। আর আব্বু বসে খেলেও সংসার তো আব্বুর সম্পদে চলে তাই না? বাইপাস করা মানুষ পরিশ্রম তো করতে পারে না।”
“বাবার জন্য এত দরদ, মায়ের কষ্ট চোখে দেখস না? এই আমি সব কলিজায় ধরে রক্ষা না করলে আজ লেখাপড়া করা লাগতো না। তোর বাপের যখন বয়স ছিল তখন কী করছে, বাইপাস করছে এই সেই দিন। একটা শখ পূরণ করতে পারলাম না, ভাবছি ছেলে মানুষ হলে সব হবে।”
“আচ্ছা আম্মু কান্না করো না তো। সব হবে ইনশাআল্লাহ। আচ্ছা এখন টাকার কী ব্যবস্থা করবা? তুমি ফুপিকে বলো আর কয়দিন পর টাকা দিবা, এর ভেতর বাসার একটা সিদ্ধান্ত হলে সেখান থেকেও টাকা দেওয়া যাবে।”
“হ্যাঁ এটা ভালো বলছিস। আমি বালা বিক্রি করবো না।”
“কইরো না। এখন ডিম দাও না, ভাত ঠান্ডা হয়ে গেল। আর আমাকে দুইশো টাকা দিও।”
“তোর আবার টাকা লাগবে কেন?”
“এক ভাইয়ার চেম্বারে যাব। চেম্বার পুরান ঢাকায়,আমার কাছে ভাড়ার টাকা নাই। দেখি ভাইয়া দেখা করতে বলছিল। বেতন দিলে ভাইয়ার চেম্বারে ঢুকে যাব।”
“তাহলে তো ভালোই হবে। বিকেলের সময়টা চেম্বারে বসলে তোর শেখা হবে, ইনকামও হবে। পড়া এর ফাঁকে ফাঁকে পড়বি। পাশ করার পর আর এত পড়া কী।”
এই প্রত্যাশার চাপই রিদমের ভালো লাগে না। মায়ের ধারণা ডাক্তার হয়ে বের হলেই ইনকাম। মায়ের এতদিনের সব কষ্টের অবসান রিদম রাতারাতি করে ফেলবে এই স্বপ্নই লাকি আক্তার এখন দিবানিশি দেখেন। অথচ জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থা যে কতটা করুণ, আর বিডিএস হলে তো কথাই নেই। পায়ের নিচে মাটি শক্ত হতেই দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়, চাকরি নাই বললেই চলে, নিজে চেম্বার দিতে হলে টাকা দরকার, পোস্ট গ্রাজুয়েশন করা ভীষণ চ্যালেঞ্জের। এই সবকিছু থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য অরণীর হাসি যেন একটা মুক্ত বাতাস। ভাত খেয়ে রিদম বের হয়ে যায়, এখন যাবে কাঁঠালবাগানের ফ্রি স্ট্রীট রোডে, অরণী কিভাবে রাগ করে থাকে সেও দেখবে।
(চলবে)