#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৩
আমিনা বেগম পরিস্থিতি বেগতিক বুঝতে পেরে আরাফাত কে বলে দেয় আড়ালের অবস্থান। আরাফাত অপেক্ষা না করে দৌড়ে যায় লাকড়ি ঘরের দিকে। আমিনা বেগম পিছন পিছন এগিয়ে যান চাবি নিয়ে। তালা দেওয়া দেখে আরাফাত রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকায় আমিনা বেগমের দিকে। আমিনা বেগম তালা খুলে দিয়ে আর দাড়ান না সেখানে। থাকার ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। ছেলেটা ভিষন বদরাগি। এখানে থাকলে কি না কি করে বসে। তাই আগে ভাগেই নিজ দায়িত্বে মাঠ ছেড়েছে।
আরাফাত ভেতরে ঢুকে দেখে আড়াল চৌকির কোনায় জড়সড় হয়ে হাটু ভেঙে বসে হাটুর ওপর মাথা দিয়ে আছে। ঘরে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয় আরাফাত। এগিয়ে যায় সামনে জুবুথুবু হয়ে বসে থাকা মায়াবিনীর দিকে। আড়াল এর মধ্যে একবারও মাথা তুলে তাকায় নি। দরজা আটকানোর শব্দ পেয়েও না। আরাফাত আড়ালকে আচমকা হেঁচকা টানে চৌকি থেকে নামিয়ে দাড় করায়। দাড় করিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে যায়। ঠোঁটের কোনা বিচ্ছিরি ভাবে ফুলে থেতলে আছে। গালে পাঁচ আঙ্গুলের স্পষ্ট ছাপ। আরাফাত আড়ালের দিকে অবাক চোখে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘এসব কি করে হলো?’ আড়াল কোন উত্তর দিলো না। একইভাবে তির্যক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো আরাফাত এর দিকে। কোনো উত্তর না পেয়ে এবার প্রশ্ন পাল্টিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কাল কেনো বিয়ের আসর ফেলে পালিয়েছিলে? আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি তা তুমি জানতে আড়াল। প্রথম দেখায় আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তাহলে কেনো আমায় ফেলে কাল চলে গেলে? ঘুরে ফিরে সেই তো আমার সামনেই আজ দাড়িয়ে আছো। আজ যদি তোমায় জোর করে বিয়ে করি, আমায় আটকানোর কিন্তু কারো ক্ষমতা নেই। এমনকি তোমারও না।’
আড়াল ঠোট প্রসারিত করে হাসে। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আরাফাত এর একদম মুখ বরাবর দাড়ায়। মাঝে দুরত্ব খুব কম। চার আঙ্গুল পরিমান জায়গা হবে হয়তো। আরাফাত প্রথমে অবাক হলেও পরে সম্মোহিত হয়ে তাকায় আড়ালের দিকে। আড়াল খুব সহজ হয়ে দাড়িয়ে আছে। কোন সংকোচ এর ছাপ নেই মুখে। আরাফাত এর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে,
‘আপনি আমাকে ভালোবাসেন তাই না? তাহলে যেইনা আমি আসর ছেড়ে পালালাম ওমনি আপনি নাদিয়া আপু কে বিয়ে করে ফেললেন। ব্যাপার টা অদ্ভুত না!’
‘তুমি ভালো করেই জানো আমার দাদীর শেষ ইচ্ছে দুই
নাতির বিয়ে একসাথে দেখার। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে এই স্টেপ নিতে হয়েছে।’
আরাফাতের পকেটে হাত দেয় আড়াল। ভেতর থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে আরাফাতের মুখের সামনে তুলে ধরে বেশ তাচ্ছিল্য করে বলে,
‘আমি জানতাম আপনি এমন কিছুই বলবেন। আন্দাজ ছিলো আমার। তবে এটা কি মিস্টার আরাফাত কবির? এটাও কি আপনার দাদীর ইচ্ছেতেই হয়েছে? উনি বুঝি আপনাকে জোর করে করিয়েছে এসব।’
আড়ালের আঙুল তাক করা জায়গায় আরাফাত এর নজর পরতেই চমকে উঠে। মোবাইলের গ্লাসে দেখা যাচ্ছে কানের দুই আঙুল নিচে কালচে দাগ বসে আছে। দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কেউ খুব ভালোবেসে তার ভালোবাসার চিহ্ন একে দিয়েছে। আরাফাত বলার মতো কোন কথা খুজে পায় না। মাথা নত করে নেয়। তারপর অপরাধীর ন্যায় কৈফিয়ত দিতে বলে,
‘আমি তোমার চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছিলাম না। জেদের বসে ড্রিংক করেছিলাম। আর সেই অবস্থায় একটা ভুল হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দাও। আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি। শুধুমাত্র তোমাকে চাই। আমি নাদিয়াকে ছেড়ে দেবো। ওকে ডিভোর্স দিয়ে তোমাকে বিয়ে করবো। তুমি শুধু আমার হাতটা ছেড়ো না। পাশে থেকো আমার। প্লিজ।’
আড়াল এবার উচ্চশব্দে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে বসে পড়ে পাশের আধভাঙ্গা শক্ত চৌকির ওপর। কোনমতে হাসি থামিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে উঠে দাড়ায়। মুখে আশ্চর্য ভাব ফুটিয়ে তুলে বলে,
‘কিন্তু এই দাগটাতো দুদিন আগের নয় আরাফাত। এটা সদ্য জন্মানো দাগ। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তা। কাল রাতে আপনার ড্রিংক করার কোন চান্স তো ছিলো না। আর যদি কোনভাবে করেও থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই মাঝরাতে ড্রিংক করে সকাল সকাল আপনি এতোটা ফ্রেশ থাকতেন না। মাঝ রাতে যার মদের নেশায় হুশ ছিলো না, ভুলে নাকি ভুল করে ফেলেছে। সে কিনা সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে আমার সামনে সহজ স্বাভাবিক হয়ে দাড়িয়ে আছে। বাহহ!’
আরাফাত এবার হিংস্র হয়ে ওঠে। আড়ালের দুই কাধে শক্ত হাতের থাবা বসিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলতে শুরু করে,
‘হ্যা তুই যা ভাবছিস একদম ঠিক ভাবছিস। এটা তোর বোনেরই দেওয়া ভালোবাসার চিহ্ন। তোর বোনের বেড পারফরমেন্স কিন্তু বেশ হাই লেভেলের ছিলো। মানতে হবে বস! তবে কি জানিস, তুই আমার জেদ ছিলি। আর এখনও আছিস। তবে আগে বিয়ে করতে চেয়েছি। এখন চাই শুধু বিছানার সঙ্গীনী বানাতে। আজ হোক বা কাল তোকে এই শরীরের নিচে পিষিয়ে মারবো আমি। মনে রাখিস।’ কথা শেষ করে উচ্চ শব্দে দরজা খুলে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায় আরাফাত।
কিছুক্ষণ পর আরাফাতের বড় ভাই সারাফাত আসে আড়াল এর কাছে। ক্ষমা চায় হাত জোর করে। আড়াল বাঁধা দিলে সারাফাত বলে ওঠে,
‘আমার কিছু বলার আছে। আমাকে বলতে দাও প্লিজ। আমি বাইরে থেকে তোমাদের সব কথা শুনেছি।
আমি যদি নাবিলা কে ভালো না বাসতাম আর ওকে বিয়ে করার জন্য জেদ না করতাম তাহলে তোমার সাথে এসব হতো না। আমার জন্যই আরাফাত তেমাকে বিয়ে করার শর্ত রাখার সুযোগ পেয়েছিলো। তুমি বিয়েতে রাজি ছিলে না তা আমি বিয়ের দিনেই জানতে পেরেছি। আগে জানলে এমনটা হতে দিতাম না। ওর মন মানসিকতা যে এতোটা বিকৃত তা আমার জানা ছিলো না। আমার দাদীর অনেক আগে খুব ইচ্ছে ছিলো আমাদের দুই ভাইয়ের বিয়ে একসাথে দেবার। আমার পরিবারকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নাবিলাকে বউ করার জন্য রাজি করিয়েছি। তারা নাবিলাকে পছন্দ করলেও নাবিলার ফ্যামিলি পছন্দ করতেন না। আমি নাবিলাকে অনেক ভালোবাসি। ওকে বিয়ের জন্য সবাইকে রাজি করাতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমি চাই নি যে বিয়েতে কোন ঝামেলা হোক। তাই নাবিলাকে দেখতে এসে তোমাকে আরাফাত যখন পছন্দ করে নেয় আমিও আরাফাতের সঙ্গে মিলে তোমার চাচিকে টাকার লোভ দেখিয়ে রাজি করিয়েছিলাম। যাতে উনি তোমার বিয়ে যে কোন অবস্থায় হোক আরাফাতের সাথেই দেয়। উনি যে কতটা লোভী তা আমি আগে থেকেই জানতাম। ভেবেছিলাম তুমিও ভালো থাকতে পারবে এই জাহান্নাম থেকে বেরোতে পারলে। আমি অল্পবিস্তর জানতাম তোমার অবস্থা সম্পর্কে। তাই এমনটা করেছিলাম। কিন্তু আমি যে তোমাকে এক জাহান্নাম থেকে আরেক জাহান্নামে পাঠাচ্ছিলাম, তা বুঝতে পারিনি। যাই হোক, উপরওয়ালা যা করেন ভালোর জন্যই করেন।’ বিয়েটা তিনি হতে দেননি। তুমি আমার সাথে বাইরে চলো। এটা তোমার জায়গা নয়।’
আড়ালকে নিয়ে সারাফাত দালানঘরে চলে যায় সবার সামনে দিয়ে। আড়ালের জন্য বরাদ্দকৃত সেই আগের রুমটিতে আসে। আমিনা বেগম তার দুই মেয়ে কে সাথে নিয়ে ওদের পিছন পিছন আসলে সারাফাত তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘আড়াল নিজের রুমেই থাকবে। ও বিয়ে থেকে পালিয়ে কোন ভুল করেনি। তাই কোন শাস্তিও ওর প্রাপ্য নয়। আর আড়াল না পালালে আপনার সাত ঘাটের পানি খাওয়া মেয়েটাকেও সুযোগ বুঝে আরাফাতের গলায় কাল ঝুলাতে পারতেন না। আশা করছি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন।’
কথা শেষ করে সারাফাত রুম থেকে বেরিয়ে গেলে আমিনা বেগম ও নাদিয়াও চলে আসে। আসার সময় নাদিয়া মায়ের সাথে ঘ্যানর ঘ্যানর করে সারাফাত এর বলা কথা নিয়ে। নাবিলা থেকে যায় সেখানেই। আড়ালের সামনে গিয়ে পাশের ড্রয়ার থেকে একটা এন্টিবায়োটিক মলম বের করে সেটা আড়ালের ঠোঁটে লাগিয়ে দেয়। লাগানো হয়ে গেলে মলমটা আগের জায়গায় রেখে আড়ালের সামনে দাড়িয়ে বলে,
‘আমি জানি না তুই কেনো এই জাহান্নাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েও আবার ফিরে এসেছিস। তবে এটুকু বুঝতে পেরেছি তুই যা করছিস জেনে বুঝে প্ল্যান করেই করছিস। আর একটা কথা। আমাকে যদি বড় বোন মনে করে থাকিস তাহলে অবশ্যই আমাকে যে কোন দরকারে ডাকবি। আমি চেষ্টা করবো তোর পাশে থাকার। তুই কেনো আমার মায়ের পেটের বোন হলি নারে আরু! অবশ্য এমন রত্ন শুধু খনিতেই থাকার কথা। কাঁদায় নয়। তোর মা ছিলো সেই খনি। রত্নখনি!’
নাবিলা চলে যায় রুম থেকে। আড়াল মনে মনে বলে, ‘আমাকে ক্ষমা করে দিয়ে আপু। সামনে যা করতে চলেছি তাতে তোমার বড্ড বেশি ক্ষতি হতে চলেছে। তোমার সাহায্য তো দুর তোমার ছায়াও হয়তো হারিয়ে ফেলবো।’
আড়াল কিছুক্ষণ থম মেরে দাড়িয়ে থাকে। এর মধ্যে টুসু আসে রুমে। হাসি মুখে জরিয়ে ধরে আড়ালকে। টুসুকে দিয়ে তার বাড়ি ফিরে আসার খবর সে নিজেই আরাফাত এর কানে পৌছিয়ে ছিলো। কাল সন্ধ্যার পর যখন বাইরে এসেছিলো তখন টুসুকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছিলো কি করতে হবে এবং কিভাবে করতে হবে। কেউ দেখার আগেই টুসু চলে যায় রুম থেকে। দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে বিছানার ওপর পড়ার চেয়ার টা রেখে তার ওপর দাড়িয়ে দেয়ালে থাকা ভেন্টিলেটর এর ভেতর থেকে একটা বাটন মোবাইল বের করে। সেই মোবাইল দিয়ে একটি নাম্বারে মেসেজ টাইপ করে পাঠায়,
‘কাল কলেজে দেখা করতে চাই।’
তৎক্ষনাৎ এক মিনিটের মাথায় একই নাম্বার থেকে রিপ্লাই আসে,
‘আমি নতুন ভবনের ছাদে থাকবো। আপনি প্রথম ক্লাস করে চলে আসবেন।’
অপর ব্যাক্তিটিকে পাল্টা প্রশ্ন করতে না দেখায় আড়াল অবাক হলেও পরে হেসে দেয়। এ হাসিতে আছে প্রসন্নতা। আড়ালের ওপর এক অদৃশ্য আস্থা ও অধিকার রাখে সে ব্যাক্তি। যার কোন ব্যাখ্যা নেই। আছে শুধু প্রাপ্তি।
#চলবে