#প্রজাপতি মন (পর্ব:7) ♡আরশিয়া জান্নাত “আমি তোকে বলেছিলাম মনে আছে? বডিগার্ড ছবিটাতে যেমন করে কারিনা ছদ্মবেশে কথা বলতো তুইও কি তিতলি সেজে কথা বলছিস কি না। আমি তোর অজান্তে অনেকবার পরীক্ষাও করছিলাম জানিস? কিন্তু কিছুতেই হিসাব মিলেনি। আজ বুঝলাম কেন মিলেনি! এই সব কিছুর পিছনে আসলে তুই ছিলি। তোর কাজিনকে দিয়ে এই নাটক সাজালি তাই না। কেন আমার ইমোশন নিয়ে এভাবে খেললি আনহা? তুই না আমার বেস্টফ্রেন্ড? তুই কিভাবে পারলি এসব করতে?” “দেখ তুই যা ভাবছিস তা না। আবার আমি তোকে ক্লিয়ারলি বোঝাতেও পারবোনা ঘটনা কি। শুধু এইটুকু বলবো আমার খারাপ ইনটেনশন ছিল না। আমি শুধু চেয়েছিলাম তুই খারাপ সঙ্গ বাদ দিয়ে ভালো হয়ে থাক।” “ক্ল্যাপ হবে! মহীয়সী নারী আনহা। যে তার বখে যাওয়া বেস্টফ্রেন্ডকে ভালো করতে কত সুন্দর ইমোশনাল একটা নাটক সাজালো! ক্যান্সারে আক্রান্ত মেয়ে মরেও গেল। ইশ আজ যদি মরা তিতলিকে না দেখতাম আমি আজীবন এটাই ভাবতাম তিতলি নামের অসম্ভব মিষ্টি একটা মেয়ে মারা গেছে।” শোন হাসিব তুই এখন স্বাভাবিক অবস্থায় নাই। একটু সময় দে আমি তোকে সবটা গুছিয়ে বলবো। হ্যাঁ আবার মিথ্যা গল্প সাজাতে সময় দিবো। তুই আবার কথা গোছাতে এক্সপার্ট ঠিকই নয়ছয় বুঝিয়ে দিবি। ওকে এতোদিন যেমন মিথ্যা শুনে শুনে অন্ধভাবে বিশ্বাস করেছি এখনো বল আমি শুনি। দেখি কতোটা স্যাটিসফাই করতে পারিস। দোস্ত এভাবে বলিস না। বিশ্বাস কর আমি ইচ্ছে করে কিচ্ছু করিনাই যা করেছিস করেছিস। এখন তিতলিকে বল আমি ওকে বিয়ে করবো। আজই করবো। আমার অনুভূতি তো নাটক না আমি ওকে ভালোবাসি ওকেই বিয়ে করবো। এটা সম্ভব না হাসিব। ও তোর বড় তাছাড়া তামান্না আপুর আকদ হয়ে গেছে অনেক আগেই। দুলাভাই বিদেশ থেকে আসলেই অনুষ্ঠান হবে। হাসিব এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। হাসতে হাসতে বললো, আমি না বুঝতে পারছিনা কিভাবে রিয়েক্ট করবো। রাগ করবো নাকি হাসবো! আনহা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। হাসিব ওর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, এইসব নাটকের দরকার ছিল না আনহা। তিতলি না আসলে হয়তো আমি তোকেই ভালোবাসতাম। একবার ভালোবেসে বললেই পারতি আমি সব ছেড়ে দিতাম। কেন অন্য একটা চরিত্র আনলি আনহা! তোকে আমি ঘৃণা করি। প্রচুর ঘৃণা। আজকের পর থেকে আমি ভুলে যাবো আনহা নামের কোনো মেয়েকে আমি চিনি। না চাইতেও সব দোষ আনহার কাঁধেই এসে পড়লো। নিশিথার পুতুলনাচের ঘানি তাকে বন্ধুত্বের বলি দিয়ে টানতে হলো! অথচ নিশিথা এইসবে বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত হলো না। । । ২০১৫ সাল,, নিশিথার জন্য খুব ভালো একটা বিয়ের সমন্ধ এসেছে। ছেলে পুলিশ ডিপার্টমেন্টেরই, তার বাবা সাবেক পুলিশ কমিশনার। তারা নিশিথাকে বহুদিন ধরেই অবজার্ভেশন করেই এই আলাপ পাঠিয়েছে। এমন রেপুটেটেড ফ্যামিলি দেখে নাফিজ সাহেব আর দ্বিমত করলেন না। তাদেরকে সরাসরি বাসায় আমন্ত্রণ জানালেন। নিশিথাও স্বাভাবিকভাবেই নিজেই সেজেগুজে পাত্রপক্ষের সামনে যায়। এমনকি পাত্রের সঙ্গে আলাদা করে কথাও বলেছে। তারা দিনক্ষণ ঠিক করে আংটি পড়িয়ে চলে গেলেন। নিশিথাও না বোধক কিছুই বললো না। ঘটনা ঘটলো তার দুইদিন পর। হুট করে নিশিথা নিখোঁজ। কোথাও তাঁর খবর নেই। সারা শহর তন্নতন্ন করে খুঁজেও নিশিথাকে পাওয়া গেল না। একটা মেয়ে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে একদম ভ্যানিশড হয়ে গেল এ ব্যাপারটা কিছুতেই কেউ হজম করতে পারলো না। টেনশনে নাফিজ সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আশেপাশের জেলাতেও তার ছবি পাঠানো হলো। আনহা একটা সেশনের জন্য ঢাকায় ছিল তিনদিন পর ফিরে এসে যখন শুনলো বোনকে পাওয়া যাচ্ছেনা ও দৌড়ে রুমে গিয়ে আলমারি খুললো। অবিশ্বাস্যভাবে দেখলো আলমারিতে নিশিথার কোনো কিছু নেই,,, “আব্বু আমাকে ক্ষমা করো। আমি একজনকে খুব ভালোবাসি। তাকে ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে জীবন কল্পনা করতে পারিনা বলেই চলে যাচ্ছি। তাকে বিয়ে করেই বাকি জীবন কাটাতে চাই। আমার খোঁজ করোনা সময়মতো আমি নিজেই ফিরবো।” চিঠিটা পড়েই নাফিজ সাহেব স্ট্রোক করলেন। তিনি কল্পনাই করেননি তার এতো আদরের মেয়ে তার মুখে চুনকালি মেখে কোনো ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে। তাই তো তিনি ডিপার্টমেন্টের সবাইকে বলে খোঁজ করাচ্ছিলেন। এখন তিনি কিভাবে সবাইকে বলবেন তার মেয়ে পালিয়ে গেছে! লজ্জায় অপমানে তিনদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন। আনহাদের জীবনে নেমে এলো নিকষ কালো অন্ধকার,,,, 🌿🌿🌿🌿🌿🌿 দেখতে দেখতে কেটে গেল অনেকগুলো বছর। পৃথিবীর সবকিছু আগের নিয়মেই চলেছে। ভোরের মৃদু রশ্মি এখনো জানালা গলে আসে, পাখির কোলাহলে সবাই জেগে উঠে, রান্নাঘরে শায়লা বুয়ার থালাবাসন ধোয়ার শব্দ। সবকিছুই আগের মতো চলছে। অথচ নেই ঘরটাতে আনন্দের হাসি, হৈচৈ এ ভরা আঙিনা। নিশিথা কেবল তার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামই নিয়ে যায়নি সঙ্গে করে নিয়ে গেছে এই পরিবারের মানসম্মান আর তার আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বাবাকেও। বিয়ের তিনমাস পর বরকে সঙ্গে করে এসেছিল এখানে। কিন্তু আনিসা বেগম মেয়েকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। এমন কু সন্তানের মুখ দেখার ইচ্ছেও তার ছিল না। নিশিথা ছিল তার বাবার অন্তপ্রাণ। সে যদি একবার বলতো তার পছন্দের কেউ আছে তিনি নিশ্চয়ই না করতেন না। মেয়েদের সকল শখ আহ্লাদ যে মানুষটা বলবার আগেই পূরণ করেছে এ আর তেমন কি? ফেসবুকে পরিচয় হওয়া স্বল্পদিনের মানুষটা এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে এতোবছরের রক্তের সম্পর্ক সেখানে ঠুনকো হয়ে গেছে। না এই মেয়েকে সে কিছুতেই ক্ষমা করবেনা। তিনি ধরেই নিয়েছেন নিশিথা মৃত। নিশিথা! এমন একটা মানুষ যার প্রজাপতির মতো উড়ুক্কু মনের জন্য আনহা তার বহুবছরের বন্ধুত্ব হারিয়েছে, তাদের জীবনের সুপারম্যান বাবাকে হারিয়েছে। পাড়াপ্রতিবেশীর কটু কথা হজম করেছে। মায়ের চোখে সন্দেহের পাত্রী হয়েছে। আনিসা বেগম এখন ছোটমেয়েকে কড়া শাসনে রাখেন। এমনকি কললিস্ট থেকে শুরু করে সবকিছু নজরদারিতে রাখেন। আত্মীয়রাও সুযোগ পেলেই কথা শোনাতে ছাড়েন না। সেদিন তো ছোট মামা পর্যন্ত বলে ফেললেন, পালানোর হলে এখনি বলে দে। তোদের পিছে টাকা ঢালার পর বলিস না! বড়বোনের পালিয়ে যাওয়া যে ছোটবোনের জীবনে কতোটা খারাপ প্রভাব ফেলে তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবেনা। এতোকিছুর মাঝেও আনহা বেঁচে আছে! মা-ভাইয়ের দিকে চেয়ে টিকে আছে। এদের যে ওকেই সামলাতে হবে। মাঝেমধ্যে তার ইচ্ছে হয় নিশিথাকে গিয়ে বলতে, কেন করলি এমন? তুই না বলেছিলি এসব শুধুই টাইমপাস! সবাই কেবলই তোর বন্ধু? কেন সব লুকিয়েছিলি আপু? তোর জন্য আমাদের জীবনটা রংহীন হয়ে গেছে। সব নষ্ট হয়ে গেছে। যারা আগে উঁচু গলায় কথা বলার সাহস দেখাতো না তারাও এখন যা নয় তা বলে! কেন করলি এমন? কিন্তু তীব্র ঘৃণায় তার সাথে কথা বলার রুচিও আসেনা। নিশিথা তো ঠিকই সুখে আছে কেবল পুড়ে মরছে আনহা। দোষ না করেও সবার চোখে সে দোষী! তার জীবনটা কি এমন হবার ছিল? পরিশিষ্ট: হ্যালো! কেমন আছ বাবা? আস্সালামু আলাইকুম আন্টি ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন? রাখছে আল্লাহ ভালোই। আন্টি আনহার সব কাগজপত্র ঠিকঠাক করেছি। ও বাকি কোর্সগুলো সিঙ্গাপুরেই করবে। যা তুমি ভালো বোঝ। তা বাবা তোমরা আসবে কবে? এই তো আন্টি এই মাসির শেষের দিকে আসবো। মায়ের ইচ্ছে ফ্যামিলির সবাই যেন আমাদের বিয়েতে এটেন্ড থাকে, তাই তিনি আগেই রওয়ানা দিবেন। বেশ তো এমনটাই তো হওয়া চাই। আচ্ছা বাবা আনু ফিরেছে ওর সাথে কথা বলো। আনহার অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করেই আনিসা বেগম তার কানে ফোন তুলে দিলেন। আস্সালামু আলাইকুম। কেমন আছেন? ওয়ালাইকুম আস্সালাম। ভালো আছি তুমি কেমন আছ? ভালো আছি। আনহা তোমার ফেভরেট কালার কোনটা? বোটল গ্রীণ, বলেই আনহা চুপ হয়ে গেল। (এই কালারটা বলা কি ঠিক হলো? সে তো এই রঙের কাপড় পড়েনা বহুবছর ধরে। কেউ একজন বলেছিল এই রঙের জামা পড়া তার জন্য নিষিদ্ধ।) নাইস। কেমন ন্যাচারাল ন্যাচারাল ফীল হচ্ছে। হানিমুন কি দেশের কোথাও যেতে চাও নাকি এখানে? প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড আসলে আমি সবকিছু প্রিপ্ল্যান করিতো তাই আর কি। দেখো বিয়ের অনেক আগেই দেশে যেতে হবে। তাই বিয়ের পর বেশি ছুটি থাকবেনা। তুমি তোমার ইচ্ছে অনুযায়ী লোকেশন বলে দিলে সব এরেঞ্জ করাটা সহজ হবে। আনহা হেসে বলল, আপনি আপনার পছন্দমতো চুজ করুন। আমার এসবে আহামরি ফ্যান্টাসি নেই। আরিয়ান আর কথা বাড়ালোনা। এতোদিনে সে ঠিকই জেনে গেছে আনহা খুব সাদামাটা একটা মেয়ে। ওর পড়াশোনার বাইরে কিছুতেই ইন্টারেস্ট নেই। এই সাদামাটা মেয়েটাকে তবুও সে ভীষণ পছন্দ করে। আচ্ছা কেউ কি কখনো জানবে আনহার খুব ইচ্ছে ছিল সবুজ শাড়ি পড়ে সমুদ্রতটে ভেজা বালিতে হাসিবের সঙ্গে অনেকটা দূর হাঁটার? হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করার, সেদিন কেন এই রঙের জামা নিষিদ্ধ করেছিলে বলোতো?? ¤সমাপ্ত