“চরিত্রহীনের পুত্র, এবং পরিজনেরা”
(স্বাগতা)

(দ্বিতীয় অংশঃ)
রোদ মাথায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কতদূর চলে এসেছে খেয়াল করে নি সোহেল। বাস্তবে ফিরলো যখন নিজেকে আবিষ্কার করলো টাউনহলের রাস্তায়। পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে ক্ষিদেতে। মাথা ঘুরছে। বাসায় রুই মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘন্ট রান্না হচ্ছে দেখে এসেছে। মনে হতেই ক্ষিদে বেড়ে গেলো। কিন্তু ঠিক একই সাথে অদ্ভূতভাবে গা গুলিয়ে উঠলো ওর। কিভাবে পারেন আম্মা? এতো কিছু হয়ে যাওয়ার পরেও সাধ করে ওর বাবার পছন্দের খাবার ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে প্রতি বেলায় উনার মুখের সামনে নিয়ে ধরতে?
বেখাপ্পাভাবে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে ও। মাথা ঝাঁকালো জোরে। চিন্তাগুলোকে মাথা থেকে বের করে দেয়ার বিফল চেষ্টা করলো যেন। ওর পাশ দিয়ে যেতে যেতে দুই একজন ফিরে তাকালো। পাগল কিনা বোঝার চেষ্টা করলো বোধহয়। মাথার চুলগুলোর মধ্য দিয়ে আঙুল চালালো সোহেল। সীমার মুখটা ভেসে উঠছে মনের পর্দায়। বিব্রত, সন্ত্রস্ত একটা চেহারা। আবার মাথা ঝাঁকালো সোহেল। খেতে হবে। আশে পাশে দেখলো। কোনও রিকশাওয়ালা বা ট্রাক ড্রাইভারদের খাবারের হোটেলে ঢুকবে ভেবে নিয়েছে। প্রচন্ড ঝাল দেয়া লাল ঝোলের কোনও তরকারি দিয়ে ভাত খাবে। মাছ-মাংস যা হোক একটা হলেই হবে। এ্যাসিডিটি হবে ও জানে, পেটে ব্যথাও করতে পারে, মা চিৎকার করবে তাও জানে। তবে বাবা হয়তো আজকে অন্তত ব্যঙ্গ করে কিছু বলবেন না। হয়তো! সেই মুখ নেই কিছু বলার। হয়তো!
উল্টোপাল্টা ভাবতে ভাবতে সোহেল খুঁজে নিলো একটা হোটেল। একটা খালি টেবিল আর বেঞ্চ খুঁজে বসে পড়লো। একটু আগের কথাটা আবার মনে পড়তেই হাসি পেলো ওর। মুখ? ওর বাবার মুখ নেই কিছু বলার! এও আবার সম্ভব? লজ্জা-শরম, মান-সম্মানের ভয়, চক্ষুলজ্জা যদি বিন্দুমাত্র থাকতো ওই লোকের তাহলে আজকের দিনটা কি আসতো ওদের জন্য? নিজের কর্মক্ষেত্রে উর্ধ্বতনদের উপর্যুপরি তৈলমর্দন আর নিজের আত্মীয়স্বজন আর পাড়াপড়শিদের সামনে নিজের অতিরিক্ত ধর্মানুরাগ আর দান-ধ্যানের নাটক দেখিয়ে এতোগুলো বছর পার করে ফেলেছেন তিনি। এখন নতুন করে নিজের কৃতকর্মের জন্য লজ্জা পাওয়া উনার দ্বারা সম্ভব কিনা, সত্যিই জানে না সোহেল।
মুখভর্তি বিস্বাদ আর সমস্ত অস্তিত্বজুড়ে থাকা বিষাদ মেখে নিয়ে হোটেলের ছোট ছেলেটার এনে দেয়া ভাতের প্লেটে হাত দিলো সোহেল।
সাজ্জাদুল ইসলামের যে চরিত্রগত সমস্যা আছে সেটা প্রথম সুস্পষ্টভাবে সোহেলের সামনে ধরা পড়ে ও যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন। ওদের দুই ভাই-বোনকে আড়াল করে ওর বাবার তর্জন-গর্জন আর মায়ের পিন পিন করে কান্না, ফুঁসে ফুঁসে ওঠা, চাপা গলার ঝগড়া, দুই-একটা চড়ের আওয়াজ, এগুলোর সাথে সোহেল পরিচিত জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই। ও ধরেই নিয়েছিলো এটাই সাধারণ-স্বাভাবিক দাম্পত্যচিত্র। পাত্তা দেয় নি সেভাবে। কিন্তু খোলস ছেড়ে বিষয়গুলো সামনে চলে আসলো যখন তাড়াহুড়া করে মিরপুরে যে বাসায় ভাড়া থাকতো ওরা বলা যায় ওর জন্মের পর থেকেই, সেখান থেকে রাতারাতি সব গুটিয়ে মোহাম্মদপুরে শিফট হতে হলো ওদের।
সেই সময় সবটুকু জানতে পারে নি, বোঝেও নি সোহেল। শুধু দেখেছে ওর মায়ের ফোলা চোখ দিনের পর দিন। চোখে-মুখে আতঙ্ক নিয়ে দ্রুত ঘরের জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা করার দৃশ্য, ওর বোনের হতবিহবল চেহারা। সিমিন, ওর বড় বোন তখন কলেজ ফার্স্ট ইয়ারে। হঠাৎ করে কি থেকে কি হয়ে গেলো, একদিন বিকেলে ওকে আর গলিতে ক্রিকেট খেলতে যেতে দিলেন না ওর মা। একদম ঘরবন্দী করে ফেললেন। ও বাইরে যাবার জন্য জেদ ধরাতে চড় খেয়েছিলো মনে আছে। ওর বোনের বাইরে যাওয়া আরও আগেই বন্ধ হয়েছিলো যদ্দুর ওর মনে আছে, আর সেটা ওর মা’কে বলে দিতেও হয় নি। সিমিন নিজে থেকেই বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো। বাবা ফিরলেন না পর পর কয়েক দিন বাসায়। ৩ দিনের মধ্যে নতুন বাসা কি করে ম্যানেজ হলো নতুন এলাকায়, আর দুই দিনের মধ্যে সমস্ত কিছু বেঁধে নিয়ে, খাট-ফ্রিজ খুলে নিয়ে কেন মধ্যরাতে একদিন ট্রাক ডেকে এনে এলাকা ছাড়লো ওরা, সেসব তখন না বুঝলেও পরে সবই পরিষ্কার হয়েছিলো সোহেলের কাছে।
ওদের আগের এলাকার এক লোকের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন ওর বাবা। ভদ্রলোক সরকারি কলেজের শিক্ষক হওয়াতে ট্রান্সফার অনুযায়ী নানান জেলায় থাকতে হতো। মহিলা কিছুতেই ঢাকার বাইরে যেতে চাইতেন না । তার ছেলের বয়স তখন ৯/১০। ছেলেকে নিয়ে একাই থাকতেন ফ্ল্যাটে। স্বামী ভদ্রলোক সপ্তাহান্তে অথবা দুই সপ্তাহে একবার করে আসতেন নিজের কর্মস্থল থেকে। সোহেলের বাবার ওই ফ্ল্যাটে যাতায়াত কিছুদিন ধরেই এলাকার লোকজন খেয়াল করছিলো। শেষ পর্যন্ত এক রাতে তাকে মহিলার বাসায় ঢুকতে দেখে বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে দেয় লোকে। বহু কাকুতি-মিনতি করে সেই পরিস্থিতি থেকে তখনকার মতো মুক্তি পেলেও এলাকায় এটা নিয়ে সালিশ বসবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। উঠতি বয়সী ছেলেরা সব শার্টের আস্তিন গুটিয়ে তৈরি ছিলো উনাকে পিটিয়ে সোজা করার জন্য। কিন্তু ওই দিন ভোর রাত্রে, অনেক অনুনয় বিনয়ের পরে মহিলার ফ্ল্যাট থেকে বের হতে পেরেই সাজ্জাদ সাহেব চম্পট দেন, এবং সরাসরি ডুব দেন। গোপনে শুধু স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন বাক্স-বস্তা বেঁধে তৈরি হতে, উনারা এলাকা বদল করবেন। ওই মহিলাও আর সেই রাত্রের পর এলাকায় থাকে নি, ছেলে নিয়ে চলে গিয়েছিলো কোনও আত্মীয়ের বাসায়। সালিশ আর বসে নি সব মিলিয়ে, তবে এলাকা ছাড়ার পর আর সোহেলরা ওই এলাকার দিকে যায় নি ভুলেও।
এই ঘটনার রাতের দুই দিন আগেই বিকেলে গলিতে খেলার সময় সোহেলের চাইতে বয়সে কিছু বড়, এলাকারই ২০-২২ বছর বয়সী একদল ছেলে এসে সোহেলের কলার ধরে ওকে ওর বাকি বন্ধুবান্ধবের সামনেই ওকে বেশ ভালো মতো শাসিয়ে গিয়েছিলো। ‘তোর বাপরে কইস ভালো হয়ে যাইতে… বুঝছিস?’ ‘বুইড়া দামড়া… মাইয়ার বিয়ার বয়স হইসে এখনও রস কমে না, না?’ ‘তোর মায়ে কি কিসু দেয় টেয় না? অন্য মাইনসের ঘরে মুখ মারতে যায় ক্যান তোর বাপ?’ ‘আর যদি এই রকম দেখি খবর আছে কইলাম!’ এই ছিলো ওদের মুখের ভাষা। সোহেলের বয়স তখন ১৩/১৪। সত্যি বলতে সেদিনের ওই ছেলেগুলির কথার অর্ধেক বুঝেছিলো আর অর্ধেক বোঝে নি ও। এখন যখন অতীতে ফিরে তাকায় সোহেল, তখন বোঝে যে ঘটনাগুলো বোঝার মত বয়স ওর হয়েছিলো, গুরুত্ব বোঝার মতো বয়স না হলেও। বিশেষত এই ধরনের পারিবারিক সমস্যার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে যেসব ছেলেমেয়ে, তাদের ম্যাচিউরিটি একটু আগে ভাগেই আসে। তারপরেও কেন সেদিনের সেই ছেলেদের ওই আচরণের কারণ ও বোঝে নি এই প্রশ্নের উত্তর নিজের কাছেই পেয়েছে ও পরে। ও বুঝতে চায় নি। সত্য থেকে নাক-চোখ-মুখ বুজে সরে থাকতে চেয়েছিলো। অস্বীকার করতে চেয়েছিলো চরম লজ্জার, মর্মান্তিক অপমানের বিষয়গুলোকে। সেই বয়সে সেটাই ছিলো ওর ডিফেন্স মেকানিজম।
কিন্তু শুধু কি ওই? বাসায় ফিরে যখন মা’কে বলেছিলো সেই ঘটনার কথা, তিনিই কি সত্যিটা বলেছিলেন ওকে? বরং ওর বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দিয়েছেন আর ঘরের মধ্যে হম্বিতম্বি করে, চিৎকার-চেঁচামেচি করে এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে বাইরে যে যা বলছে সব ভুল। সবাই ওর বাবার মতো মহান মানুষকে, তার ইনকাম, আর্থিক সঙ্গতিকে আর সুখী পরিবারকে হিংসা করে বলেই এমন কুৎসা রটায়। সেই সময় মায়ের কথাগুলো কতোই না গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিলো সোহেলের কাছে! মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে চেয়েছে সেগুলোই। আর তারপরেই রাতের আঁধারে ঘরবাড়ি, এলাকা ছাড়তে হয়েছে ওদের। ওর মায়ের গলাবাজির সাথে কাজের কোনও মিল না পেয়ে খুব ধাক্কা খেয়েছিলো সোহেল। মনে আছে। দুই একবার বলার চেষ্টা করেছে যে ওরা, বা ওর বাবা তো কোনও অন্যায় করে নি! তাহলে ওরা কেন ভয়ে এলাকা ছাড়বে? উত্তর পেয়েছিলো ওর বাবার চেহারা দেখে। চোরের মতো মুখ করে ঘরে ফিরেছিলেন তিনি। তবে ওই ঘটনার মতো ঘটনা তিনি আর নিজের থাকার জায়গায়, এলাকার মধ্যে আর ঘটান নি। যে কারণে ওদের বর্তমান এলাকায় তাঁকে নিয়ে তেমন কোনও কথা রটে নি এই সময়ের আগ পর্যন্ত।
সেই মোহভঙ্গের শুরু। ওর বোনের আরও আগেই হয়েছিলো সেটা। সেই ঘটনার পরে একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলো সিমিন। কেউ কোনও প্রশ্ন করলে উত্তর দিতো শুধু। নিজে থেকে কোনও কথাই বলতো না একেবারে। বরাবরের ভালো ছাত্রী সিমিনের ইন্টারের রেজাল্ট খুব খারাপ হয়েছিলো। তারপরেই যখন বিয়ে দিয়ে দিলো ওকে, তখনও কিছু বলে নি সিমিন। সোহেল অত অল্প বয়সেও প্রতিবাদ করেছিলো বোনের বিয়ে নিয়ে, কিন্তু সিমিন একবারও আপত্তি করে নি। স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞ সোহেল, কারণ ওর বোনজামাই মানুষটা খুব ভালো। ওর বোন যে বিয়ের পরে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করতে পেরেছে, চাকরি করছে, আর সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করছে, এটাই আশ্চর্য্য। ওর বোনকে এই সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসার পুরো কৃতিত্বটাই জামিল, মানে সোহেলের দুলাভাইয়ের। যে মেয়ে হাসতে, কথা বলতেই ভুলে গিয়েছিলো, সে এখন সামাজিকতা পালন করে, জীবনের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে স্বাভাবিকভাবে চলেফিরে বেড়াচ্ছে। প্রচন্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই মানুষটা শক্ত করে সিমিনের হাত ধরেছিলো বলেই সিমিন বেঁচে গেছে।
কিন্তু সোহেলের ভাগ্য অতোটা সদয় হয় নি ওর প্রতি। ও রয়ে গেছে ওর বাবা-মায়ের এই বিকট, বীভৎস দাম্পত্য সম্পর্কের মাঝের গিঁট হয়ে। যতো বয়স হয়েছে, ওর বোনের মতো ও নিজেও ক্রমেই কথাবার্তা কমিয়ে দিয়েছে। বাসায় থাকাকালে পারতপক্ষে মুখ খোলে না ও। বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাও নেহায়েৎই কম। ভয় হয় ওর নতুন মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়তে। কাছে আসলেই তো লোকে জেনে যাবে ওর জীবনের দুর্ভাগ্যজনক সমস্ত সত্যের কথা। সোহেল নিজে থেকে যদি কিছু নাও বলে, ওর বাবা যে কোথায় কি কাহিনী ঘটিয়ে রেখেছেন তার কি কোনও ঠিক আছে? কোন দিক দিয়ে কি সত্য বের হয়ে যাবে আর মাথা নিচু হবে ওর।
এমন যে ঘটে নি তা তো না! ওর ভার্সিটি জীবনটা বাপের পরিচিতি বা উপস্থিতির কারণে কিছুটা সহজ, কিছুটা প্রশ্রয়ের হওয়ার কথা ছিলো হয়তো বা। কিন্তু হয়েছে তার উল্টো। ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে উঠতে উঠতেই ও বুঝে গিয়েছিলো ওকে ইঙ্গিত করে আশেপাশে হওয়া ফিসফিসানির মানে। সিনিয়র আপুরা কেউ কেউ মুখ টিপে হাসতো, কেউ কেউ ভ্রূ কুঁচকে সরে যেতো ওর পথ থেকে। ওর সহপাঠী মেয়েরা যারা সহজভাবে মিশেছিলো শুরুর দিকে ওর সাথে, কিছু দিনের ব্যবধানেই তাদের আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলো সোহেল। সাথের ছেলেরা ওর সামনে স্বাভাবিক থাকলেও আড়ালে যে ওকে নিয়ে হাসাহাসি করে তা টের না পাওয়ার মতো নির্বোধ ও ছিলো না। কুঁকড়ে যেতো ও ভেতরে ভেতরে। মাথা নিচু করে নিজেকে প্রায় অদৃশ্য করে ফেলার চেষ্টা করতো সবসময়। এমনকি শিক্ষকরাও কেউ কেউ ছেড়ে কথা বলতেন না। ক্লাসে বা ক্লাসের বাইরে টিটকিরি শুনিয়ে দিতেন ওর বাবার ‘প্রেমিক সত্তা’ নিয়ে।
সেই থেকেই সোহেল বুঝে গিয়েছিলো যে রেজাল্ট ওর যেমনই হোক, এখানে, এই পরিবেশে, সকলের এই দৃষ্টির সামনে ও কিছুতেই চাকরি করার আশা করতে পারে না। ওকে চাকরি হাতে ধরে দেয়া হলেও ও করতে পারবে না এখানে। এমন কি সিনিয়র শিক্ষক দু’একজন, ডিপার্টমেন্টের হেড অথবা ফ্যাকাল্টি ডিন, তাঁদের কেউ কেউ ইঙ্গিতে ওকে বুঝিয়েও দিয়েছে, ওর বাবা উপরমহলের সাথে সুসম্পর্ক রেখে চলেন বলেই এখনও এই স্বভাব নিয়েও এখানে টিকে আছেন। কিন্তু উপরমহলও উনার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। উনার কাজের এক্সপেরিয়েন্স ভালো বলে উনাকে রাখা হয়েছে এখানে, বহুবার বহু মেয়ের অভিযোগ সত্তেও। কিন্তু তার মানে এই না যে উনার মতোই একই চরিত্রের গুণবিশিষ্ট আরেকজন কাউকে নিয়োগ দেবে বিশ্ববিদ্যালয়। অতোটা উদারতা আশা করা সোহেলের জন্য ঠিক হবে না।
সব চাইতে জঘন্য ব্যাপারটা ঘটেছিলো যখন ও অনার্সের শেষ সেমিস্টারে। ততোদিনে মেয়েরা কেউ কেউ ওকে সরাসরি বলেছে ওর বাবার ব্যাপারে। ওর বাবার কক্ষে কোনও ধরণের এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কোনও কাজে যে ওরা একা যেতে সাহস পায় না, টিউশন ফি ওয়েভারের এ্যাপ্লিকেশন, স্কলারশিপ বা রিপিট এক্সাম দেয়ার এ্যাপ্লিকেশন, যে কোনও কাজই হোক না কেন, ওরা দল বেঁধে যাওয়ার চেষ্টা করে, এই সমস্ত কিছুই সোহেলের কানে এসেছে ততোদিনে। একা পেলেই উনি একটু বেশি কথা বলেন, ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করেন, একটু বেশি সময় আটকে রাখেন রুমে, সম্ভব হলে হাতটা একটু ধরে আঙুল বোলান। কিছু কিছু মেয়ে তো মুখের উপর ফাজলামি করতো, উনার কাছ থেকে কোনও কাজ দ্রুত করিয়ে নিতে হলে জাস্ট ওড়নাটা গলায় তুলে দিয়ে জামার গলাটা একটু নামিয়ে সামনে গেলেই চলে। স্মুদ এ্যান্ড স্পিডি সার্ভিস পাওয়া যায় নাকি। মেয়েরা অবশ্য এটাও স্বীকার করতো যে উনার কথা বলার ভঙ্গীটা যথেষ্ট আকর্ষনীয়। ভারী গলায়, সুন্দর উচ্চারণে, গুছিয়ে কথা বলেন নাকি উনি। আর উনি কারও সাথে জোরাজুরিও করেন না কিন্তু! যা হওয়ার তা উভয়পক্ষের সমঝোতাতেই হয় নাকি! মেয়ে পটানো উনার একটা সহজাত গুণ। কেউ কেউ তো ব্যঙ্গ করে এটাও বলতো যে সোহেল ওর বাবার মতো স্মার্ট না। বয়সেও সোহেলের বাবা নয়, বড় ভাই মনে হয় উনাকে। ওর বাবা যেভাবে নিজেকে মেইন্টেইন করেন, কাপড়চোপড় থেকে শুরু করে মাথার পাতলা হয়ে আসা চুল পর্যন্ত, তার কিছুই সোহেলের ভেতর নেই। ওর কাছের বন্ধুরা আবার তখন প্রতিবাদ করতো ওর হয়ে, যে দরকার নাই ওইরকম স্মার্টনেসের। সোহেল কারও কথারই কোনও উত্তর দিতো না। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করতো ওর। যে বন্ধুরা ওর হয়ে কথা বলতো, তাদের কথাগুলোও যে কতটা অপমানজনক ওর পরিস্থিতিতে, সেটাও ও বোঝাতে পারতো না কাউকে।
অনার্স থার্ড ইয়ার থেকে ওর ক্লাসের দীপ্তিকে ভালো লাগতে শুরু করেছিলো সোহেলের। দীপ্তির চোখেও নিজের জন্য প্রশ্রয় দেখেছিলো সোহেল। কিন্তু দু’জনের ভালো লাগাটা কোনও সম্পর্কে পরিণতি পাবার আগেই দীপ্তি খুব অদ্ভূতভাবে ওকে এড়িয়ে চলা শুরু করেছিলো ফোর্থ ইয়ার শুরু হবার পর থেকেই। ভীষণ এলোমেলো বোধ করেছিলো সোহেল। কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না। ওর দোষটা কোথায় অনেক খুঁজেও বুঝতে পারে নি। শেষ সেমিস্টারে গিয়ে মরিয়া হয়ে দীপ্তির সাথে সরাসরি কথা বলার সিদ্ধান্ত নেয় সোহেল। দীপ্তিকে অনুরোধ করে ক্লাস শেষে ক্যান্টিনে ওকে কিছুটা সময় দিতে। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে দীপ্তি আসে নি সেদিন। এসেছিলো দীপ্তির খালাতো বোন, মৌ। একই ভার্সিটিতে তখন মাস্টার্স করছে ও, ওদের এক বছরের সিনিয়র। মুখ-চোখ শক্ত করে সোহেলকে বলেছিলো যে দীপ্তিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা যেন বন্ধ করে সোহেল এখনই। নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে সোহেল প্রশ্ন করেছিলো, জানতে চেয়েছিলো যে ওর অপরাধটা কি। মৌ দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চুপ করে তাকিয়েছিলো ওর দিকে। বুঝে নিতে চেয়েছিলো যে সোহেল আসলেই কতোটা নিরপরাধ। তারপর বলেছিলো, কিছুদিন আগে দীপ্তি ওর রেজাল্টের ভিত্তিতে আংশিক টিউশন ফি ওয়েভারের দরখাস্ত নিয়ে ওর বাবার রুমে গিয়েছিলো। সোহেলের প্রতি অনুরাগের কারণে ও বোধহয় সাময়িকভাবে ভুলে গিয়েছিলো উনার স্বভাব। সোহেলের বাবা ছাড়া আর কিছু মনে হয় নি ওর কাছে উনাকে। সেই উনি যখন হাসতে হাসতে গল্পোচ্ছলে ওকে বলেছেন, ‘তোমার গলার নিচের তিল দু’টি কিন্তু খুব সুন্দর… একদম কবিতার ছন্দের মতো… পর পর সাজানো একেবারে… ভীষণ… হাহা… যেটা বলতে ইচ্ছে করছে সেটা বললে আবার তুমি মাইন্ড করবে না তো? আমি আসলে সৌন্দর্য্যের পূজারী… সুন্দর কিছু দেখলে ইমোশনাল হয়ে পড়ি… তিল দু’টো ভীষণ সেক্সি!”, তখন বাস্তবতার রূক্ষ্ম মাটিতে আছড়ে পড়েছে দীপ্তি। ছিটকে বেরিয়ে এসেছে ওই রুম থেকে, আর সেই সাথে সোহেল ছিটকে গেছে ওর মনের আঙিনা থেকে।
মাথা নিচু হয়ে বুকে গিয়ে ঠেকেছিলো সোহেলের থুতনি মৌয়ের সামনে। দীপ্তির বিউটি বোন, অর্থাৎ কন্ঠার হাড়ের উপর দু’টো তিল আছে ছোটো। কালো তিল দু’টিকে মনে করে রাতে বিল্ডিং-এর ছাদে শুয়ে প্রেমে আর্দ্র হয়েছে সোহেলের মন কতোবার! এক নিমেষে ওর মনে হয়েছিলো যে ওর নিজেরও পাপ ছিলো সেটা। কিন্তু কোথায়! ও যখন ভেবেছে ওর মনে তো কোনও কামনা জাগে নি! মুগ্ধতা ছিলো শুধু মিষ্টি একটা লাজুক মুখের জন্য! ঘেন্না হচ্ছিলো নিজের প্রতিটা রক্তের কোষকে সেদিন। দীপ্তির শরীর থেকে ওর বা ওর বাবার দৃষ্টি উপড়ে নিতে ইচ্ছে করছিলো। আর নিজের শরীরের মাংস-হাড় সব খাবলে খাবলে ছিন্নভিন্ন করতে ইচ্ছে করছিলো। যেটাকে ও প্রেম ভেবেছিলো, সেটাকেই মনে হচ্ছিলো গর্হিত নিকৃষ্ট অপরাধ। কি করে ভুলে গেলো ও যে নারী, প্রেম, ছিমছাম পরিবার ওর জন্য না?
সেই প্রথম আর সেই শেষ, ও বাইরের কোনও মানুষের সামনে বসে চোখের পানি ফেলেছিলো। টপ টপ করে চোখের পানি পড়েছিলো ওর সামনের লাল রঙের প্লাস্টিকের টেবিলে। ওর সামনে বসে দীর্ঘ সময় ধরে ওকে পর্যবেক্ষণ করছিলো মৌ। শেষ অব্দি বোধহয় মায়া হয়েছিলো ওর জন্য। কণ্ঠ মোলায়েম করে বলেছিলো, “সোহেল, তোমার বাবার সম্পর্কে জানলেও আমি তোমার সম্পর্কে এই কয় বছরে কারও কাছে কোনও খারাপ কথা শুনি নি… দীপ্তির কাছেও যতটুকু যা শুনেছি, ভালো কথাই শুনেছি… তোমাকে দেখেও আমার খারাপ মনে হয় নি… আমি এটাও মনে করছি না যে বাবা বা মা খারাপ হলেই সন্তান খারাপ হবেই… কিন্তু তুমি তো বুঝতেই পারছো আশা করি… এটা নিশ্চয়ই তোমাকে বলে দিতে হবে না যে একটা মেয়ের বুঝতে দেরি হয় না যে কোন পুরুষ কোন প্রশংসাটা তার সম্পর্কে কোন ইঙ্গিতে করছে… যে লোক অলরেডি আমার বোনের দিকে অশালীন দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে ফেলেছে, তারই ছেলের বউ করে তো আমার বোনকে পাঠাতে পারি না, তাই না? বউ তো পরের কথা… গার্লফ্রেন্ড হওয়াটাও কি কম প্রব্লেম্যাটিক? এর পরে কি দীপ্তিই তাকে মুরুব্বী বলে সম্মান দিতে পারবে কোনদিন নাকি উনি উনার নজর ঠিক করে ফেলবে, বলো?… আমার পরিবার এসব জানতে পারলে আরও খারাপ কিছুই বলবে… তোমার সম্পর্কেও বলবে… আর তোমার বাবার সম্পর্কে সব কিছু জানলে তো কথাই নাই… কিন্তু আমি সেদিকে যেতে চাচ্ছি না… আশা করি তুমি বুঝতে পারছো…”।
এই পর্যন্ত বলে একটু থেমেছিলো মৌ। তারপর আবার বলেছিলো, “আমার মনে হয় কি সোহেল, তোমার বাবার সাথে তোমার সরাসরি কথাবার্তা বলা উচিৎ… এটা অবশ্য তোমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, আমার এখানে কথা বলাটা ঠিক মানায় না, কিন্তু তোমাকে দেখে মায়া হচ্ছে বলেই বলছি… তোমার তো একটা লাইফ আছে, তাই না? একটা ভবিষ্যৎ আছে না? মা-বাবা যদি অসুস্থ হয়… তাদের যদি কোনও দিকে কিছুর কম থাকে তো সন্তান হিসেবে তাদের পাশে দাঁড়ানোটা কর্তব্য… কিন্তু এটা তো ঠিক অসুস্থতার পর্যায়ে পড়ছে না… এটা একটা চয়েস… উনার সম্পূর্ণ সজ্ঞানে, সচেতনভাবে, সব কিছু বুঝেও করতে থাকা একটা চয়েস… এটার দায় তো তোমার উপর… বা তোমার কোনও ভাই-বোন আছে কিনা আমি জানি না… তাদের উপর এসে বর্তায় না, তাই না? উনার কর্মের ভারটা উনাকেই নিতে দেয়া উচিৎ… আর মানুষের অতীত থাকে, থাকতেই পারে… এমনকি উনি যদি তোমার মায়ের সাথে সুখী না হন, নতুন করে কোনও বৈধ সম্পর্কে জড়ানোটাও কোনও সমস্যার বিষয় না… কিন্তু উনি যেটা করেন… যা করছেন… এটাকে তো বলে…”, এতো সরাসরি কথা বলতে পারা স্পষ্টবাদী মৌও আর কথাটা শেষ করতে পারে নি, শেষ শব্দটা উচ্চারণ করতে পারে নি বাবা সম্পর্কে ছেলের সামনে। একটু বিরতি নিয়ে পরে বলে, “এভাবে তো তোমার বা তোমাদের জীবন চলতে পারে না, তাই না? কিছু করা উচিৎ তোমার… হয় উনাকে শোধরাতে হবে, নাহয় তোমাকে নিজের জীবন নিয়ে আলাদা হয়ে যেতে হবে… নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তুমি এই পরিবেশে কিন্তু কিছু ভাবতে পারবে না সোহেল… একটু বুঝে দেখো কি বলতে চাচ্ছি আমি…”, ব্যাগ কাঁধে উঠে দাঁড়িয়েছিলো এর পর মৌ। চলে যেতে গিয়েও ফিরে দাঁড়িয়ে শেষে বলেছিলো, “বড় বোনের মতো কিছু কথা বলে ফেললাম… সরি… তুমি ভালো একটা ছেলে, সোহেল… দোয়া করি যেন এমনটাই থাকো সারাজীবন… অল দ্য বেস্ট…”।
দীপ্তির সাথে আর কোনদিন কথা বলে নি সোহেল। চোখ তুলেই তাকায় নি আর কোনদিন। একটা ‘সরি’ বলার ছিলো, তাও বলা হয় নি। এখনও কানে বাজে মৌয়ের বলা কথাগুলো সোহেলের। তিক্ত অভিজ্ঞতাটা যতোই ভুলে যাবার চেষ্টা করেছে, ততোই আরও আষ্টে পৃষ্টে জাপটে ধরেছে সেই স্মৃতি। কিছুতেই ভুলতে পারে নি। কিছুতেই সরিয়ে দিতে পারে নি সেদিনের সেই তীব্র কষ্ট। মরে যেতে চেয়েছে বহুবার। সাহস ছিলো না তা না, কিন্তু সর্বগ্রাসী এক ধ্বংসের তৃষ্ণা যেন ওকে মরতেও বাধা দেয়। ও যেন অপেক্ষা করে এর পরিণতি দেখার। নিজের জন্য কোনও আশা, স্বপ্ন, সম্ভাবনা, কিছুই অবশিষ্ট নেই ওর মধ্যে। নিজেকে নিয়ে ভাবতেও ইচ্ছা করে না ওর। জীবন জীবনের নিয়মে আগায়, তাই ও সেই স্রোতে চলতে থাকে। এ্যাকিউট ডিপ্রেশনের রুগী এখন ও, ও নিজেই বোঝে সেটা। শুধু অপেক্ষা করে ওর বাবার কি হয় সেটা দেখার। একটা মানুষ এতোখানি স্বার্থপর, এতোখানি নিজের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট, আর এতোটা রিপুর বশ হয় কি করে যে তার চোখে তার চারপাশের নিজের মানুষগুলোর সর্বনাশ ধরা পড়ে না! এর শেষ দেখতে ইচ্ছা হয় ওর।
***
হোটেল থেকে খাওয়া শেষ করে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঢাকার রাস্তায় ঘুরলো কিছুক্ষণ সোহেল। বাসায় ফেরার ইচ্ছে বা তাড়া কোনটাই নেই। ওর মা ফোন দিয়েছেন বেশ কয়েকবার। ধরে নি। সেই একই ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিং, ‘তোরা সবাই আমার সাথে এইরকম করিস…’, ‘তুই না আসলে আমি ভাত খাবো না বলে রাখলাম…’, ‘সবাই মিলে পাইছিস তো এক আমারে… সব দোষ আমার… হইসে এবার? খুশি তো?…’। সোহেলের বিরক্তিতেও বিরক্তি এসে গেছে এসবে। ও ভাবে, উনি বোধহয় বোঝেও না যে বার বার, বার বার, বছরের পর বছর ধরে এই সমস্ত কথা, নাটক করতে করতে এগুলো কি পরিমাণ সস্তা হয়ে গেছে। এগুলোর কোনও গুরুত্বই এখন আর নেই। সেই সাথে হালকা হয়ে গেছেন উনি নিজে। ওর বাবা এগুলোকে পাত্তা দেন, বা বলা ভালো পাত্তা দেয়ার অভিনয় করেন, কারণ ঘরে বউয়ের এই সমস্ত মান-অভিমানের নাটকে তাল দিলে বউয়ের মাথা ঠান্ডা রাখতে উনার সুবিধা হয়। আর সেই সাথে সুবিধা হয় বাইরে রং-তামাশা করে বেড়ানোর। কিন্তু ছেলে-মেয়ের কাছে এই সমস্ত এখন গায়ে জ্বালা ধরানো, গা ঘিন ঘিন করা কিছু বিষয় ছাড়া আর কিছুই না।
এর আগে শায়লা, সাজ্জাদ সাহেবের প্রতিটা কান্ডের পরে এক প্রস্থ কান্নাকাটি, ভাঙচুর, ঝগড়াঝাঁটির পরে ছেলে-মেয়েদের কাছে এসে আবার কাহিনীর ঝুলি খুলে বসতেন। সাজ্জাদ সাহেব যা কিছু শিখিয়ে দিতেন, যা বুঝাতেন উনাকে, তাই উনি পাখিপড়া পড়ার মতো করে বলতে থাকতেন বাচ্চাদের। আসলে অমুক মহিলারই চরিত্রের দোষ। তমুক বাড়ির মেয়েটাই খারাপ। ওই মেয়ের কাপড়চোপড়ের ঠিক নাই। সেই মহিলা পুরুষ দেখলেই হেসে গড়িয়ে পড়ে। দিনে দিনে বুঝেছে সোহেল যে এই কথাগুলো ওদের বোঝানোর জন্য যতোটা না বলতেন মহিলা, তার চাইতে বেশি প্রয়োজন ছিলো তাঁর নিজেকে বুঝ দেয়া। বাবার প্রতি তো বিতৃষ্ণা ছিলোই, যতো দিন গেছে ততো বিরক্তি আর মানসিক দুরত্ব বেড়েছে মায়ের সাথেও।
ওর মা ঘরে পারতপক্ষে কখনও কোনও মেয়েকে সাহায্যকারী হিসেবে রাখতেন না। সিমিনের বিয়ের আগে সংসারের কাজ সব নিজেই করার চেষ্টা করতেন। আর মেয়ের বিয়ের পর থেকে কয়েক বার ছোট ছেলে রেখেছেন সাহায্য করার জন্য। ছুটা মানুষের পাশাপাশি এখন রাখতেই হয় কাউকে না কাউকে, উনার নিজেরও বয়স হয়েছে, এক হাতে সব কিছু করে আর কুলাতে পারেন না। বছর দুই আগে শেষ যেবার ঘরের সাহায্যকারী ১৭ বছর বয়সী মেয়েটাকে গালিগালাজ করে, খারাপ চরিত্রের দোষ দিয়ে বিদায় দিলেন শায়লা মাত্র দিন দশেকের মাথায়, তখনও শুরুতে কিছু বলে নি সোহেল। শায়লা ভেবেছিলেন সাজ্জাদ সাহেবের বয়স হয়েছে, নিজের মেয়ে আছে একটা, নাতনিও হয়েছে একটা, এখন নিশ্চয়ই উনি এতো ছোট, অল্প বয়সের কোনও মেয়ের দিকে হাত বাড়াবেন না! কিন্তু তিনি ভুল ছিলেন। মেয়েটা বিদায় নেয়ার পরে ছেলের ঘরে এসে বসে শায়লা গজ গজ করে মেয়েটার নামে নানান কথা বলা শুরু করলেন, “কত্তো বড় সাহস চিন্তা করছিস? বলে কিনা ‘খালু আমার গায়ে হাত দেয়ার চেষ্টা করে!’ হ্যাঁ! এই জন্য আমি ঘরে জোয়ান মেয়ে রাখতে চাই না। আজকাল এইগুলা এই এত্তোটুকু বয়স থেকেই পেকে যায়… আর আমাদের মতো বাড়িতে এসে শুরু করে শয়তানি। গলা বাড়সে কতো দেখিস না? … সব পয়সা খাওয়ার ধান্দা!… আজকাল আইন কানুন হইসে না সব? নারী নির্যাতনের একটা কেস করে দিলেই তো শেষ! … তাও আবার গৃহকর্মী… মান ইজ্জত সব টেনে ধুলায় নামাবে সাংবাদিকরা!… যত্তোসব… আমার ঘরে জোয়ান অবিবাহিত ছেলে!… তারে নিয়েও যদি কিছু বলতো ওই মেয়ে তো বুঝতাম!… বলে কিনা খালুর নজর খারাপ!… গায়ে হাত দিতে চায়!…”।
উনি হয়তো বলেই যেতেন এই সমস্ত কথা। কিন্তু থামতে বাধ্য হয়েছিলেন কারণ সোহেল চিৎকার করে উঠেছিলো। সেই প্রথমবার। বাবা কেন, মায়ের সাথেও উঁচু গলায় কোনদিন কথা বলে নি সোহেল, সিমিন তো নয়ই। কিন্তু সেদিন সোহেল গলা তুলেছিলো। ঘরের ছাদ ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠেছিলো, “চুপ করো আম্মা!… চুপ!… একদম চুপ!…”। থর থর করে কেঁপে উঠেছিলেন শায়লা। তাঁর কথার স্রোত প্রচন্ড বেগে এসে যেন ধাক্কা খেয়ে আটকে গিয়েছিলো কোনও কংক্রিটের কঠিন বাঁধের সামনে। দরদর করে চোখ থেকে নেমে এসেছিলো পানির ধারা। নিজের কাছেও যা স্বীকার করতে লজ্জা, সেই সত্য যে ছেলের কাছে বহু আগে থেকেই প্রকাশিত, সেটা কি তিনি জানতেন না? সবই জানতেন, সবই বুঝতেন। তবুও অযথাই এক অভিনয় করে যাওয়াটাই যেন এদের সবার বেঁচে থাকার একমাত্র পন্থা ছিল। একমাত্র আড়াল। সোহেলের চিৎকারে সেই আড়ালটা সেদিন ঝুর ঝুর করে ভেঙে পড়েছিলো বালির বাঁধের মতো। নিজেদের নগ্ন চেহারা নিয়ে একজন আরেকজনের সামনে স্থির হয়ে বসেছিলেন তারা দু’জন কিছুক্ষণ। অসহায় আক্রোশ নিয়ে তাকিয়ে ছিলো মায়ের মুখের দিকে সোহেল। কাঠ হয়ে যাওয়া শরীরটাকে তুলে নিয়ে শায়লা একটা সময় বের হয়ে গিয়েছিলেন সোহেলের ঘর থেকে। আর একটা কথাও তিনি বলতে পারেন নি।
উনার ঘ্যানঘ্যানানি, শাপ-শাপান্ত করা, বিলাপ ইত্যাদির অভ্যাস এখনও রয়েই গেছে, কিন্তু এরপরে কোনদিন স্বামীর দোষ আড়াল করে অন্য মেয়ে বা মহিলাদের চরিত্র নিয়ে টান দিয়ে কথা বলেন নি, অন্তত সোহেলের সামনে না।
মানুষ হয়তো ঠিকই বলে, সংসারে চলতে গেলে নিজের মানুষের কাছেও কিছুটা আড়াল থাকা প্রয়োজন। সব সত্য, সব বাস্তবতা নগ্নভাবে উন্মোচিত হয়ে গেলে জীবন কাটানো কঠিন হয়ে যায়। সব কিছু সবার জানা থাকলেও সব কিছু সব সময় মুখে প্রকাশ করতে নেই। কিন্তু সোহেলদের পরিবারে এই কথাটা কতোটা খাটে সেটা ভাববার বিষয়। সোহেলের কখনোই মনে হয় নি যে ওর মা ভীষণ অসহায় একজন মহিলা। মাস্টার্স করা একজন মহিলা তিনি। ভালো পরিবারের মেয়ে। যথেষ্ট বুদ্ধিমতী এবং স্মার্ট। সাধারণ রক্ষণশীল মনোভাবের মধ্য দিয়ে বড় হয়ে উঠলেও তাঁর স্বনির্ভর হওয়াতে কোনও বাধা ছিলো না। হ্যাঁ, সংসার ভাঙা বা স্বামীকে ছেড়ে চলে আসা তাদের মতো পরিবারের মনোঃপুত হবার মতো বিষয় হয়তো না, কিন্তু যে পরিস্থিতিতে তিনি জীবন পার করছেন, সেখানে তাঁকে কেউ সেভাবে দোষ দিতো না। অতোটাও মধ্যযুগীয় মনমানসিকতা তাঁর পরিবারের না যে সব কিছু জেনেও তাঁরা তাঁকে মানিয়ে নিয়েই চলতে বলতো। ইচ্ছা করলেই তিনি ছেলে-মেয়ে নিয়ে আলাদা হয়ে নিজের জন্য একটা জীবিকা খুঁজে নিতে পারতেন। সোহেল নিজেকে দিয়ে জানে, এবং বোনের ক্ষেত্রেও নিজেকেই সাক্ষী মেনে বলতে পারে যে প্রাচুর্য্য না থাকলেও ওরা ভাই-বোন অন্তত নিত্যদিনের এই মানসিক অত্যাচার আর অপমান থেকে মুক্ত হতে পারলেই বরং হাঁফ ছেড়ে বাঁচতো। শায়লা সেটা করেন নি। তিনি নিজেও এই দূষিত পরিবেশে রয়ে গেছেন, সিমিন তো বিয়ে হয়ে বেঁচেছে, কিন্তু সোহেলকেও টেনে ধরে আটকে রেখেছেন তিনি এখানে। নিজের ভাই-বোনের সাথেও বরং তাঁর সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে সাজ্জাদের জন্য। কেউ কিছু বললেই গলা তুলে ঝগড়াঝাঁটি, শাপ-শাপান্ত করেছেন। কার ঠেকা পড়েছে সেসব সহ্য করার? সোহেল রয়ে গেছে কারণ বের হতে চাইলেই শায়লা খাওয়া বন্ধ করে, কসম দিয়ে, অজ্ঞান হয়ে, অসুস্থ হয়ে স্পর্শকাতর এক পরিস্থিতির চূড়ান্ত করেন। যেমনটা আজকে করবেন, সোহেল জানে।
***
দুপুর গড়িয়ে গেলে সোহেল গিয়ে সিমিনের বাসায় উপস্থিত হলো। দরজা খুলে দিলো জামিল। সোহেলের দিকে এক নজর দেখেই দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো সে ওকে ঢুকতে দিতে। শ্যালকের চেহারা দেখেই বুঝেছে ওর মনের অবস্থা। ঘরের টি-শার্ট আর ট্রাউজার তখনও ওর পরণে। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সারাদিন রোদে আর ধূলোতে ঘোরার ফলে মুখটা ক্লান্ত, ধূলো আর ঘামে ভেজা। চোখ দু’টো লাল, উদ্ভ্রান্ত চোখের দৃষ্টি। কিছুই না বলে সোহেলকে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা আটকে দিলো সে। তার দিকে এক নজর তাকিয়ে চোখ নিচু করে নিলো সোহেল। ড্রয়িং রুমে সোফায় গিয়ে বসলো।
জামিল শুরুতেই সোহেলের কাছে না বসে ভেতরে চলে গেলো আগে। বেডরুমে সিমিন তখন মেয়ে আলোকে নিয়ে বিছানায় খুনসুটি করছে। ছুটির দিনের দুপুরের ঘুম দিয়ে উঠেছে কেবল ওরা তিন জন। জামিল ডাক্তার, নিজের চেম্বারও আছে, কিন্তু শুক্রবারে রুগী দেখে না সে। মৃদুস্বরে স্ত্রীকে বললো, “সোহেল এসেছে। ওকে আগে হাত মুখ ধুয়ে একটু ফ্রেশ হতে বলো, আর আমার এক সেট ঘরের কাপড় দাও… চেঞ্জ করে পরুক… ঘামে ভিজে গেছে একেবারে। ঐ কাপড় গায়ে শুকালে পরে জ্বর-টর এসে যাবে। গোসল করলে গোসল করে নিক… আর দেখো কিছু খাবে কিনা… মুখ দেখে মনে হচ্ছে দুপুরে খাওয়া হয় নি…”। সিমিন বিষন্ন কয়েকটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো স্বামীর মুখের দিকে। এই মানুষটার বড় আর সহানুভূতিশীল মনের পরিচয় সে বিবাহিত জীবনের প্রতিটি বাঁকে পেয়েছে। আজকের কথায় তাই অবাক হলো না। বিছানার পাশে ইজি চেয়ারের উপর রাখা ওড়নাটা টেনে নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে মেয়েকে কোলে নিতে যাচ্ছিলো সিমিন, জামিল আবার বললো, “আমি মেয়ের মুখ ধুইয়ে দিচ্ছি… তুমি ফ্রেশ হয়ে সোহেলের কাছে যাও…”। দ্বিরুক্তি করলো না সিমিন। ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো দুই হাতে চুলে খোঁপা করতে করতে।
সিমিন হাতে করে জামিলের এক সেট ধোয়া কাপড় নিয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখে দু’টো সিঙ্গেল সোফার একটাতে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে এলোমেলো হয়ে বসে আছে সোহেল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও সুস্থ বোধ করছে না। চোখ ফেটে পানি এলো সিমিনের। কোনও রকমে নিজেকে আটকে এগিয়ে গিয়ে আলতো করে ভাইয়ের মাথায় হাত বোলালো সিমিন। চোখ মেলে তাকালো সোহেল। সিমিন দেখলো চোখ দু’টো একদম লাল হয়ে আছে ওর। সিমিন বুঝলো জ্বর আসবে সোহেলের। ছোট ভাইয়ের সব কিছুর সাথেই খুব ভালো ভাবে পরিচিত সিমিন। ওদের জীবনের কষ্টগুলো ওদের আরও কাছাকাছি এনেছে। যে মানসিক দূরত্বটা রয়ে গেছে ওদের বাবা-মায়ের সাথে, সেটা ঘুচে গিয়ে ভাই আর বোন একে অন্যকে আঁকড়ে ধরেছে ওরা।
“বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে সোহেল… কাপড়গুলো চেঞ্জ করে ফেল।”
বোনের হাত থেকে কাপড়গুলো নিয়ে চুপ করে বসেই রইলো সোহেল। সিমিন আবার জিজ্ঞেস করলো, “গোসল করবি?”
নিজের প্রতি সচেতন হলো সোহেল এবার। গা, হাত, পা সব ঘাম আর ধূলো-বালিতে চিট চিট করছে। ঘরের কাপড়েই বের হয়ে এসেছে। গোসল করাও হয় নি আজকে। বাসায় ফিরে করবে ভেবেছিলো। মাথা দুলিয়ে সায় দিলো, করবে গোসল।
সোজা হয়ে দাঁড়ালো সিমিন। একই রকম মৃদুস্বরে বললো, “তুই গেস্ট রুমের বাথরুমে চলে যা। আমি তোয়ালে দিচ্ছি। আজকে এখানেই থেকে যা। ফেরার দরকার নেই। আমি রুম রেডি করে দিচ্ছি।”
বোনের দিকে চোখ তুলে তাকালো সোহেল। তারপর নিঃশব্দে উঠে চললো গেস্ট রুমের দিকে। এ বাসায় আগেও থেকেছে। রুম ওর চেনা। গেস্ট রুমের ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো সোহেল সিমিনের তোয়ালে নিয়ে আসার অপেক্ষায়। নিজের বেডরুমে গিয়েছিলো সিমিন, ওয়ারড্রোব থেকে ধোয়া তোয়ালে আনতে। তোয়ালে ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেস্ট রুমের বিছানা বালিশ ঝেড়ে রেডি করতে শুরু করলো। এর মধ্যে নিজের ফোন বেজে ওঠার আওয়াজে রুম থেকে বের হতেই যাচ্ছিলো, জামিল ফোন হাতে এগিয়ে দিয়ে গেলো। শায়লা ফোন করেছেন। ভ্রূ কুঁচকে উঠলো সিমিনের। একটা মুহূর্ত ভেবে নিয়ে রিসিভ করে বললো, “সোহেল আমার কাছে। আজকে এখানেই থাকবে… দয়া করে বার বার ফোন দিও না…”। ওপাশের কোনও কথা না শুনেই বা বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দিলো সিমিন। বাবার সাথে তো কথা প্রায় হয়ই না ওর, মায়ের সাথেও প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেই না বলতে গেলে ও।
রান্নাঘরে গিয়ে নুডলস এর জন্য গাজর, পেঁয়াজ আর বাঁধাকপি কাটতে শুরু করলো কিচেন কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে। কান খাড়া করে রেখেছে, সোহেল কখন ওয়াশরুম থেকে বের হয় সেটা শোনার জন্য। ওর শরীরের অবস্থা নিয়ে চিন্তা হচ্ছে।
‘মামনি… মামনি’ বলে কলকল করতে করতে আলো এসে ঢুকলো রান্নাঘরে। মুখচোখ ধুইয়ে সুন্দর করে দুই ঝুঁটি করে দিয়েছে লম্বা লম্বা চুলগুলো ওর বাবা। কাপড় পাল্টে একটা হলুদ আর সাদা মেশানো একটা সুন্দর ফ্রকও পরিয়ে দিয়েছে। তার বন্ধু এসেছে বাসায় বলে কথা! সোহেল হলো তার জানের বন্ধু। মামুজি-কে পেলে সে এতো গল্প করে যা বাপ-মায়ের সাথেও প্রায় করে না। কোন দাঁড়কাক কিভাবে ডাকলো আর পাশের প্লটের একতলা বাড়িগুলোর ছাদে কবে হুলো বিড়াল মারামারি করলো, সব গল্প জমানো থাকে তার মামুজির জন্য। এখন নাচতে নাচতে রান্নাঘরে ঢুকেছে মায়ের কাছে মামুজির খোঁজ নেয়ার জন্যই। বাবার কাছে শুনে ড্রয়িং রুম, গেস্ট রুম সব ঘুরে আসা হয়ে গেছে মামুজির খোঁজে।
হাসলো সিমিন। এসেই ওর হাঁটু জড়িয়ে ধরেছে মেয়ে। হাত থেকে ছুরিটা সাবধানে কাউন্টারের একটু ভেতরের দিকে সরিয়ে নামিয়ে রাখলো যাতে কোনও ভাবে ছিটকে এসে না পড়ে। এমনিতে মেয়েকে রান্নাঘরে ঢুকতেই বারণ করে, কিন্তু এখন ওকে বকতে ইচ্ছে করলো না। মেয়ের কথার স্রোত থামিয়ে জানালো যে মামুজি গোসলে গেছে, বের হলেই আলোকে ডাকবে। তখনই সোহেলের গলাও শোনা গেলো, “আমার ফড়িং পাখি কই রে?… কাঠবিড়ালীর লেজটা কই রে? … টুনটুনিটা কই গেলোওওও?” ব্যস! আর মায়ের কথা মনে রইলো না মেয়ের। লাফাতে লাফাতে চললো মামুজির কাছে। আদরের সমস্ত উদ্ভট ডাক কানে ঢুকে গেছে। আলোর পেছন পেছন রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলো জামিল। মেয়ের যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে স্মিত হাসলো সেও। তারপর সিমিনের দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলো, “কি করছিলে?”
ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুরিটা তুলে নিতে নিতে বললো সিমিন, “একটু নুডলস করবো, তাই …”
জামিল এসে ওর পিঠে হাত দিয়ে আস্তে করে বললো, “তুমি সোহেলের কাছে যাও… আমি নুডলস করে ফেলছি… তুমি শুধু নুডলস এর প্যাকেট বের করে দিয়ে যাও।”
কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে একবার জামিলের দিকে তাকিয়ে উপরের তাক থেকে নুডলস এর প্যাকেট নামিয়ে দিলো সিমিন। এসব ছোটখাটো রান্না জামিল ভালোই পারে, জানে ও। ঢাকা মেডিকেলে ডাক্তারি পড়ার সময় হোস্টেলে থেকেছে, তখনই রান্না শেখা হয়ে গেছে। অবশ্য অনেক ছোট বেলা থেকেই মায়ের হাতে হাতে রান্না আর ঘরের কাজের জোগাড়ের অভিজ্ঞতাও ওর ছিলো। মুরগির রোস্ট, পোলাও, এসবও শেখা হয়ে গেছে দেখতে দেখতে। ঈদে বা কোনও অকেশনে দেখা যায় সিমিনের পাশাপাশি একটা দু’টো আইটেম জামিল নিজেই রেঁধে ফেলে।
রান্নাঘরের লাগোয়া ডাইনিং রুমে ওদের ফ্রিজ দু’টো, নরমাল আর ডিপ। ডিপ ফ্রিজ থেকে রেডিমেড চিকেন নাগেটসের প্যাকেট বের করে নিয়ে আসলো সিমিন। ভাজবার জন্য ফ্রায়িং প্যান রেডি করে চুলা ধরিয়ে দিলো। আরেক চুলায় জামিল ততোক্ষণে নুডলস সেদ্ধ বসিয়ে দিয়েছে। সিমিনকে নাগেটস ভাজার প্রস্তুতি নিতে দেখে বললো, “সিমিন তুমি যাও… আমি করে ফেলছি এগুলো…”
আর কিছু না বলে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসলো সিমিন। ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখে তার মেয়ে নতুন কেনা বার্বি ডলের যাবতীয় ইতিহাস পড়াচ্ছে তার মামুজিকে। মা’কে দেখে গালভর্তি করে একটা হাসি দিলো। দাঁত ফোকলা তার। মামার মনের অবস্থা বোঝার মতো বয়স তার না। সোহেল ওকে কোলে আঁকড়ে ধরে চুপ করে আছে, যেন একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয়, বাইরের দুনিয়ার সমস্ত যন্ত্রণা, কুপ্রবৃত্তি, কলূষতার বাইরে একমাত্র পবিত্র আর নির্দোষ সুস্থতার প্রতীক এই শিশু, একে জড়িয়ে রেখে ও যেন নিজেকে সমস্ত কলূষ মুক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ওর পাখির মতো কলকাকলি কতোটুকু ওর কানে ঢুকছে কে জানে!
মলিন হাসি দিলো সিমিন দৃশ্যটা দেখে। আস্তে করে মেয়েকে বললো ওর ডলহাউজটা নিয়ে এসে সেটা দিয়ে খেলতে। মেয়ে তিড়িং তিড়িং করে সেটা আনতে গেলে নিজেও গেলো পেছন পেছন। পুতুলের ঘরটা আলো নিজে আনতে পারবে না, জানে। এনে দিলো তাই ড্রয়িং রুমে। পেছনে প্লাস্টিকের একটা ছোট ঝুড়ি ভর্তি পুতুলের ঘর সাজানোর জিনিসপত্র টানতে টানতে নিয়ে আসলো আলো। টুকুর টুকুর করে গল্প তার চললোই, কিন্তু মনোযোগ এখন তার পুতুল আর তাদের ঘরের দিকে। কোন কথাটা যে মা’কে বা মামাকে বলছে, আর কোন কথাটা পুতুলকে বলছে, তা ওই জানে!
সোফায় গিয়ে সোহেলের পাশে বসলো সিমিন। ওর মেয়েটা চঞ্চল হলেও যথেষ্ট লক্ষ্মী। ওকে ব্যস্ত করে দিয়েছে, এখন সে তার মতোই থাকবে। সোহেলের পাশে বসে কোনও কথা বললো না সিমিন। শুধু চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে রইলো। সোফায় বসে উবু হয়ে সোহেল ট্রাউজারের নিচের দিকটা একটা ভাঁজ দিয়ে গোটাচ্ছিলো। জামিল ওর চাইতে একটু লম্বা। ওর ট্রাউজার তাই বড় হয়েছে সোহেলের। হাতের কাজ হয়ে গেলেও সিমিনের দিকে মুখ তুলে তাকালো না। ফাঁকা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ভাগ্নির পুতুলের ঘরের দিকে। তারপর বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়লো। দুই হাতে মুখ ঘষলো জোরে জোরে, যেন ঘষে তুলে ফেলতে চাইলো সমস্ত লজ্জা। দুই হাতে মুখ ঢেকেই বসে রইলো। কথা যখন বললো, মনে হলো যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে ওর কথাগুলো, “সীমার সাথে দেখা হয়েছিলো আপু…”।
বুকটা মোচড় দিলো সিমিনের। ওরা দুই ভাইবোনই ভীষণ চাপা। সম্ভবত ওদের মা-বাবার সাংসারিক চালচিত্র ওদের দুইজনকেই এভাবে গুটিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। জামিলের সাথে বিয়ের পর ধীরে ধীরে সিমিন তাও যতোটুকু নিজেকে প্রকাশ করতে শিখেছে, সোহেল তাও না। তারপরেও ওর যতোটুকু যা বলার তা ও সিমিনের সাথেই বলে। ক্ষেত্রবিশেষে জামিলের সাথে। কোনও সিদ্ধান্ত নিতে জামিলের পরামর্শকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় সোহেল। দীপ্তির সাথে ঘটনাটা সিমিনকে বলেছিলো সোহেল। সিমিন তাই জানে কতোটা ক্ষত বহন করে চলেছে সোহেল তার হৃদয়-সংক্রান্ত বিষয়ে।
কিছুদিন যাবৎ, সোহেল চাকরি পাওয়ার পর থেকে ওর মা উঠেপড়ে লেগেছিলেন সোহেলের বিয়ে করানোর জন্য। সোহেলের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও। সোহেল কোনভাবেই চায় নি কোনও সম্পর্কে জড়াতে। ওর সেই রুচিই হয় নি। তারপরেও ওর মায়ের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে চুপ করে গিয়েছিলো। আর ওর মৌনতাকে সম্মতি ধরে নিয়ে শায়লা মহা উৎসাহে মেয়ে খোঁজার মিশন চালু করেছিলেন। তাঁর পছন্দের তালিকায় প্রথম ছিলো পাড়ার মেয়ে সীমা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। মাস্টার্সে পড়ছে। দেখতে শুনতে ভালো, ছিমছাম ঝুটঝামেলা ছাড়া ছোট্ট পরিবার। ছোট থেকেই বড় হতে দেখেছেন প্রায় চোখের সামনে। তাই চলাফেরা নিয়েও প্রশ্ন নেই। তাঁর উৎসাহে সীমাদের বাসায় দুই-একবার যাওয়া পড়েছে সোহেলের। মাথা নিচু করে গেছে, মাথা নিচু করেই বের হয়ে এসেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের কথাবার্তা শুরু হয় নি দুই পরিবারের মধ্যে, কিন্তু উদ্দেশ্য মিলে যাওয়াতে তাঁরা নিজেদের ছেলেমেয়েকে বলেছিলো নিজেদের মধ্যে একটু আলাপ-পরিচয়, কথাবার্তা বলে নিতে। তারপর এগোতো হয়তো পারিবারিকভাবে পরিকল্পনা, দুই পরিবারের কাছের আত্মীয়স্বজন নিয়ে। সীমার সাথে সেই সূত্রে বার দুয়েক বাইরে দেখা করেছে সোহেল রেস্টুরেন্টে। ব্যবহারে সহজ, সাবলীল, মায়াবী মুখের মেয়েটার প্রতি তারপরেই আকর্ষণবোধ করেছিলো সোহেল। দীপ্তির পরে সেই প্রথম কোনও মেয়ের প্রতি আগ্রহবোধ করলো। আর বুঝলো যে এখনও ভেতরটা সম্পূর্ণ মরে যায় নি ওর। নতুন করে বাঁচার ইচ্ছেটা আবার অনুভব করেছিলো। আর একটাবার নিজেকে সুযোগ দিতে ইচ্ছে করছিলো ওর। ওর জগৎটা নতুন করে সাজতে শুরু করেছিলো কেবলই, সীমার অপেক্ষায়।
আর সোহেলের এই পুরো অনুভবের যাত্রার সাক্ষী ছিলো সিমিন আর জামিল। মৃদুভাষী যুবক বোনের সাথেই ভাগ করে নিয়েছিলো ভালো লাগাটুকু। আর সিমিনের কাছ থেকে জেনেছিলো জামিল। ভাইয়ের স্বপ্ন মাখা চোখের দৃষ্টি দেখে ঠিক যতোখানি আনন্দে দুলে উঠেছিলো সিমিনের মন, আজকে ঠিক ততোটাই মুচড়ে উঠলো কষ্টে।
ছোট্ট পাড়া। পাড়ারই দু’টো ছেলে-মেয়ের মধ্যে বিয়ের কথাবার্তা চলছে, এ কথা এক কান দুই কান হতে হতে জেনেছিলো অনেকেই। খারাপভাবে নেয়ারও কোনও বিষয় সেখানে ছিলো না। ছেলে এবং মেয়ে, দু’টোই ভালো হিসেবেই পরিচিত সকলের সামনে। দুই পরিবার কবে কিরকম সমঝোতায় আসে সেই খবরের অপেক্ষায় ছিলো সকলেই। কিন্তু তারই মধ্যে সাজ্জাদ সাহেব যে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছেন, সেটা জানাজানি হয়েছে সকলের মধ্যে। আর সঙ্গে সঙ্গে সোহেলের পরিবারের সাথে একরকম সম্পর্ক ছেদ করেছে সীমার পরিবার। বিয়ের কথা আগানোর কোনও প্রশ্নই আর ওঠে নি সেখানে। জেনেশুনে তাঁরা চরিত্রহীন বাপের ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দেবেন না। চরিত্রহীন শুধু না, বর্তমানে সামাজিকভাবে অপদস্থ একজন তিনি। তাঁর মত লোকের ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেবে কোন পাগলে? বাপ যেরকম ছেলেও যে সেরকম হবে না তাঁর কি গ্যারান্টি? এমনিতেই সচ্চরিত্র পুরুষ পাওয়া কঠিন, তার উপর যদি পারিবারিক জেনেটিক ব্যাপার থেকে যায়, তাহলে তো কথাই নাই!
আজকে সোহেলের মুখে সীমার কথা শুনেই নিজের দম আটকে ধরলো সিমিন। বিয়েটা এমন পরিস্থিতিতে ভাঙার কারণে এমনিতেই সোহেল বিধ্বস্ত, আজকে আবার নতুন করে কি ঘটেছে তা ভাবতে গিয়েই আতঙ্কিত বোধ করলো সিমিন। ওর মনের কথা ওর দিকে না তাকিয়েও যেন বুঝতে পারলো সোহেল। একই রকম উদাস, নিরাসক্ত কণ্ঠে বললো, “যা ভাবছো তা না আপু, ও আমাকে কিছুই বলে নি… কিছুই হয় নি… আমি জাস্ট…”, কথাটা শেষ করার আগে সময় নিলো সোহেল। কতো সামান্য একটা ঘটনা, অথচ ওর জন্য আবারও আরও একটা দাগ এঁকে দিয়ে গেলো! “ওর হাত থেকে বাজারের ব্যাগ পড়ে গেসলো… আমি জাস্ট ব্যাগটা তুলে দিতে গেসলাম!… ও আমার দিকে এমন ভাবে তাকালো!… রাগ নিয়ে তাকালেও আমি হয়তো বুঝতাম… কিন্তু যেভাবে দেখলো!… মনে হলো… মনে হলো যেন কুষ্ঠ রোগীর ছোঁয়া লাগসে ওর শরীরে!… মনে হলো আমার থেকে কুৎসিত কোনও মানুষ… মানুষ না… জিনিস… আমার চাইতে কুৎসিত কোনও জিনিস ও জীবনে কোনও দিন দেখে নাই!… যেইভাবে চমকালো!… হাহাহা…”, কষ্টের আর্তনাদ হাসি হয়ে ছিটকে বেরুলো যেন সোহেলের কন্ঠ দিয়ে। বলে চললো, “তুমি যদি দেখতা আপু!… মরা মানুষ জেগে উঠলেও মানুষ এইভাবে চমকায় না… আর সবাই… জানো? রাস্তায়, দোকানে সবাই… সবাই তাকায় ছিলো!… কিইইভাবে যে তাকায় ছিলো!… আআআহ!…”। ওর কলিজাটা যেন কেউ ওকে জ্যান্ত রেখে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কাটছে মনে হলো ওর ‘আহ!’টা শুনে।
“ওই দোকানের মাসুম ভাই কি বলে জানো? বলে যে ভালো ঘরের মেয়েরা নাকি এখন আমার দিকে তাকাতেও ভয় পায়!… আমি এতোই অচ্ছুৎ, এতোই ঘেন্নার!…”, আর পারলো না সোহেল। গুঙিয়ে উঠলো। পাশের সোফা থেকে এক রকম গড়িয়ে চলে এলো বোনের পায়ের উপর। মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে দুই হাতে আঁকড়ে ধরলো সিমিনের হাঁটু। কোলে মুখ গুঁজে দিয়েছে প্রাণপণে।
ভারী পুরুষ কণ্ঠের গোঙানির শব্দ এই ভর সন্ধ্যার মুখে এক অপার্থিব, আতঙ্কের শীতল পরিবেশ তৈরি করলো। রান্নাঘরে জামিল শুনছিলো ড্রয়িং রুম থেকে ভেসে আসা সোহেলের কান্না। ওর গা কেঁপে উঠলো। এই কান্না ভালো না, এমন কান্না ভালো না। সহ্য করা যায় না। অস্থির লাগে, দিশাহারা লাগে এমন শব্দে। গলা শুকিয়ে আসে। যেকোনো মূল্যে এই কান্না থমিয়ে দিতে ইচ্ছা হয়, যেকোনোভাবে এই কান্নার মালিককে তার চাওয়ার যা কিছু তা দিয়ে সন্তুষ্ট করতে ইচ্ছা হয়। তবুও সে কান্না থামাক। তবুও এই শব্দ থেমে যাক। এ শুধু কান্না না, এ যেন অভিশাপ, ভয়ংকর এক অশুভ সংকেত।
দমকে দমকে গুমরে গুমরে কাঁদছে সোহেল। ডান হাতের তালুটা ভাইয়ের মাথার উপর ফেলে রেখে শক্ত পাথর হয়ে বসে আছে সিমিন। এতো উত্থান পতন এসেছে ওদের জীবনে, কিন্তু এইভাবে কাঁদতে দেখে নি ও কখনও ভাইকে। গাল গড়িয়ে নিঃশব্দে নামছে উত্তপ্ত অশ্রু। মুখে কোনও স্বান্তনার ভাষা নেই। কিচ্ছু বলবার নেই যেন ওর।
চুলার ধারে দাঁড়িয়ে অন্যমনষ্কভাবে নুডলস নাড়াচাড়া করছিলো কড়াইতে জামিল। হাঁটুর কাছে ট্রাউজারে টান পড়তে নিচে তাকালো। বার্বি কোলে আলো তার দিকে মুখটা উঁচু করে তার দিকে তাকিয়ে। দুই চোখে রাজ্যের বিস্ময় আর দ্বিধা। খেলা ফেলে সে তার প্রশ্ন নিয়ে এসেছে বাবার কাছে।
“বাবা!… মামুজির কি হয়েছে?”
একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে আগে চুলাটা বন্ধ করলো জামিল। তারপর চুলার ধার থেকে একটু দূরে সরে এসে মেয়েকে তুলে নিলো কোলে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলো, “মামুজির কষ্ট হচ্ছে মা!”
“মামুজি কি ব্যথা পেয়েছে?”
“হ্যাঁ বাবা!… মামুজি খুব ব্যথা পেয়েছে। … তোমার মা মামুজিকে আদর করে দেবে এখন, কেমন? তোমাকে আদর করে দিলে তোমার ব্যথা সেরে যায় না? মামুজির ব্যথাও সেরে যাবে তোমার মা আদর করে দিলে… আমরা আল্লাহ কে বলবো যেন মামুজির ব্যথা কমে যায়, কেমন?”
শিশু তখনও দ্বিধায়, “কিন্তু বাবা! মা’ও তো কাঁদছে!… তাহলে কি মা’ও ব্যথা পেয়েছে? মা ব্যথা পেলে মামুজির ব্যথা সারবে কেমন করে, বাবা?”
বিষন্ন হাসলো জামিল, “মামুজি ব্যথা পেয়েছে বলেই তো মা কাঁদছে, বাবা!… তুমি ব্যথা পেলে, বাবা ব্যথা পেলেও তো মা কাঁদে… মা যে অনেক দুঃখ পায়! আমরা ব্যথা পেলে!… তাই মা কাঁদছে, বাবা!” এই বলে কথা ঘোরালো জামিল, “মা মামুজিকে আদর করে দিক… আমরা চলো টেবিলে নুডলস নিয়ে যাই… বাবা নুডলস বানিয়েছি!… তোমার জন্য চিকেন নাগেটস বানিয়েছি!… দেখবা পেটটা ভরে একটু খেয়ে নিলে তোমার মামুজির ব্যথা চলে যাবে… কেমন?” বলে মেয়ের পেটে সুড়সুড়ি দিলো কুটকুট করে জামিল। খিলখিল হাসির শব্দে ভরে উঠলো ঘর। জামিলের মনে হলো একটু আগের গুমোট ব্যথার অন্ধকার কেটে যেন আবারও আলো জ্বলে উঠলো ওর ঘরে সেই হাসির শব্দে!
নুডলস বাটিতে বেড়ে এনে ডাইনিং টেবিলে রাখলো জামিল। ওর পায়ে পায়ে ঘুরছে অনবরত কথা বলতে থাকা ওর মেয়ে। একটা হাফ প্লেটে করে ভাজা নাগেটস গুলো এনে টেবিলে দিলো। টমেটো কেচাপের বোতল এনে রাখলো। চুলায় তখন ফুটছে চায়ের পানি। এবার রান্নাঘরে যেতে যেতে মেয়েকে নিষেধ করলো পেছন পেছন আসতে। চায়ের পাতিলে চাপাতা দিয়ে চুলা বন্ধ করে চায়ের পাতিল ঢেকে দিলো। মেয়ের জন্য ওর মিকি মাউজ এর মুখের আদলের তৈরি করা প্লাস্টিকের বাটি আর কাঁটা চামচ হাতে করে নিয়ে ডাইনিং এ ফিরে এসে দেখলো উঁচু চেয়ারে হামাগুড়ি দিয়ে পেট দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে ওর মেয়ে। ওর জন্য চেয়ারগুলো একটু বেশিই উঁচু। হেসে মেয়েকে তুলে বসিয়ে দিলো চেয়ারে। মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে বার্বি পুতুলটা মেয়ের কোলে দিলো। পাশের শো কেস থেকে ওদের সবার জন্য কাঁচের বাটি নামালো। তারপর নিজে মেয়ের পাশে বসে পড়লো। ওই ঘরে কোনও সাড়া শব্দ নেই দেখে গলা সামান্য তুলে ডাকলো, “সিমিন! সোহেলকে নিয়ে টেবিলে আসো… ঠান্ডা হয়ে যাবে সব।”
ওরা দু’জন ঢুকলে সোহেলের উদ্দেশ্যে বললো জামিল, “সোহেল বসো…”। আড়চোখে একটু দেখে নিলো সোহেলকে জামিল। ওর দিকে তাকিয়ে থেকে ওকে বিব্রত করতে চায় না। কেঁদেছে যে, বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে। দুলাভাইয়ের সামনে একদম সরাসরি ধরা পড়লে অস্বস্তিতে পড়বে সেটা বুঝেই ওর দিকে তাকানো থেকে বিরত থাকলো জামিল। সোহেল বসলো তার টুনটুনির মুখোমুখি চেয়ারে, আর সিমিন বসলো জামিলের মুখোমুখি। হাত বাড়িয়ে নুডুলসের বাটি টেনে নিয়ে ছোট বাটিগুলোতে বাড়তে লাগলো সিমিন। আগে দিলো মেয়ের বাটিতে। তারপর বাকিদের।
কণ্ঠে উচ্ছ্বাস এনে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো সোহেল, “আপনি করলেন নাকি এতোসব ভাইয়া?”
জামিল বুঝলো। তাই সেও স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলো, “কই আর এতোসব!… তুমি আসবা জানলে আরও কিছু করতাম বা বাজার থেকে নিয়ে আসতাম… তোমার আপু দেখলাম নুডুলস করার প্রিপারেশন নিচ্ছে, তাই আমি ওকে তোমার কাছে পাঠিয়ে করে ফেললাম… খাও খাও… ঠান্ডা হয়ে গেলে ভালো লাগবে না… কেচাপ নাও…”।
একটুখানি নুডুলসে কেচাপ মাখিয়ে নিজে নিজে খাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে আলো। শেষ পর্যন্ত তাকে খাইয়ে দিতেই হবে, কিন্তু আগে নিজে একটু খাক, মাখলে মাখুক, তবুও নিজে চেষ্টা করুক। জামিল আর সিমিন দুই জনেই বেশির ভাগ সময় ওকে নিজে নিজে খেতেই উৎসাহ দেয়। যতোটুকু সে নিজে খেতে পারে খায়, বাকিটুকু খাইয়ে দেয়। জামিল পাশে বসেছেই সেই কারণে। নাগেটস হাতে ধরে কেচাপ মাখিয়ে মাখিয়ে খুব মজা করে খাচ্ছে আলো। নুডুলসটাই সুবিধা করে উঠতে পারছে না।
নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা চললেও মেয়ের দিকে একটা নজর রেখেছে জামিল। যখনই দেখলো নুডুলস নিয়ে মেয়ের ধৈর্য্য ফুরিয়ে এসেছে, তখন হাত লাগালো নিজে। সাথে সোহেলের অফিসের খোঁজখবর নিচ্ছে। মেয়েকে খাওয়ানোর এক ফাঁকে সিমিনকে বললো চা টা নিয়ে আসতে এবার।
সিমিন জিজ্ঞেস করলো, “দুধটা জ্বাল দিয়েছিলে?”
“ওহ হো… একদম খেয়াল ছিলো না… সরি…”।
“ইটস ওকে!… ব্যাপার না… আমি দিয়ে নিচ্ছি… তোমরা কথা বলো, আমি চা নিয়ে আসি…”, এই বলে সিমিন উঠে গেলো।
এখন টেবিলে রাজত্ব চলছে টুনটুনি পাখির। সে তার স্কুলের গল্প করে যাচ্ছে মহা উৎসাহে। হাত ঘুরছে বার্বির চুলের উপর দিয়ে, এর মধ্যেই একটু কেচাপ মাখানো হয়ে গেছে তাতে। চোখ পুতুলের দিকে, নির্দিষ্ট সময় হা করে খাবার নিচ্ছে মুখে, আর এক মনে গল্প করে যাচ্ছে। সোহেল তার উপযুক্ত পার্টনার! সব কথার জবাব দিচ্ছে, সব কথাতেই কোনও না কোনও প্রশ্ন করছে। মুখে হাসি নিয়ে চুপচাপ মেয়েকে খাওয়াচ্ছে জামিল।
বিকেলের নাস্তা হয়ে গেলে ওদের বেডরুম থেকে প্যারাসিটামলের একটা পাতা এনে সোহেলের হাতে দিলো জামিল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে জ্বর এসেছে, অথবা আসার পথে। চা টা শেষ করে কোনও আপত্তি না করেই প্যারাসিটামল গিলে নিলো সোহেল। প্রথম এসে আলোকে জড়িয়ে ধরেছিলো, এখন আলো আবার ওর কোলের দিকে এগিয়ে আসলে নিজে থেকেই বললো, “কাঠবিড়ালী! আমার তো জ্বর আসছে একটু, এখন যদি তোমার বেশি কাছে কাছে থাকি, তাহলে তোমারও জ্বর এসে যাবে মামনি!… জ্বরটা সেরে গেলে আমরা আবার একসাথে খেলবো, কেমন?” জ্বর আসলে যে শরীর খারাপ থাকে, সেটা আলো জানে। কয়েক দিন আগে ওরও জ্বর হয়েছিলো। মা তখন কিভাবে হাতের উল্টো পিঠ ওর কপালে ছুঁইয়ে তাপ বোঝার চেষ্টা করতো, সেটা সে দেখে রেখেছে। এখন গম্ভীর মুখে বড়দের মতো এগিয়ে এসে সেটাই সে অনুকরণ করলো, দুই পায়ের আঙ্গুলের উপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে তারপর নিজের হাতের উল্টো পিঠ বাড়িয়ে কপালে ঠেকালো সোহেলের। হাসি চেপে কপালটা নামিয়ে আনলো ওর নাগালের মধ্যে সোহেল। আর আলো মাথা নেড়ে পাকা বুড়ির মতো বললো, “অনেক গরম… মামুজি তুমি শুয়ে পড়ো। জ্বর হলে শুয়ে থাকতে হয় তো!” জামিল শব্দ করে হেসে উঠলো। আর সোহেল মুখটাকে করুণ বানিয়ে বললো, “আমার টুনটুনি আমাকে যা বলবে, আমি তাই করবো… এক্ষুনি শুয়ে পড়ছি…”। বলে মুখ তুলে সিমিনের দিকে তাকালো, “আপু, সত্যি খারাপ লাগছে, আমি একটু শুই ওই ঘরে গিয়ে?” মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো সিমিন। বললো, “কাঁথা দেয়া আছে বিছানায়… শুয়ে থাক… রাত্রে খাবার সময় ডেকে দেবো…”। সোহেল একবার বলার চেষ্টা করলো যেন না ডাকে, কিন্তু জামিল কড়াভাবে বলে দিলো জ্বরটা নেমেছে কিনা দেখতে হবে, আর রাত্রে খাওয়ার পর আর একবার ওষুধ খেতে হলে খেতে হবে। আপাতত সোহেল বিশ্রাম নিক। সোহেল আর তর্ক না করে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
সোহেল চলে গেলে টেবিল থেকে বাসনপত্র গুছিয়ে রান্নাঘরের সিঙ্কে গিয়ে নামালো সিমিন। টেবিলটা মুছে দিতে জামিল মেয়েকে নিয়ে পড়াতে বসলো ডাইনিঙেই। ও বাসায় থাকলে ও নিজেই বসে আলোকে নিয়ে। এতোটুকু মানুষের আবার পড়া! তবু রুটিন ধরে বসানো আর কি। নাহলে অভ্যাস তৈরি হবে না। হাতের কাজ গুছিয়ে সিমিনও এসে বসলো টেবিলে। ওর হাতে ধরা এক বান্ডিল খাতা। মেয়ে আর মেয়ের বাবার খুনসুটি, পড়ালেখা, ছবি আঁকা দেখতে দেখতে নিজের কাজ করতে থাকলো।
***
(পরের অংশ আগামীকাল)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here