#অনুরক্তির_অনুভূতি
#আফসানা_মিমি
|৮ম পর্ব |
সকালের সোনালী কিরণ প্রিয়মের মুখশ্রীর উপর পড়েছে। নড়েচড়ে উঠে প্রিয়ম। চাকরি থেকে দুই সপ্তাহের ছুটি নিয়েছে। কারণ আরাত। বিগত কয়েকদিনের অক্লান্ত চেষ্টার পর আরাতের সাথে বন্ধুত্ব করতে পেরেছে। প্রিয়মের ধারণা, আরাত কষ্ট পেয়েছে।
ভালোবাসা জীবনে একবারই আসে। প্রকৃত ভালোবাসা ভুলা দায়। শত চেষ্টা করলেও অন্য কাউকে অন্তরে স্থান দেওয়া যায় না।
প্রিয়মের মনে আজ আনন্দের জোয়ার ভাসছে। এক বছর পর প্রিয়মের মন ভালো। মুখে হাসি ফুটেছে। সহধর্মিণী হিসেবে আরাতকে যতটা অপছন্দ করে বন্ধু হিসেবে আরাতকে ততটাই পছন্দ করে। প্রিয়ম তৈরি হয়ে নিচ্ছে। সারাদিন আরাতের সাথে সময় কাটাবে।
নতুন বুয়া এসেছে। রান্না করে সে। আকিল পরিপাটি পোশাকে তৈরী। গন্তব্য অফিস। খাবারের টেবিলে আলু ভর্তা,সাদা ভাত দেখে আকিলের মন বিষন্ন হয়ে আসলো। কিছুদিন আগ পর্যন্ত সকালের নাস্তায় অমৃতের স্বাদ পেত কিন্তু আজকাল খাবারের স্বাদ বিদায় জানিয়ে কোথায় যেন চলে গেছে। রিফাত এক ঘণ্টা আগে চলে গিয়েছে। কি যেন কাজ আছে। প্রিয়ম ঘর থেকে বের হয়ে আসে। টেবিলে আড়চোখে তাকায়। মন মত খাবার না পেয়ে গুনগুন গান গেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সদর দরজার কাছে।
দুইবার আরাতদের কলিং বেল চেপে ধরল প্রিয়ম। পিছন থেকে কেউ খুক খুক কাশি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিল। প্রিয়ম দেখে স্বয়ং আকিল দণ্ডায়মান। হেসে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রু যুগল কুঁচকে আসে প্রিয়মের। গম্ভীর স্বরে বলে,
” দাঁড়িয়ে আছিস কেন? অফিস নেই?
” ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার খাওয়াতে হয়, প্রশ্ন না করে।”
আকিলের গা ছাড়া উওর। প্রিয়ম সন্তুষ্ট হল না। আরাতের সাথে একান্তে থাকবে সে অন্য কেউ আসবে কেন! পরমুহূর্তে প্রিয়ম অবাক হল আরাতকে কয়েকদিন আগেও বিয়ে করবে না বলে কষ্ট দিল কিন্তু এখন আরাতের কাছাকাছি থাকতে চাইছে।
দরজা খুলে গেলো। আরাতের বদলে রত্নাকে দেখে হতাশ হল প্রিয়ম। ভিতরে প্রবেশ করে সোফায় গা এলিয়ে দেয় প্রিয়ম। জাম্বুর মুখে প্রিয়মের দেয়া হাড্ডি। দাঁতে আটকে তাকিয়ে আছে প্রিয়মের দিকে যেন জাম্বু বলছে,’ খেলব বস’।
আকিল নাস্তা করছে। রুটি আলু ভাজিতে অমৃতের স্বাদ পাচ্ছে। আরাতের মা নিজে বসে খাওয়াচ্ছে আকিলকে যেন সে নতুন জামাই। প্রিয়মের সহ্য হচ্ছে না। কঠিন দৃষ্টিপাত করে আরাতের ঘরের দিকে আগায়। আকিলও খাওয়া শেষ হতে অফিসে চলে যায়।
——
সময় সংকীর্ণ। আরাত তৈরী হচ্ছে তাড়াহুড়ে। গন্তব্য রিয়নের বাড়ি। রিয়ন অসুস্থ দেখতে চাইছে আরাতকে। আরাত আজ খুবই অস্বস্তিবোধ অনুভব করছে। রিয়নের বাসায় আসা যাওয়া খারাপ দেখায়। প্রিয়মের আগমন ঘটে। না বলে প্রবেশ করাতে অস্বস্তিতে পড়ে নিজেই। বের হয়ে যায় ঘর থেকে। ওড়নাহীন আরাত ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত। প্রিয়মের উপস্থিতি বিষয়ে অজ্ঞাত।
” ব্যস্ত তুমি?”
পরিচিত স্বর। আরাতের চাহনি ভয়ার্ত। প্রিয়ম কী এসেছিল ঘরেতে! সন্দেহ। আবারও প্রিয়মের স্বর শোনা যাচ্ছে দরজার অপরপাশ থেকে।
” অপেক্ষা করছি। ঘুরতে যাবো।”
আরাত চিন্তাত। পরিস্থিতি অস্বাভাবিক। একদিকে অসুস্থ মানব অন্যদিকে প্রিয়ম নামক বন্ধু। কোথায় যাবে সে? নিজেকে পরিপাটি করে বাহিরে বের হয়ে আসে। প্রিয়মের দৃষ্টি জমিনে নিবদ্ধ। একমনে চিন্তা করে যাচ্ছে। আরাত প্রায় কয়েক সেকেন্ড প্রিয়মের পাশে দণ্ডায়মান ছিল। প্রিয়মের নড়চড় না দেখে আরাত বলে উঠে,
” নাস্তা হয়েছে তোমার? আমি একটু বের হচ্ছিলাম। বিকালে সময় হবে তোমার? তখন বের হই!”
প্রিয়মের কথাটা পছন্দ হয়নি। তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আরাতের দিকে। যেন আরাত প্রিয়মের একান্ত জন। অন্য কারো না। প্রিয়মকে ছাড়া অন্য কাউকে সময় দিবে ভাবতে পারছে না। প্রিয়ম প্রত্যুওর করল,
” তুমি তো ঐ হাসপাতালের দিকে যাচ্ছো। তাহলে চলো আমি তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি। আমিও সেখানে যাব।”
আরাত উশখুশ করছে। প্রিয়মকে জানাতে চাচ্ছেনা রিয়নের কথা। প্রিয়ম জানতে পারলে অবশ্যই আরাতকে একা ছাড়বে না। এমনকি আরাতের মাও চাইবেনা আরাত একা কোথাও যাক। আরাতের মায়ের কাছে এখনও আরাত এবং প্রিয়মের বিষয় অজানা। তিনি ভালো পরিকল্পনা করছেন মেয়ের ভবিষ্যৎ বিয়ের জন্য। সময় নষ্ট করতে চাচ্ছেন না। তাই ধীরেসুস্থে প্রিয়ম এবং আরাতের কথা জানাবে বলে মনস্থির করলেন।
” আসলে আমি একজন বান্ধবীর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।”
“এই শহরের রত্না ছাড়া তোমার দ্বিতীয় কোন বান্ধবী নেই। রত্না তো তোমার বাসায়, বান্ধবীটা কে শুনি?”
আরাত অস্থির। ঘেমে যাচ্ছে সকাল সকাল। চুরি করে ধরা পড়ে গেছে এমন। রাগ হল খুব। প্রিয়মের অতি নিকটে এসে বলল,
” বন্ধু ভেবেছি, স্বামী নয়। জ্বালাচ্ছেন কেন আমাকে?”
” বউকে সন্দেহ করা খারাপ, বন্ধুকে নয়। বলে দিলেই ঝামেলা শেষ।”
জাম্বুর আগমন ঘটে। আরাতের সাথে বাহিরে যাবে। জাম্বুকে রাখা দায়। জাম্বু বসে লেজ নাড়াচ্ছে। যেন বলছে,’ আমিও যাব’। চোরা চোখে প্রিয়মেযমর দিকে তাকাল। জাম্বুর কাছে বসে বলল,
“তোকে আজ একাই থাকতে হবে। একজন অসুস্থ মানুষকে দেখতে যাচ্ছি। সেখানে তোকে নিলে তোলকাম ঘটিয়ে ফেলবি।”
আরাতের মায়ের স্বর ভেসে আসে প্রিয়ম এবং আরাতের কর্ণধরে। তিনি বলছেন,
” নাস্তা খেয়ে বের হবে দুজন। সামনের সপ্তাহে শপিং করতে যাবে। আমি তোমাদের বিয়ে তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে চাই। এই বিষয়ে ভাইজানের সাথে কথা বলেছি। ভাইজান চলে আসবেন সামনে সপ্তাহে।”
আরাতে কোন ভাবান্তর হয়নি কিন্তু প্রিয়ম ভয় পেয়ে যায়। আরাত মায়ের কথা শুনে চোরা চোখে মায়ের দিকে তাকায়। প্রিয়ম আয়াতের উদ্দেশ্যে বলে,
” তুমি এখনো কিছু জানাওনি কেন? জানাবে না তুমি! জানো না আমি কেমন? তোমার সাথে আমার যায় না। তুমি আমার কাছে সুখে থাকবে না। আমরা বন্ধু আছি বন্ধু থাকি।”
” সময় হলে জানাবো। নাস্তা করি!
মানুষ বড্ডা আজব। আমরা যাকে সহ্য করতে পারি না একসময় তারা আমাদের কাছে আপন হয়ে উঠে। একদম আপন, চাইলেও আপনি তাকে দূরে সরাতে পারবেন না। শেষে সম্পর্কটা এমন হয়ে যায় যে ছাড়তে পারবেন না ধরতেও পারবে না।
আরাত ভাবছে প্রিয়মের কথা, কয়েকদিন আগ পর্যন্ত প্রিয়ম আরাতের চিরশত্রু ছিল। আর এখন খুব ভালো বন্ধু। জীবনে চলার পথে কতক মানুষের দেখা মিলে, কেউ আপন হয়ে তো কেউ শত্রু হয়ে।
নাস্তা শেষ করে আরাত মাকে এবং জাম্বুকে বিদায় জানিয়ে চলে আসে। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রিয়মের আগমন ঘটে। আরাতের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
“আমি খুব একা। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে? যেখানে যাচ্ছো। কথা দিচ্ছি, তোমাকে বাঁধা দিব না কোন কাজে।”
আরাত নাকচ করল না। কি হবে না বলে! রিয়ানের সাথে তো কোন সম্পর্ক নেই আরাতের যে ভয় পাবে! অগত্যা প্রিয়মকে নিয়ে রওনা হল রিয়ানের বাসার উদ্দেশ্যে।
রিক্সায় পাশাপাশি বসে আছে দুজন। কথা হচ্ছে না। শুধুমাত্র রিক্সার প্যাডেলের আওয়াজ হচ্ছে। পরিবেশটাও শান্ত, স্তব্ধ। প্রিয়ম বলে উঠে,
” আমাকে কি ভয় পাও?”
“না।”
” বন্ধু বলে নাকি অন্য কারণে?”
” আমি কখনোই ভয় পাইনি আপনাকে। নিজেকে আত্মরক্ষা করার প্রশিক্ষণ আছে আমার। ”
“এজন্যই তো যাকে তাকে অনেক কিছু বলতে পার। আমি ভেবেছিলাম তুমি বড্ড নিরামিষ হবে। এখন দেখি চালাকের সাথে বুদ্ধি ও আছে।”
হেসে উঠে আরাত। ” আপনি অতিরিক্ত কথা বলেন । কিছুদিন আগের আপনি আর এখনকার আপনিকে আয়নার সামনে দাঁড় করালে চিন্তে পারবেন!”
” নিজেকে পরিবর্তন করতে শিখছি। একজনের অশ্রু যন্ত্রণা দিচ্ছে খুব। আপনজন হারিয়ে আমার অধপতন হয়েছে। ভুল শুধরে নিচ্ছি।”
” আপনার পাশে থেকে শান্তি খুঁজে পাই না। কারণটা কি আপনি না আমি!”
” হয়তো নিয়তি।!
” তবুও বন্ধু হয়ে থাকতে চান?”
” হ্যাঁ।”
” কিন্তু কেন?”
” কিছু প্রশ্নের উওর অজানা থাকাই শ্রেয় আরাত।”
রিয়নের বাড়ির সামনে নেমে যায় দুজন। প্রিয়ম টাকা পরিশোধ করে একবার দালানে নজর ঘুরায়। ভবনের সামনে দাঁড়ানো দারোয়ান বিনা বাক্যে দুজনকে প্রবেশ করতে দেয়। সদর দরজা খোলা ভেতরে প্রবেশ করতে দেখা মেলে বদরুল মাহমুদকে। উনি চা পান করছেন এবং পত্রিকা পড়ছেন। আরাতকে দেখা মাত্র উঠে আসেন। হাসি মুখে বলেন,
” তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। রিয়ান কিছুটা সুস্থ অনুভব করছে। বাসায় এসে ভদ্র বাচ্চা হয়ে গেছে। তোমাকে দেখতে চাইছে।”
” জি আঙ্কেল। দেখা করে আসি।”
প্রিয়মের দিকে তাকাতে বদরুল মাহমুদ ভ্রু কুঁচকে ফেলেন এবং প্রশ্নবোধক কণ্ঠস্বরে বলেন,
” পাশের জন কে?”
আরাত বলার আগে প্রিয়ামের উত্তর,” বন্ধু।”
বদরুল সাহেব অহ বলে সরে গেলেন। কাজের মেয়েকে বললেন রিয়নের ঘরটা দেখিয়ে দিতে।
গতবারের মতো এবারও রিয়নের ঘরটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। আরাত আলো জ্বালিয়ে দেয়। ঘরের দেয়ালে অসংখ্য ছবি একজন মেয়ের। যাকে দেখতে অনেকটা আরাতের মতো। যদি কেউ হঠাৎ দেখে তাহলে মনে করবে মেয়েটা আরাত কিন্তু ভুল! আয়াতের মুখে কোন তিল নেই কিন্তু মেয়েটার মুখে ঠোঁটের কোনায় কালো কুচকুচে তিল বিদ্যমান আছে।
” এই সেই ছেলে না! যার জন্য তোমার কথা শুনতে হয়েছে? তোমার বয়ফ্রেন্ড নাকি?”
চলবে……….