#অনুরক্তির_অনুভূতি
#আফসানা_মিমি
|৭ম পর্ব |
” আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও, প্রিয়া। এখানে দম বন্ধ হয়ে আসছে। অপরিচিত লোকজন দেখে ভয় জাগছে অন্তরে।”
করুণ স্বরে আবদার। ফেলা দায়। অন্তরের গহীনে জমে রাখা কথা বলে যাচ্ছে রিয়ান। এসেছি পাঁচ মিনিট সময় অতিবাহিত হয়েছে। রিয়ান সুস্থ। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কথার জোর বেড়েছে। রিয়ান এখনও অপরিচিত আমার কাছে। শুধুমাত্র বিকৃতিমস্তিস্ক রোগী বলে এসেছি। মুখে হাসির রেখা টেনে আনলাম। আশ্বস্ত স্বরে বললাম,
” ভয় কীসের? আমি আছি তো। আপনার কি লাগবে বলুন!”
” তোমাকে লাগবে। তোমার উপস্থিতি লাগবে। তোমাকে পুরোটাই লাগবে।”
থমকালাম, ভরকালাম, অনুভূতিহীন হলাম। পরমুহূর্তে পাগলের কথায় কিছু মনে না করে মিষ্টি হাসি উপহার দিলাম।
” আমি আছি এখানে সর্বদা আপনার সাথে। এখন কিছু খেয়ে নিন।”
রিয়ন চটপটে হয়ে গেল। উৎফুল্লের সহিত বলল,
” অবশ্যই খাবো। তবে তোমার হাতের রান্না বিরিয়ানি।”
আশাহত হলাম। ভেবেছিলাম কথা কাটিয়ে চলে আসবো রিয়নের কাছ থেকে। আমি যত দূরে সরে যেতে চাইছি রিয়ন ততটা আস্টেপিস্টে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে নিচ্ছে। কৃত্রিম হাসলাম। জ্ঞানীদের মত রিয়নকে বুঝালাম, ” এখানে রান্না করার ব্যবস্থা নেই। আমি আবার যখন আসবো রান্না করে নিয়ে আসবো।”
মানলেন না রিয়ান। উত্তেজিত হয়ে গেলেন নিমেষেই। ভয় পেলাম। পিছিয়ে গেলাম দালান ঘেঁষে। রিয়ন ঘরের আসবাবপত্র ছুঁড়ে মারছে আর বলছে, ” কেউ ভালোবাসে না। না শব্দটা অপছন্দ জানো না তোমরা? প্রিয়া দূরে চলে যাবে আগের মতো। প্রিয়াও কথা রাখেনি। বলেছিল যাবে না কিন্তু চলে গেলো। ফিরে এসে বলছে আবার চলে যেতে? দিবো না। কাছ ছাড়া করব না। আমার প্রিয়াকে চাই।”
ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। ভয়ে কান্না করে দিলাম। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা দুঃখভরা মানব নজরে আসলো। রিয়নের ঘরে উঁকি দিচ্ছে আর কি যেন বলছে। আমাকে দেখা মাত্রই চমকাল। এগিয়ে এসে বলল, ” তুমি ফিরে এসেছো?”
অপরিচিত মানবের নিকট যখন আপনি পূর্ব পরিচিত হবেন কিন্তু পরিচিত বিষয়টি আপনি অবগত নন তখন কিরূপ মনে হবে? মানবটি কাছে এসে উৎকন্ঠের সহিত বলল, ” দুঃখিত মা! তোমাকে অন্য কেউ ভেবেছিলাম। আমি রিয়নের বাবা বদরুল মাহমুদ। ছেলের অবস্থা দেখছোই তো। মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে গেছে একজন মেয়ের জন্য। জ্বরের কথা শুনে দৌঁড়ে আসলাম।”
” রিয়নকে এখানে না রেখে বাসায় রাখলেও তো পারেন। ”
বদরুল মাহমুদ নিশ্চুপ। সময় নিয়ে উওর করলেন, ” বাসায় থাকলে নিজেকে ক্ষতি করার চেষ্টা করে। অন্যকে আঘাত করে।”
কিছু সময়ের জন্য বদলে গেলাম। ক্ষিপ্ত স্বরে বললাম,
” আপনজনের কাছে থাকলেই একজন অসুস্থ মানুষ সুস্থ হয়ে যায়। আপনি কোটিপতি চাইলে নিজের কাছে সন্তানকে রেখে সুস্রসা করতেন।”
আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বদরুল মাহমুদ। আচমকা আমার হাত ধরে অনুনয়ের সহিত বললেন,
” আমার ছেলেকে সুস্থ করে তুলতে সাহায্য করবে, মা!”
———–
ঘামার্ত শরীর নিয়ে বের হয়ে আসলাম হাসপাতাল থেকে। জীবনের মোড় কোন দিকে ঘুরে যায় কেউ জানে না। সবকিছু যেন স্বপ্নের ন্যায় মনে হচ্ছে। রিয়ন অজ্ঞান বড়ো হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। অফিস আদালত এই সময়ে ছুটি হয়। রিকশা পাওয়া মুশকিল। কর্মজীবী মানুষেরা প্রিয়জনের নিকট দ্রুত পৌঁছাতে জীবন বাজি রেখে যাতায়াত করছে।
” কার জীবনে আলো ঢেলে এলে?”
পরিচিত স্বর। এখানে কি করছে সে? সবসময় কি অনুসরণ করতে হবে? ভেবে পাচ্ছি না। অনুসরণ তাকেই করা যায় যাকে আপনি আপন ভাবেন। কিন্তু আমি তো তার আপন না! হতেও চাই না। কি দরকার মিথ্যা সম্পর্ক অন্তরে গাঁথা! ফিরে তাকালাম। কঠিন দৃষ্টিপাত করলাম। অদূরে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়ম। হাতে সিগারেট। জ্বালানো হয়নি এখনও। এক ধ্যানে দৃষ্টিপাত করে আছে আমার দিকে। মায়ায় জড়ালাম না প্রত্যুত্তর করলাম, “আপনাকে বলতে বাধ্য নই।”
হেসে উঠলেন প্রিয়ম যেন কোন মজার কথা বলেছি। কাছে আসলেন। অনুভব করছি অন্তরের অবাধ্য আওয়াজ। থামছেই না যেন। লোকটার চরিত্র এত জটিল কেন? ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে প্রিয়মের কথায়,” তো কাকে বলবে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে যে ভালোবাসি বলে তাকে?”
রাগ হলো প্রচুর। উওর দিতে ইচ্ছে হলো না। রিকশা ডাকলাম। চড়ে উঠলাম। আপনজনকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য আমি কিন্তু কোন পরগাছাকে নয়। রিকশার ঝাঁকিয়ে উঠলো পাশ ফিরে দৃষ্টিপাত করে দেখলাম প্রিয়ম বসা আমার পাশে। কেঁপে উঠলাম। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। এ কেমন অভদ্রতা শুনি? নাকি প্রতিশোধ নিবে দুপুরের কথায়!
” উওর পেলাম না। আমি আবার কোন কথা অপূর্ণ রাখি না। উওর দাও নয়তো নামব না।”
ত্যাড়া স্বভাবের ছেলেদের আমার পছন্দ না। এজন্যই হয়তো প্রিয়মের সাথে আমার বনে না। কথা বলছি না। ইচ্ছে করছে না। কেন বলবো! কি হয় সে?
” উওর দিবে না? ঠিক আছে! মামা রিকশা থামাবেন না। যেখানে ইচ্ছা নিয়ে যান।”
রিকশা ওয়ালাকে আগাতে বলছেন কেন? মেরে যদি গুম করে দেয়! মুখ খুললাম। রিকশা ওয়ালাকে থামতে বললাম,” রিকশা থামান মামা। আমি আর আগাবো না। ” মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো প্রিয়ম শক্ত কন্ঠে আদেশ করল, ” থামবেন না। টাকা আমি দিবো আজ খোলা আকাশের নীচে আরোহণ করব।”
কবি কবি ভাব কিন্তু কবিতার অভাব। এমন মুহূর্তের মধ্যে পড়তে হডে জানলে বলে আসতাম না। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারলাম যেন।
” নেমে যান। আপনাকে সহ্য হচ্ছে না। অপরিচিত আপনি, সুযোগে অসৎ ব্যবহার করবেন।”
প্রত্যুওর করল না প্রিয়ম। মাথার পিচ্ছিল কেশবে হাত বুলিয়ে গাইতে শুরু করল,
” তোমায় দেখলে মনে হয়!
হাজার বছর তোমার সাথে,
ছিলো পরিচয় বন্ধু ছিলো পরিচয়!”
মধুর কন্ঠস্বর যেন নয় কাকের গলা। ছেলেদের স্বর হয় মধুর। শুনলে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু প্রিয়মের কন্ঠস্বর শুনে ইচ্ছে করছে রিকশা থেকে লাফিয়ে ম’রি। বিড়বিড় করে বলছি, ” গরুর কন্ঠ।”
রাতের শহরে ভ্রমণ করা আনন্দ অনেক। ল্যাম্প পোস্টের আলোতে প্রিয়জনের হাতে হাত ধরে সুদূর পথ অতিক্রম করা সম্ভব। বরাবর রাতের শহর পছন্দের অথচ উপভোগ করতে পারছি না। শহর থেকে অদূরে বহমান নদী রয়েছে যেখানে নতুন ব্রিজ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। রিকশা থামলেন সেখানে। পাঁচশত টাকার নোট এগিয়ে দিলেন এবং বললেন,
” অনেক কষ্ট করেছেন মামা। আপনার পারিশ্রমিক,
না করবেন না। ”
রিকশা ওয়ালা একগাল হাসলেন। প্রিয়ম নেমে গেছে। ঠায় বসে আছি রিকশায়। ইচ্ছে আছে চলে যাওয়ার। রিকশা ওয়ালা মামাকে পা চালাতে বললাম। প্রিয়ম ব্রিজে দাঁড়িয়ে পানির স্রোত দেখছে হয়তো। রিকশা ওয়ালা মামা বিপাকে পড়েছেন। আমার দিকে আর প্রিয়মের দিকে কয়েকবার দৃষ্টিপাত করলেন। হয়তো আমাদের ভাবভঙ্গি বুঝতে পারছেন না। আশ্বস্ত স্বরে বললাম,” আপনার কোন ক্ষতি হবে না, চলুন।”
রিকশা চলতে শুরু করলো। পিছন থেকে প্রিয়মের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কান দিলাম না। রিকশা ওয়ালাকে বললাম তড়িঘড়ি চালাতে। সম্ভব হলো না। প্রিয়ম রিকশা থামলেন। হাত ধরে টেনে নামালেন। কিছুক্ষণ আগের নরম স্বর যেন কোথায় উবে গেছে। রিকশা ওয়ালাকে ধমকে পাঠিয়ে দিলেন।
নির্জন স্থান, স্তব্ধ হয়ে আছে সব। প্রিয়ম চাইলে কোন অঘটন ঘটাতে পারে। ভীত হলাম। আশেপাশে দৃষ্টিপাত করলাম। শক্ত হাতে ধরে রেখেছে প্রিয়ম। ব্রিজের কিনারায় দাঁড় করিয়ে বাহু চেপে ধরল। যেন একটু ধাক্কা দিলেই আমি শেষ। আৎকে উঠলাম। মাথা নাড়িয়ে না করলাম। স্বর বের হচ্ছে না কন্ঠনালী থেকে। প্রিয়মেররাগান্বিত মুখশ্রী। দেখতে অনেকটা নেশাখোরদের মতো মনে হচ্ছে। রক্তিম বর্ণ চোখ। পর পর লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, ” যা বলব চুপচাপ শুনবে, নয়তো এখান থেকে ফেলে দিবো।”
মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম। ছেড়ে দিলো প্রিয়ম। বক্ষঃস্থলে হাত রেখে লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ করলাম। প্রিয়ম বলা শুরু করল,
” তোমাকে ছুঁয়ে দিতে চাইনি বলে রিকশা থেকে নেমে চলে আসছিলাম। কিন্তু আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি হচ্ছো আমার প্রতিবেশী, ত্যাড়া প্রতিবেশী।”
” মে’রে ফেলবেন কি?”
” ইচ্ছে আছে। পালাবে?”
” আমার আর পথ খোলা নেই।”
হাসলেন প্রিয়ম, মিষ্টি হাসি। স্বাভাবিক হলেন যেন। মাথার কেশব টেনে বললেন,
” ক্ষমা করে দাও আরাত! দুপুরে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তোমাকে।”
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, অবিশ্বাস্য স্বরে বললাম,
” আমার কর্ণ ভুল শুনছে না তো!”
” সঠিক শুনেছে। কিন্তু আমি সত্যিই চাই না আমাদের বিয়ে ব্যপারে আগাতে।”
মলিন হলো মুখশ্রী। দুর্বল হলে চলবে না। যে আমার নয় তাঁকে ধরে বেঁধে রাখা যাবে না। সংযত করলাম। বুঝালাম ভালো কেউ আছে হয়তো। প্রত্যুওর করলাম,
” তাহলে কী চান, ক্ষমা?”
” তার সাধ্যি তোমার আছে। বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে চাই। আপন হতে না পরি, বন্ধু হতে সমস্যা কোথায়!”
অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে। বন্ধুত্ব করে লাভ হবে কি? মাথা নিচু করে আছি। নদীর পাড়ে বাতাস বইছে। কেশবগুলো অধিকারহীন উড়ছে। বাঁধা প্রদান করছি না। ব্রাজের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললাম,
” এখান থেকে পড়লে বেঁচে ফিরব তো? নাকি নদীর স্রোতে ভাসিয়ে নিবে আমায়?”
” উওর দিলে না, আরাত!”
” কিছু প্রশ্নের উওর হয় না প্রিয়ম! বাসায় যেতে চাই। মা অপেক্ষা করছেন।”
হাত ধরলেন প্রিয়ম। করুণ চোখ ভাসমান। নেত্র পল্লব ফিরিয়ে নিলাম। ঐ চোখের ভাষা পড়তে চাই না আমি।
” আমি মানুষটা খুব খারাপ, ভালো হতে চাই। সুযোগ দিবে আরাত?”
চলবে……….
কি মনে হয়? সুযোগ দিবে কি?