#অনুরক্তির_অনুভূতি
#আফসানা_মিমি
|৬ষ্ঠ পর্ব |
স্বপ্নের রাজ্যে পরিচালনায় মাহির সবাই। বাস্তবে যা সম্ভব না। ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে বাস্তব যা স্বপ্নে সম্ভব।
একজন অবয়ব এসেছে অতি নিকটে। বক্ষঃস্থলের গহীনের হৃদপিন্ডের আওয়াজ অনুভব করছি। মুখশ্রী অস্পষ্ট। অন্ধকারে ঘেরা। নিশ্বাসের উত্তাপে জ্বলে যাচ্ছি। নিবদ্ধ হলো আঁখি। অদূরে আরো একজন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে আমার। দূরে সরে গেলাম। অদূরের ছায়ামূর্তির দিকে অগ্রসর হলাম। অনুভব করলাম কেউ একজনের হাতে হাত আবদ্ধ করে নিয়ে যাচ্ছে ছায়ামূর্তির কাছে। অন্তরে পীড়া হচ্ছে। নিকটস্থ অবয়ব থেকে দূরে যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু নিয়তি হয়তো সাথে নেই। ছায়ামূর্তির হাতে তুলে দিয়ে অবয়ব চলে যাচ্ছে দূরে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো। ছায়ামূর্তির চেহারা সুস্পষ্ট হলো। রিয়ান, সেই পাগল রিয়ান।
হাস্যজ্বল মুখশ্রী। ঠোঁট নেড়ে কিছু বলছে কিন্তু কর্ণধারে প্রবেশ করছে না। মিষ্টি হেসে ঠোঁট এগিয়ে দিলো।
চুমুর পরিবর্তে মুখশ্রীতে পানির ছিটা বুঝতে পেরে ঘুম ভেঙে গেলো। আঁখি পল্লব খুলতেই জাম্বুর মুখশ্রী অবলোকন করলাম। জিহ্বা বের করে হাপাচ্ছে। আমার চোখ খুলতে দেখে মুখে লেহান দিলো আবারও। তারমানে স্বপ্নে কারোর চুমু খাইনি বরঞ্চ বাস্তবে জাম্বুর লালা খেয়েছি।
উঠে পড়লাম শোয়া থেকে। জাম্বুকে বেয়াদবি প্রশিক্ষণ দেইনি আমি। উদ্ভট কাজ করার সাধ্য নেই। তীক্ষ্ম দৃষ্টিপাত করলাম। জাম্বু ক্যা ক্যা আওয়াজ করে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মুখে লালা চিপচিপে। আলগোছে ফ্রেস হতে চলে গেলাম।
” কী ভিবছিস আরু?”
স্বপ্নের ব্যাখ্যা খুঁজছিলাম। মায়ের প্রশ্নে শক্ত হয়ে গেলাম। মুখ ফুটে কিছু বললাম না। অভিমান করেছি খুব। কেনই করবো না। অভিমান তো আপনজনের সাথে করে। আপনজন যতক্ষণ না অভিমান ভাঙাবে ততক্ষণ মন শান্ত হবে না।
এক ধ্যানে দৃষ্টিপাত করে আছি মায়ের দিকে। মায়ের ডাক শুনছি না। চিন্তা করছি প্রিয়মের কথা। যা সন্দেহ করছি তা নয়তো?
” তুই খুশি হোস নি আমি আসাতে?”
ধ্যান ভাঙে এবার। অভিমান পুষে মুখ ফিরিয়ে নিলাম অন্যদিকে। মা বুঝতে পারলেন। মুখশ্রীতে হাসির রেখা টেনে ছোট বেলার মতো বললেন, ” আমার টুকটুকি কি রাগ করেছে? রাগ করলে যে টুকটুকিকে কেউ বিয়ে করতে আসবে না। রাগ করে যে হেরে যায় সে।”
মা কাছে বসলেন। মাথায় চুমু এঁকে দিলেন। হাতের উপর হাত রেখে বললেন, ” প্রিয়মের মা ই তোকে আংটি পড়িয়েছিল। কথা দিয়েছিল চার হাত এক করবেন। আপার শেষ ইচ্ছে ছিলো। তোকে ছেলের বউ করাবেন। কিন্তু তার আগেই সব শেষ। আপা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। ভাইজান ভেঙে পড়লেন। প্রিয়ম শহরে নিজের বাসস্থান করে ফেলে মায়ের মৃত্যুর পর।”
সোজা হয়ে বসলাম। মুখ শক্ত হয়ে আসলো। মনের বিদ্বেষ প্রকাশ পেলো।
“আমার কী দোষ ছিলো মা? নামহীন এক সম্পর্কের জন্য অপেক্ষা করছিলাম এতদিন। সে কেনো আসেনি? সে কী জানতো না? জেনেও কেন এলো না?”
মা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন। পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ঘর গোছাতে ব্যস্ত হলেন। বুঝতে পারলাম মা উওর দিবেন না।
ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। জাম্বুর দেখা মিলল। সোফার নিচে মুখ ঢুকিয়ে কি যেন করছে। অকাজের কথা স্বরণে আসলো। এগিয়ে গেলাম, আচ্ছা মত বকে দিব আজ।
” কি করা হচ্ছে জাম্বু? তুই আমার মুখে তখন চেটেপুটে কী খেয়েছিস?”
চোরা চোখে আমার দিকে তাকালো। মাথা নুয়ে বসে রইলো। সোফার উপর বসলাম। জাম্বুর ভাব বুঝলে চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণ পর পর জাম্বুর নজর সোফার নিচে তাকাচ্ছে। বিষয়টা সন্দেহজনক। উঁকি দিলাম সোফায় নিচে। নকল হাড্ডি পড়ে আছে সেখানে যা কুকুরদের পছন্দ। জাম্বুর চোরা কাজ ধরা পড়ে গেলো। রাগান্বিত চোখে তাকালাম। ধমকে বললাম,
” সত্যি করে বল কোথায় থেকে চুরি করেছিস। নয়তো রাস্তায় ফেলে অসবো।”
নুয়ে গেল জাম্বু। পরিহিত কাপড়ের ওড়নার এক অংশ কামড়ে ধরল। দাঁড়িয়ে গেলাম। নজরবন্দি করলাম সবকিছু। আঁচল কামড়ে নিয়ে গেলো পাশের প্রতিবেশীর বাড়িতে। ফ্ল্যাটের দরজা খোলা ছিলো। তালাবদ্ধ ছিলো না। হাতল ঘোরাতেই খুলে গেল।
ভাবছি প্রতিবেশীদের কথা। এরা না চাকুরিজীবী? বাসায় কী কাজ? সারাদিন বাসায় থাকে যে?
আলো নেভানো। দরজা জানালা বন্ধ। দমবন্ধ পরিবেশ। গা গুলিয়ে আসছে সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধে। পৃথিবীর আশি শতাংশ পুরুষ ধুমপান করে। কেউ প্রেমের বিরহে তো কেউ খারাপ বন্ধুদের সান্নিধ্য পেয়ে। জাম্বু ঘেউঘেউ করে উঠলো। টনক নড়ল। ধোঁয়ার উৎস খোঁজ করছি। প্রিয়মের ঘর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে।
জাম্বু পিছনে। জানালা খুলে দিলাম। নজর ঘুরালাম চারপাশে। বিছানার পাশে বসা প্রিয়ম। চোখ রক্তিম বর্ণ। ভয় পেলাম। চলে আসা উওম মনে করলাম। জম্বুকে ডাকতেই আঁচল কামড়ে প্রিয়মের নিকট নিয়ে গেল। প্রিয়মের বরাবর দাঁড় করিয়ে গোল গোল করে ঘুরতে লাগলো। যার অর্থ হাড্ডি প্রিয়ম দিয়েছে। বুঝতে পারলাম। কথা বলার ইচ্ছে নেই। চলে আসার উদ্যোগ নিলে প্রিয়ভের কন্ঠস্বর কানে আসে,
” নিজেকে কি মনে করো তুমি, সুন্দরী? তোমার রুপে পাগল হবে সব পুরুষ?”
জ্বলে ওঠে শরীর। রাখে কাঁপতে থাকি অনবরত। ঘৃণা হচ্ছে নিজের উপর। কেন এসেছিলাম এখানে? যেই মানুষকে এতদিন হৃদয় থেকে চাইতাম আজ ঘৃণা করি তাকে। তার আচার, স্বভাব, চরিত্র সবকিছুকে ঘৃণা করি। বাস্তবে বা কল্পনায় এই মানুষকে চাই না। উওর করলাম,
” খুবই সাধারণ আমি কিন্তু অসাধারণ। যার ঘরে যাবো, উজ্জল করবো তার ভবিষ্যত। মায়ের কথা। মা আমাকে নিয়ে যা বলে তাই সত্যি হয়।”
উওরখানা পছন্দ হলো না প্রিয়মের। উঠে এসে হাত শক্ত করে ধরলো। মুখে লাল আভা। কঠোর স্বরে বলল,” চলে যাও এখান থেকে। আর আসবে না। তোমাকে আমি কখনও বিয়ে করব না।”
হেসে উঠলাম। মনের কথা শুনলাম।
” ধন্যবাদ। আপনার আগে আমি নিজেই আপনার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করলাম।” থমকে গেল প্রিয়ম। হাত ছেড়ে দিলো তৎক্ষনাত। রেগে গেলাম। বাম হাতের অনামিকা আঙুলের আংটির উপর হাত বুলিয়ে নিলাম। অদেখা সম্পর্কের ইতি টানলাম আংটি খুলে। প্রিয়মের হাতে আংটি জোর করে দিলাম।” এতদিন আংটির মালিককে না দেখে মনের এক কোণে জায়গা দিয়েছিলাম কিন্তু আজ দেখে সব সম্পর্ক ছিন্ন করলাম। আপনাকে না দেখে এতদিন যেমন সম্মান করতাম এখন স্বচক্ষে দেখে ততটা ঘৃণা করলাম। আর যাই হোক না কেন আমি আপনার কাছে কখনোই ফিরব না। আপনার প্রতি অনুভূতি কখনও জন্মাবে না।”
চলে আসলাম ফ্ল্যাট থেকে। পিছনে শুনতে পেলাম দরজা লাগানোর জোরালো শব্দ। ধ্যান দিলাম না সেদিকে। লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ করলাম। আজ থেকে আমি মুক্ত পাখি। আকাশে উড়াল দিবো যে কোন সময়।
পৃথিবীতে তুমি একা হয়ে এসেছো একাই ফেরত যাবে।
কেউ তোভার জন্য অপেক্ষা করবে না।
হাতের অনামিকা আঙুলে তাকালাম। এক বছরে এক দিনের জন্যও খুলিনি আংটিটা। সাদা দাগ বসে রয়েছে। জানি না কবে এই দাগ মুছবে।
অনবরত ফোন বেজে চলছে। মা ঘর থেকে চিল্লিয়ে বলছে, ” তোর কল এসেছে। দশবার ফোন দেয়া হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি ধর, নয়তো অপর পাশের মানুষ ম’রে যাবে।”
মুখ বাঁকালাম। কিছুক্ষণ আগের কথা ভুলে গেলাম। অচেনা নাম্বার। দশটা মিসড কল। আবারও কল আসলো। রিসিভ করলাম।
” ম্যাম আমি জীবন হাসপাতাল থেকে বলছি। রিয়ন নামক রোগী খুব অসুস্থ। দেখতে চাইছে আপনাকে।”
চিন্তায় পড়লাম। নাম্বার কীভাবে পেলো এরা? মনে পড়ে গেল। হাসপাতালে রিয়নের সাথে দেখা করার সময় ফোন নাম্বার দিতে হয়েছিল। গলা পরিষ্কার করে উওর দিলাম,
” কি হয়েছে উনার?”
” জ্বর অনেক। আপনার নাম নিচ্ছে। রোগীর বাবা ও এসেছেন। ছেলের অবস্থা দেখে উত্তেজিত হচ্ছেন। আপনি কী একবার আসবেন?”
দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে নিলাম। অপরাহ্নের সময়। সকালে মা এসেছে। মাকে সময় দিতে হবে। এদিকে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর কি হয়েছে জানা নেই। ক্ষুধা লেগেছে। সব মিলিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছি। নার্সকে আশ্বস্ত করলাম। বলে দিলাম আসবো।
মা এসেছে। খাবারের ঝামেলা নেই। মজার খাবার রান্না করে খাওয়াবে এখন। তৈরি হয়ে নিলাম। সোফায় বসে দুপুরের সহ বিকালের খাবার খাচ্ছি। মায়ের কন্ঠস্বর কানে আসে। মা কাউকে বলছে, লজ্জা কীসের? চলে আসো। আমি তোমার মায়ের মতোই।” আর শুনতে পেলাম না। মা ঘরে চলে গেলেন। মিনিট পাঁচেক পর কলিং বেলের আওয়াজ শুনতে পেলাম। রত্না বাসায় নেই। মা বলে কয়েকবার হাক ছাড়লাম। লাভ হলো না। অগত্যা ভাত মাখা হাত নিয়ে এগিয়ে গেলাম দরজা খুলতে।
তিনজন যুবকের চেহারা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। দুইজন হাস্যজ্বল মুখে আর একজন তেতো মুখে। বিরক্ত হলাম। আঙুলে লেগে থাকা খাবার চেটেপুটে খেয়ে মা বলে ডেকে উঠলাম,
” মা পাশের বাসার প্রতিবেশীরা এসেছে। কি লাগবে দিয়ে দাও। তাদের ঘরের চাল ডাল যখন তখন ফুরিয়ে যায়। ব্যাংক থেকে এবার বেশি করে টাকা তুলতে হবে। চাল,ডাল বেশি করে কিনে রাখতে হবে প্রতিবেশীদের জন্য।”
প্রিয়মের মুখশ্রীতে ভাবান্তরের রেশ নেই। আকিল রেগে গেছে রিফাত বরাবরের মত নিশ্চুপ। আকিল দরজার সামনে থেকে চলে যেতে যেতে বলে, ” গুন্ডির সাথে রাক্ষসী বললেও চলে। এমন প্রতিবেশী বাবার জন্মেও দেখিনি। কথায় কথায় খোঁটা দেয়া অভ্যাস।”
আকিল চলে গেল। রিফাত, প্রিয়ম সোফায় বসে। রক্তিম বর্ণ চোখ জমিনে নিবদ্ধ করা।
আয়নায় নিজেকে দেখে নিলাম। পরিপাটি লাগছে। মনের কষ্ট, বিদ্বেষ ধুয়ে মুছে গেছে। মনের কোণে জমিয়ে রাখা ভালোবাসা মূর্ছা গেছে। কপালে কালো টিপ পরে নিলাম। মা বলে কালো টিপে মানায় আমাকে। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। মায়ের সামনে দাঁড়াতে প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম। মায়ের উত্তেজিত স্বর, ” কোথায় যাচ্ছিস এ সময়ে? বাড়িতে প্রিয়ম এসেছে। কোথায় সময় দিবি ছেলেটাকে, তা না করে বের হচ্ছিস।”
হাসলাম মায়ের চিন্তায়। স্বাভাবিক স্বরে বললাম, ” তুমি তো আছো। তাঁদের আপ্যায়ন তুমিই আজ করো। এতদিন আমি করেছি। হাসপাতালে যাচ্ছি মা। একজনকে আমার প্রয়োজন। সন্ধ্যার আগে চলে আসবো।”
মা কিছু বললেন না। পথ আটকালো জাম্বু। ক্যা ক্যা আওয়াজ করে পায়ে ঘেঁষে যাচ্ছে পর পর। বুঝতে পারলাম আবদার করছে বাহিরে যাওয়ার। হাঁটু গেড়ে বসলাম। জাম্বুর গলায় হাত বুলিয়ে বললাম,
” চলে আসবো জলদি। হাসপাতালে যাচ্ছি। একজনের আমাকে খুব প্রয়োজন। তোর পছন্দের বিস্কুট নিয়ে আসবো।”
জাম্বু বুঝতে পারলো। গোল গোল ঘুরে সম্মতি জানালো। আশেপাশে আর ফিরে তাকালাম না। চলে আসলাম বাহিরে। সেখানে থাকা দায়। মনের কলুষিত স্মৃতি উঁকি দিবে বারবার।
আপনাকে আপন ভেবে করেছি আমি ভুল,
অপেক্ষার অবসান হয়েছে তবে
বিচ্ছেদ হবে সঠিক কি ভুল।
চলবে……