#অনুরক্তির_অনুভূতি
#আফসানা_মিমি
|৩য় পর্ব |
মাথার উপর বৈদ্যুতিক পাখা ঘুরছে। প্রচন্ড গরম। তীব্র রোদে গরম হয়ে আছে সব। ছাদের নিচ বরাবর ফ্ল্যাট হওয়াতে দালান আসবাবপত্র সব গরম হয়ে আছে।
ওড়না পড়ে আছে মাটিতে। মাথার কেশব খোলা, বাতাসে এলোমেলো ভাবে উড়ছে। মুখশ্রীতে লাল আভা ছড়িয়ে আছে। নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছি না। বারবার ছাদের কথা মনে পড়ছে।
জাম্বু পায়ের কাছে ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে। মেজাজ খারাপ বুঝতে পালছে হয়তো! রত্না তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
” এমন পাগল বেশে বসে আছিস কেন? ছাদে কি ভূত দেখে এসেছিস?”
আগুনে ঘি ঢালা যেন রত্নার কাজ। তেতে গেলাম আমি। রত্নার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। মনের সকল ক্ষোভ পেশ করতে শুরু করলাম একে একে।
” ভূতের দেখা পেলে তো ভালোই হতো। তোর জন্য ঘেচুভূত চাইতাম।”
” রাগ করছিস কেন? আসল কাহিনী বল। রাজপুত্রের দেখা পেয়েছিস নাকি? কিছু করেছে কি সে?”
রাগ যেন দাউদাউ করে মাথায় উঠে গেছে। কেশবগুলো আলগোছে গুছিয়ে এক এক সব বলতে শুরু করলাম।
কিছুক্ষণ আগে ছাদে যুবকের কথা শুনে তেতে উঠি। আশ্চর্য হয়ে কাপড়ের দিকে তাকাই। একজন মেয়ে মানুষ হয়ে ছেলেদের কাপড়ের সুগন্ধি খোঁজ করতে যাবো কেন?
” কাপড় সরিয়ে অন্য কোথাও জায়গা খোঁজ করুন। এটা আমার রশি।”
” নাম লিখা আছে কোথাও? তোমার মত গুন্ডীকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনেছি। নিশ্চয়ই অন্য কারোর রশিকে নিজের নাম করে ছিনিয়ে নিয়েছো।”
” সাহস পকেটে রেখে দিন। এতো সাহস ভালো না। আমি অন্য মেয়েদের মতো না। আমার সাথে লাগতে আসলে,,,
” কি করবে? আবার তোমার ঐ কুকুরের কামড় খাওয়াবে?”
চুপসে গেলাম। অপরাধ ঢাকা আমার কাজ নয়। তবে ইচ্ছে করে তো অপরাধ করিনি। মুখ ফুলিয়ে বলতে পারবো। যুবকটা যে আমার চির শত্রু হয়ে গেছে তা বুঝেছি। তবে পিছু পা হবো কেন? নারী বলে? কখনও না। প্রত্যুওর করলাম,
” ইচ্ছে করে জাম্বু কামড়য়নি। আমার জাম্বুকে কখনও খারাপ শিক্ষা দেইনি।”
” তুমি যেমন গুন্ডি, তোমার জাম্বুও তেমন গুন্ডা। কাপড়ে যদি হাত লাগিয়েছ তাহলে আমিও হাত তুলবো।”
ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলাম। এ পুরুষ মানুষ নাকি ঝগড়ার মাস্টার কে জানে? উপলব্ধি করলাম এই মানুষের সাথে পারব না। রাগে দুঃখে চলে আসলাম নিচে।
বর্তমানে,
রত্না লেবুর শরবত হাতে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। সাহস জুগিয়ে বলেই ফেলল,
” যাই বলিস আরাত বেবি, ছেলেটার বুকে সাহস প্রচুর। তোর মত গুন্ডিকে চুপ করিয়ে দিলো এক মিনিটেই! তোর যদি আংটি বদল না হতো তো তোর হয়ে ঐ ছেলেকে দুলাভাইয়া হিসেবে পটিয়ে নিতাম।”
” আমি তোর কোন জন্মের শত্রু রে? তুই কী আদৌও আমার বান্ধবী? আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় হো।”
” ভালো কথার দাম নাই। একদিন এই রত্নার পাত্তা পাওয়ার জন্য পা ধরবি কিন্তু পাত্তা পাবি না।”
রত্না জীবনেও ভালো হবে না। ইচ্ছে করছে লাঠি ভাঙতে। কলিং বেল আবারও বেজে উঠলো। এগিয়ে গেলো রত্না, দরজা খুললে দৃশ্যমান হলো প্রতিবেশী।
” প্রতিবেশীর বোন চিনি হবে?”
—————
ছাদে পায়চারি করছে প্রিয়ম। হাতে সিগারেট। জ্বালাবে কী জ্বালাবে না বুঝছে না। কখনও টানা হয়নি। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ও কখনও ছুঁয়ে দেয়া হয়নি। আজ খুব ইচ্ছে করছে নিকোটিনের ধোঁয়া আকাশে উড়িয়ে দিতে। জ্বরে উল্টা পাল্টা ভাবনা আসছে শুধু।
“প্রেমের বিরহে পুড়ে যেই মন, ছাই হয়ে যায় অনিমেষে। নিকোটিনের ধোঁয়া আকাশে উড়িয়ে যায় দিন পাড়। প্রিয়জনের হারানো যন্ত্রণা ভোলা যায় না আর।”
প্রিয়মের আপনজন বলতে বাবা আছেন বেঁচে। মা গত বছর মারা যান। প্রিয়মের বন্ধু, গল্প করার সাথী ছিল, মা। রাগ করে অভিমান চলে চলে গিয়েছে না ফেরার দেশে। অভিমান কীসের তা না বলি। প্রিয়ম মায়ের মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করে। এক বছর আগে মায়ের কথা শুনলে হয়তো এমন হতো না। প্রিয়মের বাড়ি গাজীপুরে। পড়াশোনা শেষ করে ঢাকা শহরে প্রাইভেট কম্পানিতে চাকরি করে। রিফাত আকিল ও। কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি বদল করেছে। গাড়ি ঠিক করতে বের হওয়ার পর আরাতের ভুল বুঝে এবং যা তা বলে। প্রিয়মের এ নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। বরং আজকের করা কাজের জন্য ভীষণ রেগে আছে। মেয়েটির কুকুরকে পেলে অপহরণ করবে ভাবছে।
মধ্যাহ্নের শেষ সময়। প্রিয়ম নিচে নেমে আসে। দুপুরের খাবার তৈরি। বুয়া ঠিক করা হয়নি। রিফাত, আকিল রান্না করছে। ব্যাচেলার হলেও পুরো ফ্ল্যাটে জিনিস ভর্তি। এক বছরে সব কিনেছে প্রিয়ম।
রিফাত কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে। আকিল পেট চেপে বসে হাসছে। প্রিয়মের ক্ষুধা পেয়েছে। টেবিলে রাখা শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে এক নিশ্বাসে পান করে ফেলে কিন্তু গিলতে পারেনি, মুখ থেকে বের করে দেয় সব।
” গা’জা খেয়েছিস নাকি শা’লা’রা? চিনির পরিবর্তে কী মিশিয়েছিস? লবন সস্তা বলে শরবতে ঢেলে তেতো বানাবি? আমাকে মারতে চাস নাকি?”
আকিলের হাসি বেড়ে গেছে। সোফার থেকে ধপাস করে নিচে পড়ে হাসছে। গাড়াগড়ি দিয়ে হাসতে। একপর্যায়ে বলে উঠে,
” শা’লা’য় পার্ট লইবার গেছিল প্রতিবেশীর ঘরে। চিনির বদলে নুন নিয়ে আসছে। আজ খাওন একটাও খাইবার মত না”
” শুদ্ধ ভাষায় কথা বল আকিল। তোর গাইয়া ভাষা শোনার উপযুক্ত না।”
” এখন তো আমার ভাষার দোষ। তোর কপালের দোষ কে খুঁজবে শুনি?”
দুই বন্ধুর কথায় কাটাকাটি শুরু। জ্বরে নাজেহাল প্রিয়ন কাবু হয়ে গেছে আরো। মাথা চেপে বষে পড়লো চেয়ারে। হাতল ধরে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে চেষ্টা করল।
” তোরা থামবি?”
কথা বন্ধ। দৃষ্টি প্রিয় বন্ধুর উপর। যে যার অবস্থান থেকে ফিরে এসে বন্ধুকে সামলাতে ব্যস্ত।
——-
গভীর রাত। জাম্বু নির্ঘুম সাথে আমিও। বারান্দায় বসে অদূরের দালান দেখছি। নিভু নিভু আলো। অন্ধকার বলা ঠিক হবে না আলোকিত বলাও ঠিক হবে না। টিমটিম আলো উপভোগ করছি দুজন।
শুনেছি প্রাণীরা রাত হলে ঘুমে থাকে। কিন্তু জাম্বু বিপরীত। মন খারাপের সঙ্গী সে। জাম্বুকে পেয়েছিলাম আরো এক বছর আগে। রাস্তায় ঝোপের আড়ালে ঘাসপাতা নিয়ে খেলছিল। মায়ায় পড়ে যায়, নিয়ে আসি বাড়িতে। মা অনেক বকেছে। কিন্তু ফেরত দিতে ইচ্ছে হয়নি। সেই থেকে জাম্বু আমার কাছে। মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। আমার ভাই।
” বুঝলি জাম্বু, বাবুর নামটা জানা হলো না, চেহারও চেনা হলো না। নয়তো তার কাছে গিয়ে জানতে চাইতাম কেন এত অবহেলা, বিষাক্ত কেন তার মন! ফিরে তাকালে কী খুব ক্ষতি হয়ে যেত?”
জাম্বু কিছু বলল না। ক্যা ক্যা করে আমার পায়ের সাথে মিশে শুয়ে পড়ল। আচমকা সেই বিকৃতমস্তিষ্ক যুবকের কথা মনে পড়ে গেলো। সেদিনের পর তো আর খোঁজ নেয়া হলো না।
” জাম্বু, পাগলকে কখনও ভয় পাবি না। পাগলদের মন একদম পবিত্র।”
আমার কথায় সায় দিলো জাম্বু। বিনিময়ে হাসলাম। উঁকি দিয়ে রত্নাকে দেখে নিলাম। যে এখন হাত পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে।
———
শুক্রবার ছুটির দিন। রফিক সাহেব এসেছেন পুরো বাড়ি তদারকি করতে। সমস্যা সমাধান করতে আবার সমস্যা তৈরী করতে। রফিক সাহেবের সাথে এসেছেন উনির কনিষ্ঠ কন্যা রেজিয়া। আরাতকে খুব পছন্দ করে। বাবাকে সাহায্য করার পরিবর্তে পাঁচ তলায় চলে গেছে আড্ডা দিতে।
দুই ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। সম্মুখ পশ্চাৎ দরজার কারুকাজ একই। রেজিয়া ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে ডাক দেয় জাম্বুর নাম ধরে। সাড়াশব্দ নেই। নিস্তব্ধ পরিবেশ ঠাওর করে চোখ খুলে। সোফার সামনে ছেলেদের ছোট বড়ো প্যান্ট, মোজা, শার্ট ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রেজিয়া ছি ছি করছে। আরাতকে ছেলের সহিত ঐ অবস্থায় কল্পনাও করে ফেলেছে। সোফার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে কেউ। পরিধানে সাদা পাতলা গেঞ্জি আর লুঙ্গি যা হাঁটুর উপর উঠে আছে। ছি বলে রেজিয়া চোখ ঢেকে নেয়। উঠে যায় ঘুমন্ত মানুষ। চিৎকার করে উঠে,” আমার ইজ্জত খেয়ে ফেলল রে!”
আগমন ঘটে জাম্বুর। ঘেউঘেউ করে উঠে জাগ্রত মানুষের সামনে গিয়ে। আকিল দুই হাতে গা ঢেকে আছে। যেন সে মেয়ে তার ইজ্জত কেউ লুটে খেয়েছে।
” এই কুত্তা থাম! তোর কি হয়েছে। এখানে কি করতে এসেছিস? আজ তোকে আটকে রাখবো। মালিক তোর খোঁজও পাবে না।”
জাম্বুর আওয়াজ বেড়ে গেল। ঘর থেকে ঘুম ঘুম চোখে প্রিয়ন বের হয়ে আসলো। সময়ের ব্যবধানে জাম্বুকে চিনে ফেলল। সাতটা সুই দিয়ে তবে জাম্বুকে ছাড়বে পন করল। রেজিয়া পড়েছে মহা বিপদে। ভুল করে ভুল ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে ফেলেছে অনুধাবন করতে পারছে। দুই যুবকের অগোচরে বের হয়ে আসলো ফ্ল্যাট থেকে। সঠিক ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে প্রথমে টেবিল থেকে পানি গলাধঃকরণ করে নিলো।
রত্নার সকাল সকাল গোসলের অভ্যাস। কম বেশি আরাতের বাড়িতে আসা যাওয়ায় রেজিয়াকে চিনতে পারে। অস্থিরতা দেখে কাছে আসে এবং প্রশ্ন করে,
” কি হয়েছে?”
” জাম্বুকে বাঁচান।”
এতটুকু কথাই যথেষ্ট ছিলো। তৈরি হচ্ছিলাম বের হবো। জাম্বুর কথা শুনে টনক নড়ে। চলে অসি বাহিরে। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাই রত্নার পানে।
” পাশের প্রতিবেশীরা জাম্বুকে আটকে রেখেছে।”
ওড়না কোমড়ে গুঁজে নিলাম। রত্নার হাতে শলার ঝাড়ু, রেজিয়ার হাতে বিছানার ঝাড়ু, আমার হাতে হটিস্টিক যা নিচ তলার রাহেলের কাছ থেকে চুরি করে এনেছিলাম।
যুদ্ধে যাচ্ছি। জয়ী হয়ে ফিরব। আমার জাম্বুকে উদ্ধার করে আনব।
কি মনে হয়। জাম্বুকে প্রতিবেশীরা কী করবে?
চলবে…..
ছবিটি দিয়েছে রুবু পাখি।
এতো এতো ভালোবাসা তোমার জন্য