###জীবন যখন যেমন(১৯তম পর্ব)
###লাকি রশীদ

এতো এতো গুমোট গরমের মধ্যে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমি আমার ক্লাশ নাইনের ছাত্রীকে পড়িয়ে বাসায় পা দেবো মাত্র। ঝুমঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। নতুন করে গজানো দুই রুমের উপরে ছাদে
যাবার জন্য লোহার প্যাচানো সিঁড়ি লাগিয়েছি আমি। এর একটা বড় কারন হলো,খালি জায়গা
আর নেই। এতে ঘর উঠে যাওয়ায় মায়ের বাগান করার জায়গা সংকীর্ণ হয়ে গেছে। সামান্য ৪ হাত
জায়গা শুধু আছে। আজকাল ছাদ বাগান করার কতো সুন্দর একটা আইডিয়া এসেছে। তাছাড়া, কাপড় শুকানোর কোনো উপায় থাকবে না। এই ভেবে আমার সিঁড়ি লাগানো।

মালাবু জায়গাটাকে পরিস্কার করে রাখে, খুব ভালো করে ঝাড়ু দেয় প্রতিদিন। সেদিন আমাকে খুব খুশি হয়ে বলছে, গোসল করে ছাদে উঠে চুল হুকাইতো করি এত দিন মর্জিনার দাফ(দেমাগ) ছিল। এদ্দিনে আমবাও(আমিও) দেহাইতে পারুম। সত্যি বলতে কি, এই মহিলার সাথে কথা বলতেই আমার ভয় লাগে। সবকিছু তেই তার মর্জিনার সাথে কম্পিটিশন। সেদিন মর্জিনাকে সাদি ভাই বিয়ে করছে……….. না বললে হয়তো বা খাজুর বেগমও আসতেন না আর আমার ফোনে শাওনের মেসেজটাও আসতো না। এই একটা জিনিস যেন গত তিনদিন ধরে আমাকে অসংখ্য বার ছোবল মারছে। নীল দংশনে সারা শরীর যেন জর্জরিত। এই তিনদিনে তিনটি ঘন্টাও ঘুমোইনি।
বলা ভালো ঘুমুতে পারিনি। চোখ দুটো বুজলে শাওন যেন সর্বরুপেই ধরা দেয়। কখনো আকুল হয়ে কাঁদতে থাকা শাওন ছোটফুপুর ছাদের এক
পাশে রেলিং এ ধরে থাকা অবস্থায়। কখনো মুখ চেপে ধরে শ্বাস প্রশ্বাস ফেলতে থাকা শাওন আর
কখনো হাত ধরে মিনতির স্বরে বলা “আবার কবে
দেখা হবে” বলা‌ শাওন। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় জানা থাকলে,আমি তাই করতাম

বৃষ্টির পানিতে শার্ট,প্যান্ট ভিজে একসা। কোনো দিকে না তাকিয়ে ছাদের ঠিক মধ্যিখানে গিয়ে বসে পড়ি। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি। নিজেকে অনেক বেশি শক্ত, মজবুত ভাবা সাদি পাগলের মতো ভাবে “এতো কষ্ট ভালবাসায়” !!! ভাবছি সব
কি একপক্ষের ছ্যাচড়ামো ছিল? শেষের দিকে আমারো কি যথেষ্ট প্রশ্রয় ছিল না? কিছুক্ষণ পর ভাবি,মা এভাবে দেখলে সমস্যা আছে। জেরা না
করেই সবকিছু জেনে যাবে। চোরের মতো বাসায় ঢুকি। আমি না আমার আত্মার একটি অংশ শুধু ঢুকে সেটা অবশ্য বলা মুশকিল।

বড়চাচার দাওয়াতের দিনক্ষণ ঠিক হয়েছে। ফ্রি
আছি দেখলেই আবার কাজে লাগিয়ে দিবেন। এখন আর এসব ভালো লাগছে না। মাকে বলে রাকিবের বাসায় চলে যাই। বিরাট বিরাট কাঠের ২ দরজায় তালা মারা। ডুপ্লিকেট চাবি আমার সাথেই আছে। ঘরে ঢুকে সোজা রাকিবের রুমে গিয়ে এসি ছাড়ি। বিছানায় শুয়ে ভাবছি আগামী ৫/৬ দিন আর এখান থেকে যাচ্ছি না। হঠাৎ করে পৃথিবী কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে গেছে,অসহ্য লাগে
সবকিছু। ইদানিং চোখ বুজতেই আমার যেন ভয় হয়। সর্বক্ষণ এক নারীর করুণ মুখ দেখতে পাই।
আজকে এই বাসার ৩ জনের একজন কেও বলি নি যে, আজকে এখানে থাকবো। নাহয় টেবিলে খাবার রেডি থাকতো। ফ্রিজের দরজা খুলে দেখি সব তরকারি এখানে রাখা। কে এখন এসব গরম করে খাবে? কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। চোখে কান্না নিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেও জানিনা।

“এই সাদি কখন এসেছিস”………কানে যেতেই দেখি রাকিব ধাক্কা দিচ্ছে গায়। মাথায় ধপ্ করে আগুন জ্বলে উঠলো। চিৎকার করে উঠি, ষাঁড়ের মতন চেঁচাচ্ছিস কেন? রাকিব দু’পা সরে গিয়ে বলে, শালা কোথাও মারামারি করে এলি না কি?
এতো ক্ষেপে গেলি কেন? কথা বললেই বাড়তে থাকবে বলে চুপচাপ ওপাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়েছি। রাকিব মনে হয় কি ভেবে রুম ছেড়ে চলে গেছে। শুনশান নীরব বাসায় বেশ কিছুক্ষণ পর উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি,সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা বাজে। আমার জীবন যেমন অদ্ভুত, তেমন যেন আমার কর্মকাণ্ড গুলোও অদ্ভুত। কোনো সময় ৩ দিনেও ৩ ঘন্টা ঘুম হয়না আবার কোনো সময় এতো কষ্ট নিয়েও ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেই। কি যে এক অবস্থা আমার !!!

ওয়াশরুমে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে গিয়ে দেখি খালা,খালু দুজনেই অফিস থেকে এসে পড়েছেন।
আর তার সুযোগ্য পুত্র রাকিব ছুরি দিয়ে আপেল কেটে খাচ্ছে। খালা আমাকে দেখেই হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কাছে বসিয়ে বল্লেন, কি খাবি বাবা? চা
না বন্ধুর মতো ফল। খিদেয় আমার পেট চো চো
করছে। সেই কোন সকালে ৪/৫ টা রুটি ও চা খেয়ে বেরিয়েছিলাম। বললাম, খিদেয় চোখে তো অন্ধকার দেখছি। ভাত খাবো আমি, আছে খালা?
সাথে সাথে বলছেন,আহহা রে !!! ফ্রিজে সবকিছু আছে, মাইক্রোওয়েভে গরম করে নিলেই হতো।নিজে গিয়ে বিশাল ফ্রিজ খুলে কি কি সব বাটি বের করছেন। আমি বলি, এতো খাবার কে খাবে?
একটা আইটেম দিয়ে দাও শুধু। এবার বলছেন, তুই টেবিলে যা তো বাবা। আমি ঝটপট গরম করে দিচ্ছি।

কেন যেন আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে, এতো এতো ভালবাসা পেয়েও নিজেকে দুর্ভাগ্যবান মনে করো সাদি? যেটা পাওনি সেটার
জন্য মন খারাপ করে সারাদিন পাগলের মতো কি করেছো আর এখন যে আরেক মমতাময়ী নারী অস্থির হয়ে তোমার খাবার গরম করে দিচ্ছে……..
সে শুকরিয়া আদায় করবে কিভাবে? ভাবছি এই
কথাগুলো কিন্তু খালার দিকে তাকিয়ে আছি। এই সময়ে খালা অবাক হয়ে বলছে, কি রে আজ কি হয়েছে বাবা তোর? আমি একান্ত বাধ্য না হলে,
পারিবারিক কোনো জটিলতা কারো সাথে শেয়ার করতে চাই না। হেসে বলি, কি আবার হবে? ক্ষিদে
পেয়েছে, দয়া করে একটু তাড়াতাড়ি করে দাও।

এদের বাসায় সবসময় ভালো ভালো খাবার থাকে। মাছ, মুরগি গরম করে ট্রেতে তুলবার চেষ্টা করতেই আমি বলি, আমি নিচ্ছি। গরম সবকিছু নিয়ে হাত পা পুড়াতে চাও নাকি? এখন শুরু হয়েছে আফসোস পর্ব, অফিস থেকে সেই কখন এসেছি। জানলে চারটা ভাত বসাতে কতক্ষন?
কালকের ঠান্ডা ভাত গরম করে দিতে হলো। আমি বলি,ডাষ্টবিন থেকেও কুড়িয়ে খাচ্ছে মানুষ,
আর তুমি তো তুলতুলে নরম ওভেনে গরম করা ভাত দিলে। বসে পড়ো, তোমার চা কিন্তু ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। খালুর চা খাওয়া শেষ, আমাকে গ্লাসে পানি ঢেলে দিচ্ছেন।

এতোক্ষণ ধরে অনেক কষ্টে চুপ করে থাকা রাকিব বলছে, বাবা বলোতো মা যদি ঠিক এই অবস্থাটা আমার ক্ষেত্রে দেখতো তাহলে খাবার গরম করে দিলেও কমপক্ষে ঘন্টা খানেক তো বকতোই। “এতো বড় ছেলে অলসের একশেষ। সামান্য খাবার গরম করতে হাত পা নষ্ট হয়ে যায় না কি? মায়ের জন্য বসে আছে, এমন আজব ইডিয়ট ছেলে আমার বাপের জন্মেও দেখিনি”। আর এখন চা খাওয়া ফেলে সাদি কে সবকিছু গরম করে দিলো। তোমার আবার গ্লাসে পানি ঢালাও শেষ। আমি হেসে বলি,আহারে !!! সেই হিংসেয়
জ্বলে পুড়ে মর এখন। রাকিব এবার চেঁচাচ্ছে, এই
পরিবারের সদস্যরা এতো বৈষম্য কারী !!! ছিঃ !!!

খেতে খেতে খালু তার অফিসের অনেক গল্প করলেন। খালা এবার খালু কে বলছেন এই শোনো, একটা কথা বলি? আমার না মঈন
ভাইয়ের দাওয়াতে আজকে আর যেতে ইচ্ছে করছে না। তারচেয়ে চারজন মিলে গল্পগুজব করি আমরা। অসম্ভব ভদ্র খালু এবার গলায় সারা পৃথিবীর বিনয় ঢেলে বলছেন, কিন্তু মঈন মাইন্ড করবে যে। তাড়াতাড়ি চলে আসবো না হয়। আমি এবার খালার দিকে তাকিয়ে বলি, কমপক্ষে
৩/৪ দিন তো আছি আমি এখানে। সুতরাং, এখন কোনো তাড়াহুড়ো করে আসতে পারবে না। এতো খুশি হয়েছেন যে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে বলছেন,
সত্যি !!! তুই ৩/৪ দিন থাকবি বাবা !!! এসে আমরা প্ল্যান করবো, কোনদিন কি করা যায়। বল্ ঠিক আছে তো? আমি মাথা নেড়ে হ্যা বলি।

উনারা চলে যাবার পর লিভিং রুমে বসে আছি
দুজনে। রাকিবের আয়েশ করে সিগারেট খাওয়া শুরু হয়ে গেছে। খুব আস্তে করে বললো, সত্যি করে বলতো তোর আজ কি হয়েছিল? মন খারাপ কেন? আমি হেসে বলি, কি আবার হবে? কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে তোর মতো ইডিয়টের মুখ সামনে যদি দেখতে হয়………….. মেজাজ তো খারাপ হবেই।
এবার বলছে, বলে ফেল বন্ধু। এত চাপা স্বভাবের হওয়াও ভালো না। দম আটকে মরে যাবি কিন্তু। শাওন কিছু করেছে? বললাম সবকিছু,এ কদিন কি ঘটেছে। এবার ওকে জিজ্ঞেস করলাম, শেষের দিকে আমারো যথেষ্ট প্রশ্রয় ছিল। কিন্তু মায়ের মতের বিরুদ্ধে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি যেতেও চাই না। শাওনের জন্য অনেক কষ্ট হচ্ছে রে। একশটা
বোম্বাই মরিচ কে যেন ডলে দিয়েছে আজ আমার বুকের ভেতর। এজন্যই মনটা খারাপ হয়ে আছে।

রাকিব এবার বলছে, তোর বিষয় টা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। আমার মনে হয়, খালার সিদ্ধান্ত টাই ১০০% সঠিক। এতো এতো কষ্টের পর তোরা এখন হয়তো সুখের মুখ দেখবি। তাছাড়া, বিয়ে কি শুধু বর কনের নাকি? দুটো পরিবারের মধ্যে শুধু কথা কাটাকাটি হলে, তুইও শান্তিতে থাকতে পারবি বল? আমি বললাম,হ্যা সেটাই বন্ধু। মনকে বুঝ দিতেই হবে। তা না হলে আমার ধ্বংস কিন্তু অনিবার্য। বছরের পর বছর এতো এতো কষ্টের পর, আমরা দুই ভাইয়ের কাছ থেকে কষ্ট পাওয়া মা মোটেও ডিজার্ভ করে না রে। মুখে কিছু বলবে না, কিন্তু মনোকষ্টে মা একদম ভঙ্গুর হয়ে যাবে।

মনে হচ্ছে, দূরে অনেক দূরে কোথাও চলে যাই। কেউ আমাকে ডেকে আর পাবে না। ভালো লাগে না। নিজের দোষে ই আমার এই অবস্থা বুঝলি? প্রথম দিকে যেরকম শক্ত ছিলাম সেরকম শক্ত থাকলে আজ এরকম হতো না রে। কি জন্য যে কাঁদতে দেখে এমন দুর্বল হলাম। রাকিব বলছে, এরকম অপরাধবোধে ভুগবি না তো। তোর মতো কজন হালাল/হারাম মেনে থাকতে পারবে। আমি কিন্তু নিজেও বিশ্বাস করি, ধৈর্যের ফল সবসময় মিষ্টি হয়। পৃথিবীর সব সুখ তোর হাতে ধরা দেবে ইনশাআল্লাহ। আমি কঠিন প্রকৃতির মানুষ, কিন্তু তোর জন্য আজ ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার।

ঠিক সেই মুহূর্তে ফোন বেজে উঠলো। চেয়ে দেখি ভাইয়া করেছে। হ্যালো বলতেই স্বর ভেসে এলো,
তুই ঠিক আছিস সাদি? বললাম,হ্যা ঠিক আছি। কেন আমার আবার কি হবে? কাঁপা স্বরে বললো, কালকে স্বপ্নে দেখি তুই নদীতে ভেসে যাচ্ছিস। চিৎকার করে ভাইয়া, ভাইয়া ডাকছিস। কিন্তু, সে ডাক আমি শুনতে পাচ্ছি না। আমি মনে মনে ভাবি, তোমার নিজের ই স্বাধীনতা নেই আর আমি
ডাকলে সাড়া দিবে কি করে?

স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললাম,এসব কিছু না। স্বপ্ন তো স্বপ্ন ই। আশেপাশে নিস্তব্ধ, কোনো শব্দ নেই শুনে আন্দাজে বলি, তুমি কি ওয়াশরুম থেকে কথা বলছো না কি? হেসে বলছে, না না গাড়িতে করে বাসায় যাচ্ছি। এবার বলি, তোমার শালার করা ঝামেলা কি মিটলো? না এখনো সে সমস্যা বহাল আছে? এবার উচ্ছসিত স্বরে বলছে, না রে
একটা দোকানের মালিকানা আমি পাবো। হেসে বলি, বললাম না তোমার বৌ ঝগড়া করে করে ঠিক ই আদায় করে নিবে। যাক শান্তনা এটুকু অন্তত যে,সব কূল তোমার ডুবেনি। ভালো থেকো।

খালা দাওয়াত থেকে এসে বলছে,চলো আগামী কাল কোথাও যাই। খালু বলছে,ঢাকার তুরস্ক বাজার এন্ড রেস্টুরেন্ট এ এখনো যাইনি আমরা।
আমি হেসে বলি, বাজার মানে? এবার খালু বলছে মনে হয় কিছু বিক্রি করে আবার টার্কিশ ফুডও খেয়ে এলাম। বুঝলে সাদি টার্কিশ ফুড অনেক ডেলিশিয়াস। রাকিব বলছে, আমি যাবো না। আমার জরুরি কাজ আছে। খালা বললো,
শোন জগৎ সংসারে বান্ধবীর কাজ ছাড়াও বহু কাজ আছে।

সেটার জন্য মাঝে মাঝে মা বাবার সাথেও যেতে
হয়, তাদের মনরক্ষাও করতে হয়। এখনো তো বলিই নি,বৃদ্ধ হলে মা বাবাকে দেখেশুনে রাখতে হয়। বাবা মায়ের দিকে একবার ভালবাসার নজরে
তাকালেও অনেক সওয়াব পাওয়া যায়। রাকিব এবার বলছে, ঠিক আছে ঠিক আছে তোমাদের সাথে আমি যাবো। হলো তো? আশ্চর্য, মা তুমি যেন দিন দিন ট্রেনিং দিচ্ছো কেমন করে মানুষকে
ঘায়েল করতে হয়। খালা এবার আমার ও খালুর দিকে তাকিয়ে বললো, মা বাবা হলেই যে শুধু ছেলেদের সূবিধা অসুবিধা দেখবো আর আমাদের খুশি অখুশি তারা দেখবে না…….. এই জিনিস কি ভালো নাকি? আজকে কান খুলে শুনে রাখো তুমি
রাকিবের বাবা, না কাঁদলে মাও দুধ দেয় না।

গেলাম পরদিন ওখানে, আগেকার সুলতানদের শেরোয়ানি,পাগড়ি আর মহিলাদের কাপড় চোপড় রাখা আছে। আনারকলির মতো ড্রেস, উড়না দিয়ে মাথা ঢাকা সহ নেকাব ষ্টাইলে পরা…….যেন পূর্ব যুগের এক টুকরো তুরস্ককে বসানো হয়েছে। খালা খুব সৌখিন মানুষ,খালু ও তিনি এগুলো পরে ফটো তুললেন। আমি ও রাকিব পরবো না বলায় ভাগ্যিস আর জোর করেননি। আমি মনে মনে হাসছি,নুন আনতে পান্তা ফুরায়…………. এই সাদি তুরস্কের সুলতানের পোশাক পরাটা একটু বেশিই হয়ে যাবে।

খুব সুন্দর সুন্দর বাসনপত্র বিক্রির জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু অসম্ভব বেশি দাম লেখা তার গায়ে। খালার আবার বাসন কেনা একটা নেশার মতো হয়ে গেছে। একবার বছর দুয়েক আগে, একটি দাতব্য সংস্থায় কাজ করে ছিলাম। মাত্র ৪০ টাকায় একজন মানুষ এর মুখে খাবার তুলে দেবার ব্যবস্থা করে দিয়ে,এরা কি এক অপার্থিব ও অকৃত্রিম হাসি উপহার পাচ্ছে তা বলার মতো না। শুধু বাসন কিনে মাসে এতো এতো টাকার অপচয় দেখে, এরকম দুটো সংস্থায় খালাকে স্থায়ী দাতা সদস্য বানিয়ে দেই। কয়েক মাস পর বলেছেন, এখন আর বেশি কিছু কিনতে পারি না রে। আগে দুটো সংস্থার টাকা আলাদা করে রেখে তারপর খরচ করি। এবং খুব আনন্দ নিয়েই করি। আমার তখন ভীষণ ভালো লাগে। একটা দামী সুদৃশ্য ডিনারসেট ১/২দিন হয়তো ব্যবহার হয়েছে, কিন্তু আরেকটি পছন্দ হওয়ায় সাথে সাথে নতুন টা এসে গেছে। আমার তখন মনে হতো…….হায় !!! কি বিশাল অপচয় !!! এটা কিছুটা হলেও বন্ধ করে দিয়েছি আমি।

হামাস, একটা প্ল্যাটারে ৫ রকমের কাবাব সহ সামান্য ভাত, পানীয় আইরান(বাটার মিল্কের মতো) মনে হয়েছে টকদই দিয়ে যেন এটা বানানো হয়েছে,ডেজার্ট বাকালাভা খেলাম। খালুর পিউর
টার্কিশ খাবার খাওয়া জিহ্বা এতো সহজে এসবে
মাতোয়ারা হবে না…….. বলাই বাহুল্য। উনি এখন বলছেন, আসল টার্কিশ খাবার আরো অনেক মজাদার। তবে সবাই স্বীকার করেছি,প্ল্যাটারের ২ টা কাবাব খুব মজা হয়েছে। একটি হলো আদানা কাবাব ও অন্যটি ল্যাম্ব কাবাব। আমার চিকেন কাবাবও ভালো লেগেছে। কি নরম, তুলতুলে…….
মুখে দিলেই যেন গলে যাচ্ছে। কি এক সুখানুভূতি
যে !!! এবার রাকিবের গুনগুন শুরু হয়েছে, এটা
বাকালাভা হলো। বাকালাভা থাকবে পেস্তাবাদাম
এর লেয়ার দিয়ে দিয়ে। এবার খালা ধমক দিলেন,
কি বাপ ছেলে খাবারের একটার পর একটা খুঁত বের করে যাচ্ছো। চুপ করো তো। সময়টা সেদিন সত্যিই অনেক সুন্দর কাটছিল।

কথা ছিল আরো ২ দিন খালার ওখানে থাকবো। কিন্তু বাসায় পা দিতেই বড়চাচার ফোন, তুই কই?
বললাম, এখন বলছেন তোকে কিছু করতে হবে না বাপ। কিন্তু,অনুষ্ঠানে তুই নেই ভাবলেই কলিজা
টা খা খা করছে। এক্ষুনি চলে আয়। কালকের অনুষ্ঠানের পরে না হয় আবার চলে যাবি বাবা।
তাই খালাকে বলে রওয়ানা হলাম। বাসার ঢুকার অনেক আগে থেকেই রান্নার খুশবু পাচ্ছি। চাচাকে
এখানে নেই দেখে ভাবলাম আগে মায়ের সাথে দেখা করে আসি। কিন্তু ওখানে আমার জন্য মস্ত বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল। মেঘলা দরজা খুলে হাসিমুখে বলছে,”ওয়েলকাম হোম ভাইয়া”।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here