গল্প :- সঙ্কোচ
পর্ব :- ০৩
Writer :- Kabbo Ahammad
.
.
-:”মিরা চিৎকার করে উঠলো। ওর চিৎকার শুনে সাথে সাথে কাব্যও জেগে গেলো। জিজ্ঞেস করলো।
–“কি হয়েছে? (কাব্য)
–“আশা ছুরি মেরেছে আমাকে। (মিরা)
–“কই, আশা কই?
মিরা তখন চারদিকে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই। তবে ও স্বপ্ন দেখছিলো? কিন্তু সব একদম বাস্তবের মতো, পেটে এখনো জ্বালা টের পাচ্ছে।
কাব্য তখন লাইট জ্বালিয়ে দেখলো মিরার পেটে এক লাল পিঁপড়া কামড়ে চিপকে রয়েছে। এটা দেখে কাব্য হাসতে হাসতে শেষ। মিরাও লজ্জা পেলো বটে, কিন্তু আশা ওর বাচ্চার ক্ষতি করতে পারে এ কথাটা মনে গেঁথে গেলো তার।
পরদিন থেকে মিরা আশার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলা শুরু করলো। ওর কাছ থেকে তো দূরে থাকেই, এমন কি আশার দেয়া কিছু খায়ও না মিরা। আশা সব বুঝতে পারলো, প্রথম কিছুদিন চুপচাপ থেকে একদিন সরাসরি মিরাকে প্রশ্ন করলো।
–“আপনি ভয় পান কেন আমাকে?
–“কই, ভয় পাবো কেন? (মিরা মিথ্যা বললো)
–“না, আপনি ভয় পান। আপনি ভাবছেন আমি আপনার বাচ্চার কোনো ক্ষতি করবো, তাই না?
মিরা তখন কিছু বললো না।
আশা তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো।
–“আপনি আমাকে যা দিয়েছেন, তার তুলনা এই পৃথিবীতে নেই। তবুও আপনার ক্ষতি করবো, এতো অকৃতজ্ঞ কি করে ভাবলেন আমাকে? (আশা)
এটা শুনে মিরা বেশ লজ্জা পেল। ঠিকই তো, আশাকে শুধু শুধু সন্দেহ করছে সে। এটাতো ঠিক না, এবার থেকে আর এমন করবে না সে।
কিন্তু মানুষ যা ভাবে তা হয় না।
দুপুরে আশা ওর এক তেলের শিশি খালি মনে করে রুমের বাইরে রেখেছিলো, পরে ফেলে দেয়ার জন্য। সেটাতে তখনো কিছু তেল ছিল, সেই শিশি কারো পায়ে লেগে তেলটুকু ছিটকে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছিল। মিরাও এতো কিছু খেয়াল করে নি। ঐদিক দিয়েই হেঁটে আসছিলো ও, তখন তেলে হোঁচট খেলো মিরা।
সামনে ঠিক তার দুকদম পরেই সিঁড়ি, সেখান থেকে পড়লে মিরার বাঁচবার উপায় থাকে না।
কিন্তু মিরার কপাল ভালো, পাশের দেয়ালটুকু ধরে মিরা সামলে নিলো নিজেকে। এবং সে যাত্রায় বেঁচে গেলো মিরা।
কিন্তু আশা বাঁচলো না। দোষ গিয়ে ওর ওপরই পড়লো।
কাব্য তখন মিরাকে বললো।
–“আমি তো ওকে ডিভোর্সই দিতে চাচ্ছিলাম, তুমি তো মানা করলে। তুমি যদি চাও, আজই ওকে ছেড়ে দেবো।
মিরাও অবশ্য মনে মনে রাজি ছিলো, কিন্তু আশার করুন মুখটা দেখে খুব মায়া হলো ওর। তখন কাব্যকে বললো।
–“এভাবে বলো না। ওর হয়তো দোষ নেই, আসলেই হয়তো ও ইচ্ছা করে রাখেনি বোতলটা। কোন প্রমাণ ছাড়া ওকে দোষী করি কিভাবে? (মিরা)
কিন্তু কাব্য শুনলো না, ভয়ানক ভাবে রেগে গেছে ও। তারপর আশাকে ও বললো।
–“তুই আজ থেকে তোর বাবার বাসায় থাকবি, মিরার বেবি না হওয়া পর্যন্ত। এরপর এই বাসায় আসিস।
আশা অনেক অনুনয় করলো, কিন্তু ওর প্রার্থনা অনুমোদন হওয়ার যোগ্যতাটুকু ও হারিয়ে ফেলেছে। কারন বাড়ির সবাই সায় দিলো কাব্যর প্রস্তাবে।
ওরা তো আর জানে না, আশা কি পরিমাণ ঘৃণা করে নিজের বাড়িকে, কত লাঞ্ছনা গঞ্জনা ওকে সইতে হবে ওর বাড়ি ফিরে আসার জন্য। ওর দুই ভাবি ওর সাথে যে ভাষায় কথা বলে, মানুষ রাস্তার লোকের সাথেও বুঝি তা বলে না।
এরপর হলোও তাই, ও বাড়ি পৌঁছানোর সাথে সাথেই বড় ভাবি খেঁকিয়ে উঠলেন।
–“এসেছো ননদিনী? ঘাড় ধাক্কা দিলো তো? আগেই তো বলেছিলাম।
–“কিছুদিন থাকতে এসেছি ভাবি, সারাজীবনের জন্য আসি নি। (আশা মাথা নিচু করে বললো)
–“ঐ হলো। এমনেই হয় সব। আজ কয়েকদিন বেড়াবার কথা বলে বাড়ি পাঠিয়ে দিবে, কাল ডিভোর্স পেপার হাতে ধরিয়ে দেবে।
ঠিক তখন ওর ছোট ভাবী পিছন থেকে বললো।
–“ঠিক বলেছো আপা। মজা করে সতীনের ঘর করতে চলে গেলে, এখন বুঝো ঠেলা। কত করে বললাম আমার চাচাতো ভাইয়ের সাথে সম্বন্ধে করতে, তাতো ইনাদের ধাঁচে সইবে না। ইনাদের গলা আরো বড়। ছোট মুখে বড় লোকমা গিলতে গেছে তো, এখন খাবার গলায় আটকেছে।
বলেই খিলখিল করে হাসতে লাগলো আশার দুই ভাবি।
এ মুহুর্তে আশার মনে হচ্ছে ও যেন মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। ওর চাইতে ওর বাবার জন্যই কষ্টটা বেশি লাগছিলো। বাবা দূরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন। ছোট ভাবি ওর শেষ কথাটুকু দিয়ে শুধু ওকেই না, ওর বাবাকেই অপমান করছিলো। ভাবির চাচাতো ভাই ছিলো এলাকার সবচেয়ে সেরা লম্পট। সারাদিন মদ বিড়ি খেয়ে ঘুরে বেড়াতো, আর রাত নামলেই অসৎসঙ্গে জড়িয়ে পড়তো। এই লম্পটটা যখন ওদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো, তখন বাবাই মানা করে দিয়েছিলেন। আর তাতেই ছোট ভাবির এত রাগ।
রাতে ওর দু’ভাই বাড়ি ফিরে ওকে দেখে দ্বিগুণ চটে গেল। সংসারের খরচ বাড়ছে, এর মধ্যে এই উটকো ঝামেলাকে পালা কি চাট্টিখানি কথা? এই তো কিছুদিন আগেই ওর বিয়েতে কত খরচ বেড়িয়ে গেল। এরপরেও যদি সেই ওকে টানাই লাগে, তো বিয়ের দরকার কি ছিলো? ভাইদের রাগের ঝাঁঝ বাবার উপরও পড়লো। মানুষটা ভাইদের সংসারে আশ্রিতের মত থাকেন, কিছুই বলতে পারেন না, চুপচাপ শুনে যান। আশা মাথা নিচু করে সবটুকু দেখলো, শুনলো। কারন তার কিছু বলার ছিলো না।
রাতে সবাই যখন গভীর ঘুমে, তখন আস্তে আস্তে বিছানা ছাড়ল আশা। বাবার রুমের সামনে গিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, ঘুমন্ত বাবার কাছ থেকে মনে মনে বিদায় চেয়ে নিলো, এরপর বেরিয়ে পড়লো বাড়ি থেকে। এতো অপমান সে সহ্য করতে পারছে না, এ বাড়ি তার নয়। যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবে।
ওদিকে মিরা সে সময়টিতে ঘুমিয়ে ছিলো, খুব সুন্দর এক স্বপ্ন দেখছিলো সে। কুয়াশা ঘেরা এক বনের মধ্যে দিয়ে সে হেঁটে চলছিলো চুপচাপ। এসময় তার সামনে কোথা থেকে এক ছোট্ট মেয়ে উদয় হলো। মেয়েটা এতো সুন্দর যে! মিরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এরপর জিজ্ঞেস করলো।
–“কে তুমি?
কিন্তু মেয়েটা কিছু না বলেই ছুটে পালিয়ে গেলো। মিরা খুঁজতে শুরু করলো ওকে। কিন্তু এতো বড় বন, কোথায় পাবে ও মেয়েটাকে?
একটু দূরে গিয়েই মিরা দেখতে পারলো, বনের মাঝে এক সুন্দর দিঘী। দিঘীর টলটলে জলের ওপর কুয়াশা মেঘের মতো জমে আছে। দিঘীর পাশেই বসে আছে মেয়েটি। ওর চোখ ভেজা।
মিরা ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে বললো।
–“জানেন, আমার যখন খুব মন খারাপ হতো, তখন এই দিঘীর পাড়ে এসে বসে থাকতাম। একসময় মা আসতেন। আপনার মতোই আমার পাশে বসে আমাকে সান্ত্বনা দিতেন, বোঝাতেন, মাঝে মাঝে গান গেয়ে শোনাতেন। খুব সুন্দর গানের গলা ছিলো আমার মায়ের। আমার মন ভালো হয়ে যেতো। (মেয়েটি)
–“তোমার মা তোমায় অনেক ভালবাসতেন? (মিরা জিজ্ঞেস করলো)
–“অনেক। আমার মা-ই ছিলেন আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। (মেয়েটি)
–“তা কোথায় তোমার মা?
–“মারা গেছেন।
মিরার খুব খারাপ লাগলো শুনে। তখন সে আবার জিজ্ঞেস করলো।
–“মাকে মিস করো? (মিরা)
–“করি। অনেক মিস করি। মা ছাড়া কেউ আমাকে ভালোবাসে না, কেউ বুঝতে পারে না আমাকে। কেউ একজনও যদি বুঝতো, তবে এভাবে অসময়ে আমায় মারা যেতে হতো না।
–“কি বলো! তুমি মারা গেছো?
–“না, মারা যাবো।
–“আমি তোমাকে মারা যেতে দেবো না।
মেয়েটা তখন মিরার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললো।
–“আপনার জন্যই তো মারা যাচ্ছি আমি। আপনি যদি আজ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে না দিতেন, তবে আজও হয়তো আমি বেঁচে থাকতাম।
–“কে তুমি?
–“আমি আশা।
এরপর হঠাৎ মিরার ঘুম ভেঙে গেলো। চিৎকার করে কাব্যকে জাগিয়ে বললো।
–“কাব্য আশা মারা যাচ্ছে। ওকে বাঁচাও।
–“উফফফ। আবার কি শুরু করলে এই মাঝরাতে। স্বপ্ন দেখেছো আবার। (কাব্য)
–“স্বপ্ন না। প্লিজ তুমি একটি বার ওর খোঁজ নাও।
কাব্য তখন বিরক্ত হয়ে আশার মোবাইলে কল দিলো। ফোন সুইচড অফ। তখন মিরার জোরাজুরিতেই এবার আশার ভাইদের ফোন করলো সে। আশার খোঁজ নিতে বললো। আশার ভাইরা ঘুম থেকে উঠে দেখলেন আশা ঘরে নেই, বাসার কোথাও ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তখন খোঁজ করা শুরু করলেন তারা চারপাশে।
এদিকে কাব্য সব শুনলো ফোনে। ওর মুখ কালো হয়ে গেলো। ওর পাশেই মিরা মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়লো। বারবার বলতে লাগলো।
-“আমি মেরে ফেলেছি আশাকে।
ওদিকে আশা ততক্ষণে অনেক দূরে চলে এসেছে বাড়ি থেকে। চুপচাপ অচেনা অন্ধকার পৃথিবীর মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলছিলো সে। ও বুঝতেও পারলো না, সেই নির্জনতার মধ্যেও কিছু ভয়ঙকর মানুষ ওর পিছু নিয়েছে, ওকে আজ রাতের শিকারে পরিণত করবে বলে।
.
.
চলবে…………….