#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_২৭
#Saji_Afroz

আজ আর ঘুম হলো না নিহিরের। তাহরিমাকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চেয়েছে সে। তার চাওয়াই কোনো ভুল ছিল না। তবুও কেনো তার সাথে তাহরিমার মতো একটা মেয়ে জড়ালো!
ভাগ্যিস বিয়েটা হয়নি। নাহলে অনেক বড়ো একটা ভুল হয়ে যেত।
নিহিরের সহ্য ক্ষমতা বেশি বলে হয়তো বুক ফেটে কষ্ট তার হচ্ছে না। কিন্তু একই মেয়ের জন্য নিখিল কতই না কষ্ট পেল!
এই মেয়ের শাস্তির খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। এই ভেবে মনকে শান্ত করলো নিহির।
.
.
কেনো যেন নওয়াজের কথা ফেলতে পারলো না বুশরা। হয়তো নিজের করা ভুলের জন্য ক্ষমা চায়বে সে। নয়তো বলবে, সে তানিশাকে বিয়েই করেনি। যা বলেছিল সবটা মিথ্যে। এই আশায় তার সাথে দেখা করার জন্য সকাল সকাল তৈরী হয়ে নিলো বুশরা। নিহিরের কাছে এসে তাকে জানালো এসব। নিহিরও বেরুচ্ছে। তাই বুশরাকে বলল, আসুন আপনাকে নামিয়ে দিই।
.
নিহিরের সাথে সে বেরিয়ে পড়ে। নওয়াজ যে রেস্টুরেন্টে থাকবে বলে তার সামনে বুশরাকে নামায়। নওয়াজ সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। নিহিরকে দেখে সে বলে উঠলো, আরে আপনি না সেদিন তায়শার সাথে ছিলেন?
.
নওয়াজের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করে তাকে মনে করার চেষ্টা করলো নিহির। এরপর বলল, জি। চিনেছি আপনাকে।
-ভালোই হলো আপনাকে পেলাম। প্লিজ একটু আসবেন? আমরা একটু বসি?
.
নিহিরকে ডেকেছে বলে বুশরা অবাক হয়। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে নওয়াজের দিকে।
নিহির গাড়ি পার্ক করে তাদের সাথে এসে বসলো। নওয়াজ বলল, আসলে আমি ও বুশরা একে অপরেকে ভালোবাসতাম।
-বুঝতে পেরেছি।
-আসলে আমি দেশের বাইরে থাকতাম বলে সত্যটা জানতাম না। আমার কান ভারী করেছে মানুষ। কিন্তু আমি সত্য জানার জন্য তায়শার কাছে আসি, সেদিন আপনিও ছিলেন। তাই তো?
-জি।
-তায়শাও আমাকে মিথ্যে বলে। যার কারণে আমিও বিশ্বাস করে ফেলি।
.
বুশরা ছলছল নয়নে তাকিয়ে বলল, কী বলেছে তায়শা?
-বলেছে তোমার নামে যা শুনেছি সব সত্য। আর তোমার জন্য সে ভুক্তভোগী। বিশ্বাস না হলে উনাকেই জিজ্ঞাসা করো।
.
বুশরা চোখের পানি লুকোনোর চেষ্টায় আছে।
নিহির মুচকি হেসে বলল, আপনি যা বলছেন সবই সত্য। কিন্তু আপনি যা করেছেন তা কী ঠিক হয়েছে? অন্য জনের কথার উপরে ভিত্তি করে বিয়ে করে নিয়েছেন?
-আমি যা করেছি রাগের মাথায়। এখন তা সংশোধন করতে চাচ্ছি।
.
বুশরা ক্ষীণস্বরে বলল, আসলেই বিয়েটা করেছ তুমি?
.
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে নওয়াজ বলল-
হুম। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তানিশাকে ডিভোর্স দেওয়ার। সেও মেনে নিয়েছে।
– ডিভোর্স কেনো?
-তোমাকে বিয়ে করব।
.
এইবার তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বুশরা বলল, আমি কেনো এমন একজন পুরুষকে বিয়ে করতে যাব? যে কি না ইচ্ছে হলেই বিয়ে করে আর বিয়ে ভাঙার মতো সিদ্ধান্ত নেয়!
-কারণ তুমি আমাকে ভালোবাসো।
-যেদিন আমাকে নষ্টা বলতেও তোমার মুখে বাধেনি, সেদিন থেকে ভালোবাসাও চলে গেছে।
.
এইবার নিহির উঠে বলল, আমি আসি। আপনারা কথা বলুন।
.
বুশরাও দাঁড়িয়ে বলল, আমার আর কোনো কথা নেই।
-বুশরা আমি তোমার জন্য তানিশাকে ছাড়ব!
-ছাড়লেও আমি ফিরে আসব না।
-কেনো?
-কারণ বিয়েটা তুমি ওকেই করেছ। গ্যারান্টি কী? দু’দিন পর আর কারো কথা শুনে আমাকেও ছাড়তে চায়বে না তুমি? মাথার উপর মা বাবার ছায়া নেই বলে যা খুশি করতে পারো না তোমরা আমার সাথে।
.
এই বলে হনহনিয়ে বেরিয়ে যায় বুশরা। তার পিছু নেয় নিহির। সে বলল, আপনি সত্যিই তাকে ভালোবাসেন না?
-নাহ৷ যদিও তার ফোন পেয়ে আমি আবারও নরম হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার এমন সিদ্ধান্ত শুনে ঘৃণা জন্ম নিয়েছে। মানলাম সে ভুল করেছে। তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিতো। তাই বলে বউ ছেড়ে দেবে! ছেলে খেলা বিয়ে? মেয়েটার মনটা নিয়ে একবারও ভাবলো না সে!
.
ঝাঝালো কণ্ঠে কথাগুলো বলল বুশরা। নিহির বলল, শান্ত হোন। চলুন বাড়ি পৌঁছে দিই আপনাকে।
.
এদিকে নওয়াজ বেশ ক্ষেপে যায়। সে ভেবেছিল বুশরাকে বলার সাথে সাথেই রাজি হয়ে যাবে। কিন্তু হলো না কেনো! বড়োলোকের বাড়িতে থেকে কী তার নজরটাও বড়ো হয়ে গেছে?
.
.
বুশরা ভেতরে এসে আলিয়া খাতুন ও নাফিশাকে দেখে চমকে উঠে। আলিয়া খাতুন সেনোয়ারা বেগমের সাথে কথা বলছিলেন। বুশরাকে দেখে তার কাছে এসে বুকে টেনে নিয়ে কান্নার অভিনয় করতে লাগলেন। বেচারি বুশরা তা সত্য মনে করে বলল, কিছু হয়েছে?
.
তাকে ছেড়ে আলিয়া খাতুন বললেন, তোকে ছাড়া ভালো লাগে না রে মা৷ যখন তোর খোঁজ পেলাম আর ছুটে না এসে পারলাম না। যা করেছি তার জন্য ক্ষমা চাইছি। বাড়ি ফিরে চল মা।
.
নাফিশা মা এর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কীভাবে এত নিখুঁত অভিনয় করতে পারে তার মা!
বুশরা নিহিরের দিকে তাকায়। নিহির বলল, আপনার যা মনে চায় করুন।
.
বুশরা ভাবে ওই বাড়িতে আর যাবে না। কিন্তু আলিয়া খাতুন তাকে অবাক করে বললেন, তোর বাবা আসবে দেশে। এসে তোকে না দেখলে তার খারাপ লাগবে না? তোর জন্যই আসবে সে।
.
একথাটি শুনে আনন্দে বুশরার চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে। প্রথমবার সে তার বাবাকে দেখতে চলেছে।
.
বুশরা আলিয়া খাতুনকে বসতে বলে বলল, আমি ব্যাগ গুছিয়ে আসছি।
.
ওই বাড়িতে আর যাবে না ভেবেছিল বুশরা। কিন্তু বাবা আসবে শুনে নিজেকে আঁটকে রাখতে পারছে না সে। জলদি ব্যাগ গুছিয়ে নেয়। সে ফাহমিদা বেগমের রুমে আসলো। তিনি ঘুমোচ্ছেন। বুশরা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে তার। নিঃশব্দে রুমের বাইরে আসে। নিখিল বাসায় নেই। দেখা হলো না। নিহিরকে দেখে তাকে বলল, কষ্ট দিয়ে থাকলে ক্ষমা করে দেবেন।
.
নিহির তার দিকে একটি প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল, আপনার বেতন?
-এখন বাড়ি যাচ্ছি। আমার বাবাও আসবে। এটার প্রয়োজন নেই।
-বাবার সাথে প্রথমবার দেখা না?
-জি।
-তার জন্য কিছু নেবেন।
.
এটা বলাতে বুশরা প্যাকেট টা নেয়। নিহিরকে ধন্যবাদ দিয়ে তার সাথে নিচে নেমে আসে। এসে দেখলো আলিয়া খাতুন সেনোয়ারা বেগমকে বলছেন, দেখুন বুশরাও আমার ঘরের মেয়ে। তায়শাকে বাদ দিয়ে ওকে বিয়ে করা আপনার ছেলের ঠিক হবে? তায়শা নাহয় ভুল করেছে। ছোট মানুষ সে। ক্ষমা করে দিলেই হয়।
.
নিহির বলল, সব ভুলের ক্ষমা হয় না। এই বিষয়ে আর কথা বলবেন না আন্টি।
.
আলিয়া খাতুন কথা না বাড়িয়ে বুশরাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তবে নিহির ড্রাইভার কে বলে তাদের গাড়ি করে পাঠানোর ব্যবস্থা করলো। পথিমধ্যে বুশরা শপিংমল এ নেমে বাবার জন্য কেনাকাটা করলো। দেখলো, বেতনের চেয়েও দ্বিগুন টাকা এতে রয়েছে। সে হেসে সবার জন্যই কিছু কেনাকাটা করে বাসায় ফিরলো।
আলিয়া খাতুন বাসায় এসেই তায়শাকে ডাকলো। সে আসলে বলল, ধর প্যাকেট। তোর বোনের হবু জামাই এর টাকাতে তোর উপহার।
.
বুশরা কিছু না বলে ভেতরে চলে যায়। তায়শা রেগেমেগে বলল, নিহিরের টাকায়?
-হুম।
.
সে নিজেকে শান্ত করতে না পেরে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যায়। ভাবলো নিহিরের সাথে শেষ বারের মতো দেখা করা উচিত। পথে তার দেখা হয় নওয়াজের সঙ্গে। নওয়াজ তাকে দেখেই বলল, তোমার জন্য বুশরাকে হারিয়েছি আমি। ও এতটাই রেগে আছে যে তানিশাকে ডিভোর্স দেব বলেছি তাও মানছে না।
.
তায়শা অবাক হয়ে বলল, তানিশাকে ডিভোর্স দিতে চান আপনি?
-হুম। বুশরার জন্য।
.
তায়শা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, রাজি হবে কেনো? রাজা বিয়ে করতে চলেছে সে। আমার হবু বরকে নিজের বর বানিয়ে নিচ্ছে।
-মানে?
-ওতশত বোঝাতে গেলে অনেক কথা। সত্যিকারে ভালোবাসলে বিয়েটা আটকান। চোখের সামনে নিহিরকে আর কেউ বিয়ে করুক আমি মানতে পারব না।
-আমাকে সবটা খুলে বলো।
.
তায়শা সব বলার পর নওয়াজ বলল, তুমি আরেকটাবার নিহিরকে রাজি করার চেষ্টা করো। আর আমি বুশরাকে।
-যদি রাজি না হয়?
-তবে আমরা প্ল্যান বি করব।
.
এই বলে রহস্যময় এক হাসি দেয় নওয়াজ। তায়শাও তাকে সাহায্য করবে সিদ্ধান্ত নেয়।
.
.
নিখিল বাড়ি ফিরে জানতে পারলো, বুশরা চলে গেছে। তার মনটা বেশ খারাপ হলো। যাওয়ার আগে মেয়েটির সাথে দেখা হলো না।
এদিকে ফাহমিদা বেগম বুশরা বলতে বলতে অস্থির হয়ে যাচ্ছেন। তাকে সামলানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে দীপ্তির। সে হতাশ হয়ে বলল, কেনো যে বুশরা চলে গেল।
.
অনেকদিন পর আজ রান্নাঘরে আসলেন সেনোয়ারা বেগম। বুশরা থাকাকালীন তিনি রান্না করাই ভুলে গেছেন। প্রথমে বুশরার রান্না করাটা তিনি পছন্দ না করলেও তার রান্নার প্রেমে পড়ে চুপ ছিলেন। বুশরার রান্না তার বেশ ভালো লাগতো। তাই এতদিন রান্নাঘরে তাকে আসতে হয়নি। মেয়েটাকে মনে পড়ছে তার। অনেক খারাপ ব্যবহার করতো তার সাথে।
.
এদিকে নিহির নিজেকে নিয়ে নিজেই চিন্তিত। তায়শাকে সে ভালোবাসতো। তাকে জীবন থেকে ছুড়ে ফেলেও এতটা খারাপ লাগেনি, যতটা খারাপ বুশরা চলে যাওয়াতে লাগছে। তার এমনটা লাগছে কেনো!
.
সে ফোন থেকে গতকাল অনুষ্ঠানের বুশরার একটি ছবি বের করে দেখতে থাকে। নিখিল এসেছে ভাই এর সাথে কথা বলতে। ভাই বুশরার ছবি দেখছে বলে কিছু বলল না। চুপচাপ নিজের রুমে চলে আসে। ভাই এরও নিশ্চয় মনে পড়ছে তাকে। তবে তাকে যেতে দিলো কেনো। নিখিল থাকলে নিশ্চয় আটকাতো। এতকিছুর পর ওই বাড়িতে যাওয়াটা ঠিক হয়নি।
.
নিহিরের খুব ইচ্ছে হচ্ছে বুশরার সাথে কথা বলতে। কিন্তু তার কাছে ফোন নেই। তাই নিহির ভাবলো একটি ফোন পাঠানো যায় বুশরার কাছে। মেয়েটির প্রয়োজনেও কাজে দেবে। সেও কথা বলতে পারবে। এই ভেবে সে তার ড্রয়ার থেকে একটি ফোন বের করে। এটি সে নিয়েছে কিছুদিন আগেই। কিন্তু ব্যবহার করা হয়নি। সেখানে একটি সিমও দেয় নিহির। এরপর খালেকুজ্জামান কে ডেকে বলল, এটি বুশরাকে দিয়ে আসুন।
.
.
বুশরা তার কাপড়চোপড় গোছাতে ব্যস্ত ছিল। আজ সে তায়শাদের রুমে আসেনি। অন্য একটি রুমে নিজে থাকবে বলে ঠিক করেছে। আলিয়াও বাধা দেয়নি।
হঠাৎ আলিয়ার ডাক শুনতে পায় সে। ছুটে আসতেই খালেকুজ্জামান কে দেখলো। বুশরা সালাম দিতেই তিনি মোবাইল এর প্যাকেট টা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এটা স্যার আপনার জন্য দিয়েছে।
.
সাথে হরেক রকমের নাস্তাও ছিল। ওসব টেবিলে রাখেন তিনি। কিন্তু বুশরা বলার পরেও বসলেন না। কাজ আছে বলে চলে গেলেন।
তায়শা আর নাফিশাও এলো। নিহির বুশরার জন্য মোবাইল পাঠিয়েছে দেখে তায়শা রাগে ফুলতে থাকলো।
আলিয়া খাতুন ভ্রু কুচকে বললেন, আগে তায়শার উছিলায় এই দামি নাস্তা খেতাম এখন তোর উছিলায় খাব? হায়রে নিয়তি!
.
বুশরা কিছু না বলে নিজের রুমে আসে।
তায়শা তার মা কে বলল, তুমি ওর সাথে কোনো ধরনের খারাপ ব্যবহার করছ না কেনো?
-মাত্র তো এলো। সবুর কর। আমার মাথায় সব আছে। কীভাবে একে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাই দেখ তুই।
.
নাফিশা বলল, কেনো তোমরা এসব করবা? বুশরা আপির দোষ কোথায়?
.
তায়শা বলল, সে নিহিরকে বিয়ে করবে এটাই তার দোষ।
.
এই বলে সে বুশরার রুমের দিকে যায়। দেখলো বুশরা ফোনে কথা বলছে। সে আড়ি পেতে শুনতে থাকে।
-আপনি আবার কষ্ট করতে গেলেন কেনো?
.
নিহির তার কণ্ঠস্বর শুনেই যেন মনে শান্তি পেল। সে বলল, আপনার এটা প্রয়োজন মনে হলো। তাছাড়া মা এর আপনাকে দরকার হলে আসতে হবে এখানে। আমার খবর দিতে হবে না?
.
বুশরা হেসে বলল, নিশ্চয় আসব।
.
তায়শার মোটেও এসব ভালো লাগছে না। সে আপনমনে বলল, তুই যাকে খুশি বিয়ে কর আপি। আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তুই নিহিরকে বিয়ে করতে পারবি না। কিছুতেই না। এটা আমিই হতে দেব না। পেলে নিহিরকে আমি পাব। নতুবা কেউ না!
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here