#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_২৬
#Saji_Afroz
নিহিরের এই কাজে মেহমানরা খুশি হলেও তার পরিবার, তায়শা, নাফিশা ও বুশরা বেশ অবাক হয়।
বুশরা নিহিরের কাছ থেকে নিজের হাতটি সরিয়ে নেয়। কিন্তু নিহির আবার তার হাত ধরে সবার সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকে। বুশরা কী করবে ভেবে পায় না। সে তায়শার দিকে তাকায়। তায়শার দু-চোখ ছলছল করছে। যেটা দেখে নিখিল মজা পেলেও ভাই এর ব্যাপারটা সে বুঝলো না। তায়শার নাম না বলে তার ভাই বুশরার নাম কেনো বলল?
সেনোয়ারা বেগমের বুশরাকে পছন্দ নয়। তার মধ্যে হুট করে এমন একটা কাণ্ড তিনি মেনে নিতে পারছেন না। তিনি তায়শার হাত ধরে টেনে তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। তাদের পিছু নেয় নাফিশা।
রুমে এসে তিনি তায়শাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে বললেন, কী করছ তুমি? কী এমন করেছ যার কারণে নিহির ওই কাজের মেয়েকে বিয়ে করতে চাচ্ছে? কেনো সে তোমার নাম বলেনি?
.
এমনিতেই তায়শার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। তার উপরে সেনোয়ারা বেগমের এমন ব্যবহার সে সহ্য করতে পারলো না। সে প্রায় চেঁচিয়ে বলল, প্রশ্নটা আমি করব। আমাকে আপনারা রিং পরিয়ে এসেছেন। আজ বিয়ের এনাউন্সমেন্ট হওয়ার কথা। সেখানে নিহির অন্য একটা মেয়েকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। আপনারা কেনো এমনটা করলেন আমার সাথে?
.
তায়শা যে চুপ থাকার পাত্রী নয় এটা বুঝেছেন সেনোয়ারা বেগম। বাসায় অনেক মেহমান। তাই তিনি এখন কোনো ধরনের ঝামেলা করতে চান না। তায়শা বলল, আমি এখুনি সবার সামনেই ওকে জিজ্ঞেস করব।
.
তাকে থামিয়ে সেনোয়ারা বেগম বললেন, এমনটা করোনা। এখানে বসো। সবাই চলে যাক। আমি সহ প্রশ্ন করব ওকে। কেনো সে এমনটা করলো আমারও জানতে হবে।
.
এই বলে তিনি রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
তায়শা নাফিশাকে বলল, আমার মনেহচ্ছে এসব বুশরা করেছে। সেই নিহিরকে সব বলে দিয়েছে।
-আপি বলার সময় কোথায় পেয়েছে? একসাথেই তো নামলাম আমরা।
-তাহলে নিখিল?
-হতে পারে। আগেই বলেছিলাম চলে যাই। সত্য কখনো চাপা থাকেনা।
-সত্য সামনে এসেও নিহিরের আমাকেই বিয়ে করতে হবে। কারণ এনাউন্সমেন্ট যাকে নিয়েই করুক না কেনো, রিং সে আমাকেই পরিয়েছে।
তাই আমি ওর হবু বউ।
.
.
ডিনার শেষে ধীরেধীরে সব মেহমান চলে যায়। বুশরা এক জায়গায় নিশ্চুপ হয়ে বসে ছিল। কী হয়েছে, কেনো হয়েছে কিছুই তার বোধগম্য নয়। শুধু সে জানে, যা হয়েছে ভালো হয়নি।
মেহমান যেতেই সেনোয়ারা বেগম সোজা বুশরার সামনে এসে দাড়ালেন। বুশরা বসা থেকে উঠে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। সেনোয়ারা বেগম বললেন, জাদু টোনা এসবে আমি বিশ্বাস করি না। তবে তোমার কী এমন আছে যার মোহে পড়ে নিহির তায়শার মতো মেয়েকে ছেড়ে তোমাকে বিয়ে করতে চায়ছে?
.
বুশরা কিছু না বললে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন। যার শব্দ শুনে সেখানে উপস্থিত হয় তায়শা ও নাফিশাও।
বুশরা কাঁপাস্বরে বলল, আমি কিছু জানিনা। স্যারকে জিজ্ঞাসা করুন।
.
নিখিল ভাইকে জিজ্ঞাসা করলো, ভাইয়া? তাহরিমার নাম কেনো নাওনি তুমি?
-যাকে বিয়ে করব তার নামই তো নিলাম।
.
সেনোয়ারা বেগম বললেন, একজন কে রিং পরিয়ে আরেকজনকে বিয়ে করার ইচ্ছেটা কেনো হলো শুনি?
.
নিহির কিছু বলার আগেই তায়শা বলে উঠলো, এত ভালোবাসা সব মিথ্যে ছিল? আমি সবটা উজাড় করে তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। কে কী বলল না বলল এসব শুনে তুমি আমাকে ভুল বুঝবে?
-কীভাবে বুঝলে কেউ আমাকে কিছু বলেছে?
.
তায়শা নাফিশার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখেছিস? আমি বললাম না কেউ নিহিরের কান ভারী করেছে। আর এটা কেউ নয়। তার ভাই নিখিল।
.
সেনোয়ারা বেগম ভ্রু কুচকে বললেন, কীসব বলছ তুমি?
-ঠিকই বলছি। জিজ্ঞেস করুন আপনার ছেলেকে, আমার নামে সে উল্টাপাল্টা কী বলেছে নিহিরকে?
.
নিখিল বলল, ভাইয়া সে কিন্তু অহেতুক আমাকে দোষারোপ করছে।
-চোরের কাজই এটা। অন্যের উপর দোষ চাপানো।
..
তায়শা কিছু বলতে যাবে তখনি নিহির বলল, আমাকে কেউ কিছু বলেনি। আমি সবটা নিজের কানে শুনেছি আড়াল থেকে। নিখিল যখন তোমাকে ডাকতে যায়, আমি ওর পিছনে যাই তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে। আর তখনি ওসব শুনে ফেলি। না শুনলে হয়তো বাকিটা জীবন আমায় আফসোস করতে হত। আর সব শুনে আমি তোমাকেই বিয়েটা করব? অসম্ভব।
.
তায়শা ভেবেছিল নিহির নিখিলের কাছ থেকে কিছু শুনেছে। নিখিলের নামে আজেবাজে বলে সে পার পাবে ভেবেছিল। কিন্তু এমনটা হলো না। এইবার কী করবে সে!
নিহির তায়শার কাছে এসে বলল-
যে মেয়ে নিজেকে অন্যের কাছে ভালো রাখার জন্য বোনের নামে উল্টাপাল্টা বলে, দামি দামি উপহারের জন্য একটা ছেলের সাথে ভালোবাসার নাটক করে। তার সম্পর্কে সবটা জেনেও কীভাবে তাকে বিয়ে করব আমি?
-দেখো বুশরা আপিকে নিয়ে যা বলেছি ওসব আমার ভুল মানলাম। কিন্তু তোমার ভাই নিখিল ধোয়া তুলসি পাতা না। সে আমাকে বলেছে সব কিছুর মালিক সে। মানে তার বাবার ছিল। তুমি না কি সব আত্মসাৎ করেছ। দরকার হলে সে তোমাকে খুন করবে। তবুও সব ফিরিয়ে নেবে।
আমি ভাবলাম যেখানে দুই ভাই এর মধ্যে ঝামেলা, সেখানে নিজেকে ঠেলে লাভ কী? এসব ঝামেলায় নিজেকে জড়াতে চাইনি বলে নিখিলের লাইফে আমি আসিনি।
.
এসব শুনে নিখিল হাসলেও সেনোয়ারা বেগম বলে উঠলেন, এসব কী বলছে এই মেয়ে! আমার ছেলের নামে এসব কেনো বলছে!
-আপনার ছেলের সাথে আমার আগে কথা হত। তখনকার কথা বলছি আমি। তখন জানতাম না নিখিলের সেই ভাইটাই হলো নিহির।
.
নিহির বলল, এখন তো জানলে। এখনো আমায় বিয়ে করতে চাও?
-হু। কারণ সে সব মিথ্যে বলেছিল। আসল মালিক তো তুমিই।
-আর তোমার মূল লক্ষ্য এটাই। তাইতো?
-কীসব বলছ? আমি ভালোবাসি তোমাকে।
.
এইবার খানিকটা রেগে নিহির বলল
-চুপ! একদম চুপ৷ নিখিল তোমাকে ওসব বলেনি। বরং সব সত্যিটা বলেছে। সত্য শুনে তোমার মনে হয়েছে, তোমার শখ পূরণ এ সে কম হয়ে যাচ্ছে। আর তাই তুমি ওর জীবনে আসোনি। এটাই সত্য।
-এটা সত্য না।
-তুমি কী যাবে? না কি দারোয়ান ডাকতে বাধ্য হব?
.
এইবার নাফিশা বোনকে তার সাথে যেতে বলল। সে রাজি না হলে তাকে জোর করে টেনে বের করলো।
সেনোয়ারা বেগম বারবার প্রশ্ন করার কারণে দুই ভাই মিলে শুরু থেকে সবটা খুলে বলল তাকে। এইবার তিনি বুঝতে পারলেন বুশরা এখানে কেনো এসেছে। তিনি সব শুনে অবাক হয়ে বললেন, আমার ছেলেদের জন্য এই মেয়ের এমন দশা। তারপরেও আমার খারাপ ব্যবহারে সে টু শব্দটা করেনি। এত ভালো মেয়েটাকে এতদিন ভুল বুঝতাম আমি!
.
নিহির বলল, আমাদের ভুলের জন্যই সে বাড়ি ছাড়া। তাই তাকে এখানে এনেছি। আর আমি না জেনেই একই মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছি। সব জেনে বুশরাকে বিয়ে করার মতো মিথ্যে কথা আমি ইচ্ছে করেই বলেছি। যাতে করে তায়শা মানুষকে ঠকানোর কষ্টটা বুঝতে পারে।
.
নিহির এসে তার এই কাজের জন্য বুশরার কাছে ক্ষমা চায়। সাথে তায়শা যে এতদিন তার নামে কী কী বলেছিল সবটা জানায়। বুশরা চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, এতদিন জানতাম ওই দুইটা বোনই আমার আপনজন। শেষমেশ তায়শা এসব করলো! আসলেই আমার হয়তো এই দুনিয়াতে আপন বলতে কেউ নেই, হবেও না।
.
.
নাসরিন আক্তার তানিশাকে ঘরে আনার কথা বললেন নওয়াজকে। তা শুনে নওয়াজ বলল, তানিশাকে ঘরে আনব কেনো?
-যা হয়েছে এতে নাসিমা বেশ ক্ষেপে গেছে। সে চায় অনুষ্ঠানের আগেই তানিশা এই বাড়ি আসুক।
-তানিশা কী চায়?
-ওর মা যেটা চায়বে সেটা ও চায়বে না?
-নাহ। ও কী চায় বলেই তো গেল। তানিশা আর আমার চাওয়া একই।
-কী?
-ডিভোর্স।
.
নাসরিন আক্তার নিজেকে শান্ত করে বললেন, নওয়াজ মাথা ঠান্ডা করে ভাব। বিয়ে সাদি এসব ছেলে খেলা না। আল্লাহ এর কালাম পড়ে তুই ওকে বিয়ে করেছিস।
-বিয়ে করার যেমন নিয়ম আছে, ছাড়ারও নিয়ম আছে। তখন মাথা গরম করে এসব করেছিলাম, এখন যা করছি তা ঠান্ডা মাথায়। উকিলের সাথে কথা বলেছি ডিভোর্স নিয়ে। একটু পর তানিশার সাথেও বলব।
-মেয়েটার এতবড়ো সর্বনাশ তুই করিস না।
-তুমি যতটা ভাবছ মা, সে ততটা ভাবছে না। এই ডিভোর্স তো হবেই।
.
.
তায়শা ও নাফিশা বাড়ি আসতেই তাদের দিকে এগিয়ে এলেন আলিয়া খাতুন। তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, আমাদের জন্য কেক মিষ্টি দেয়নি?
.
তাদের হাত খালি দেখে তিনি বিরক্তি নিয়ে বললেন- এতবড়ো লোক তারা। বিয়াই গুষ্টির জন্য এইরকম অনুষ্ঠানে কিছু পাঠাতে হয়। দাওয়াত দিলো না মানলাম। অন্তত কিছু পাঠাবে তো!
.
তায়শা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, এদিকে আমার সব শেষ হয়ে গেছে আর সে পড়ে আছে মিষ্টি নিয়ে!
.
এই বলে সে রাগে গিজগিজ করতে করতে ভেতরে চলে যায়। আলিয়া খাতুন চমকে উঠে বললেন, কী হয়েছে রে নাফিশা?
.
নাফিশার মুখে সবটা শুনে তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে উঠলেন, হায় হায় রে! আবার কী হয়ে গেল এটা! বিয়ে আবারও ভেঙে গেল এই ভাঙা কপাল ওয়ালী মেয়ের!
.
.
ফাহমিদা বেগমকে খিচুড়ি খাইয়ে দিচ্ছে বুশরা। এমন সময় তার কাছে নিখিল আসলো। সে বলল, ভাইয়া যদি আজ সত্যি তোমাকে বিয়ে করতে চাইতো তবে তুমি কী রাজি হতে?
.
বুশরা হেসে বলল, স্যারের মাথা কোনদিকে খারাপ হবে যে আমায় বিয়ে করতে চায়বেন?
-যদি চায়?
-প্রশ্নই উঠেনা। তাই ওসব নিয়ে আমি ভাবতেও চাইনা।
.
একটু থেমে নিখিল বলল, দুই বোনের মাঝে কত তফাত তোমাদের। হয়তো একই মা এর পেটের বোন না বলে।
.
বুশরা কিছু বলল না। নিখিল ভেবেছিল তায়শাকে নিয়ে মনের ক্ষোভ সে প্রকাশ করবে। কিন্তু এমনটা না করাই নিখিল বেশ অবাক হয়। এই মেয়েটা কী কাউকে নিয়ে খারাপ কথা বলতে পারে না?
.
.
আজ বাসার সবার মন খারাপ। কোনো রান্না যে হবে না এটা ভালো করেই বুঝতে পারলো নাফিশা। তাই সে ফ্রিজে ডিম আছে কি না দেখতে গেল। ডিমও নেই। ডিম, ডাল দিয়ে অন্তত আজকের খাবারটা খেতে হবে। এই ভেবে নাফিশা ডিম কিনতে দোকানে আসে। পথিমধ্যে তার সাথে নওয়াজের দেখা হয়। তাকে দেখেই নওয়াজ বলল, বুশরার কোনো খবর জানো?
-জানি৷ কিন্তু আপনি তো এখন বিবাহিত। তার খবর কেনো নিচ্ছেন?
-দেখো নাফিশা, যা হয়েছে সবটাই তায়শা আর আমার মা এর জন্য। মা আমাকে বুশরার নামে উল্টাপাল্টা বলেছে। ওসব সত্য কি না তায়শাকে জিজ্ঞাসা করি। ও বলল সত্য।
-তায়শা আপু বলেছে?
-হু। এইজন্য তো রাগের বশে বিয়েটা করে ফেলি। এখন আমি ভুল শোধরাতে চাই।
-কীভাবে?
– ডিভোর্স এর মাধ্যমে। তানিশাও সবটা শুনে রাজি। প্লিজ তুমি আমাকে বুশরার ফোন নাম্বারটা দাও।
-দেখুন আপির নাম্বার আমার কাছে নেই। তবে সে যে বাসায় থাকে সেখানের কারও নাম্বার আমি নিয়ে দিতে পারি। আপনি ফোন করে তাকে দিতে বলবেন।
-বেশ। নাম্বার?
-বাসায় গিয়ে তায়শা আপির ফোন থেকে দিচ্ছি। আপনি আমাকে আপনার টা দিন।
.
নওয়াজের নাম্বার নিয়ে বাড়ি ফিরে নাফিশা। এরপর তায়শার ফোন থেকে নিখিলের নাম্বার নিয়ে তাকে মেসেজে পাঠায়।
.
নাম্বার পেতেই নিখিলকে ফোন দেয় নওয়াজ। সে বলল বুশরাকে দিতে। তার পরিচিত কেউ। নিখিল ফোন দেয় বুশরাকে। নওয়াজের কণ্ঠস্বর শুনে সে লাইন কেটে দিতে চাইলেও তার রিকোয়েস্ট এ কাটলো না। নওয়াজ একটাবার তার সাথে দেখা করতে চায়। অনেক জোরাজোরির পর আগামীকাল দেখা করতে রাজি হয় বুশরা।
এদিকে বুশরার বাবা আলিয়া খাতুনকে ফোন করে বকেছেন। তিনি কারও মাধ্যমে জানতে পেরেছেন, বুশরাকে বের করে দিয়েছেন তিনি। বুশরার বাবা হুমকি দিয়েছেন, মেয়েকে বাড়ি ফিরিয়ে না আনলে এই বাড়িতে তাদের জায়গা হবে না এমনকি টাকাও পাঠাবেন না।
সবমিলিয়ে হতাশ হয়ে বসে আছেন আলিয়া খাতুন। সিদ্ধান্ত নেন বুশরাকে ফিরিয়ে আনার জন্য।
এদিকে তায়শা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, সে মহারানী হতে চলেছে। এটা জেনেও তার বাবা ফিরিয়ে আনতে বলেছে?
-ওতকিছু বলেছি না কি! মহারানী হওয়া বের করছি ওর আমি। কালই গিয়ে কানে ধরে নিয়ে আসব বাড়িতে।
-দেখো আসে কি না!
.
চলবে