#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_২৫
#Saji_Afroz
নিখিলকে দেখেই চোখ জোড়া বড়ো হয়ে গেল তায়শার। তার মানে বুশরা ঠিকই বলছে! এটা নিখিলেরও বাড়ি!
সে নিজেকে নিখিলের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে বলল, দেখো প্লিজ উত্তেজিত হবে না।
-উত্তেজিত হব না? ওকে হলাম না। শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করছি, তুমি এইখানে কেনো?
.
তায়শা আমতাআমতা করে বলল, আমি এখানে… আসলে আমি এখানে বুশরা আপির সাথে দেখা করতে এসেছি।
.
তার কথা শুনে নাফিশা ও বুশরা একে অপরের দিকে তাকালো। তায়শা আরও বলল, জানতে পারলাম ও এখানে আছে৷ তাই দেখা করতে এলাম।
.
নিখিল এক মুহুর্তের জন্য এটা সত্যি ভাবলেও পরক্ষণেই তার মনে পড়ে, এই রুমে ভাই এর হবু বউ থাকার কথা। কোনোভাবে সেই মেয়ের সাথে তায়শার সম্পর্ক নেই তো?
বুশরার কাছে এসে তাকে নিখিল বলল, তোমরা এখানে কী করছ?
-স্যার এখানে বসতে বলেছে।
-কিন্তু এখানে তাহরিমা ভাবী থাকার কথা।
.
নিখিল নাফিশাকে চেনেনা বিধায় তার দিকে তাকায়। ভাবে এটাই কী তাহরিমা? বুশরা বলল, তাহরিমাও আছে এখানে।
.
নিখিল ভাবলো নাফিশাই হয়তো তাহরিমা। এদিকে তায়শা ইশারায় বুশরাকে সত্যিটা জানাতে নিষেধ করছে। কিন্তু নিখিল যখন নাফিশাকে দেখে ফিক করে হেসে বলল, ভাবী তো দেখি পিচ্চি!
তখনি বুশরা তায়শাকে উপেক্ষা করে বলল, ভাবী ঠিকই আছে। যাকে ভাবী ভাবছ সে তো তোমার ভাবী নয়।
.
এইবার বিস্ময়ভরা চোখে বুশরার দিকে তাকিয়ে নিখিল বলল, মানে?
.
বুশরা একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো। এই মুহুর্তে তার সত্য উপস্থাপন করা উচিত, এটাই ভাবলো সে। কারণ তায়শা বুঝছে না, এই সময়ে মিথ্যে বললে হিতে বিপরীত হবে। তার চেয়ে সত্যিটা বলে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার সময় চলে এসেছে তার।
বুশরার তায়শার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, তায়শা হলো তাহরিমা।
.
এটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না নিখিল। সে তায়শার দিকে অবাক হয়ে তাকায়। নিজেকে একটু সময় দিয়ে শান্ত হয়ে নেয় সে। এরপর তায়শার কাছে এসে রাগে গিজগিজ করতে করতে বলল, আমার ভাইকে পটাতে তোমার লজ্জা করেনাই?
.
তায়শাও নিজেকে স্বাভাবিক করে উঁচু গলায় বলল, আমি জানতাম না নিহির তোমার ভাই। তাছাড়া আমি পটাইনি। সে আমার জন্যে পাগল হয়ে গেছে।
-পাগল তো আমিও হয়েছিলাম। আমার সাথে এতটুকু সম্পর্ক তো গড়ায়নি তোমার!
-কারণ আমাদেরটা ভালোবাসা ছিল না। শুধুমাত্র কথাবার্তা বললে, চ্যাট করলে, ঘুরতে গেলে ভালোবাসা হয়ে যায়?
-কীভাবে হয়?
-ভালোবাসা হয় মন থেকে।
.
নিখিল উচ্চশব্দে হেসে বলল, মন থেকে? না কি ভাইয়া আমার থেকেও দামী গিফট দিতে পারে বলে?
.
এইবার হকচকিয়ে উঠলো তায়শা। নাফিশা ভয়ে বুশরার হাত চেপে ধরেছে। জানেনা কী হতে চলেছে!
তায়শা কিছু বলার আগেই নিখিল বুশরাকে বলল, ভাইয়া জানে কিছু? নিশ্চয় জানেনা।
.
বুশরা বলল, উনি জেনে এটা করতেন কখনো?
.
তায়শা বলল, আমিই জানিনা সে কীভাবে জানবে?
.
নিখিল মুচকি হেসে বলল, তোমার কী মনেহয়? সবটা জেনে ভাইয়া তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে?
তায়শা বলল, হবে। কারণ সে আমাকে অনেক ভালোবাসে।
-বিষয়টা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছ তুমি?
-ভালোবাসার জোরে বলছি।
-ওকে। তবে চলো।
.
এই বলে নিখিল পা বাড়ায়।
এইবার চিন্তায় পড়ে যায় তায়শা। সে টা বললেও জানে, নিহির জেনে দূরে সরে যাবে। তাই দ্রুত মাথায় বুদ্ধি খাটিয়ে নিখিলকে থামিয়ে তায়শা বলল-
বলার আগে কিছু বিষয় ভেবে নাও। সে যদি সবটা জেনেও আমায় বিয়ে করতে চায় তবে তোমাদের সম্পর্কে দেয়াল সৃষ্টি হবে। আর যদি না করতে চায় তবে তার মন ভাঙবে। শুনেছি সে কখনো প্রেমে পড়েনি। তোমার জন্য হয়তো ভালোবাসা ত্যাগ করবে। কিন্তু তার মনে তো আমি রয়েই যাব। আমি নাহয় ধন-সম্পত্তির জন্য ভালোবেসেছি। কিন্তু সে? সে মন থেকেই বেসেছে৷ এটা তো মানো?
.
তায়শার কথা গুলো হজম করতে নিখিলের মিনিট খানেক সময় লাগে। এবং সে এটাই বুঝতে পারে, তায়শা ভুল কিছু বলছে না। সব জানার পরেও ভাই যদি তায়শাকে বিয়ে করে নেয়, এতে সে কষ্ট পাবে। আবার যদি বিয়েটা না করে ভাই কষ্ট পাবে। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সেই ভাইটাই মাথার উপর ছায়া হয়ে আছে। আর তাকে কী না সে কষ্ট দেবে শুধুমাত্র তায়শাকে সে ভালোবাসতো বলে?
তায়শাকে নিখিলের পছন্দ নয়। তার স্বভাব সম্পর্কে অবগত সে। কিন্তু সে যা চায় সবই নিহিরের মাঝে আছে। তাই নিহিরকে সে কষ্ট দেবে না এই ব্যাপারে নিশ্চিত সে। রাগের বশে ভাইকে কিছু না জানানোই ভালো হবে।
এই ভেবে নিখিল বুশরাকে বলল, ওদের নিয়ে নিচে নেমে এসো। কেক কাটার সময় হয়েছে আর সময় হয়েছে নিহির ভাই ও তাহরিমার বিয়ের এনাউন্সমেন্ট এর।
.
এই বলে নিখিল চলে যায়। নাফিশা এসে তায়শাকে বলল, তুই এটা ঠিক করছিস না আপু। চল এখান থেকে। একদিন না একদিন সত্যিটা নিহির ভাই জানবে।
-বিয়ের আগে না জানলেই হলো। পরে সবটা সামলে নেব আমি৷ বিয়েটা একবার হতে দে।
.
এই বলে বুশরার সামনে এসে তায়শা বলল, তখন নিষেধ করার পরেও সত্যটা বলে দিয়েছ। এখন কী নিহিরকেও বলে দেবে?
-সত্যিটা তুই সস্তা মিথ্যে দিয়ে লুকোতি কীভাবে? তখন সত্য বলা প্রয়োজন ছিল। আর এখন নিখিল সব জানে। তাই নিহির স্যারকে আমার কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
.
তায়শা জড়িয়ে ধরতে চায় বুশরাকে। তাকে বাধা দিয়ে বুশরা বলল, ফুফু নিশ্চয় আমার থেকে দূরে থাকতে বলেছে?
-কীভাবে বুঝলি?
-আচরণে। যাই হোক নিচে চল।
.
.
তানিশার কাছে সবটা শুনে তার মা নাসিমা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। মেয়েকে শান্তবা দেবে না কী বোনকে ফোন দেবেন এই নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়লেন।
তানিশা খুবই কান্নাকাটি করছে। একটামাত্র মেয়ে তার। ওর সাথেই এমনটা হতে হলো!
তিনি তানিশাকে শান্ত হতে বললেও সে অনবরত কাঁদতে থাকে। জানে এই ব্যথার মলম শান্তনা হবে না।
তানিশা নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। নাসিমা বারবার দরজায় নক করলে সে বলল, ভয় পেওনা। আমি একটু একা থাকতে চাই। আর কিছু না।
.
নাসিমা মেয়ের এমন দশা দেখে বোনকে রেগেমেগে ফোন দিলেন। নাসরিন আক্তার ফোন রিসিভ করে কাঁপাস্বরে বললেন, হ্যালো?
.
এপাশ থেকে নাসিমা চেঁচিয়ে বললেন, বাইরের কেউ এমনটা করলে মেনে নিতাম আমি। কিন্তু তোরা আমার মেয়ের সাথে এটা কীভাবে করতে পারলি?
-নাসিমা তুই শান্ত হও।
-তুই না আমার বড়ো বোন? আমাকে সব জানাতে পারতি? এইভাবে ছোট বোনকে ঠকালি! আরে তোর কাছে একমাত্র মেয়েটাকে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকব ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন আমার মাথায় চিন্তার পাহাড় ফেলে দিলি। মেয়েটা আমার দরজা বন্ধ করে বসে রয়েছে। ওর যদি কিছু হয় তোদের কাউকে আমি ক্ষমা করব?
-তুই গিয়ে মেয়েকে বল আমি সবটা ঠিক করে দেব।
-তোকে এখনো আমি বিশ্বাস করব?
-দেখ নাসিমা, যা হয়েছে ভুল হয়েছে মানলাম। কিন্তু নওয়াজ যে মেয়েকে পছন্দ করতো সে চলে গেছে জানতাম এক ছেলের সাথে। এখন শুনছি এসব সত্য নয়। এতে আমার কী দোষ বল তো? আমি তো নওয়াজ আর তানিশার ভালোর জন্যই সব করলাম। ওই মেয়ের ভরসায় ছেলের জীবন নষ্ট করতাম?
-আমি ওতশত কিছু বুঝি না। নওয়াজ এসে যেন তানিশাকে ঘরে নিয়ে যায়। দরকার নেই কোনো অনুষ্ঠানের। আগে মেয়ে তুলবে পরে অনুষ্ঠান দেখা যাবে। ওর ঘরে ওকে নিয়ে যেতে বল।
-তাই হবে। নওয়াজ অবশ্যই যাবে। তুই শান্ত হো, মেয়েকেও হতে বল।
.
নাসিমা ফোন রেখে মেয়ের দরজার সামনে এসে বললেন, মগের মুল্লুক না কি? বিয়ে হতেই ছাড়াছাড়ি হবে! চৌদ্দ গুষ্টিকে দেখে নেব আমি ওর। বলেছি নওয়াজকে এসে তোকে নিয়ে যেতে। সে আসবেও। না এসে কোথায় যাবে! তোর পা এ ধরে মাফ চেয়ে নিয়ে যাবে তোকে।
.
এদিকে নওয়াজ তানিশাকে ধন্যবাদ আর সাথে দুঃখিত লিখে মেসেজ পাঠিয়েছে। আরও লিখেছে-
জানি যা হয়েছে ভালো হয়নি। কিন্তু আরও বেশি দেরী হওয়ার আগে ডিভোর্সটা হয়ে গেলেই ভালো। মিথ্যে সম্পর্কে তুমিও ভালো থাকবে না। তোমার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই আমি।
.
তানিশা চোখের পানি মুছে নিজেকে শক্ত করে মিনমিনে স্বরে বলল, আমাকে এভাবে ঠকানোর জন্য স্যালুট তোমাকে।
.
.
বুশরার সাথে সাথে তায়শা ও নাফিশা নিচে নেমে এলো। তায়শাকে সাদরে নিজের কাছে টেনে আনলেন সেনোয়ারা বেগম। দুই ভাই এর পাশে তাকে দাঁড়াতে বললেন। এরপর তিনি নিখিলকে কেক কাটতে বললেন। আর সবার উদ্দেশ্যে বললেন, কেক কাটার পরই একটা এনাউন্সমেন্ট করব। যেটা শুনে উপস্থিত সকলে বেশ খুশি হবেন।
.
নিখিল তায়শার দিকে তাকালো। তায়শা জানে, নিখিল কিছু বলবে না। সে নিজেকে চালাক মনে করলেও, প্রকৃতঅর্থে সে খুবই বোকা। এই ভেবে মৃদু হাসলো তায়শা।
নিখিল কেক কাটা শেষ করে মা ও ভাইকে খাওয়ালো। এরপর অনেকেই বলল, এইবার বলুন কী এনাউন্সমেন্ট?
.
সেনোয়ারা বললেন, আমার বড় ছেলে মানে নিহিরের বিয়ে সামনেই।
.
কথাটি বলতেই সকলে করতালি দিয়ে উঠলো। একজন বলল, কে সেই ভাগ্যবতী?
-এখানেই আছে। পরিচয় করিয়ে দেব সবার সাথে।
.
তায়শা খুশিতে দুই বোনকে কাছে ডাকলো। নাফিশা ও বুশরা তার পাশে এসে দাঁড়ায়। বুশরা মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বারবার মনেহচ্ছে নিহিরের সাথে অন্যায় করা হচ্ছে। নিখিল বা সে তাকে কিছু না জানিয়ে কী ঠিক করছে?
.
সেনোয়ারা বেগম আরও কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনি নিহির হাসিমুখে বলল, পরিচয়টা আমি করিয়ে দিই সবার সাথে?
-নিশ্চয়।
.
নিহির তায়শার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। উত্তেজনায় তায়শার হাত-পা কাঁপছে। একটু পরেই সবাই জানবে, সে নিহিরের হবু বউ। এই বাড়ির হবু বউ!
.
তায়শা নিহিরের দিকে হাত বাড়াতে যায়। কিন্তু নিহির এসে আচমকা বুশরার হাত ধরে টেনে তাকে তায়শার পাশ থেকে সরিয়ে কিছুটা সামনে নিয়ে আসে। এরপর সবার উদ্দেশ্যে সে বলল, ও হলো বুশরা। আমার হবু বউ।
.
চলবে