#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_৯
#Saji_Afroz

তায়শা রুমের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। নাফিশা অনেকক্ষণ যাবত তাকে ডেকে চলেছে। কিন্তু সে দরজা খুলতে নারাজ।
আকবর আলী এসে নাফিশা কে বললেন, এত চিল্লানির কী আছে? সে মরে যাবে না। মরে যাওয়ার মেয়েও না সে।
-এসব কী বলছ বাবা? এমন কথা বলতে নেই।
-অনেক কথাই বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু নিজের মেয়ে বলে চুপ করে আছি। অন্যের মেয়ে হলে হয়তো ঘর থেকেই বের করে দিতাম। যেমনটা তোর মা বুশরা কে দিয়েছে।
-মানে?
-বুশরা কে বাড়ি থেকে বের করে দিছে সে। গিয়ে দরজাটা খুলে আয় তোরা। ওর বাপ জানলে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেবে। তখন কী হবে ভেবেছিস? মাথার উপরের ছাদটাও চলে যেতে পারে।
-তুমি এসব নিয়ে ভাবছ? এত রাতে একটা মেয়েকে বের করে দিয়েছে এটা ভাবছ না?
-আরে সব ভাবছি বলেই তো তোদের জানালাম।
.
তায়শা সবটা শুনে দরজা খুলে দেয়। নাফিশা কে বলল, তাড়াতাড়ি চল।
.
তারা দু’বোন ছুটে আসে। কিন্তু দরজা খুলে বুশরা কে দেখতে পায় না। অনেকটা এগিয়েও দেখে তারা। এক পর্যায়ে মাথায় হাত দিয়ে কেঁদে ফেললো তায়শা। আর বলতে লাগলো, এসব আমার জন্য হয়েছে৷ নিজের হাতে সবটা শেষ করে দিয়েছি।
.
নাফিশাও চিন্তিত স্বরে বলল, এত রাতে কই গেল বুশরা আপি!
.
.
রাত প্রায় দু’টো। নিহির ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে শহর ঘুরছে। মন খারাপ থাকলে এমনটা করে সে।
আজ নিখিল ও বাড়ি থেকে আসার পর নিহিরের সাথে একটি কথাই বলেছে শুধু। আর তা হলো, নিজের ভাই না বলে হয়তো কাজটা তেমন গুরুত্ব দিয়ে করোনি তুমি। যদি করতে তবে আজ তায়শা আমার পাশে থাকতো।
.
কথাটি শুনে বুকটা ধুক করে উঠেছিল নিহিরের। তায়শার বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছিল কি না সেটাও সে জানে না। যদি না হয়ে থাকে তাহলে কী আরেকবার সে চেষ্টা করে দেখবে?
ভাবতে ভাবতেই একটি গাছের নিচে চোখ গিয়ে আঁটকায় তার। প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও গাড়ি পিছিয়ে আনে নিহির। গাড়ি থামিয়ে ভালো করে দেখলো সে৷ না এটা মনের ভুল নয়। গাছের নিচে গুটিসুটি মেরে বসে বুশরা।
নিহির বেশ অবাক হয়। তাকে নিখিল কী বাসায় পৌঁছে দেয়নি?
সে ছুটে যায় বুশরার কাছে। বুশরাও তাকে দেখে অবাক হয়। সাথে হয় বিরক্ত। সে বিরক্ত মাখা কণ্ঠে বলল, আপনি?
-আপনি এত রাতে এখানে? নিখিল বাসায় দিয়ে আসেনি আপনাকে?
-এসেছিল। না দিয়ে আসলেও আমার বাসা আমি চিনি।
-তবে আপনি এখানে কেনো?
.
এইবার দাঁড়িয়ে পড়ে বুশরা। সে প্রায় চেঁচিয়ে বলল, আপনার জন্য। আপনার জন্য আমাকে সবাই ভুল বুঝেছে আর তাই ঘর থেকে বের করে দিয়েছে আমায়।
.
নিহির অনেকটা অবাক হয়ে বলল, এত রাতে বের করে দিয়েছে?
-হুম।
-সাথে তায়শা কে দেয়নি? সব দোষ ওর ছিল!
-আমি তো আর তাদের নিজের মেয়ে নই।
-তবে?
-তায়শার মা আমার ফুফু।
-তাই বলেন।
.
দু’জনেই নীরব হয়ে যায়। নিহির নীরবতা ভেঙে বলল, চলুন আপনাকে বাসায় দিয়ে আসি।
-যাব না আর ওই বাসায়।
-কেনো যাবেন না?
-বের করে দিয়েছে বললাম তো।
-তাই বলে কী আর ঢোকাবে না?
-নাহ। আপনি আমার ফুফুকে চেনেন না।
.
আকাশের অবস্থা দেখে ভালো মনে হচ্ছে না নিহিরের। বিদ্যুৎ ও চমকাচ্ছে। সে কিছু একটা ভেবে বলল, আমার সাথে আমার বাসায় চলুন। কাল আপনার ফুফুর কাছে নিজে যাব আমি আপনাকে নিয়ে। দেখবেন কথা বলে সমস্ত রাগ অভিমান সবটা ভেঙে যাবে।
.
এত রাতে বুশরারও এখানে থাকতে ভয় করছে। তাই সে রাজি হয়ে যায় নিহিরের প্রস্তাবে। নিহিরের সাথে গাড়িতে উঠে বসে সে। গন্তব্য এখন নিহিরের বাড়ি!
.
.
বাড়ি ফিরে সে বুশরা কে একটি রুম দেখিয়ে দেয়। বুশরাও চুপচাপ রুমটায় প্রবেশ করে।
বেশ বড়সড় একটা বাড়ি। রুমটাও কী সুন্দর! এদের নিশ্চয় অনেক টাকা। তাই তো টাকার জোরে কিডন্যাপের মতো জঘন্যতম কাজ করতেও ভাবেনি একবার। টাকা থাকলে সবই সম্ভব।
বুশরা ওয়াশরুমে আসে। বেসিনের সামনে থাকা আয়নায় নিজেকে দেখে সে। কেমন ফ্যাকাশে লাগছে তাকে! গয়না গুলো খুলে হাত-মুখ ধুয়ে নেয়। ভারী কাপড় পরাতে ঘেমে ভিজে একাকার হয়ে গেছে সে। ইচ্ছে থাকলেও কাপড় বদলানোর সুযোগ তার নেই। রুমে এসে ফ্যানটা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে লম্বা হয়ে। এতকিছু হয়ে গেছে কিন্তু তার ঘুম আসছে প্রচুর। অথচ আজ তার জেগে থেকে দুঃখ পেয়ে কাঁদার কথা। সে কী অতি দুঃখে শক্ত হয়ে যাচ্ছে?
আর ভাবলো না বুশরা। চোখজোড়া বন্ধ করে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো সে।
.
.
সকালে ভোরে ঘুম থেকে উঠা নিহিরের অভ্যেস। তার চাচীও ভোরে উঠেন নিহিরের জন্য নাস্তা বানানোর উদ্দেশ্যে। আজও এর ব্যতিক্রম হলো না। নিহির ও তার চাচী নাস্তা করতে বসলেন। নিখিল এত সকালে ঘুম থেকে উঠে না। আর নিহিরের মা এর ঠিক নেই। কখনো ভোরে বা কখনো দুপুরেরও পরে উঠেন তিনি।
বুশরার কথা মাথায় আছে নিহিরের। সে এই বাড়িতে আছে তা চাচীকে জানানো হয়নি। কীভাবে জানাবে এটা নিয়ে ভাবনায় মগ্ন সে।
সেনোয়ারা বেগম নিহিরের মা এর জন্য খাবার নিয়ে যায় তার রুমে। কিন্তু তাকে সেখানে পান না তিনি। তাই তাকে আশেপাশে খুঁজতে থাকেন। খুঁজতে খুঁজতে দোতলার একেবারে শেষের দিকের রুমটায় আসেন। দরজাটা খোলাই আছে। তবে তিনি ভেতরে তাকিয়ে যেন বড়সড় একটা ধাক্কা খেলেন। প্রথমে ভেবেছিল মনের ভুল, কিন্তু নয়! বিছানায় শুয়ে আছে একটি মেয়ে। তার মাথার কাছে বসে আছেন ফাহমিদা বেগম। তিনি মেয়েটির তিকে হা করে তাকিয়ে আছেন।
এর কিছুক্ষণ পর…
ড্রয়িংরুমে রাজ্যের ঘুম চোখে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বুশরা। তার পাশে রয়েছে নিহির। সেনোয়ারা বেগম জানতে চাইলেন, কে এই মেয়েটি নিহির?
.
নিহির আমতাআমতা করে বলল, কাল অনেকটা রাত করে এসেছিল তাই আর আপনাকে ডাকা হয়নি চাচী মা।
-বুঝলাম। কিন্তু মেয়েটির পরিচয়?
-ও আমার বন্ধুর বোন।
-বন্ধুর বোন?
-হুম। আসলে সে গ্রাম থেকে এসেছে এখানে কাজের খোঁজে।
-গ্রামে তোমার বন্ধু?
-হু আছে। একসাথে এখানে পড়ালেখা করলেও সে নিজ গ্রামে ফিরে গেছে। ওরই বোন ও।
-আচ্ছা!
-রাত হয়ে গিয়েছিল বলে পরিচয় করিয়ে দিতে পারিনি। আর এখুনি আমরা বেরুবো।
-কই যাবে?
-ইন্টারভিউ আছে ওর। এরপর একটা বাসা ঠিক করে দেব। এই আরকি।
-ওহ আচ্ছা! ড্রাইভার কে বলে ওর জিনিসপত্র গাড়িতে উঠিয়ে নাও। আর আমি নাস্তা দিচ্ছি। খালি পেটে না যাক।
.
এই বলে রান্নাঘরের দিকে গেলেন তিনি।
বুশরা বলল, আমার তো কোনো জিনিসপত্র নেই।
-হুশ! চাচী মা তো সেটা আর জানেন না। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে আসুন।
.
.
নাস্তা সেরে গাড়িতে উঠে বসে দু’জনে। গাড়ি চালাতে শুরু করে নিহির। বুশরা বলল, ধন্যবাদ। কাল রাতে আমাকে আশ্রয় না দিলে কোনো বিপদও হতে পারতো। মাথা গরম করে রাতে এতদূর চলে এসে ভুল করেছিলাম।
-ইটস ওকে। এখন নিজের বাসায় ফিরে যান। দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে। উলটা তারা আপনার জন্য হয়তো চিন্তিত হয়ে আছে।
-হুম। নিশ্চয় ফুফু আম্মা টেনশন করছেন। আর তায়শা ও নাফিশা তো কেঁদে কেঁদে অস্থির হয়ে যাবে।
.
বাসায় পৌঁছে যায় তারা। গেইট খোলা দেখে দু’জনেই প্রবেশ করে।
.
এদিকে ড্রয়িংরুমে আলিয়া খাতুনের সাথে বসে আছেন এক প্রতিবেশী। তিনি বললেন, কাল তো মাথা ব্যথার জন্য বিয়েতে আসতে পারলাম না আলিয়া আপা। ঘটনা টা সত্য না কি? তোমার মেয়ে না কি কাকে ঠকায়ছে?
.
আলিয়া খাতুন বললেন, তওবা তওবা! ঘটনা মোটেও ওইরকম না। আসলে ওই ছেলেটারও দোষ নাই আর আমার মেয়েরও না। সব দোষ ওই বুশরার। আমার মেয়ের ফোন থেকে সে কথা বলতো, মেসেজ টেসেজ করতো। আর নিজের নাম বলেছে তায়শা। ব্যাস, ছেলে প্রেমে পড়ে এটা সেটা পাঠায়ছিল। পরে বুশরার সব দোষ পড়লো আমার মেয়ের ঘাড়ে।
-তাই নাকি!
-হুম। সত্যিটা এখন সবাইকে জানাতে হবে। আপনি তো জেনেছেন। কেউ জিজ্ঞাসা করলে এটা বলিয়েন।
-অবশ্যই। সত্য চাপা থাকে না কি? থাকে না বোন থাকে না।
.
এমন একজন মহিলাকে কথাটি বললেন আলিয়া, যিনি কি না এলাকায় নিউজ নামে পরিচিত। অর্থ্যাৎ তার কাছে এলাকার সকলের খবরাখবর থাকে।
এই খবরও সে এখন পুরা এলাকায় ছড়াবে।
তাদের কথোপকথন সবটা আড়াল থেকে শুনে বুশরা ও নিহির। তাদের কেউ দেখে না। বুশরা ছুটে বেরিয়ে যায়। তার পিছু নেয় নিহির। সে বুশরা কে শান্তনা দিলে বুশরা বলল, শান্তনা দিয়ে কী হবে? পারবেন আমার হারানো সম্মান ফিরিয়ে দিতে?
-আমি আপনার চাচীর সাথে কথা বলতে এসেছি।
-কিন্তু আমি চাইনা এখানে থাকতে।
-তাহলে?
-আপনি আমার ক্ষতি করেছেন আপনিই আমাকে উদ্ধার করবেন।
-আমি কী করতে পারি?
.
বুশরা একটু ভেবে বলল,
কিছুদিন আপনার বাসায় জায়গা দিতে পারবেন? আমি কোনো রাস্তা বের করে চলে যাব।
.
বুশরা আপনমনে নওয়াজের কথা ভাবছে। তাকে বললে নিশ্চয় কোনো ব্যবস্থা হবে।
নিহির একটু ভেবে রাজি হয়ে যায় তার প্রস্তাবে। এরপর দু’জনে আবারও গাড়িতে উঠে বসে। নিহির বলল, কিন্তু মনে রাখবেন। আমি আপনাকে খুব বেশি সময় দিতে পারব না।
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here