তবু মনে রেখো
২য় পর্ব
– এরকম বেহায়ার মতো এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন??
বিগত পনেরো মিনিট যাবৎ শিমুল ইফতির দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো, নক করার সাহস তার ছিলো না। কালকের অপমানের পর তার কোনোভাবেই ইচ্ছে ছিলো না ইফতির সামনে দাঁড়ানো। তার মধ্যেই ইফতি দরজা খুলেছে আর প্রথমেই এই কথাটা বললো। শিমুলের খারাপ লাগছে কিন্তু কিছু করার নেই,
– মা আপনাকে ডাকছে।
বলেই সে রান্নাঘরের দিকে হাটা দিলো। এখন ইফতির সামনে সে দাঁড়াবে না, কিছুতেই না। কেন দাঁড়াবে, অপমানিত হতে?? তার কি বিয়ে করার ইচ্ছে ছিলো নাকি সে জোর করে ইফতিকে বাধ্য করেছে। সেও নিরুপায় ছিলো, শুধুমাত্র অথৈকে নিজের কাছে রাখবে বলে করেছে, এই লোকের মোটা মাথায় এটা ঢুকবেও না।
রান্নাঘরে ঢুকতে যাবে তখনি তার মামী শাশুড়ী এবং শাশুড়ী মায়ের কথোপকথন তার কানে এলো।
– আপা জগৎ ঘুরে এই বাজা মেয়েকে কেন ইফতির জন্য বাছলা? আরো সুন্দরী মেয়েকি ছিলো না? এই বাজা মেয়ে তাই বলে, আমাদের ইফতি তো তাইলে আর জীবনে বাচ্চার মুখ দেখবে না।
– ইফতি বকুলকে এখনো ভুলে নি ভুলবে বলে মনেও হয় না
– কিন্তু আপা, ভুলবে না বলে যে কখনো ভুলবে না, তাতো না; তাই না? আর আপা যে মাইয়ার আঠাশ হওয়ার পর ও বিয়ে হয় না তার সাথে আমাদের ইফতির মতো পোলার কেনো বিয়ে দিতে হলো??
– দেখো সুরাইয়া আমি ভবিষ্যতে নাতির মুখ দেখতে বিয়েটা দেই নি! তাহলে একটা ভালো মেয়ে দেখেই দিতাম, আমি চেয়েছি এমন কেউ যে ইফতি আর অথৈকে দেখে শুনে রাখতে পারবে। অথৈ ছোট একটা মেয়ে ওর মায়ের দরকার। সুন্দরী মেয়ে তাকে মায়ের ভালোবাসা দিতে পারবে না, আর ইফতি অথৈর জন্য এই বিয়েটা করেছে। এটা মাথায় রাখো, এই নিয়ে কোনো কথা শুনতে চাচ্ছি না।
কথাটা বলে আফসানা বেগম কিচেন থেকে বের হতেই দেখলেন শিমুল দাঁড়িয়ে আছে। উনার মনে খচখচ করছে; নিজের ছেলের জন্য মেয়েটাকে নিয়ে এসেছে বউ করে। এখন তাকে নানা কথা শুনতে হচ্ছে। না জানি তাদের কি ভাবছে মেয়েটা।
– কিছু লাগবে শিমুল?
– না, মা বলতে এসেছিলাম উনাকে ডেকে দিয়েছি। এখন খাবার গুলো সার্ভ করে দেই?
– না না ওইটা আমরাই৷ করছি, তুমি নাস্তা বানিয়েছো আর কিছুই লাগবে না। চলো খাবে চলো।
শিমুল আর কথা বাড়ালো না, সে তো এসব কথা নতুন শুনছে না। শিমুল যখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ার, তখন একবার মাসিক বাদেও তার অকারণের ব্লিডিং শুরু হয়। ডাক্তার দেখালে জানা যায় তার ওভারির লেয়ার ক্ষয় হচ্ছে এবং সে কনসিভ করতে পারবে না। যদি করেও বাচ্চা ধরে রাখার ক্ষমতা তার নেই। এই ব্যাপারটা গোপন করার মতো মনমানসিকতা হারুণ সাহেব কিংবা শিমুলের নেই। একারনে বিয়ের জন্য বরপক্ষ দেখতে এলেও তার বিয়ে ভেংগে যেতো। এই ব্যাপারটা ইফতির পরিবার ও জানে। এইজন্য তারা এবং ইফতি বিয়েতে অমত জানায় নি।
– বউ মা, ইফতিকে ডালভুনা দাও। ওর পরোটার সাথে ডালভুনা খুব ভালো লাগে।
– জ্বী মা
– লাগবে না, আমি ঠিক আছি (ইফতি)
– আরে খেলি কোথায়!! শিমুল দাওতো আরেকটা পরোটা।
– বললাম তো লাগবে না।
ইফতি রেগেমেগে উঠে রুমে চলে এলো। বিরক্ত লাগছে ওর। একে বিয়েটা ওর করার ইচ্ছে ছিলো না, এখন এটা নিয়ে অহেতুক আদিক্ষেতা দেখে গা জ্বলছে। বকুলকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে; ওকে ভুলে যাওয়া ওর পক্ষে সম্ভব নয়। আর শিমুলকে দেখলে ওর মাথাটা আরো ও খারাপ হয়ে যায়। একটা মেয়ে কিভাবে নিজের ছোট বোনের হাসবেন্ডকে বিয়ে করতে পারে! ইফতি ভেবেছিলো ও রাজি হলেও শিমুল কখনো রাজি হবে না, কই সেই মেয়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করতে করতে বিয়েতে রাজি হয়ে গেছে। দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে ইফতির ধ্যান ভাংগে। দরজা ভেজানো থাকায় সে নক করেই ভেতরে চলে এসেছে। ইফতি দরজার দিকে থাকাতেই মেজাজ তার আরো খারাপ হয়ে গেছে৷ সামনে আর কেউ নয়, শিমুল দাঁড়িয়ে আছে কাপ হাতে। কাঁপা কাঁপা হাতে কাপ এগিয়ে দিতে গেলেই, ইফতি কাপটা ছুড়ে ফেলে দিল।
– কি ভাবো? আমি কিছু বুঝি না?? আমি তোমার মনের সব কুচিন্তা খুব ভালো করে বুঝি!! কি মনে করেছো?? এমন আদিক্ষেতা করে তুমি বকুলের জায়গা নিতে পারবে??
ইফতির চিৎকারে শিমুলের বুক কেঁপে উঠছে, পরক্ষণে আবার ইফতি বলা শুরু করলে শিমুলের মাথায় আকাশ ভেংগে পড়ে।
– তোমরা বাবা মেয়ে ইচ্ছে করে, ছলনা করে এই বিয়ে করেছো। কি মনে করো আমি বুঝি না?? আমার মানা করা সত্ত্বেও কেন এই রুমে ঢুকেছো।
– মা আপনাকে কফি দিতে বলেছে।
– কেন এতোদিন যখন তুমি ছিলে না তখন কফি কে দিত আমাকে?? তুমি কি ভাবো আমি বুঝি না তোমার চাল?? তোমার মত বেহায়া আমি খুব কম দেখছি। আসছো আমার মেয়ে পালতে আমার আশেপাশে কেন থাকো তুমি? এই শিক্ষা দিয়েছে তোমার মা-বাবা?? নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে মানুষ। বিয়ে হচ্ছিলো না বলে তুমি আর তোমার বাবা অথৈর আশ্রয় নিয়েছো। কি চাই, আমার ভালোবাসা; জীবনেও সেটা হবে না। বুঝলে!!
আর নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারলো না শিমুল। এতোক্ষণ ভেবেছিলো বকুলকে ভালোবাসে বিধায় এমন বিহেভ করছে। কিন্তু না, ইফতি হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। যা নয় তাই বলছে।
– চুপ একদম চুপ। নিজেকে কি ভাবেন আপনি?? রাজকুমার কোনো রাজ্যের?? হিরো আপনি যে আপনাকে বিয়ে না করলে আমি মরে যাবো?? আমি এই বিয়ে অথৈর জন্য করেছি। আমিতো এই বিয়ে করতে চাই নি!! আপনার বাবা-মা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে বাবার কাছে যান। আর ভুলে যাবেন না বাবা আমার একার বাবা না, বকুলেরও বাবা। আমার কাছে অথৈ থাকতো আমার তো আপত্তি ছিলো না। তবে কেন আপনার বাবা-মাকে বিয়ের জন্য আটকান নি?? হ্যা?? কেন?? আপনার মন-মানুষিকতা এতো নিচ জানলে কোনোদিন বকুলের বিয়ে আমি আপনার সাথে দিতাম না; কোনোদিন ও না। আর বিয়ে বিয়ে, আমি কি ফেলনা নাকি যে বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগবো?? আমার বিয়ে না হলেও কিছুই যায় আসতো না। আপনি আমার নাম মাত্র স্বামী। আমাকে এতো অপমান করার সাহস আপনার হয় কিভাবে?? হ্যা?? খবরদার আবার যদি আমাকে এভাবে অপমান করার কথা চিন্তাও করেন তো দেখে নিয়েন।
এক নাগারে মুখে যা এসেছে তাই বলে শিমুল ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সে তার ইহজীবনে কারোর সাথে উচ্চবাচ্য ব্যবহার করে নি, কিন্তু আজ বাধ্য হয়েছে। ইফতি অপমান গুলো সে নিতে পারছিলো না। শুধু তাই নয় তার বাবাকেও ইফতি গালমন্দ করছিলো। ইফতি মানষিক দিক থেকে প্রচুর ভেংগে পড়েছে। এইজন্য শিমুল চুপচাপ সব অপমান হজম করছিলো। কিন্তু আজকে যেন সকল সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। শিমুলের মাথা অত্যাধিক হ্যাং হয়ে আছে। একে রাতে ঘুম ভালো হয় নি, সকালে ভালো করে খাওয়া দাওয়া হয় নি, উপরন্তু এই ইফতির সাথে চেচামেচি করে এখন প্রচুর মাথা ব্যাথা করছে। রুমে যাওয়া দরকার। তার আছে কড়া করে এক কাপ চা খেতে হবে।
শিমুল চা নিতে অথৈ এর রুমে এলো। অথৈ তখন কাজের মেয়ে সখিনার সাথে খেলছিলো৷ শিমুলকে দেখে মামুনি,মামুনি করে ছুটে এলো। অথৈ দেখতে পুরো বকুলের মতো। শুধু চোখ দুটো পেয়েছে ইফতির। কুচিকুচি দাঁত, গুলুমুলু গাল আর গোলগোল চোখ; যে দেখবে আদর করতে চাইবে পিচ্চিটাকে। শিমুলের দুই চোখের মনি ও। এতোক্ষণের সব অপমান, রাগ, কষ্ট মিটে গেছে অথৈকে দেখে। সব চিন্তা ছেড়ে অথৈকে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো শিমুল।
সারাদিন আজ অথৈর সাথেই কাটলো তার। অথৈকে খাওয়ানো, গোসল করানো, ঘুম পাড়ানো। অথৈ দুপুরে ঘুমালে খেয়াল হলো, দুপুর হয়ে গেছে। শাওয়ার নিয়ে নীল একটা শাড়ি পড়ে নিলো শিমুল। নামায পড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো; বেশ বাতাস ছুটেছে। বর্ষাকালের দুপুরে আকাশে কালো মেঘ ছেয়ে গেলে এমন বাতাস ছুটে, হয়তো বৃষ্টি হবে। খোলা চুল উড়ছে শিমুলের৷ মনে মনে ভাবছে, এ কোন পরিস্থিতি, এ কোন সম্পর্কে আল্লাহ তাকে বেধেছেন যেখানের ভবিষ্যৎ তার জানা নেই। সে কি আদৌ এই সম্পর্কগুলোকে এক সুতোয় বাঁধতে পারবে৷ ইফতি আর ওর গন্তব্য কি কোনোদিন এক হবে??
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি