‘মনমুকুরের প্রতিচ্ছায়া’
~আরিফুর রহমান মিনহাজ
পর্ব ০২ এবং অন্তিম পর্ব

পরের সপ্তাহের শুক্রবারে আসরের নামাজের পর আনিকাকে দেখতে এলো। মাওলানা সাহেব দেখা করার প্রক্রিয়া আগেই বাতলে দিয়েছেন সজল আহমেদকে। সাধারণ বাঙালি ঘরে যেভানে কনে দেখা হয় হুজুর-সমাজে সেভাবে তার প্রচলন নেই। অর্থাৎ দলবেঁধে পাত্রপক্ষের লোকজন মেয়েকে দেখবে এমনটা তাঁরা চিন্তাও করতে পারেন না৷ শুধুমাত্র পাত্র আর পাত্রপক্ষের মহিলারা কনেকে দেখবে। এখন,পাত্রের যেহেতু পরিবার-পরিজনের কেউ নেই,কাজেই পাত্র একাই পাত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন। যথারীতি চিরাচরিত নিয়মের উলটো করে সজল সাহেব মাওলানা সাহেবের খেয়ালখুশিমতো সমস্ত বন্দোবস্ত করলেন। মমিতাকে লক্ষ্মী হয়ে ঘরের এককোনায় পড়ে থাকার অনুরোধও করা হলো। মাওলানা সাহেবের মতোন জ্ঞানীগুণী মানুষের সামনে যেন বাবাকে বেইজ্জত না করে সেই সম্পর্কে ভালোভাবে সাবধান করা হলো।
আনিকা আজ ভীষণ অপ্রস্তুত। মাদ্রাসার একজন ওস্তাদ তাকে নিকাহের উদ্দেশ্যে দেখতে আসবে এটা শোনার পর সে কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না। তাছাড়া প্রস্তাবটি নিয়ে এসেছে স্বয়ং মাওলানা সাহেব! মাওলানা সাহেব এই তল্লাটে তার ন্যায়নিষ্ঠতা ও তাঁর জ্ঞানগর্ভ শরীয়াহ এলেমের জন্য ভীষণ জনপ্রিয়। আনিকা ভাবল, এ কী অস্বাভাবিক কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। স্বপ্ন নয় তো! উপরি-উপরি যথেষ্ট শান্ত মনে হলেও তার হৃদয়াকাশে যেন ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে। রুদ্ধ অস্থিরতায় পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে ঘামের সূক্ষ্ম একটি ধারা নেমে যাচ্ছে। প্রভাতের প্রারম্ভে ঘাসের বুকে জমতে থাকা শিশির-বিন্দুর মতোন কপালে দেখা দিল বিন্দু বিন্দু ঘাম। মুখ বাড়িয়ে আয়নায় সে নিজেকে দেখে নিল একবার। তার চেহারা আর রঙের সঙ্গে তাল রেখে খুবই হালকাপাতলা সাজগোজ হয়েছে। রঙটা তো বরাবরই কালোর দিকে। তবে কেন জানি আজ আয়নায় নিজেকে মায়াবতী মনে হলো! দৃষ্টিভ্রম কি-না বুঝতে পারল না৷ ধীরে ধীরে আদিঅন্তহীন ভাবনায় বিধুর হয়ে গেল সে। লোকটা কেমন হবে? তাকে পছন্দ করবে তো! কবে এই দেখাদেখির জগৎ থেকে মুক্তি পেয়ে তার নিজের একটা সুন্দর সংসার হবে? আদৌ কখনো হবে! বয়স যে বেড়ে গিয়ে জীবন-যৌবনের সমস্ত নির্যাস শুষে নিতে চলেছে! এই বাড়ির প্রতিটা বস্তু যেন স্ব স্ব অবস্থান থেকে তাকে বিদেয় করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।

দরজায় টোকা পড়ল।
– আনিকা…
বাবার কণ্ঠ। অদ্ভুতভাবে ভীষণ মোলায়েম আর স্নেহবাৎসল্যে ভরপুর সে কণ্ঠ। আনিকা চমকে উঠে দাঁড়িয়ে আধো-আধো গলায় বলল,
– জি বাবা,আসুন।
সজল সাহেব প্রবেশ করলেন একজন কালো জুব্বাপরুয়া যুবককে সঙ্গে করে। যুবকের চলনভঙ্গি খুবই নম্র। বাবার পিছুপিছু নতমস্তকে সে প্রবেশ করল। আনিকা একঝলক তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল৷ মুখে দাড়ি,মাথায় সুদৃশ্য কালো পাগড়ি,পরনে হলহলে কালো জুব্বা,শ্যামলা গায়ের রং,শান্ত নজরকাড়া মুখশ্রী… এটুকু তার মস্তিষ্কে গেঁথে গেল নিমেষেই। জিভ শুকিয়ে গেল তার। বেড়ে গেল হৃৎস্পন্দন। দ্বিতীয়বার তাকানোর সাহস হলো না৷
সজল সাহেব কী বলবেন বুঝতে না পেরে গলাখাঁকারি দিয়ে ফরফরে সুরে বললেন,
– আনিকা,উনি হচ্ছে আনিসুর রহমান। আর আনিস,ও হচ্ছে আমার বড় মেয়ে আনিকা। বসুন,বসুন আপনি, তো… কথা বলো তোমরা। আমি বাইরে মাওলানা সাহেবের সঙ্গে আছি।
বাবা দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। আনিকার মনে পড়ল,এখনো সালাম দেওয়া হয়নি। তড়িঘড়ি করে সে সালাম দিতে মুখ খুলতেই অপরপ্রান্ত থেকেও সালাম বাণী ভেসে এলো। ফলস্বরূপ দুজনেই সমস্বরে বলে উঠল, আসসালামু আলাইকুম। প্রথম সাক্ষাতের প্রথম বাক্য নিঃসরণের এই অদ্ভুত মিলে অবাক হয়ে একে অপরের দিকে চেয়ে ফিক করে হেসে উঠল দু’জনেই। মুচকি হাসি।
মুখোমুখী সোফার দু’প্রান্তে বসল দু’জনে। সুমুখের টেবিলে রাখা নানাপ্রকার ফলমূল, আর তেলেভাজা মুখরোচক নাশতা। দুজনের কেউই আপাতত সেগুলো ছুঁয়ে দেখল না। একটু নীরবতার পর আনিসই প্রথম কথা বলল,
– আপনার সম্মন্ধে প্রাথমিক জ্ঞান আমার নেওয়া হয়েছে। আমার সম্মন্ধে আপনি কী জানেন?
আনিকা চোখ তুলে চেয়ে আবার নামিয়ে নিল। বলল,
– আমিও টুকটাক জানি।
– ওহ আচ্ছা। আসলে আমি মোটেও বাকপটু না। কখনো কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন হয়নি। সারাজীবন তো আবাসিক ছাত্রাবাসে পড়ে আর পড়িয়ে কাটিয়ে দিলাম। কী বলব খুজে পাচ্ছি না।
আনিকা একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
– নাশতা নিন না!
আনিস একটা আপেলের টুকরো হাতে নিয়ে বলল,
– আপনিও নিন।
আনিকাও নিল। আপেল সে কখনোই খায় না। কিন্তু আজ আপেলই নিল। আপেলটা মুখে পুরে আনিস তার পাশ থেকে একটা কাগজে মোড়ানো প্যাকেট খুবই সাবধানে তুলে নিয়ে আনিকার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
– এটা আপনার জন্য।
– কী আছে এতে?
-বাংলা অর্থসহ কোরআনুল কারীম। শুনেছি,কনে দেখতে হলে কনের জন্য কিছু একটা নিয়ে যাওয়া উচিত।
আনিকা সংকোচ অথচ সম্ভ্রমের সাথে প্যাকেটটি বাড়িয়ে নিয়ে মুখে চুম্বন করে কপালে ঠেকিয়ে টেবিলের ওপর তুলে রাখল। এরপর বলল,
– ধন্যবাদ।—এর আগে আপনি কোথাও পাত্রী দেখেননি?
– না। আমার ওস্তাদজী কথাবার্তা শুরু করতেন৷ কিন্তু আমার বিস্তারিত বিবরণ শুনে কেউই খুশিতে রাজি হয়নি। তাছাড়া ইসলামি অনুশাসন পুরোপুরি মানে এমন কাউকে পাওয়া এখানে দুষ্কর। বাইরের কেউও আমার মতো অচেনাকে মেয়ে দিবে না। তাই আমিও আর আগ্রহ দেখাইনি।
বলে মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন আনিস। একটু থেমে যোগ করলেন,
– গতপরশু ওস্তাদজী আবার আমাকে ধরে পড়লেন। আধাঘন্টা বয়ান করে চরিত্র হেফাজতের জন্য বিবাহের গুরুত্ব বুঝালেন। আপনার কথাও বললেন।
আনিকা কৌতূহল বোধ করল। উৎসুক দৃষ্টি তুলে বলল,
– কী বললেন?
আনিস বিব্রতভাবে ঠোঁট ভিজিয়ে বললেন,
– বললেন,আপনি জেনারেল লাইনে পড়াশোনা করলেও দ্বীনের ওপরে অটল আছেন। শান্ত,শিষ্ট—মানে সবদিক দিয়ে উপযুক্ত আরকি।
আনিকা এবার হুট করে চটুল গলায় বলে ফেলল,
– সবদিক দিয়ে? আমাকে দেখে নিশ্চই আপনার পছন্দ হয়নি!
আনিস সেকেন্ডকয়েক আনিকার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন৷ আনিকা নিজের কথায় এবং আনিসের অবাক দৃষ্টিতে যারপরনাই লজ্জিত হয়ে দৃষ্টি অবনত করে মনে মনে জিভ কাটল। এমন বেআবরু হবার কোনো মানে আছে! আনিস নির্নিমেষ চাহনিকে সংযত করে চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা ঘুরিয়ে বললেন,
– আস্তাগফিরুল্লাহ।… আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। বাকীটা আপনার এবং আপনার পরিবারের ওপর।
আনিকা প্রবল বিস্ময়ে চেয়ে রইল আনিসের দিকে। এই মোল্লার নিশ্চয় প্রথম কোনো মেয়ের সংস্পর্শ পেয়ে মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। নতুবা তার মতো একটা কালো আইবুড়ো মেয়েকে এই সৌম্যকান্তি যুবক কেন পছন্দ করতে যাবে? তওবা তওবা,একজন ভালো ছেলেকে নিয়ে এসব কী ভাবছে সে! নিজের ভাবনার লাগাম টেনে ধরে আনিকা ধীর-গম্ভীর গলায় বলল,
– আমি শুনেছি,আপনি ঢাকার একটা বড় মাদ্রাসায় চাকরির অফার পেয়েছেন। ওখানে গেলে কিন্তু আমার চেয়ে হাজার গুণে ভালো এবং সুন্দরী পাত্রী আপনি পাবেন। আপনার যোগ্যতা দেখে ওস্তাদরা স্বয়ং নিজের মেয়ে বিয়ে দেবে আপনার সঙ্গে।—আমি চাই না পছন্দ না হয়েও বাধ্য হয়ে আমাকে বিয়ে করেন৷ আমি জানি,আমরা দু’জনেই প্রায় সমান পথের পথিক। কিন্তু আপনার সুন্দর একটি ভবিষ্যৎ আছে,আমার সেটি নেই। আমার ভাগ্য অপরিবর্তিত। চেষ্টা করলেই আমি সুন্দরী হতে পারব না৷
কথাগুলো বলে আনিকা হাফ ছাড়ল। মোটেও বাড়িয়ে বলা হয়নি। তার মতো কুৎসিত-দর্শন রমণীকে একদেখায় পছন্দ হয়ে যাবার পেছনে হয়তো অন্যকোনো কারণ থেকে থাকবে৷ হতে পারে,কেউ খুশিমনে তাঁর সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিতে রাজী হচ্ছে না বলে নিতান্ত বাধ্য হয়ে আনিকাকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে গেছে লোকটা! কী করবে! বিয়েসাদী তো করতেই হবে। পারতপক্ষে তো কেউ আর কালো মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয় না! মনে মনে আবারো ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ পড়ল আনিকা। একজন মানুষকে না জেনে না শুনে সত্যমিথ্যার কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য আবারো অনুতপ্ত হলো সে। আনিসের মুখে টালমাটাল স্মিত হাসির রেখা।
– আপনি কি তাহলে আমাকে মিথ্যাবাদী বলছেন!
আনিকার ভুরু কিঞ্চিৎ কুঁচকে উঠল৷
– মম… মানে?
– মানে হলো। কাউকে পছন্দ না হলে ‘হয়নি’ বলা কিংবা তার মনে কষ্ট না দিয়ে সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার সৎসাহস আমার আছে৷
আনিকা ব্যথিত হয়ে পড়িমরি করে বলতে গিয়েও নিজেকে প্রাণপণে সংযত করে বলল,
– মাফ করবেন। ভুল হয়েছে৷ কিন্তু,…কিন্তু আমি কি জানতে পারি,কেন আমাকে আপনার পছন্দ হলো?
– সেটি এখন বললে তো নিজের কাছে আমি নির্লজ্জ হয়ে যাব।— আপনার ভালো একটি মন আছে৷ হায়া আছে,যেটি একজন নারীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটা মানুষকে পছন্দ হতে এটুকুই কি যথেষ্ট নয়?…

আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলার পর কনেদেখা পর্বের সমাপ্তি ঘটল। মাওলানা সাহেব আর আনিস প্রস্থান করতেই মমিতা খলবলিয়ে নিজের খোলস থেকে বেরিয়ে এলো। হইহই করে সে আনিকার ঘরে এসে হাহাকার করে বলল,
– মানে কী আপা। শেষপর্যন্ত তুই এই দাড়ি-টুপিওয়ালা হুজুরকে বিয়ে করবি!
আনিকা তখনো হিম হিম আবেশে, নিজের চারপাশে বিবশ অনুভূতির দেয়াল গাঁথিয়ে স্থানুবৎ বসে ছিল সোফার ওপর। একটু আগের স্বপ্নিল সময়টার ঘেরাটোপ ফুঁড়ে কোনোমতেই বেরুতে পারছিল না সে। মমিতার কথায় সে সিধা হয়ে বসে একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল,
– বিয়ে করব কে বলল? আমি তো এখনো কোনো মত দিইনাই৷
– দেসনাই, দিবিও না। এসব হুজুররা হচ্ছে মিচকে শয়তান বুঝলি না? ধরে ধরে বাচ্চাদের বলৎকার করে। আর মোটেও রোমান্টিক না। এরচেয়ে তোর গাঞ্জুটি, মদখোর পাত্র ভালো ছিল। মদ খেয়ে ধোলাই দিলেও আদরের বেলায় একশ একশ।
– কে জানে,আমি তো তোর মতো অভিজ্ঞ না!
– ইনসাল্ট করতেছিস? যা-ই করিস। এসবের দরকার আছে। নইলে বুঝবি কেমনে কোন পার্টনারটা তোর জন্য উপযুক্ত?
– কী বলিস এসব!
– ঠিকই রে। আমি আর চেপে রাখতে পারতেছি না৷ গতসপ্তাহে দুইটা দিন আর জন্য খুব স্পেশাল ছিল। কাউকে বলিস না,আ’ম ইন আ সিরিয়াস রিলেশনশিপ। এন্ড উই হ্যাভ হ্যাড আ ফিজিক্যাল…
আনিকা হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইল বোনের দিকে। এই মেয়েটা এত তাড়াতাড়ি এতটা নীচে নেমে যাবে ভাবতেও পারেনি সে। আনিকা মোটামুটি নিশ্চিত, ওকে শাসন না করে এভাবে মুক্তবিহঙ্গ হয়ে উড়তে দেবার ফল একদিন ঠিকই ভোগ করবে বাবা-মা। যেদিন মুক্তবিহঙ্গ কৃতকর্মের দুর্বিপাকে ডানা ভেঙে ভূপৃষ্ঠে পতিত হবে সেদিন আর কিছুই করার থাকবে না৷

দিন দুই পর সজল সাহেব দোকানে যাবার আগে সপরিবারে চা খেতে খেতে গাঁটের খবর জানতে চাইলেন মেয়ের কাছে,
– বিয়েটা তবে ঠিক করে ফেলি?
আনিকা খাবার থামিয়ে নিশ্চুপ বসে রইল। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ভেবে সজল সাহেব মনে মনে ভীষণ হালকা বোধ করলেন। তার কাছে মনে হলো, দীর্ঘ পঁচিশ বছর যাবৎ বুকের ওপর পাকাপোক্ত আসন গেঁড়ে থাকা একটা জগদ্দল পাথর আচমকা নেমে গেল। নড়েচড়ে বসে চায়ে চুমুক দিয়ে তিনি বললেন,
– বাপের বাড়ির মতে আয়েশে থাকতে পারবে না ওখানে। ছেলের কামাই কম। চলতে পারবে কি-না ভেবে দেখ।
আনিকা নত মস্তকে ঈষৎ চোখ তুলে চেয়ে মাথা দুলিয়ে বলল,
– পারব।
মমিতা হতাশ হবার ভান করে শ্লেষাত্মক গলায় বলল,
– শেষমেশ তাহলে ওইটাই হবে আমার দুলাভাই? দেখলেই তো মাথা ঘুরায়।
সজল সাহেব কিছু বললেন না। মরিয়ম বেগম বললেন,
– ক্যান? ছেলে তো ভালাই। আনিকার থেকে হাজারগুণে সরস৷
– তা তো সরসই। কিন্তু এই হুজুরগুলা…
কিছু একটা বলতে গিয়েও বাবার শান্ত অথচ খবরদারিতে পূর্ণ চোখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল মমিতা। আনিকা নির্বিকার খেয়ে যেতে লাগল। এসবে তার কিছুমাত্র যায় আসে না। আড়ালে-আবড়ালে কিংবা মুখোমুখি অপমানের সঙ্গেই ওর নিত্য বেড়ে ওঠা। সব গা-সওয়া হয়ে গেছে। গত দুইদিন ধরে ওর দেহমন যার ভাবনায় বিভোর,শরীরের সমস্ত রোমকূপ যার নামে জয়োৎসব করছে,সমস্ত রক্তবিন্দু যার জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে হৃদয় উজানে ছুটে চলেছে সেই নামটি হলো,আনিস! কোনো ছল নেই,কপটতা নেই;কেমন করে বলে দিল ‘আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে।’ আজতক কেউ বলেনি একথা! এখনো নিজের কক্ষে ঢুকলে মনে হয় মানুষটার মিষ্টি আতরের ঘ্রাণ এখনো সেই ঘরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘাপটি মেরে বসে আছে। সেই আতরের ঘ্রাণে বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যায়। আনিকার মনের ভাব ফুটে উঠছে চোখে। মমিতা দিনরাত জ্বালাতন করছে।
– তোর রুচি একেবারে বাজে আপা। এই ব্যাটার হাবভাবই তো ভালে ঠেকেনাই আমার কাছে। আসল, দেখল, আর ঠাস করে বলে দিল পছন্দ হইছে। কেমনে কী?
আনিকা অবশ্য এবিষয়ে বোনের সঙ্গে কোনোপ্রকার বাদানুবাদে যায়নি। ঠোঁটজোড়া এঁটে চুপ করে বসে নিজস্ব ভাবনায় বিভোল ছিল।

দুই পক্ষের শলাপরামর্শের মাধ্যমে ঠিক হলো,আসছে শুক্রবারই হবে বিয়ে। সুন্নতি বিয়ে হবে। কোনোপ্রকার অনুষ্ঠান হবে না। আক্দ পরিয়ে কনেকে উঠিয়ে আনা হবে।
পরের শুক্রবার আসরের নামাজের পর মসজিদে আনিকা এবং আনিসের বিয়ে হয়ে গেল। আনিকার কবুল নেওয়া হলো বাড়িতেই। এরপর নেহাত স্বল্প আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতিতে কনের বাড়িতে রাতের খাবার-দাবারের পর মেয়েকে উঠিয়ে নেওয়া হলো। আনিকা একপ্রকার নিশ্চিত ছিল যে বিদায়বেলায় সে একফোঁটাও চোখের জল ফেলবে না। মাথা উঁচু করে, দৃপ্তভঙ্গিতে সে এবাড়ির চৌহদ্দি পেরিয়ে যাবে,একবারের তরেও পেছনে ফিরে তাকাবে না। কখনো বা অবচেতন মন অকেলাসিত,অযাচিত চিন্তার ফোয়ারা ছড়িয়েছে। ভেবেছে,যাবার বেলায় বাবা-মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মিঠেকড়া গলায় বলবে,‘তোমরা আজ মুক্ত হলে,আমিও মুক্ত হলাম।’ কিন্তু এসব মেয়েলি অখল রূঢ়তা কেবল গল্প-উপন্যাসেই মানায়। বাস্তবতা ভিন্ন।
বস্তুত, কাঁদার মতো মায়া এই বাড়ীর মানুষগুলো তাকে দিতে পারেনি কিংবা দিতে চায়নি কখনো। তবুও সেই সময়টা যখন বাস্তবে এলো তখন আর দশটা নারীর মতোই আনিকার চোখের গন্ডি ছাপিয়ে জল এলো। মাকে জড়িয়ে ধরতেই সেই চোখের জল আর বাঁধ মানল না। অবিশ্রান্ত বর্ষায় টইটম্বুর নদীর বাঁধ যেমন নিজের বুকে জমে থাকা জলের ভার সইতে না পেরে ভেঙে খানখান হয়ে হুহু করে মাঠ-ঘাট প্লাবিত করে দেয়, ঠিক তেমনিভাবে দীর্ঘ পঁচিশ বছরে প্রিয়জন থেকে পাওয়া অবহেলা আর যাতনার ঘনীভূত প্লাবন অসংযত কান্না হয়ে নেমে এলো। মরিয়ম বেগমের চোখও কি ভিজে উঠল! নাকি লোকদেখাতেই চোখ মুছলেন তিনি। কে জানে! সজল সাহেব বরাবরই কঠিন মানুষ। তিনি খানিক বিরক্ত হয়ে বললেন,
– আহা কী কান্নাকাটি লাগালে…।
কে একজন পাশ থেকে বলল,
– হয়েছে হয়েছে,গাড়িতে উঠো।
মমিতাকে জড়িয়ে ধরে আরেকদফা কান্নার ঢেউ তুলল আনিকা। এই বোনটা তাকে পদে পদে যতই শরবিদ্ধ করে কথা বলুক না কেন,তারই তো বোন! এক লহমার তরে জগতের সব স্নেহ তার বুকের ভেতরে জমে উঠে ওর মনে হলো,ওকেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে আনিকা। সময়ে-অসময়ে সেটি পরিস্ফুট হলেও মমিতার নিরন্তর কটুকাটব্যে সেই ভালোবাসা কখনো দন্তস্ফুট করেনি৷ আড়ালেই থেকে গেছে। আনিকার কানের ফিসফিস করে মমিতা বলল,
– তোর দুঃখে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করতেছে এই মোল্লাকে বিয়ে না করলেই পারতি। দেখ,আমার দিকে তাকালও না পর্যন্ত! অথচ দুলাভাইরা কত মজা করে!
আনিকা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে বলল,
– নিজের মতো চলাটা এবার বন্ধ কর সোনা। তুই মেয়ে!
মমিতা যেন উত্তেজিত হয়ে নারী-স্বাধীনতা নিয়ে বিরাট বুলি ছাড়তে যাচ্ছিল,এমনই করে উঠল। কিন্তু চারিপাশে এত মানুষের ভিড়ভাট্টার মধ্যে ওর ভাব এবং কথা দুটোই চাপা পড়ে গেল। আনিকা বোনকে ছেড়ে দেবার আগে শুনতে পেল,
– অয়েল ইউর অউন মেশিন।

আনিসুর রহমান নতুন জীবনকে উপলক্ষ করে মাদ্রাসার পাশেই একটা টিনশেডের ঘর ভাড়া নিয়েছেন। মাওলানা সাহেবের হুকুমে মাদ্রাসারই কয়েকজন সিনিয়র ছাত্র গিয়ে বাড়িটাকে একেবারে ধুয়েমুছে, সাফসুতরা করে সাজিয়েগুছিয়ে ফিরে এলো। আনিসের নিজস্ব আসবাবপত্র বলতে একটা সিঙ্গেল খাট আর বইয়ের থাক ছাড়া কিছুই ছিল না৷ টুকটাক রেডিমেড আসবাবপত্র যেমন খাট,আলমারি, আলনা, আর সাংসারিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে শুরু করে বাথরুমের বদনা পর্যন্ত সবকিছুই নতুন করে কিনতে হলো। উর্ধ্বগতির বাজারে সে এক বিরাট অঙ্কের থাক্কা। যাইহোক, নবোঢ়া স্ত্রীকে নিয়ে নতুন বাসায়, নতুন জীবনে পা রাখল আনিস। আনিসের জনাকয়েক সহকর্মী-বন্ধু মিলে বাসরঘরটাকে সুসজ্জিত ও সুশোভিত করে সাজিয়ে দিয়েছিল। সেই ঘরটায় ঢুকে প্রাণটা অনাবিল আনন্দে ভরে উঠল আনিকার। এ-ই তার ঘর,নিজের ঘর! যেই ঘরে কেউ তাকে কালো ভ্রমর বলে নাক সিঁটকে কথা বলবে না৷
একদল অপরিচিত মেয়ে আনিকাকে বাসরঘরের মধ্যমণি করে সংসার-জীবন নিয়ে নানান খুটিনাটি বিষয় নিয়ে আদেশ-উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে। ইশারা-ইঙ্গিতে কান-লাল-করা কথাবার্তা বলে হাসাহাসি করছে নিচু স্বরে। আনিকার বড় জানতে ইচ্ছে হলো,এরা কারা। কী সুন্দর এদের কথাবার্তা, চালচলন। কিন্তু সংকোচের কারণে জিজ্ঞেস করতে পারল না। বেশভূষা আর বাক্যগঠনের ধরণ শুনে ধারণা করে নিল,এরা হয়তো মাদ্রাসার ওস্তাদদেরই স্ত্রী-কন্যা হবে। একটু পর সবাই চলে গেলে আনিসুর রহমান প্রবেশ করল ঘরে। আনিকা সসম্মানে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম করল স্বামীকে। আনিস সালামের জবাব দিয়ে নিকটে এসে নববধূর কপাল চুম্বন করলেন। হৃদয়-সিন্ধুর উথাল-পাতাল জলোচ্ছ্বাসের মধুময় বিধূননে আনিকা চোখজোড়া বন্ধ করে রইল। এ যেন দিবাস্বপ্ন। চোখ খুললেই যেন সেই স্বপ্নটি মিথ্যে হবার ভয়। আনিস ওর থুতনি ধরে মায়ায় বিগলিত হয়ে নিচু স্বরে ফিসফিসিয়ে শুধালেন,
– আমাকে পেয়ে আপনি খুশি তো, প্রিয়?
আনিকা দুচোখ চেপে উপচে-পড়া জলের ধারার আগল খুলে দিয়ে ভয়-লজ্জা-আর সংকোচ কাটিয়ে বলল,
– আলহামদুলিল্লাহ। অনেক খুশি হয়েছি।… আপনি খুশি তো?
– আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর কাছে লাখো-কোটি শুকরিয়া৷
এতটুকু বলে আনিস স্ত্রীর দিকে সতৃষ্ণ নয়নে চেয়ে থেকে আবৃত্তি করে উঠলেন,
‘বিবাহের রঙে রাঙা আজ সব
রাঙা মন, রাঙা আভরণ,
বলো নারী “এই রক্ত আলোকে
আজ মম নব জাগরণ!”
পাপে নয়, পতি পুণ্যে সুমতি
থাকে যেন, হয়ো পতির সারথি।
পতি যদি হয় অন্ধ, হে সতী
বেঁধো না নয়নে আবরণ;
অন্ধ পতিরে আঁখি দেয় যেন তোমার সত্য আচরণ।’

আনিকা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। ফস করে ঠোঁটের অগ্রভাগে উঠে এলো,‘আপনি নজরুল পড়েন?’। কিন্তু ছন্দপতনের আশঙ্কায় কথাটা সে গলাধঃকরণ করে বলল,
– আপনার ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষা, আমার কাছে আদেশের মতো। আমৃত্যু আপনার পথের সারথি হতে আমি প্রস্তুত। কিন্তু আমিই অন্ধ,আপনার প্রজ্ঞার আলোয় আলোকিত হলে আমি ধন্য হব।
– আসুন তবে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে দু’রাকাআত নফল নামাজ পড়ি।…

ওদের বিয়ের বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেল। শীতের শেষে প্রকৃতির জরঠ দেহে বাসন্তী যৌবনের মোলায়েম ছোঁয়া লেগেছে। সেই অতুল স্পর্শে রুক্ষ প্রকৃতি যেমন অপরূপ শ্যামলিমায় সজীব হয়ে উঠেছে ঠিক তেমনিভাবে আনিকার জীবনের তাবত রুক্ষতা যেন নবজীবনের নব নর্মসহচরের ছোঁয়ায় ছোঁয়ায় অম্লান হয়ে উঠেছে। প্রতিটা দিন তার কীভাবে যে কেটে যায় নিজেও বুঝে উঠতে পারে না। ফজরের নামাজটা পড়েই আনিকা নাশতা প্রস্তুত করে। দু’জনে মিঠেকড়া খুনসুটিতে মুখরিত হয়ে একসঙ্গে নাশতা করার পর দশটা অবধি গভীর অভিনিবেশে আনিসের সঙ্গে বসে শরীয়াহর বিভিন্ন বিষয় শিখে। দশটার আগে আগেই আনিস ক্লাস নিতে মাদ্রাসায় চলে যায়। একটার মধ্যে আনিকা ছোট্ট সংসারের সমস্ত কাজকর্ম সেরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে আনিসের জন্য অপেক্ষা করে। মধ্যাহ্নভোজের পর একটু বিছানায় গা এলিয়ে গুনগুন করে গল্পগুজব করে দুইটা বাজতেই আনিস আবার মাদ্রাসায় চলে যায়৷ এই অলস দুপুরটায় আনিকা বসে বসে বই পড়ে,কাঁথা সেলাই করে, পাটি বোনে, কখনোবা বেতের মোড়া বানায়। আবার কখনো-বা পতির অনুমতি নিয়ে প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে নতুন নতুন হস্তশিল্প শেখে। বিকালে একটা দাখিলের ছাত্রী অঙ্ক-বিজ্ঞান পড়তে আসে তার কাছে। আনিসও রাত আটটা পর্যন্ত মাদ্রাসায় থেকে তারপর ফেরে ঘরে। কখনো দেরি হয়ে গেলে কিছু একটা সওগাত নিয়ে এসে আনিকাকে বুঝ দেয়। আনিকা জানে, সংসারে একেবারে সাদাসিধা হয়ে থাকলে চলে না। মাঝেমধ্যে একটু-আধটু মান-অভিমান, মানভঞ্জন,অভিযোগ-অনুযোগের পর্ব না চললে সম্পর্কটা একঘেয়ে হয়ে যাবে। এমনি রাসূল সাঃ এর প্রিয়তম স্ত্রী হযরত আয়েশা বিভিন্ন সময় রাসূলের ওপর অভিমান করতেন কিংবা রাগান্বিত হতেন। এসব বিষয় মাথায় রেখেই আনিকা আর নিজের রাগ-অভিমানকে লুক্কায়িত করে না। তবে বেশি বাড়াবাড়িও করে না।
দুপুরে মমিতা আসে মাঝেমাঝে। স্বামীকে নিয়ে ওর বাচনিক প্রগলভতায় আনিকা যারপরনাই ব্যথিত এবং বিরক্ত হলেও মুখফুটে কড়া কথা বলে না বোনকে। আসতেও নিষেধ করতে পারে না। ওর মনে হয়,মমিতা আনিকার শূন্যতায় পীড়িত হয় বলেই মাঝেমধ্যে দেখা দিয়ে যায়। একদিন দুপুরে আনিসের ক্লাস ছিল না। ঘরেই ছিল। বসার ঘরে বসে একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করছিল আনিকার সঙ্গে। এমনসময় হঠাৎ কোথা থেকে ঝটিকার বেগে মমিতা ঘরে ঢুকে গেল। ঢুকেই বলল,
– ওমা দুলাভাই যে। কতদিন আপনারে দেখি না। আগের চেয়ে সুন্দর হয়ে গেছেন। বিয়ের সময় চিকনা ছিলেন।
আনিসের তখন পরাণ যায়-যায় অবস্থা। গেঞ্জি পরা অবস্থায় না পারছে সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে আর না পারছে ভেতরের দরোজা দিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে যেতে। কারণ দরোজার সামনেই মমিতা বেশ দৃপ্ত ও বিশ্রী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। আনিকাকে দেখে মনে হলো ও এক্ষুনি কেঁদে দেবে। টালমাটাল গলায় সে বলল,
– মমিতা তুই একটু বাইরে যা।
মমিতা বোনের কথায় কোনো পাত্তা না দিয়ে বলল,
– আরে এই প্রথম দুলাভাইকে বাগে পেলাম। চুপ কর তুই। দুলাভাইয়ের ফিগারটা কিন্তু মাশাল্লাহ। এই… গোপনে জি*হাদি ট্রেনিং-ফেনিং দেয় না তো! চোখে চোখে রাখিস কিন্তু। বিশ্বাস নাই।
আনিস মুখটা তখন রাগে লাল হয়ে গেছে। তা দেখে মমিতা আবার বলল,
– ওরে বাবা,দুলাভাইয়ের আবার রাগও আছে! আমার দিকে তাকান একবার,সব রাগ পানি হয়ে যাবে।

আনিস এমন পরিস্থিতিতে কী করবে ভেবে পেল না। রাগের মাথায় তার মনে হলো,সাধারণ পরিবার থেকে বিয়ে করা তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। গোবরে পদ্মফুল ফুটলেও গোবর ডিঙিয়ে সেই পদ্মফুল নিজের করে নেবার দুঃসাহস দেখানো তার উচিত হয়নি। দৃষ্টি নিচের দিকে রেখে সে নীরব ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে সামনের দরোজা দিয়েই বেরিয়ে গেল৷ মমিতার ঠোঁটের কোণে কামিল হাসি ছড়িয়ে গেল। আনিকা ঠোঁট চেপে উদগত অশ্রু সংবরণ করে উত্তপ্ত কণ্ঠে বলল,
– এটা কী করলি তুই? তোকে কতবার মানা করেছি ওর সামনে না আসতে!
মমিতা খিলখিল করে হেসে উঠল,
– কী করলাম। বাপরে আপা,তুইও শেষমেশ এসব ধারা ধরে ফেললি! কে বলবে তুই অনার্স-পাশ করা একজন শিক্ষিত মেয়ে? সে আমার দুলাভাই, একটু মজা তো করতেই পারি!
আনিকা ক্রোধে ফেটে পড়ে দুকদম এগিয়ে গিয়ে সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল বোনের গালে।
– বের হ আমার ঘর থেকে। আর জীবনেও আসবি না এদিকে। নির্লজ্জ মেয়ে কোথাকার!
মমিতা স্তব্ধ। রাগে কি অপমানে ওর চোখজোড়া কানায়-কানায় পূর্ণ কলসির মতো টলটলিয়ে উঠল৷ বড় ধরনের একটা হুমকি দিতে গিয়েও দাঁতে দাঁত চেপে সদর্পে বেরিয়ে গেল সে।

আনিস ঘরে ফিরে এসে দেখল,আনিকা মেঝেতে বসে অঝোরে কেঁদে চলেছে। নিজের পূর্ববর্তী ভাবনার জন্য অনুতপ্ত হলো সে। কী হয়েছে জানতে চাইলে আনিকা প্রথমে কান্নার দমকে কিছু বলতে পারল না। আনিস অনেকক্ষণ সময় নিয়ে তাকে শান্ত করে আনিকার কান্নার হেতুটা বের করে আনল। সব শুনে তিনি বেশ মর্মাহত হলেন। ছোট একটা বিষয় নিয়ে এতটুকু বাড়াবাড়ি তিনি আশা করেননি। একটু আগেই নাকি মরিয়ম বেগম ফোন করে আনিকাকে একপ্রস্ত বকাঝকা করেছেন এবং সর্বশেষে এটাও বলেছেন যে,আজ থেকে তোমাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। সজল সাহেব ফোন করতেন কালেভদ্রে, কেমন চলছে,কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি-না,টাকাপয়সা লাগবে কি-না ইত্যাদি জানতে চাইতেন। কিন্তু এই ঘটনার পর থেকে তিনিও সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন মেয়ের সাথে। মেয়ের প্রতি তার কোনো দয়ামায়া না থাকলেও আলেম হওয়ায় মেয়ের জামাইকে তিনি যথেষ্ট সমীহ করতেন। কিন্তু এই ঘটনার পর তিনি জামাইয়ের প্রতি যেন সেই শ্রদ্ধাবোধটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন। বছরে-ছমাসে পথেঘাটে দেখা হলেও আগের সেই নিরঞ্জন ভক্তিবাক্য তার মুখে ঝরে না। আনিকার বদ্ধপরিকর ধারণা,মমিতা বাবা-মাকে কেঁদেকেটে মূল ঘটনাকে মাল-মশলাগ দিয়ে,তিলকে তাল করে, যা নয় তা বুঝিয়েছে আর বাবা-মাও সেসব অন্ধভাবে বিশ্বাস করেছে। হাজার হলেও তাদের অতি আদরের কন্যার অপমান সহ্য করবে কেন তারা? কাজেই কন্যাকে শান্ত করার জন্য অপর কন্যার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পথটাই তিনি বেছে নিলেন।
ওঁদের বিবাহিত দিনগুলো এভাবেই কাটতে লাগল। মাদ্রাসার নামেমাত্র বেতন আর টিউশনির অল্প টাকায় ওদের সংসারের স্বচ্ছতা না থাকলেও অভাব নেই। ছোট থেকে আনিকা উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হলেও ওর শখ-আহ্লাদগুলো কেবল অকাট্য প্রয়োজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কাজেই ছিমছাম জীবনযাত্রাটা ওর ভালোভাবেই রপ্ত করা ছিল৷ খাবার-দাবার,পোশাক-পরিচ্ছদে ওর বাড়তি চাহিদা কখনোই ছিল না। কারণেই, খুব দ্রুত আনিকা নিজেকে এই ছোট্ট সংসারের সঙ্গে মানিয়ে নিল। কিন্তু বাবা-মায়ের সঙ্গে মনোমালিন্য তাকে নীরবে পীড়া দিত। আনিস সব বুঝেন। কিন্তু কিছু করতে পারেন না। ফোন দিয়ে তিনি শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে দাওয়াত দিয়ে কথাবার্তার মাধ্যমে বিষয়তা মিটমাটের চেষ্টাও করেছেন, কিন্তু তারা নানান অযুহাত দেখিয়ে এমুখো হননি।

বছর দেড়েক পর আনিকা একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানদের জন্ম দিল। কন্যাটি দেখতে হুবহু আনিসের মতো হয়েছে। সেই সুডোল নাক, উজ্জ্বল চোখ, বাঁকানো ভুরু…সবকিছুতেই আশ্চর্য মিল! মেয়ে হবার পর থেকে আনিস একেবারে খুশিতে ডগমগ হয়ে থাকে সারাদিন। গম্ভীর সহকর্মীর ফুরফুরে মেজাজ দেখে সহকর্মীরা টিপ্পনী কাটে। আনিস আপনমনে হাসে আর মাথা নাড়ে। তার বৈচিত্র্যবর্জিত একঘেয়ে জীবনটা আচমকা খুশির জোয়ারে ভ’রে উঠেছে। প্রথম খুশি আনিকার মতো একজন মায়াবতী,সহজ-সরল,নির্লোভ,নিরহংকার,নিরলস স্ত্রী তার জীবনে আসা। দ্বিতীয় খুশি তার সদ্যজাত কন্যা… আয়েশা। সকাল-দুপুর-রাত্তিরে মেয়ের নবনীতকোমল দেহের মিষ্ট সুভাস নিতে নিতে আনিস চিন্তা করে, আজতক আল্লাহ তার কোনো ইচ্ছে অপূর্ণ রাখেনি। একজন দ্বীনদার পয়মন্ত স্ত্রী সে চেয়েছিল,পেয়েছে। প্রথম সন্তান হিসেবে কন্যা চেয়েছিল,তাও পেয়েছে। আর কী চাই জীবনে? এই শুকরিয়া আদায় করে শেষ করবার মতো নয়।

প্রথম নাতনী জন্মের খবর পেয়ে সব ভেদাভেদ ভুলে মরিয়ম বেগম ও সজল আহমেদ একগাদা জিনিসপত্র নিয়ে ছুটে এসেছেন। নাতনী মেয়ের মতো কালো হয়নাই দেখে মরিয়ম বেগম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। সজল আহমেদ একটু হাসিহাসি মুখে নাতনীকে দেখলেন, কোলে নিলেন। তাঁকে দেখেও সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে৷ হাজার হোক,প্রথম নাতি-নাতনি অনুভূতি একটু অন্যরকমই হয় বটে;সেই সময়টাই উপভোগ করছেন তারা। নয়তো,আনিকা জানে,পৃথিবীর মাটিতে বাবা-মায়ের বৈরিতা কখনোই সমাপ্ত হবার নয়। দু’দিন পরই হয়তো আবার কোনো একটা বিষয় নিয়ে উলটে বসে থাকবেন। মরিয়ম বেগম বললেন,
– হ্যারে,চল। কয়টাদিন বাড়ি থেকে ঘুরে আয়।
কথাটা শুনতে খুবই ভালো লাগল আনিকার। কিন্তু পরক্ষণেই তার গর্ভকালীন দুর্ভোগের কথা মনে পড়ল। আনিকার সেবা থেকে শুরু করে রান্নাবান্না,কাপড়কাচা, ঘরদোর মোছা সব একহাতে করেছেন আনিসুর রহমান৷ আনিকার ওপর কঠোর নির্দেশ আরোপিত হয়েছিল,সে যেন এক গ্লাস জলও গড়িয়ে না খায়৷ সে নির্দেশ ভাঙার দুঃসাহস আনিকার ছিল না। গোটা গর্ভকালে সতেরবার কোরআন খতম করেছে আনিকা,বসে বসে এটিই ছিল তার একমাত্র কাজ। কিন্তু গর্ভকালে একটা বিষয় আনিকাকে ক্লেশিত করত সেটি হলো, বাড়ি যাওয়া। সারাবছর আনিকা দেখে এসেছে। পাড়াপড়শিদের কোনো বউ প্রথমবার পোয়াতি হলে তাদেরকে বাপেরবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হতো, যাতেকরে সেবাশুশ্রূষায় কোনো কমতি না হয়,পোয়াতির মনও শক্ত থাকে আপনজনদের কাছে থেকে। কিন্তু এই পুরোটা সময় আনিকার পরিবারে পক্ষ থেকে সেরকম কোনো আহবান আসেনি। আনিসও অবশ্য চায়নি৷ কষ্টগুলোকে ধামাচাপা দিয়ে আনিকা বলল,
– না মা। উনার কলিগের বউরা তো দেখতেছেই আমাকে। তাছাড়া, উনি দিবে না।
মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে মরিয়ম বেগম আর কিছু বললেন না। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে দুঃখী সুরে বললেন,
– মমিতা তো আমারে জ্বালায়া খাচ্ছে। লোকের মুখে নানান কথা শুনতেছি৷ বিয়ে দিয়ে দিতে হবে।
আনিকা এই প্রসঙ্গে কিছু না বলে চুপ করে রইল।

মমিতা ওর চেনা ছকে সত্যিই ইতোমধ্যে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। ‘পিউর লাভ’ বলে দুই-তিনজন ছেলের কাছে সে নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর তার মনে হয়েছে,খেলোয়াড় হিসেবে এরা দারুণ হলেও,স্বামী হিসেবে একেবারেই বাজে হবে। স্বামী হতে হবে একটু নরম-সরম,মেধাবী এবং অবশ্যই পয়সাওয়ালা। নতুবা এদের উপর ছড়ি ঘুরিয়ে আদপেই মজা নেই। বউয়ের ন্যাওটা না হলে সেই স্বামীর সঙ্গে সংসার করে কি মজা আছে! ভার্সিটির এক আগুন রূপওয়ালা বড় আপুর সঙ্গে মিশে এসব মতবাদ গ্রহণ করছে মমিতা। অসীম স্বাধীনতা আর স্বপ্ন নিয়ে জীবনটা সে নিজের মতো করে উপভোগ করছে। রাত জেগে পড়াশোনা, উথালপাতাল যৌনতা, ঘনঘন ট্যুর, জমিয়ে আড্ডা, ছেলেবন্ধুদের ইশারা-ইঙ্গিতে কামিনীসুলভ আবেদন দেখিয়ে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরানো…সবমিলিয়ে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো অতিবাহিত করছে সে। জীবনটা এতো সুন্দর হতে পারে! অথচ তার বোনটা কী করেছে! একটা কেতাদুরস্ত হুজুরের সঙ্গে লটকে পড়েছে! গায়ের রং কালো হলেও তার যৌবনের উচ্ছলতা দেখে মমিতার নিজেরও হিংসা হতো মাঝেমধ্যে। সে চাইলেই তার জীবনটা উপভোগ করতে পারতো। কেন,মমিতার বান্ধবী তো সোনিয়া করছে না! কালো হলেও কী স্মার্ট মেয়েটা,কালোকেই যেন সে দারুণভাবে স্মার্টনেসে পরিণত করেছে।

কিন্তু সজল সাহেব মেয়েকে উড়ন্ত অবস্থায় জমিনে ভূপাতিত করলেন। মেয়ের উশৃঙ্খল জীবন-যাপনে এলাকায় ঢিঢিক্কার পড়ে গেছে, লোকমুখে বদনাম শুনতে শুনতে দুকান পচে যাবার মতে অবস্থা হয়েছে। কন্যার ডানাকে ধীরে ধীরে নিজ হাতে পিঠে গুটিয়ে দিয়ে বললেন,
– তোমার জন্য একটা সম্মন্ধ আসছে। ছেলে আমেরিকা থাকে,ওখানে পড়াশোনা করে,ওখানেই সেটেল্ড। তোমাকে বিয়ে করে ওখানে নিয়ে যেতে চায়৷ আহা, ক্ষেপার দরকার নাই। ছেলেটাকে দেখো। পছন্দ হলে হলো,না হলে ক্যান্সেল।
ছেলেটাকে দেখে,কথা বলে একেবারে ফিদা হয়ে গেল মমিতা। ঠিক যেমনটা সে চেয়েছে,টাকাওয়ালা, একটু বোকাসোকা,দেখতে সুদর্শন। আর কী লাগে? দুদিন যাবত ভেবে ভেবে সবদিক বিবেচনা করে অবশেষে জমকালো আয়োজনে বিয়েটা সে করে ফেলল। সদ্যপ্রসূত বাচ্চা নিয়ে বিয়েতে উপস্থিত হওয়া সম্ভব হলো না আনিকার। তাছাড়া ওরকম নাচ-গানের বেহায়াপনার পরিবেশে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও তার ছিল না৷ আল্লাহর রহমতে বিয়েটা এমনসময় পড়েছে,যখন সে নড়চড় করার মতো ভালোভাবে সুস্থ হয়ে উঠেনি৷ নতুবা,বোনের বিয়েতে বোন কেন আসেনি,এনিয়ে একটা কথা উঠতে পারতো। সম্পর্কটাকে ঠিক রাখতে আনিস শুধু আকদতে গেল আর বিয়ের দিন কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে চটপট দুটো খেয়ে নিয়ে পরীক্ষার ডিউটির অযুহাতে চলে এলো। যদিও সদ্যঃপ্রসূত সন্তানকে মমিতা দেখতে অবধি আসেনি তবু অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে মমিতার নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা জানাতে ফোন করেছিল আনিকা। কিন্তু মমিতার অটল রূঢ়তার বিপরীতে খুব সংক্ষিপ্তভাবে পর্বটা সেরে নিল সে।

বিয়ের সপ্তাহখানেক পরেই মমিতা স্বামীকে নিয়ে আমেরিকা উড়াল দিল। আনিকা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল,
– ভালোই হলো বাবা,মেয়েটার একটা গতি হলো। ওর উশৃংখলতা মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল একেবারে।

ছয় বছর পর

আজ আনিস-আনিকার সপ্তম বিবাহবার্ষিকী। সেই উপলক্ষে ওরা প্রথমবারের মতো দূরে কোথাও ঘুরতে এসেছে। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। যেখানে সাগরের নীল জলরাশি আর নীলাকাশ মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে।… এতগুলো বছর সংসারের দৈন্যতাহীন অস্বচ্ছলতায় কোথাও যাবার ফুরসত মেলেনি তাদের। দু’দিন আগে এক রাতে হঠাৎ আনিকা আবদেরে গলায় বলল,
– চলেন না আমরা দূরে কোথাও ঘুরে আসি!
আনিস মেঝেতে বসে কিছু বইপত্তর নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিলেন। আনমনে বললেন,
– দূরে কোথাও কোথায়?
– অনেকদিন থেকেই আমার সেন্টমার্টিন যাবার শখ!
আনিস এবার চোখ তুলে আমতা আমতা করে বলল,
– সে তো,বিরাট খরচের কথা। জানেনই তো আমার…
কথা শেষ হবার আগেই আনিস দেখতে পেল আনিকা বিছানার তলা থেকে একতাড়া টাকা তার সামনে রাখল। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আনিস বলল,
– কোথায় পেলে এত টাকা!
– সাত বছর ধরে আপনার ঘর সামলানোর পাশাপাশি দু তিনটে করে টিউশনি করিয়েছি। কখনো জিজ্ঞেস করেছেন,সেই টাকাগুলো কোথায় যায়! কী করি!
– কেন করব? আপনার ভরণপোষণের দায়িত্ব আমার। সেই দায়িত্ব যদি আমি ঠিকমতো পালন করতে না পেরে আপনার টাকায় হাত পাতি,এটা আমার জন্য শরমের বিষয়। তাছাড়া বাচ্চাকাচ্চার পেছনে কত খরচই তো থাকতে পারে! আমি ভাবতাম…
-আচ্ছা যাইহোক। এবার আমার টাকায় বেড়াতে যেতে আপনার আপত্তি নেই তো?
আনিস চিন্তিতভাবে চুপ করে রইল। আনিকা
– এই দেহ-মন আপনার৷ আমার পুরো সত্তটাই আপনার সঙ্গে মিশে আছে। আপনি নিজেই বলেন,আমার কষ্ট হলে আপনি কষ্ট পান। এখন আমার কষ্টের টাকায় আপনাকে প্রথম কোনো উপহার দিতে চাচ্ছি,আপনি এতে আপত্তি করবেন কেন?
– আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনার অভিমানের মুখে পড়ার চেয়ে বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়ানো আমার জন্য সহজ।
দু’কান প্রসারী নির্মল হাসি জেগে উঠেছিল আনিকার ওষ্ঠাধরে। খুশিতে ভরে উঠেছিল মন। এই মানুষটা বরাবরই তার মান-অভিমান নিয়ে সচেতন এবং খানিকটা ভীতুও। কারণ নাকি,আনিকা রাগলেও মুখে কিংবা কাজেকর্মে তা কখনো প্রকাশ করে না। ভেতরে ভেতরে চেপে রেখে মনমরা হয়ে থাকে। এই জায়গাতেই আনিসের যত ভয়। অথচ সত্যি কথা হলো,মাঝখানে এই যে এতগুলো বছর পেরিয়ে গেল আজ অবধি কখনো এই মানুষটার ওপর সত্যিকারের রাগ জিনিসটা আসেনি৷ হ্যাঁ,দাম্পত্য জীবনের কত ছোটখাটো চড়াই-উতরাই তো ওরা অতিক্রম করেছে,কিন্তু কোনটির গভীরতাও অতোটা ছিল না৷
সেন্টমার্টিন এসে ওদের তিনজনের দিনটা বেশ আনন্দমুখরতায় কেটে গেল। এর আগে সমুদ্রকে এতটা কাছ থেকে উপভোগ করেনি আনিকা, মনে মনে ভীষণ উৎফুল্ল ছিল সে। আনিস অবশ্য চট্টগ্রাম পড়াকালীন বন্ধুদের সঙ্গে মিলে পতেঙ্গা সৈকতে গিয়েছিল। কিন্তু সমুদ্রের রূপ এখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেমন বিধ্বংসী তেমনি মনোহর,দৃষ্টিনন্দন। সৈকতের বেলাভূমিঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সার সার নারিকেল গাছ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। আসরের নামাজের পর হালকা নাশতা করে সাগরপাড়ে বসে নিজেদের মধ্যে আলাপে মশগুল ছিল তারা৷ আয়েশা বসে ছিল বাবা-মায়ের মাঝখানে। ওর বয়স এখন ছয় বছর। নূরানী মাদ্রাসায় প্রথম জামাতে পড়ছে। ভীষণ মেধাবী। ইতোমধ্যেই বাবা-মায়ের তেলওয়াত শুনে আগ্রহান্বিত হয়ে কোরআন শরীফের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বড় বড় সূরা মুখস্থ করে ফেলেছে। আনিস আয়েশার অগোচরে মজা করো বলে,‘ও তো গর্ভে থেকেই আপনার কাছে হাফেজা হয়ে বসে আছে। দুনিয়ায় একটু মনে করিয়ে দিলেই দেখবেন সে পারছে৷’
এক্ষণে,আয়েশাকে নিয়েই ওরা দু’জন মেতে আছে। একবার নূরানী মাদ্রাসার মুয়াল্লিম নাকি একটা মজার গল্প বলেছিল,সেটিই বাবা-মাকে শুনাচ্ছে আয়েশা। বাবা-মা যদিও গল্পটা জানে,তবুও এমনভাবে উৎকর্ণ হয়ে শুনছে যেন এর আগে কখনোই এমন সুন্দর গল্প তারা শ্রবণ করেনি৷ ফলশ্রুতিতে আয়েশার আত্মবিশ্বাস আর উৎসাহ দ্বিগুণ বর্ধিত হচ্ছে।

এসবের মাঝেই হঠাৎ দূরে একটা মানুষকে দেখে আনিকার বেশ চেনা চেনা মনে হলো। পরক্ষণেই ওর হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল। সেদিকে একদৃষ্টে চেয়ে উঁকিঝুঁকি দিতে দিতেই আনিকা বাঁ হাতটা বাড়িয়ে আনিসের জুব্বার খুঁট ধরে টান দিয়ে বলল,
– মনে হলো মমিতাকে দেখলাম!
আনিস কপাল কুঁচকে দৃষ্টি সংকুচিত করে বললেন,
– কী বলো!
– হ্যাঁ সত্যিই। আপনি আয়েশাকে নিয়ে বসুন। আমি দেখে আসছি।
আয়েশা বলে উঠল,
– কোথায় মমিতা আন্টি! আমিও যাব।
আনিস বললেন,
– আপনি যান। আমরা আছি আপনার থেকে একটু দূরে দূরে।
আনিকা বৈকালিক সূর্যের আভায় রাঙা সৈকতের কবোষ্ণ বালুকাবেলায় দ্রুত পা ফেলে অগুনতি মানুষের ভিড়ে একটা পরিচিত মানুষের আদল আঁতিপাঁতি করে খুঁজে বেড়াতে লাগল। একবার ওর মনে হলো, দৃষ্টিভ্রম নয় তো! পরক্ষণেই মন জোর দিয়ে মুহূর্তটার কথা স্মরণ করিয়ে দিল। দূরে দাঁড়িয়ে ঠিক ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল মমিতা। এরপর ঝট করে কোথায় মিশে গেল মেয়েটা! থেকে থেকে ওর সঙ্গে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনাগুলো মানসসরোবরে ভেসে উঠতে শুরু করল। আমেরিকা যাবার পর উপযাচিকা হয়েই আনিকার সঙ্গে আবারও পুরোদমে যোগাযোগ শুরু করে মমিতা। ভিডিয়ো কলে ভীষণ দম্ভভরে ঘুরে ঘুরে দেখায় ওর অসামান্য,উন্নত জীবনযাত্রার টুকরো টুকরো অংশ। ওর সাধারণ কথাবার্তার ভাঁজে ভাঁজে খুঁজে পাওয়া যেত নিজের ‘হাই-ক্লাস’ জীবনের অহমিকা আর আনিকার অতিসাধারণ জীবনের প্রতি সুস্পষ্ট ঘৃণা। এতকিছুর পরেও বোনের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করতে পারেনি আনিকা। কারণ সে চাইতো,বোন ফিরে আসুক সুপথে। ভেবেছিল, বিয়ের পরে সব ঠিক হয়ে যাবে,কিন্তু হয়নি। বরঞ্চ আমেরিকার মতো একটা দেশে গিয়ে ওর মনের ভেতরে থাকা সুপ্ত বাসনাগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। পরিবেশের উলঙ্গ ছোঁয়ায় উশৃংখল জীবনযাপনের সঙ্গে নিজেকে আরো শক্তপোক্তভাবে জড়িয়ে নিল। বোকাসোকা অথচ কড়িপিশাচ স্বামীর সাময়িক অনুপস্থিতির সুযোগে ইউনিভার্সিটি যাবার নাম করে রোজ রোজ মেতে উঠল নতুন সঙ্গী অন্বেষণে। অল্পদিনের মধ্যে একদল তরুণতরুণীর সঙ্গে ওর ভালোই বন্ধুত্ব হয়ে গেল। সেখানে একজনের সঙ্গে আবার ওর আশনাই ঘটে গেল। এভাবে একসময় পড়াশোনাটাও ছেড়ে দিল সে। স্বামীর অঢেল টাকা আছে,আরামদায়ক জীবন আছে, খেলুড়ে প্রেমিক আছে, ঘোরাঘুরির জন্য অসংখ্য নতুন জায়গা আছে! জীবন তো একটাই,কী দরকার সব থাকতে পড়াশোনায় সময় ব্যয় করা! কোনোমতে নামেমাত্র গ্রাজুয়েশন নিয়ে নিলেই হলো। একটা সময় তার লক্ষ ভিন্ন ছিল,তাই সে মনোযোগ দিয়ে পড়েছে। এখন সেসবের আর প্রয়োজন নেই। এভাবে কেটে গেল দুই বছর। স্বামী,শ্বশুর-শ্বাশুড়ি সকলেই ওর ওপর চরম বীতশ্রদ্ধ। ক্ষণে ক্ষণে মমিতার কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আসে বাংলাদেশে। তবে স্বামীকে মমিতা এমনভাবে মায়ার জালে আবদ্ধ করে রেখেছে যে, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি হত্যে দিয়ে ছেলের কাছে অনুরোধ করলেও ছেলে বউকে ছাড়বে না৷
এমন একটা সময় আচমকা মমিতার জীবনো-আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা দিল। ওর ক্রমবর্ধমান উন্নতির জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ জনপ্রিয় ছিল সে। তিন-চার বছর আগে সেলোয়ার-কামিজ পরা মেয়েটা আমেরিকা গিয়ে ছোট ছোট কাপড় পরে ছবি দিচ্ছে এটা উপভোগ করার মতো বিষয় বটে! কাজেই সোশ্যাল মিডিয়ায় শুধুমাত্র মজা নেবার উদ্দেশ্যে মমিতাকে ফলো করে হাজার বিশেক মানুষ। একদিন একেবারে আচমকা মমিতার ফেসবুক আইডি হ্যাকড হয়ে গেল,এবং সঙ্গে সঙ্গেই ওর ফেসবুক আইডি থেকে একটা ভিডিয়ো আপলোড করে দেওয়া হলো। ভিডিয়োতে দেখা গেল, আধো-অন্ধকার একটি কক্ষে একজন বাংলাদেশি যুবার সঙ্গে হেসেখেলে আদিম খেলায় মেতে উঠেছে মমিতা। ঘন্টাখানেকের মধ্যে ভিডিয়োটা রিমুভ হয়ে গেলেও ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। সারাদেশের তরুণসমাজের ফোনের গুপ্ত গ্যালারিতে স্থান পেয়ে গেল এই রগরগে স্ক্যান্ডালটি। ভিডিয়োতে মমিতার মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। দেখা যাচ্ছিল,কীভাবে সে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অংশ নিয়েছিল এই আদিমতায়। এরপর যা হবার তা-ই হলো। মমিতার ডিভোর্স হলো। না চাইতেও মেয়ের ভিডিয়োটা দেখে ফেলে দুঃখে-কষ্টে-অপমানে আত্মহত্যা করলেন সজল সাহেব। মরিয়ম বেগম একবুক কষ্ট নিয়ে আনিকার কাছে এসে স্বীকার করলেন,তাদের মাত্রাতিরিক্ত আদর পেয়েই মেয়েটা এমম উচ্ছনে গেছে। এরপর গোটা গোটা তিন বছর পেরিয়ে গেলেও মমিতার কোনো খোঁজ মেলেনি৷ কেউ বলে আমেরিকাতেই আছে,আবার কেউ বলে দেশে এসে উদ্ভ্রান্তের মতো জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। মরিয়ম বেগম এখনো শূন্য ঘরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে একবারের তরে মেয়ের খোঁজ চান। যতযাই হোক,মায়ের মন তো!

– কীরে আমাকে খুঁজতেছস?
চকিতে চমকে উঠে আনিকা। পেছনে ফিরে দেখে সহাস্য মুখে,অম্লান বদনে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে মমিতা৷ চেনা যাচ্ছে না ওকে। যে রূপের কারণে ওর এত বারফট্টাই ছিল সেই রূপ এখন পশ্চিমাকাশের অস্তাচলগামী সূর্যের মতোন মিহি আলো ছড়াচ্ছে। আনিকার মুখে রা নেই। বুকের বাঁপাশটা ঢিপঢিপ করছে তার। আবারো খোঁচা দিয়ে বলে উঠে মমিতা,
– শরীরটা নোংরা বলে জড়াই ধরবি না?
আনিকা তবুও প্রস্তরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। একটুসময় পর বলল,
– কোথায় ছিলি এতদিন?
মমিতা ম্লান হাসল,
– দেশ হতে দেশান্তরে।
– কী করিস এখন?
– সেটা শুনলে তোর লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করবে।
– এতকিছুর পরেও এমনকিছু কেন করিস তাহলে?
– চারপাশে একবার তাকায়া দেখ,সবাই আমারে দেখতেছে,সবাই চিনে আমাকে। আমার আর কিছু করার নাই বুঝলি। আমি শেষ হয়ে গেছি৷ আমার কারণে বাবা মরছে। মা পাগল হইছে। এখন নিজেরে এক্কেবারে শেষ করার মতোন সাহস নাই বইলাই তো তিলে তিলে শেষ করতেছি।
আনিকা চারপাশে একনজর তাকিয়ে দেখল,প্রায় প্রত্যেকটা মানুষ মুখে ক্রূর হাসির রেখা টাঙিয়ে মমিতার দিকে আড়নয়নে তাকাচ্ছে। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে আনিকা বলল,
– কত সতর্ক করছি, মনে আছে তোর…। অথচ…।
– বাদ দে না! খুব সুখে আছিস না?
আনিকা একটা বড় নিশ্বাস টেনে অদূরে উদাসীনভাবে দণ্ডায়মান স্বামী-কন্যার দিকে চেয়ে রাশভারি গলায় বলল,
– হুম,খুব। দীর্ঘ চব্বিশ বছর ধৈর্যের পরীক্ষার পর আল্লাহ আমাকে যে পুরষ্কার দিছে… সবই আল্লাহর দয়া। ধৈর্যের ফল। আমি কখনো আল্লাহর কাছে অভিযোগ করিনাই যে, আল্লাহ আমারে কেন কালো বানায়ে পাঠাইলা! কেন আমার বাবা-মার মনে আমার জন্য একটু মায়াদয়া দাওনাই।
– জানি তো,…সুখের নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নাই জানিস! সুখশান্তি বলে আমি শুধু মরিচীকার পেছনে ছুটছি। যাইরে,আমার জন্য দোয়া করিস। মাকে বলিস,আমি ভালো আছি।
বলেই জবাবের অপেক্ষা না করে মমিতা দ্রুত প্রস্থান করল। আনিকা ওকে আটকাতে চেয়েও পারল না৷ আরো অনেক কথা বলার ছিল,বলা হলো না।
বল্কলধারী সন্যাসীর মতো এভাবেই ঘুরে বেড়িয়ে নিজেকে অনিবার্য ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে সে! আনিস দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। সেদিকে এগোতে এগোতে আনিকার মনে একটা দারুণ তত্বকথার উদ্ভব হলো,‘অতিরিক্ত আদরস্নেহ যেমন মানুষকে সুপথগামী করতে পারে না,তেমনি অতিরিক্ত অবহেলা আর বৈষম্য মানুষকে বিপথগামী করতে পারে না। সাত আসমানের ওপরে যিনি অধিষ্ঠিত সেই খোদাওন্দের পরিকল্পনা বুঝার সাধ্যি কার?’
ফিরে এসে ওরা তিনজন একান্ত নিরজনে সমুদ্রপাড়ে হাঁটতে লাগল। আয়েশার ছোট দুই হাত দু’দিক থেকে আলতো করে ধরে আছে আনিস আর আনিকা। উত্তাল সাগরের নীলাভ ফেনিল জলরাশি নির্দিষ্ট সময় পরপর ওদের পদতল চুম্বন করে ফিরছে…।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here