#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
২৭.
খাবার টেবিলে চেয়ার টেনে বসে আছে আভাদের পুরো পরিবার। আভার মা স্বামী সন্তানের পাতে মাংসের টুকরো তুলে দেন। আভা মায়ের হাত থামিয়ে বলে,’ মাংস না। ভাজি দাও মা। ‘
আভার মা মেয়ের কথামত এক চামচ ভাজি মেয়ের পাতে দেন। মিনহাজ খাবারের ফাঁকে আড়চোখে বাবাকে লক্ষ্য করে। বাবা বেশ খোশ মেজাজে আছেন। হয়ত এখন বিয়ের কথাটা তুললে মন্দ হয় না। মিনহাজ কিছু বলার পূর্বে আভা বলে উঠে,
‘ বাবা, আমি সিলেট যেতে চাই। ‘
জুনায়েদ খাবার খাওয়া থামান। থমথমে মুখে মেয়েকে খানিক পরখ করে পুনরায় মাথা নত করে খেতে থাকেন। আভা মৃদু নিঃশ্বাস ছাড়ে। বাবা কি যেতে দিবেন না? আভা মায়ের দিকে কাতর চোখে তাকায়। আদুরে মেয়ের কাতর দৃষ্টি ফেলতে পারেন না আভার মা। স্বামীর দিকে চেয়ে বলেন,
‘ যেতে চাইছে যখন, যাক না। ‘
জুনায়েদ বলেন,
‘ কদিন আগে সাজেক গিয়ে এল। এখন আবার কেন যাবে? ‘
‘ কদিন কই, বাবা? তিনমাস আগে গিয়েছি। ‘
‘ তিনমাস বেশি সময়? ‘
‘ তা না। ‘
আভার কণ্ঠ নিচু হয়ে আসে। বাবার কথা অমান্য করার সাধ্য তার নেই। কখনো বাবার মুখের উপর কথা বলতে পারে না আভা। আল্লাহ হয়ত আভাকে সে শক্তি দেন নি। বাবাকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করে সে। আভার মা মেয়ের মন খারাপ দেখে স্বামীকে বলেন,
‘ মেয়েটা যেতে চাইছে। তাছাড়া এখন পরীক্ষা শেষ। বন্ধতে কোথাও ঘুরে আসলে পড়াশোনা ভালো হবে। ‘
জুনায়েদ খানিক সময় মেয়েকে লক্ষ্য করলেন। আভা চোখ ছোট করে বাবার দিকে চেয়ে আছে। একটুখানি আশা পাওয়ার উদ্দেশ্যে। জুনায়েদ মৃদু নিঃশ্বাস ছাড়লেন। বললেন,
‘ তিনদিনের জন্যে যাবে। ‘
আভা চেয়ারে নেচে উঠল। চোখ দুখানা উজ্জ্বল হয়ে গেল। ছোট ছিমছাম গড়নে প্রবল আনন্দের ছাপ। আনন্দের চোটে পাশে বসে থাকা মায়ের দেহ জড়িয়ে ধরলো। আভার মা মেয়ের এমন পাগলামি দেখে হাসতে লাগলেন। বোনের খুশিতে মিনহাজ আর নিজের খুশির কথা তোলার সাহস করতে পারল না। চেপে গেল আরোহীর কথা।
______________
সিলেটের যত্রাগামী বাস স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আভা এবং তার বাবা। মেয়ের ব্যাগে এক বোতল পানি রেখে বললেন,
‘ আর কিছু লাগবে? ‘
আভা মানা করল। জুনায়েদ পকেট থেকে তিন হাজার টাকার নোট বের করে মেয়েকে দিলেন। বললেন,
‘ কার্ড দিয়েছি ব্যাগে। আর খুচরো কোনো প্রয়োজন হলে এই টাকাগুলো খরচ করবে। ‘
‘ আচ্ছা। এবার আসি? ‘
আভার বাবার চোখ ভিজে উঠল। মেয়ের মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করে দোয়া পাঠ করে বললেন, ‘ আসো। সুস্থভাবে ফিরে আসবে। ‘
‘ তুমিও ভালো থাকবে। ‘
আভা বাসে উঠে পড়ে। বাসের জানালার কাছে সিট পেয়েছে আভা। ব্যাগটা সিটের উপরে রেখে জানালার কাছে বসে। জানালার কাঁচ খুলে দিল। আজ প্রচণ্ড গরম পড়েছে। গরমে বোধ হচ্ছে গা পুড়ে যাচ্ছে। আভা খোলা চুল খোঁপা করে নিল। ব্যাগ থেকে পানি বের করে দু ঢোক পানি খেল। অতঃপর অপেক্ষা করতে লাগল আহনাফদের।
দশ মিনিট পরে আহনাফ ও তার বন্ধুরা বাসে উঠে। দূর থেকে আভাকে দেখে বাঁধন চমকে উঠে। এতদিন পর সেই কাঙ্ক্ষিত মেয়ে? হুড়মুড়িয়ে আভার কাছে এসে দাঁড়ায় বাঁধন। আভা মুচকি হাসে। অবাক হওয়ার ভান করে বলে,’ বাঁধন ভাই, তোমরা এই বাসে? সিলেট যাচ্ছ নাকি? ‘
বাঁধন নিজের হাতে চিমটি কাটে। আশ্চর্য লাগছে তার। আভাকে হন্যে হয়ে খুঁজেও সন্ধান পায়নি। আর আজ আভা স্বয়ং তার চোখের সামনে। তাদের সাথে সিলেট যাচ্ছে? হাতের চিমটি খেয়ে ব্যথায় ‘ উহ ‘ করে উঠে বাঁধন। আভার দিকে চেয়ে বলল,
‘ তুমি সত্যি আভা তো? ‘
আভা আশেপাশে তাকায়। তারপর নিজের গা ছুঁয়ে বলে,
‘ তাই তো মনে হচ্ছে। কেন আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে তোমার? আভার ভূত? ‘
আভা কিটকিট করে হেসে উঠল। বাঁধন মুগ্ধ চোখে আভাকে দেখল। এই মেয়েকে পাওয়ার জন্যে এতদিন বাঁধন কি না কি করেছে? বন্ধুদের কাছে দুহাত পেতে ভিক্ষা চেয়েছে আভার নাম্বার। কেউ দেয়নি নাম্বার। বাঁধন জানে ওদের কারো না কারোর সাথে আভার যোগাযোগ আছে। তবুও যে কেন তারা বাঁধনকে আভার নাম্বার দেয়নি কে জানে?
বাঁধন বলল, ‘ আভা, আমি তোমার পাশে বসি? যদি তুমি কিছু মনে না করো। ‘
আভা কিছুটা অপ্রস্তুত হল বটে। ওরনা টেনে গায়ের সাথে মিশিয়ে বলল, ‘ আসলে…..’
‘ বাঁধন, এটা আমার সিট। ‘
আহনাফ কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বাঁধনের পাশে এসে দাঁড়ায়। বাঁধনের কাঁধে হাত রেখে মৃদু হাসে। বাঁধন অসহায় বোধ করে। আভার পাশে বসার জন্যে সে মরে যাচ্ছে। আর এই আহনাফ কি না এখন আমার সিট, আমার সিট বলে চেঁচাচ্ছে। বাঁধন আহনাফের কানে কানে বলল, ‘ ভাই, একটু ম্যানেজ কর না। কতদিন পর মেয়েটাকে দেখলাম। একটু বসতে দে। গল্প করব দুজন। ‘
আহনাফ কিছু বলার আগে কামরুল পেছন থেকে চিৎকার করে ডাকে বাধনকে। বাঁধন পেছনে ফিরে তাকালে কামরুল নিজের পাশে সিটটা দেখিয়ে বলে, ‘ এই দ্রুত এই সিটে এসে বসে যা। বাস ছেড়ে দিচ্ছে। ‘
বাঁধন অসহায় চোখে আহনাফের দিকে চায়। দু চোখের ইশারায় সিটটা দিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করে। আহনাফ বন্ধুর কাতর চোখের দৃষ্টি উপেক্ষা করতে পারে না। আভার দিকে আড়চোখে চেয়ে পেছন ফিরে চলে আসতে চায়। অথচ আভা সবার সম্মুখে ডাক দিয়ে উঠে, ‘ আহনাফ, আমি আপনার পাশে বসতে চাইছি। যদি আপনি কিছু মনে না করেন। ‘
আহনাফ মাথা নত করে ঠোঁট টিপে হেসে উঠে। অতঃপর বাঁধনের দিকে ফিরে তাকিয়ে এমন ভাব করে যেন তার এখন কিছুই করার নেই। বাঁধন দুঃখী দুঃখী দৃষ্টিতে আভাকে দেখে। আভা নিরুত্তর। বাঁধনকে চোখের ইশারায় সরি বলছে। কি আর করার! বাঁধন চুপ করে সরে যায় তাদের মাঝখান থেকে। আহনাফ ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছাড়ে। ব্যাগটা পাশে রেখে আভার পাশের সিটে বসে। রোদ চশমা চোখের থেকে খুকে শার্টের কলারে ঝুলিয়ে রাখে। আভা আড়চোখে আহনাফকে দেখে। তারপর আহনাফের দিকে ঝুঁকে এসে মিনমিন করে বলে, ‘ সানগ্লাস শার্টের কলারে ঝুলিয়ে রাখলে আপনাকে অনেক সুন্দর দেখায়, রাগীনাফ। ‘
আহনাফ কপালে আঙ্গুল ঘষে মৃদু শব্দ করে হেসে ফেলে। আভার দিকে চেয়ে আভার ন্যায় মিনমিন করে বলে, ‘ প্রশংসার জন্যে কি দেওয়া যায়? চুমু দিলে চলবে? ‘
আভা হকচকিয়ে উঠে। দ্রুত নিজের জায়গায় বসে ওড়না ঠিক কর বলে, ‘ ছিঃ, অসভ্য লোক। ‘ আহনাফ মৃদু হাসে।
বাস ছেড়ে দিয়েছে। আভার বাসে উঠলে ঘুম পায়। ঘুমে চোখ যেন অসাড় হয়ে আসে। এখনো ঘুম পাচ্ছে। আর তাকিয়ে থাকতে পারছে না। আভা আলতো করে আহনাফের কাঁধে মাথা রাখে। চোখ বুজে বলে, ‘ এখানে ঘুমাই আমি? ‘
আহনাফ আভার ওড়না সুন্দর করে মেলে দেয় আভার গায়ে। সম্পূর্ন শরীর ওড়না দিয়ে ঢেকে আভার হাত নিজের হাতে পুড়ে নেয়। সহসা বলে, ‘ এখন ঘুমাও। ‘
আভা মুচকি হাসে। চোখ বুজে বিড়বিড় করে আওড়ায়, ‘ আপনি খুব ভালো, রাগীনাফ। পুরুষরা এত ভালো হয়, জানা ছিল না। ‘
দেখা গেল, কিছুক্ষণের মধ্যে আভা ঘুমে কাহিল। আহনাফ মোবাইলে কিছু একটা দেখছে। সহসা বাঁধনের দিকে চোখ যায়। বাঁধন খুব অন্যমনস্ক। আহনাফ বুঝতে পারে, বাঁধনের মন খারাপ। তার কি দোষ? আভার পাশে বসে সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার লোভ যে সে সামলাতে পারেনি। প্রেমিক হতে গিয়ে হয়ত সে বন্ধুত্বের দায়িত্ত্ব পালনে ব্যর্থ হয়ে গেছে। আহনাফ ঘাড় হালকা কাত করে আভার দিকে চায়। ঘুমন্ত কিশোরীর ন্যায় লাগছে আভাকে। ফোলাফোলা গালে ইচ্ছে করছে চট করে একটা চুমু বসিয়ে দিতে। কিন্তু আহনাফ হচ্ছে ভদ্র পুরুষ। সে নিজেকে সংযত করতে জানে। আহনাফ বিড়বিড় করে আওরায়,
‘ গতবার প্রেমে পড়েনি দেখে বেঁচে গেছি। এবার কি করে বাঁচব? এই মেয়েটা দেখছি এবার আমার চরিত্রে দাগ লাগিয়েই ছাড়বে। উফ, ভয়ংকরী। ‘
______________
বাস থেমে যায় মৌলভীবাজারে। আভাসহ সকল বাসযাত্রী নেমে দাঁড়ায় বাস থেকে। আভা মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে। সদ্য ঘুম থেকে উঠার দরুন মাথার চুল এলোমেলো, অগোছালো। কপালের উপর পড়ে আছে কিছু বেবি হেয়ার। মুখে তৈলাক্ত ভাব। নরম তুলতুলে গাল ফুলে আছে এই মুহূর্তে। আভাকে এমন অবিন্যস্ত দেখে আহনাফ বলল, ‘ মুখ ধুবে? ‘
আভার চোখে এখনো ঘুমেরা ছোটাছুটি করছে। আভা ঘুমঘুম কণ্ঠে বলল, ‘ হু। ‘
আহনাফ তার ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে আভার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে মুখ চোখ ধুয়ে নাও। ‘
আভা পানির বোতল হাতে নিয়ে হেলেদুলে রাস্তার পাশে চলে গেল। মুখ হাত ধুয়ে আবার ফিরেও এল। আহনাফ টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ মুখ মুছে নাও। ‘
আভা বাধ্য মেয়ের ন্যায় আহনাফ যা বলছে তাই করছে। আহনাফের হাত থেকে টিস্যু নিয়ে মুখ মুছে ফেলল। আহনাফ বলল, ‘ তুমি সামনের ওই মহিলাদের সাথে হাঁটো। আমি পেছন পেছন আসছি। ‘
‘ আচ্ছা। ‘
আভা কোনোরূপ দিরুক্তি না করে চুপচাপ সামনে চলে গেল। আহনাফ মৃদু নিঃশ্বাস ছেড়ে বন্ধুদের কাছে এল। বাঁধন এতক্ষণ শকুনি দৃষ্টিতে আভা এবং আহনাফের কার্যকলাপ দেখছিল। আভার প্রতি আহনাফের এমন যত্নআত্তি দেখে তার ভেতর খটকা লাগছে। ওদের দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে তারা পূর্বপরিচিত। শুধু পরিচিত নয়, আভা আহনাফের বিশেষ কেউ। আহনাফ বন্ধুদের সামনে এসে দাঁড়াল। রোদ চশমা চোখে দিয়ে বুক টানটান করে বলল,
‘ যাওয়া যাক এবার। ‘
কামরুল মুখে চোখে পানি ছেটাচ্ছে। এতটা দূর সফর করে এসে সে বড্ড ক্লান্ত। চিত্রা লাগেজ হাতে নিয়ে চোখ মুখ খিঁচে দাড়িয়ে আছে। আহনাফকে দেখে বিরক্ত হয়ে বলল,’ হিল পড়ে পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে আমার। কি করব এখন? আমি আর কোনো জুতো আনিনি। ‘
দিহান রাগ করে বললো, ‘ এই পাহাড়ি এলাকায় তুই হিল জুতো কোন যুক্তিতে আনিস? সব জায়গায় ফ্যাশন না দেখালে চলে না? ‘
আহনাফ দিহানকে আটকালো। বলল, ‘ বাদ দে। চিত্রাকে সামনের কোনো দোকান থেকে স্যান্ডেল কিনে দেওয়া যাবে। আপাতত কষ্ট করে হাঁটতে হবে। ‘
চিত্রা দিহানের দিকে রাগ নিয়ে চাইল। বলল,’ সবসময় তোর রাগারাগি। আহনাফের কাছে সকল সমস্যার সমাধান আছে। তোর মত মাথামোটা না সে। ‘
দিহান বিড়বিড় করে কতগুলো বকা দিয়ে পেছন ফিরে গেল। আসলে সাত ঘণ্টার এত লম্বা সফর করে সবারই মেজাজ বেশ চটে আছে। খিটখিটে মেজাজ নিয়ে কারো সাথে কথা বাড়ান মানে ঝগড়া করা। আহনাফ বাধনের দিকে চাইল। বলল, ‘ তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? হোটেলে যাবি না? ‘
আহনাফ বাধনের কাঁধে হাত রাখলে বাধন চট করে আহনাফের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সামনে হাঁটা ধরে। আহনাফ ভ্রু কুঁচকে বাধনের যাওয়ার পথে চেয়ে থাকে।
#চলবে