#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম – ২০
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
_______________________________
রাত দুটো বেজে দশ মিনিট। সারা পাড়া চুপ। রাতের আঁধারে ঢাকা ধরনী। নিস্তব্দ ঘরে নিঃশ্বাসের শব্দ অব্দি শোনা যাচ্ছে। পড়ার টেবিলে বসে রয়েছে আভা। সশব্দে সাধারণ জ্ঞান মুখস্ত করছে। রাতে নিশ্চুপ অবস্থায় পড়া ভালো হয় আভার। আহনাফের কড়া নজরদারির কারণে আভার আরো ভালো করে পড়াশোনা করতে হয়। আভা হামি ছাড়ে। বড্ড ঘুম পাচ্ছে। ইচ্ছে করছে, বিছানায় এখনি লুটিয়ে পড়তে। কিন্তু পড়া বাকি এখনো। কি করবে?
আভা ফোন বের করল। আহনাফের দুটো মেসেজ এসেছে।
‘ পড়ছ? ‘
‘ কল করব? ‘
আভা হেসে ফেলল। কদিন ধরে আহনাফের সাথে পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু নিয়ে কথা হয় না তার। আভা চায়, আহনাফ আগের ন্যায় বেহেয়া কথা বলুক, দুষ্টু হোক। অথচ আহনাফ সেসব কিছুই করে না সারাক্ষণ শিক্ষকদের ন্যায় আভার পড়া নিয়ে পড়ে থাকে। খারাপ লোক! আভা কল দিল আহনাফের নাম্বারে। আহনাফ কল কেটে দিল। এক মিনিট পর নিজে কল ঘুরাল।
‘ কল কাটলেন কেন? আমার মোবাইলে টাকা ছিল। ‘
আহনাফ উত্তর দিল,
‘ একজন কল করলেই হলো। পড়াশোনা কেমন যাচ্ছে? ‘
আভা ঠোঁট উল্টে বলল,
‘ পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু বুঝেন না আপনি? সারাক্ষণ শুধু পড়া আর পড়া! ‘
আহনাফ মৃদু হাসে। বলে,’ আপাত অর্থে না। ‘
‘ খারাপ লোক। ‘
‘ ভিডিও কলে আসো। ‘
‘ এখন? আচ্ছা। ‘
আভা কল কেটে ভিডিও কল দেয় আহনাফকে। আহনাফ কল ধরে। আহনাফ পড়ার টেবিলে বসে রয়েছে। টেবিলের একপাশে মোবাইল হেলান দিয়ে রাখা। টেবিলের সবখানে ছড়িয়ে আছে বই আর বই। একেকটা বইয়ের আকার বিশাল থেকে বিশাল। আভা চোখ বড়বড় করল। অবাক কণ্ঠে সুধাল, ‘ এত বড় বই? কখন পড়েন এসব? ‘
আহনাফ ক্লান্ত কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘ মেডিকেলে সব বই এমন। কিছু করার নেই। পড়তে হয়। ‘
আভা ভয় পেয়ে বলল,’ এসব বই দেখে আমার মেডিকেল পড়ার ইচ্ছে মাটি হয়ে গেছে। ‘
আহনাফ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বলল, ‘ বাজে কথা বলবে না। জীবনে কিছু অর্জন করতে হলে কষ্ট করতে হয়। তুমিই তো বলেছিলে, কষ্ট ছাড়া কিছু পেয়ে গেলে তার মূল্য ফিকে হয়ে যায়। এখন নিজেই পিছিয়ে যাচ্ছ। ‘
আভা মন দিয়ে শুনে আহনাফের কথা। মনে পড়ে, বাবা মায়ের তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার কথা। বাবার ইচ্ছে, আভা যেন দেশের সেরা মেডিকেলে পড়ে খুব ভালো ডাক্তার হয়। আভাকে এভাবে হেরে গেলে চলবে না। জিততে হবে।
আহনাফ বলল, ‘ আজ কি কি পড়লে? সব একে একে বলো। ‘
আভা বিরক্ত হল। বলল, ‘ আমি এখন পড়া নিয়ে কিছু বলতে চাইছি না। আমি এখন অন্য কথা বলব। ‘
আহনাফ ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ পাগলামি করবে না। এখন প্রেম করার সময় না। বই বের করো। ‘
‘ না। বই বের করব না। ‘
আভার নাছোড়বান্দা উত্তর। আহনাফ চোখে উল্টে মৃদু নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘ পড়ার ব্যাপারে সিরিয়াস হতে হবে, আভা। এভাবে পড়লে ডাক্তার হতে পারবে না। ‘
‘ আপনি অযথাই চিন্তা করছেন। আমি সবসময় পড়া ফাঁকি দেইনা।”
‘ তাই? ‘
আহনাফ ভ্রু বাঁকাল। ঠোঁটে কৌতুক হাস। আভা বলল, ‘ হ্যাঁ। কোনো সন্দেহ আছে? ‘
‘ আচ্ছা? তা, আর কি কি জানেন আপনি? ‘
আহনাফের কণ্ঠে আপনি সম্বোধন শুনে আভার শিরদাঁড়া কেপে উঠল। এত মধুর লাগল কথাটা। ইশ! সে সদা এমন করে কথা বলে না কেন? আভা উত্তর দিতে পারল না। কেমন যেন কণ্ঠ অসাড় হয়ে এল। আভাকে লজ্জায় লাল হতে দেখে আহনাফের চোখে লাল-নীল মুগ্ধতা ছড়াল। ভুলে গেল নিজের গম্ভীরতা। মেতে রইল প্রিয়তমাতে।
_____________________________________
আজ আভার ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষনা হবে। সকাল থেকে আভা ভয়ে সেটে আছে ল্যাপটপের সামনে। গা কাপছে। এতদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল আজকে জানবে আভা। এ কদিন আহনাফের সাহায্য আভার সারাজীবন মনে থাকবে। কথায় আছে, প্রেমে পড়লে পড়াশোনা গোল্লায় যায়। অথচ আভার ক্ষেত্রে তা একদম ভিন্ন। এই তিনমাস আহনাফের সাথে পড়াশোনা ব্যতীত অন্য কথা খুব কমই হয়েছে। আহনাফ সদা সতর্ক ছিল আভার পড়াশোনা নিয়ে। আভার হয়তো হঠাৎ হঠাৎ আহনাফের এসব সতর্কতা ভালো না লাগলেও, আহনাফ ঠিক বেশ সামলে নিয়েছে আভাকে। এই তিনমাস আহনাফ নিজ হাতে আভাকে পড়িয়েছে। আজ যদি আভা হেরে যায়, আভার সাথেসাথে আহনাফও হেরে যাবে। আভা চায় না, আহনাফ হেরে যাক। আহনাফের এতদিনের কষ্টের মূল্য আভা দিতে চায়। একসঙ্গে ডাক্তার হতে চায় দুজনে।
ফলাফল ঘোষিত হয়েছে। আভার হাত কাপছে। ল্যাপটপের কিবোর্ড চাপতে পারছে না। বুক ধরফর-ধরফর করছে। এই বুঝি জ্ঞান হারাল আভা। আভা চোখ বুজে কালিমা পড়ল কয়েকবার। আভার মা মেয়ের পাশে বসে শক্ত করে চেপে রেখেছেন আভার হাত। আভার বাবা জুনায়েদ মেয়ের পাশে বসে ল্যাপটপে চেয়ে আছেন। কখন ফলাফল চোখের সামনে ভাসবে? মেয়েকে নিয়ে দেখা এতদিনের স্বপ্ন কখন পূরন হতে দেখবেন?
আভা নিজেকে শান্ত করল। আল্লাহর নাম জপ করে নিজের নাম লিখে সার্চ করল। লোডিং হচ্ছে। আজ সার্ভার বেশ ডাউন। প্রতি বছর এমন হয়। ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল দেখার সময় সার্ভার ডাউন হয়ে যায়। আভা চোখ খিচে রয়েছে। প্রাণ যেন কেউ টেনে ধরেছে। সময়টা এত লম্বা কেন?
‘ আমার মা চান্স পেয়ে গেছে, মনোয়ারা। আমার মা চান্স পেয়ে গেছে। ‘
আভার বাবা জুনায়েদ খুশিতে আত্নহারা হয়ে আভাকে জড়িয়ে ধরলেন। আভা পাথর হয়ে আছে। বিশ্বাস করতে পারছে না। আভা ধীরে চোখ খুলে ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকাল। ঢাকা মেডিকেলের পাশে আভার নাম জ্বলজ্বল করছে। আভার চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। সে জিতে গেছে, বাবা-মা জিতে গেছেন, আহনাফের কষ্টগুলো জয়ী হয়েছে। আভা কেঁদে ফেলল। ঝরঝর করে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো বাবা-মাকে। আভার বাবা মায়ের চোখেও আজ জল চিকচিক করছে। এ দিন আভার জীবনে শ্রেষ্ট দিন হয়ে থাকবে। আভা সারাজীবন মনে রাখবে জীবনের এই শ্রেষ্ট প্রাপ্তির দিনকে।
____________________________
আভা বিছানায় বসে আছে। দ্রুত মোবাইল হাতে নিয়ে আহনাফের ফোনে কল করল। প্রথমবার রিং বাজার সঙ্গেসঙ্গে আহনাফ কল রিসিভ করল। আভা কথা বলতে পারছে না। কথাগুলো গলায় আটকে রয়েছে। আভা নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করল। অতঃপর মৃদু চিৎকার করে বলল,
‘ আমরা জিতে গেছি, আহনাফ। জিতে গেছি আমরা। ‘
আহনাফ মৃদু হাসে। আভা খুশিতে আজ পাগল হয়ে গেছে। আহনাফের বুকে পানি আসে। বুকটা প্রশান্তিতে ছেয়ে যায়। মৃদু কন্ঠে বলল
‘ ওয়েলকাম টু আওয়ার কলেজ, বউফ্রেন্ড! ‘
আভার চোখে জল টুইটুম্বর করছে। বুকে হাত চেপে চোখ বুজে রয়েছে আভা। এত খুশি সে আর কখনো হয়নি। আহনাফ আভার খুশি অনুভব করার চেষ্টা করে। আভা আর আহনাফের সাথে কথা বলছে আর অযথাই হাসছে। হাসি যেন আজ বাঁধ ভেঙেছে আভার। আহনাফ ধৈর্য্য নিয়ে আভার কথা শুনছে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here