#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম – ১৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
__________________________
আভার আকাশে মন খারাপের মেঘ ন্যায় উড়ে বেড়ায়। আহনাফের আকাশে বিভ্রান্তের দেয়াল। সুতোর দু প্রান্তে দুজন ভালোবাসার কাঙালের ভাবনার দাপট। সে কি তীব্র যন্ত্রণা! আকাশে মন পুড়ে যাওয়ার বিদঘুটে গন্ধ।
আহনাফ গিটারে সুর তোলার চেষ্টা করল। পারল না। আবার চেষ্টা করল। চোখ বুজে নিল। চোখের আয়নায় কে ভাসে? এক এলোকেশী কন্যা। যার গায়ে বধূর শাড়ি। মখমলে পা আলতায় ডুবে। আঁচলে মুখ আড়ালে। চোখ দুখানা দেখা যায়। চোখে যে কি মায়া। ও চোখে ডুবে যাওয়া যায় অবলীলায়। সাঁতরে পাড় হওয়া যায় না। প্রেমের ঢেউয়ে গা ভেসে যায়। কে সে? কে এই কন্যা? আহনাফ চোখ বুজে বিড়বিড় করে, ‘ আভা! আমার আকাশের তারা। আমার আকাশরানী। ‘
আহনাফের ঠোঁট হাসে, চোখ হাসে। ঠোঁটের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ভালোবাসার হাস। কপালের কুঁচকে রাখা ভ্রুযুগল সোজা হয়। আহনাফ সুর তুলে। গলা ছেড়ে গায়,
‘ যে পাখি ঘর বোঝেনা
যে পাখি ঘর বোঝেনা
উড়ে বেড়ায় বন বাদাড়ে
ভোলা মন মিছে কেন
মনের খাঁচায় রাখিস তারে
যে পাখি ঘর বোঝেনা
যে পাখি ঘর বোঝেনা
উড়ে বেড়ায় বন বাদাড়ে
ভোলা মন মিছে কেন
মনের খাঁচায় রাখিস তারে
ও পাখি বাঁধন হারা ছন্নছাড়া
মানেনা প্রেমের শিকল
ও পাখি দশ দুয়ারে
শত মন করে দখল
যে পাখি ঘর বোঝেনা
যে পাখি ঘর বোঝেনা…. ‘
গানের প্রতি শব্দ যেন আভাকে উদ্দেশ্য করে লেখা। গানের শিল্পী যেন আভাকে সামনে রেখে খুব নিপুণ চোখে আভাকে আগাগোড়া পরখ করে গান গেয়েছেন। আহনাফের হুশ ফেরে ফোন কলের শব্দে। আহনাফ গিটার পাশে রাখল। ফোন রিসিভ করে কানে ধরল,
–’ বাঁধন, বল। ‘
–’ কি খবর? আসার পর একবারও দেখা করলি না। আজ আমাদের মন্টু মামার চায়ের দোকানে দেখা করার কথা ছিল। আমরা সবাই পৌঁছে গেছি। তুই কোথায়? ‘
–’ আমার ভালো লাগছে না। তোরা গল্প কর। ‘
–’ ফালতু কথা বলে মজা নষ্ট ক্যান করো, মামা। দ্রুত আসো। কোনো অজুহাত না। ‘
–’ কামরুল এসেছে? ‘
–’ হ্যাঁ। আসবে না কেন? ‘
–’ আমি আসছি। দশ মিনিট লাগবে। ‘
–’ দ্রুত আয়। ‘
আহনাফ ফোন কেটে দিল। গিটার কাঁধে তুলে কক্ষে এল। গিটার ব্যাগে রেখে বাসার টিশার্ট প্যান্ট পড়েই বেড়িয়ে গেল মন্টু মামার চায়ের দোকানের উদ্দেশ্যে।
–’ আহনাফ আসবে? ‘
–’ হ্যাঁ। ‘
দিহান আশ্বস্ত হল। বাঁধন বেঞ্চে বসল। কামরুলের দিকে চেয়ে কিঞ্চিৎ সন্দিহান কণ্ঠে সুধাল,
–’ তোর কথা জিজ্ঞেস করেছে। তুই এসেছিস কি না। এসেছিস বলতেই আসছি ফোন কেটে দিল। ব্যাপক সন্দেহ মামা। তোমার কাছে কি কোনো স্পেশাল কিছু আছে? আহনাফ ছুটে আসছে তোর জন্যে। ‘
–’ আরে ও তো আভার….’
কামরুলের শব্দ ভান্ডার থমকে গেল। দ্রুত কেশে উঠল সে। যেন গলার শব্দগুচ্ছ পরিষ্কার করল। বাঁধন সন্দিহান চোখে কামরুলকে পরখ করল। অতঃপর বলল,
–’ আভা কি? আহনাফের সাথে আভার কথা হয় নাকি? ‘
কামরুল হাসার চেষ্টা করল। বলল,
–’ আরে না। আহনাফের সাথে তো আভার কোনো যোগাযোগই নেই। কথা-টথা হবে কিভাবে? ‘
–’ আভার নাম্বার কি কারো কাছেই নেই? মেয়েটার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। ওকে আমার পছন্দ হয়েছে ভীষন। আচরণে কি চঞ্চলতা। কিশোরীদের ন্যায় যেন উড়ে উড়ে হাঁটে। এমন মেয়েই আমার জন্যে পারফেক্ট। ওর নাম্বার আছে তোর কাছে? ‘
কামরুল অন্যপাশে তাকাল। বুকে হাত চেপে ঘনঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করল, ‘ আহনাফ ছুইটা আসতেছে ওর নাম্বার নিতে। বাঁধন চাইপা ধরসে নাম্বারের জন্যে। আর আভা হুকুম দিয়েছে, কাউকে নাম্বার দেয়া যাবে না। হায়রে খোদা। কই যাব? ‘
–’ কি রে? নাম্বার আছে? কথা কস না ক্যান? ‘
কামরুল স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। ফিক করে হেসে বলল,
–’ আমার কাছে নাম্বার থাকবে কিভাবে? আমি কি বাংলাদেশের সব মেয়ের নাম্বার নিয়ে ঘুরি? অদ্ভুত কথাবার্তা! ‘
বাঁধন ভ্রু কুঁচকে তাকাল। কামরুলের বিভ্রান্ত চেহারা আগাগোড়া জরিপ করে সুধাল,
–’ সত্যিই তোর কাছে নাম্বার নেই? ‘
–’ আরে, মন্টু মামার চায়ের কসম। সত্যি আমার কাছে নাম্বার নেই। ‘
–’ কসম কাটলে নিজের মাথা ধরে কাটবি। মন্টু মামার চায়ের কসম আবার কি? মজা লস? ‘
–’ ধুর। কথা পেঁচাইস না। আহনাফের জন্যে চা দিতে বল। এক্ষুনি এসে পড়বে ও। ‘
বাঁধন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কামরুল মন্টু মামার দিকে চেয়ে বলল,
–’ মামা, চা টা একটু দেখেশুনে বানাবে। তোমার চা খেয়ে আবার না আমি ম’রে-টরে যাই। ‘
মন্টু নামের চায়ের দোকানদার সুন্দর হাসল। চাঁদের আলোয় নিষ্পাপ হাসি ঝলমল করে উঠল। মন্টু চায়ে দু চামচ চিনি মিশিয়ে বলল,
–’ আমার চা চোখ বন্ধ করে খাইতে পারো, কামরুল মিয়া। একদম খাঁটি চা বানাই। দুই নাম্বারী আমার খাতায় নেই। ‘
কামরুল মুচকি হেসে বিড়বিড় করল,’ দুই নাম্বারী আমার খাতায় আছে মামা। তাই বলেছি। ‘
কথা বলার ফাঁকে দেখা গেল আহনাফ এসে বেঞ্চে বসেছে। দিহান আহনাফকে আগাগোড়া লক্ষ্য করে বলল,
–’ মামা কি বিয়ে থেকে আসছ? ‘
আহনাফ বলল,
–’ মানে? বিয়েতে যাব কেন? ‘
–’ না, মানে। আজ একটু বেশীই হ্যান্ডসাম লাগছে আরকি। তাই জিজ্ঞেস করলাম। রাতের বেলায় চাঁদের নিচেও জ্বলজ্বল করছ। ব্যাপার কি? ‘
আহনাফ কথা এড়িয়ে গেল। মন্টু মামাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–’ মামা, এক কাপ চা দিও। দু চামচ চিনি। ‘
মন্টু মামা উত্তর দিলেন,
–’ বলতে হবে না, ভাই। তুমি কেমন চা খাও, আমার একদম মুখস্ত হয়ে গেছে। তোমার চা আমি আগেই বানাই রাখসি। ধরো। ‘
মন্টু এক কাপ চা এগিয়ে দেয় আহনাফের দিকে। মন্টু মামা আহনাফ বলতে একপ্রকার উন্মাদ। আহনাফ তার দোকানে এলে সে শশব্যস্ত হয়ে যায় তাকে অ্যাপায়ন করার জন্যে। আহনাফ বিপদে আপদে মন্টুর পাশে থাকে বলেই মন্টু সারাক্ষণ কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে। আহনাফকে পছন্দ করায় তার বন্ধুদেরও বেশ খাতির যত্ন করে সে। মানুষটা বড্ড সহজ সরল। গরীবদের মন ধনীদের ন্যায় অত পেঁচানো না। ধনীদের সবাই টাকার গরমে সারাক্ষণ কুর্নিশ করে। গরীবরা ভালো ব্যবহার পেয়ে অভ্যস্ত নয়। কিন্তু যখন কেউ তাদের মন খুলে ভালোবাসে, তাদের হৃদয় মোমের ন্যায় গলে যায়। তারা সেই মানুষটার জন্য নিজের জীবন দিয়ে দিতে কুণ্ঠিত হয় না। গরীবরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে জানে। ধনীদের গায়ের রক্ত খারাপ। তারা বরাবরই অকৃজ্ঞতার পরিচয় দেয়।
আহনাফ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে তাতে চুমুক বসাল। বাঁধন প্রশ্ন করল,
–’ আহনাফ, তোর সাথে আভার যোগাযোগ আছে? ‘
বাঁধনের মুখে ফের আভাকে নিয়ে কৌতুহল আহনাফকে বিরক্ত করল। বাঁধনকে বন্ধু হিসেবে তার ভালো লাগে। এক কথায় সেরা বলা যায়। কিন্তু বাঁধন যখন আভাকে নিয়ে কোনো কথা বলে, আহনাফের সহ্য হয় না। আভার নাম শুধু আহনাফের ঠোঁটে থাকবে। শুধু বাঁধন নয়, অন্য কোনো পুরুষের ঠোঁটে আভার নাম কেন থাকবে? আহনাফ নিজের অযথা রাগ সামলে, ভ্রু কুঁচকে ফের চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
–’ না, নেই। ‘
–’ ওর নাম্বার আছে তোর কাছে? ‘
–’ আশ্চর্য। যোগাযোগ নেই ত নাম্বার থাকবে কিভাবে? ‘
–’ তোদের কারো কাছেই কি নাম্বার নেই? ওর সাথে কথা বলতাম একটু। মনে পড়ছে খুব। ‘
দিহান বলল,
–’ এই বাঁধন পাগল হয়ে গেছে। সারাক্ষণ এ ওর থেকে আভার নাম্বার চেয়ে বেড়াচ্ছে। ‘
–’ পাবনা পাঠিয়ে দে। তাহলেই ল্যাটা চুকে যায়। ‘
কামরুলের কথায় দিহান উচ্চস্বরে হেসে উঠল। বাঁধনের মুখ শুকিয়ে এটুকু হয়ে গেল। বাঁধন চুপসে যাওয়া মুখ নিয়ে থ বসে রইল। কেউ তার অনুভূতি সচেতন চোখে দেখছে না। বাঁধনের বেশ রাগ হল। সে যে বারবার চিৎকার করে বলছে, আভাকে তার ভালো লাগে। অথচ কেউ কানেই তুলছে না কথা। এমন কেন সবাই?
গল্পের আসর সমাপ্ত হল রাত বারোটায়। সবাই যার যার বাড়ি চলে গেছে। শুধু আহনাফ আর কামরুল বাকি রয়েছে। তারা এখনো মন্টু মামার চায়ের দোকানে বসে পঞ্চমবারের মত চা খাচ্ছে। শেষ চায়ের কাপটা রেখে আহনাফ বিল মেটাল। মানিব্যাগ পকেটে পুড়ে কামরুলের পাশে এসে দাঁড়াল। আহনাফ কামরুলের কাঁধে হাত রেখে বলল,
–’ আমি জানি, আভার ঠিকানা তোর কাছে আছে। কিন্তু তুই দিবি না। আভা নিশ্চয়ই মানা করেছে। অবশ্য আমি ঠিকানা চাইবও না। নিজে খোঁজে নেওয়ার মত বুদ্ধি আমার আছে। আসছি। ‘
আহনাফ চলে যাচ্ছে। কামরুল স্থির পায়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। আহনাফ জেনে গেছে তাহলে? কামরুলের খুব অপরাধবোধ হচ্ছে। আহনাফ নিশ্চয়ই ভেতরে খুব ছটফট করছে। আভাও তার ব্যতিক্রম নয়। দুপাশে দুজন তড়পাচ্ছে। অথচ কেউই জেদ ছাড়তে চাইছে না। এ কেমন অবিচার? তবে কামরুল জানে, আহনাফের মনে যদি আভার জন্যে বিন্দু অনুভূতি থাকে তবে আহনাফ আকাশ পাতাল এক করে আভাকে ঠিক খুঁজে নেবে। আহনাফের সেই প্রখর বুদ্ধি আছে। কামরুল ছোট থেকে চেনে আহনাফকে। আহনাফের যা চাই, তা যেকোনো মূল্যে সে অর্জন করেই ছাড়ে। বড্ড জেদী ছেলে আহনাফ। জেদের আগুন যেন আহনাফের রক্তে রক্তে বয়ে বেড়ায়।
#চলবে