#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম – ৪
লেখনীতে – আভা ইসলাম রাত্রি
______________________________
সবাই খুশিতে বাকবাকুম হয়ে আছে। বাঁধন দু হাত দিয়ে দিকে মেলে চোখ বুজে চেয়ে আছে সামনে। কামরুল নিজের ঝাঁকড়া এলোমেলো চুল সোজা করতে করতে চারপাশ চেয়ে চেয়ে দেখছে। দিহান ব্যস্ত ছবি তুলতে। আভা নিজের গায়ের জ্যাকেট দুহাতে আকড়ে ধরে চোখ বুজে আছে। আহনাফের বন্ধ চোখ জোড়া শীতলতায় ঘেরা। চিত্রা আঙ্গুলের ফাঁকে আহনাফের হাত ধরতে চায়। তবে আহনাফ হাত সরিয়ে নেয়। ভ্রু কুঁচকে গভীর কণ্ঠে বলে,
–’ বিরক্ত করবি না চিত্রা। মোমেন্টটা এনজয় করতে দে। ‘
সবাই ব্যস্ত এই সুন্দর পরিবেশ মন খুকে উপভোগ করতে। একে একে সবাই চোখ খুলে। বাঁধন বলে,
–’ এই তোরা জাম্বুরা খাবি? ‘
কামরুল বলে,
–’ মরিচ এনেছ কেউ? ‘
আভা বলে,
–’ আমি এনেছি। ‘
আভা নিজের ওড়নার অগ্রভাগের গিট্টু খুলে। সেখানে মরিচের ছোট্ট এক কৌটা রাখা। দিহান বলে,
–’ ওড়নায় মরিচ বেধে নিয়ে এসেছে? কি বুদ্ধি! ‘
আভা মুচকি হাসে। অতঃপর সবাই গাছ থেকে জাম্বুরা পেড়ে নেয়। আভা নিজের জন্যে একটা জাম্বুরা পাড়ে আবার দিহানের জন্যে নেয়। গাড়িতে দিহান ছবি তোলার পারিশ্রমিক হিসেবে জাম্বুরা চেয়েছিল। আভা তা ভুলেনি।
অতঃপর সবাই একে একে নিজেদের জাম্বুরায় মরিচ মাখায়।
বাঁধন বলে,
–’ কাউন্ট করি। সবাই একসাথে খাব। ‘
আভা উত্তেজিত। চেঁচায়,
–’ ৩,২,১, ০…. ‘
সবাই একসাথে জাম্বুরার টুকরায় দাত বসায়। ভীষন মজা জাম্বুরাগুলো। মুখে দেওয়ার সাথে সাথে জিহ্বা থেকে লালা ঝড়ে। বাঁধন চোখ বুজে খাচ্ছে। দিহান খেতে খেতে বলে,
–’ ভাই, খেতে সেই কিন্তু। ‘
আহনাফ শুনে। বাঁধন বলে,
–’ আমারও ভালো লাগছে। ‘
আভা উত্তর দেয়,
–’ মনে হচ্ছে মুখে দেওয়ার সাথে সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে। উফ।’
চিত্রা আভার কথা শুনে মুখ বাঁকায়। বলে,
–’ আভা, তুমি কখনো জাম্বুরা খাও নি? এমন পেটুক আচরণ করছ কেন? ‘
আভার খাওয়া থেমে যায়। কেউ যে এভাবে সরাসরি খাবার নিয়ে খোটা দিতে পারে, আভা বুঝতে পারেনি। আভা সামান্য হাসার ভান করে। বলে,
–’ জাম্বুরা আগেও অনেকবার খেয়েছি। তবে সাজেকে ভ্রমন করতে এসে জাম্বুরা খাবার মজাটা কি আর পাঁচ টা ছটা জাম্বুরার মত? ‘
চিত্রা কিঞ্চিৎ হাসার ভান করে। অতঃপর আবার খাওয়ায় মন দেয়। তবে আভার মন খারাপ থেকে যায়। পূর্বে চেহারায় উত্তেজনার ছাপ ছিল। এখন তা কেমন যেন মিইয়ে আসছে। আহনাফ তা লক্ষ্য করে। চিত্রার এমন কি কথা বলা উচিত হয়নি। বাঁধন চিত্রাকে বলে,
–’ তুই এমন অদ্ভুত আচরণ করছিস কেন? আসার পর থেকে দেখছি। কেমন যেন মুখ ভার করে বসে আছিস। প্রবলেম কি? ‘
চিত্রা রাগে থরথর করে কেঁপে উঠে। বলে,
–’ আমার প্রবলেম বলতে? আমি তোদের সাথে এসে প্রবলেম তৈরি করছি? এটা বলতে চাইছিস তুই? ‘
কামরুল বাঁধ সাধে।বলে,
–’ চিত্রা, তুই অযথাই ক্ষেপছিস। বাঁধন সেসব কিছুই বলেনি। ও তো…’
চিত্রা মাথা গরম হয়। বলে,
–’ তার মানে তুই কি বলতে চাইছিস? আমি সিনক্রিয়েট করছি? তোদের আমাকে নিয়ে এতই সমস্যা তাহলে আমাকে এই ট্রিপে আনলি কেন? রেখে আসতি। ‘
পরিবেশ নিমিষেই অশান্ত হয়ে উঠল। অনুভূতিরা পিষে যেতে লাগল। ভালো লাগা কেমন যেন ছুটে পালাতে চাইল। বরাবরই পরিস্থিতি শান্ত করতে আহনাফের জুড়ি মেলা ভার। সে চিত্রার কাধে হাত রাখল। বলল,
–’ রিলাক্স চিত্রা। তুই এমন ভাবছিস কেন? তোকে নিয়ে আমাদের কেন সমস্যা হবে। ইউ আর অ্যা জ্যাম ফর আস। হু? ‘
চিত্রার কান্না করার উপক্রম। বলে,
–’ আমি আর থাকব না। ওরা সবাই আমাকে বারবার অপমান করছে। ‘
আহনাফ চিত্রাকে বুকে টেনে নেয়। সুন্দর করে মাথায় হাত বুলিয়ে আলতো সুরে বলে,
–’ কান্না থামা। এত সুন্দর জায়গায় এসে কাদলে মানায়? বাচ্চা হয়ে যাচ্ছিস দিনদিন। ‘
আভা চোখ দিয়ে সব দেখে। লক্ষ্য করে। আভার বুকে মোচড় দিয়ে উঠে। সে এসেছে বলেই কি আহনাফদের বন্ধুত্ত্ব নষ্ট হচ্ছে? চিত্রাকে কি আভা কাদিয়েছে? হ্যাঁ। আভা এমন করে কথা না বললে নিশ্চয়ই চিত্রা কান্না করত না। হাসত। আভার সবাইকে হাসতে দেখতে ভালো লাগে। আভার জন্যে কেউ কান্না করলে আভার মন খারাপ হয়। কান্না পায়। এখন চিত্রা কাদঁছে। আভারও কান্না পাচ্ছে। এত খারাপ কেন আভা? আভা চিত্রাকে উদ্দেশ্যে করে বলে,
–’ আমি দুঃখিত, চিত্রা। আমি তোমাকে কাদাতে চাইনি। ‘
চিত্রা সাপের ন্যায় ফণা তুলে আভার দিকে চায়। আভা ভয় পায়। চিত্রা কি তবে খুব রেগে আছে? আভা দমে যায়। পরিস্থিতি অস্বাভাবিক ঠেকছে। আভার এখন দম বন্ধ লাগছে। দ্রুত সে চলে যেতে চায় এখান থেকে।
আভা বলে,
–’ আমরা যাব কখন? ‘
বাঁধন বলে,
–’ কেন যেতে চাইছ? মন খারাপ লাগছে? ‘
আভা মাথা নাড়ায়।
–’ না। ‘
কামরুল বলে,
–’ আমরা সূর্যাস্ত দেখে যাব। ‘
–’ সূর্যাস্ত? ‘
আভার চেঁচিয়ে উঠে। দিহান ছবি তুলতে তুলতে বলে,
–’ হ্যাঁ। সূর্যাস্ত। শুনেছি, কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যাস্ত খুব সুন্দর দেখায়। তাই এসেছি যখন। এত সুন্দর বিষয় মিস করা যাবে না। ‘
এত সুন্দর সূর্যাস্ত দেখবে ভেবে আভার মন খারাপ হু হু করে হৃদয় ছেড়ে পালায়। খুশিতে নেচে উঠে। আভা বলে,
–’ আর কত সময় পর সূর্যাস্ত হবে? ‘
বাঁধন ঘড়ি দেখে। তারপর বলে,
–’ এখন বাজে ৫ টা ১০। আর এক ঘণ্টা পর সূর্যাস্ত হবে। ‘
আভার তর সইছে না। সময়কে যদি পেছানো যেত? তবে আভা এখনি সূর্যাস্ত দেখে নিত।
সুন্দর বিষয় আমাদের সবসময় অপেক্ষা করায়। দীর্ঘ অপেক্ষার রজনী কাটানোর পর যখন দু চোখ ভরে সেই সুন্দর বিষয় অবলোকন করি, আমাদের আত্মা তৃপ্ত হয়। মনে হয়, এটাই জীবন। যে জীবন তৃপ্তির, আনন্দের, শান্তির।
অতঃপর সূর্য পশ্চিম দিকে অস্তমান। আভা, আহনাফ, দিহান, কামরুন, বাঁধন, চিত্রা সবাই পশ্চিম দিকে এসে দাঁড়িয়েছে। কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় সূর্য যে হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়। সূর্য যেন দেহের উপর ঢলে পড়ে। সূর্যের রক্তিম আভায় দেহ টলমল ছলছল করে। মুখের উপর সূর্যের আলো লেপ্টে যায়। আভার মুখ হা। মৃদু স্বরে বলে,
–’ ওয়াও! ‘
দিহান চট করে সূর্যাস্তের কতক ছবি তুলে। বাঁধন বলে,
–’ কেমন লাগছে? ‘
আহনাফের চোখ স্থির। হালকা কণ্ঠে বলে,
–’ ইটস পিউর। ‘
কামরুল বলে,
–’ সুন্দরতম। ‘
আভার মৃদু কণ্ঠ,
–’ দারুন। ‘
চিত্রা বলে,
–’ ইটস লাভ। ‘
দিহান বলে,
–’ ইটস অ্যা পারফেক্ট ফটোশপ ব্যাকগ্রাউ্ড। ‘
সবার চোখ গেথে আছে অস্তমান সূর্যের পানে। মনে হচ্ছে সূর্য তাদের গিলে নিচ্ছে। সূর্যের উত্তাপ গা ছুয়ে অদ্ভুত শিহরন দিচ্ছে। পুরো সাজেক যেন চোখের সামনে ভাসছে।
–’ সূর্যকে নিয়ে সবার একটা ছবি তুললে কেমন হয়? ‘
দিহানের কথায় সবাই মুহূর্তেই রাজি হয়ে যায়। সবাই পাশাপাশি দাড়ায়। আহনাফের পাশে আভা। আভার মাথা আহনাফের বুক ছুঁইছুঁই। আভার দেহ আহনাফের দেহ ছুঁয়ে। আভা লজ্জায় জমে যায়। মাথা নত করে। আহনাফের দৃষ্টি আভার দিকে। দিহান ক্যামেরা সেট করে।
–’ ৩,২,১,০, রেডি ‘
সবাই পা উচু করে লাফিয়ে উঠে। ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক। পরপর তিনটি ছবি উঠে। সবার ঠোঁটে হাসি। নতুন কিছু উদ্ভাবন করার জয়। সাজেক সুন্দর। বাংলাদেশ সুন্দর। এখানের মানুষ সুন্দর। এখানের অনুভূতিসমূহ পবিত্র।
#চলবে