#দুজনা পর্ব-০৩
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-০৩

মা কারো কাছে চড়া সুদেও টাকা পেলেন না।আর বাকি আছে মাত্র দুইদিন।দুইদিন পর বাবার থেরাপী দিতে হবে।অথচ এখনো টাকা জোগাড় হয়নি।জোগাড় হবেও কি না,তাও অনিশ্চিত। সবরকমের চেষ্টা করা শেষ মায়ের!মা সকাল থেকে পাগলের মতন করতেছেন!বিশ-ত্রিশ বার কল করা শেষ আমাকে।কল করে শুধু এটুকুই বলতেছেন,

“কি হবে,প্রিয়া?কি হবে?কি হবে!”
আমার উত্তর শুধু কান্না!আসলে উত্তর করার মতন আমার কোনো শব্দ জানা নেই।তবে ভাবছি বাসায় যাবো।যেয়ে আমিও চেষ্টা করবো।দেখি টাকার ব্যবস্থা করা যায় কি না।আল্লাহ উপায় একটা অবশ্যই দেবেন।শাশুড়ী মাকে বলতে হবে বাড়ি যাওয়ার কথা।

——————————————————-
বিকেলের নাস্তা বানানো সেগুলো টেবিলে রাখি।শাশুড়ী মা ডাইনিং ই বসা ছিলেন।জা এবং ননদ এখনো আসেননি।আসবেন।শাশুড়ী মা চেয়ারে বসে বসে তসবি গুনছেন আর আমার দিকে তাকাচ্ছেন।আমি সবকিছু চটজলদি হাতে শেষ করার চেষ্টা করি।চাচ্ছি বাসায় যাওয়ার কথাটা আমার ননদ এবং জা এখানে আসার আগেই মাকে বলে নিব।পরে উনাদের সামনে বললে শাশুড়ী মা রাজি হন কি হন না কে জানে!কিচেনে শেষ কিছু এঁটো থালাবাসন ছিল।সেগুলো তাড়াতাড়ি ধুঁয়ে ওড়নায় কোনমতে হাত মুছে ডাইনিং আসি,ূ

“মা?একটু কথা ছিল।”

উনার তসবির কড়ি গোনা শেষ হয়নি বোধহয়।ঠোঁট নড়তেছে।তাই সাথে সাথে উত্তর পাই নি।উত্তর পেতে আরো এক মিনিটের মতন দাঁড়িয়ে থাকি।সবগুলো কড়ি পড়া শেষ হলে কি যেনো একটা সূরা পড়েন।তারপর বুকে,দুইকাঁধে ফু মারেন।এবার আমার দিকে তাঁকিয়ে,

“দেখতেই পাচ্ছ তসবি পড়তেছি।তসবি পড়ার মাঝে কথা বলা কোনধরণের বদভ্যাস?”

মাথা নুইয়ে ফেলি।আসলেই আমি বাসায় যাওয়ার চিন্তায় ওলটপালট প্রায়।তাই ঠিক খেয়াল করিনি।তবে শাশুড়ী মাকে আর কিছু বললাম না।উনি এবার গলা খাঁকারি টেনে বলেন,
“কি বলতে এসেছো বলো?”
“মা আমার বাবারলকে আর দুইদিন পর থেরাপী দেওয়া হবে।আমি বাসায় যেতে চাচ্ছি একটু।তাই আপনাকে বলতে এসেছি।”
“গত মাসে যে বাবাকে থেরাপী দিলে তখন কোনা বাসায় ছিলে?”
“জ্বী,এই বাসায়।”
“তো এবারো যাওয়ার কি দরকারা!থেরাপী দিবে তোমার মা আছে,মামা আছে।আর তুমিতো ডাক্তার না যে যেতেই হবে,নাকি?”
“মা আমার এবার যেতে খুব মন চাচ্ছে।না করবেন না মা।বাবাকে অনেকগুলো দিন হলো দেখি নি।”

বলতেই চোখজোড়া থেকে টপটপ করে পানি বেয়ে পড়লো! এরমাঝে জা এবং ননদ চলে আসেন।আমার চোখে পানি দেখে,
“কাঁদছে যে?”

শাশুড়ী মা মুখটা ভার করে খাওয়াতে হাত লাগালেন ।জা এবং ননদের কথার জবাব দিলেন না।উনারাও জবাবের আশা না করে চেয়ার টেনে খেতে বসলেন।।আমি যে দাঁড়িয়ে,আর চোখে পানি। কারো খেয়াল নেই।আর খেয়াল করার প্রয়োজনও মনে হচ্ছে না এদের কারো।নিজেকে স্বাভাবিক আনতে সময় লাগলো।তবে আর বেশিক্ষণ দেরী করলাম না।আত্মসম্মানে তীব্র আঘাতে রুমে ফিরে এলাম এদের সামনে থেকে।রুমে এসেও শব্দ করে কান্না করতে পারলাম না।অবশের মতন হয়ে গেলাম।ফোনটা হাতে নিলাম।খুব ইচ্ছে হলো আদিলকে কল করতে।আদিল হয়তো অফিসে।তাও আমার কিছু যায়-আসলো না।কল করে বসলাম।তিন-চারবার রিং হতে রিসিভ করলো আদিল।আর আমি এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলাম।অন্য সময় হলে আদিল কলটা কাটার জন্যে অস্থির হয়ে যেত,”প্রিয়া,কল কাঁটো বস দেখে ফেলবে!চাকরি যাবে।”আদিল আজ তা করলো না।আজ সে আমার কান্নায় অস্থির হয়ে গেল,

“কি হয়েছে প্রিয়া?কি হয়েছে তোমার?”
” আমি আমাদের বাসায় যাবো।আগামী বুধবারে বাবাকে থেরাপী দিতে হবে।মায়ের হাতে কোনো টাকা নেই।মা কারো থেকে ধারও পাচ্ছে না।আমি বাসায় গিয়ে চেষ্টা করবো টাকার ব্যবস্থা করার।সময় নাই।যেতে না করবেন না আমাকে।”

ওপাশ থেকে আদিলের মিনিট একের মত নিস্তব্ধতা শুনতে পেলাম। পরে বললেন,
“তারমানে বুধবারেই টাকাটা লাগবে,তাইতো?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা তুমি বাসায় যাও।আমি কল করে বলে দিচ্ছি।আর পারলে আজকেই চলে যাও।”
“মা দিবেন না।আমি মাকে বলেছি।”
“আচ্ছা আমি কথা বলতেছি।রাখো।”

————————————————–
সন্ধে নেমে আসে।চারদিকে ঝিঁ ঝি পোকা ডাকছে।আঁধার নেমেছে কিছুটা।আমি রুমের জানলাগুলো বন্ধ করে পর্দা নামিয়ে দিলাম।এমন সময় আমার ননদ আমার রুমে আসেন।বলেন,
“তোমাকে মা ডাকছেন।”
বলেই চলে যান।আমি শাশুড়ী মায়ের রুমে যাই।মাগরিবের নামাজে দাঁড়াবেন।জায়নামাজ বিছিয়েছেন ফ্লোরে।আমাকে দেখামাত্রই বলেন,

“আমাকে রাজি করাতে পারো নি, গলায় ঝুঁলে স্বামীকে নিজে রাজি করিয়ে নিলে অবশেষে?বাসায় যেতে খুব ইচ্ছে হলো না?এখনই যাও!”

বলেই নিয়ত বেঁধে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম।আমি বিস্ময়ে কিংকর্তব্য বিমূঢ়!কি বললেন উনি এটা!সন্ধের পরই বের হই আমি।রিজার্ভ সি.এন.জি নিয়ে।আদিল ঢাকায় যাওয়ার সময় আমার হাতে হাজার দুয়েক টাকা দিয়ে যায়।তার থেকে ভাড়া দিই।বাসায় আসাতে মা খুশি হয়ে যান।বাবাও।বাবাকে দেখে আমার খুব কান্না পেয়ে যায়।যে’বার শেষ দেখলাম, মনে হয় পাঁচ মাস হবে।বাবাকে মোটামুটিভাবে স্বাস্থ্য আর মোটা দেখলাম।কিন্তু এবার তো বাবার শরীরের ওজন ৩৫ কেজির বেশি হবে না।শরীরের হাড্ডিগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।বাবার কাছে যাই।আলতো কপালে হাত বুলিয়ে দিই।বাবা হাসেন।আর হ্যাঁ,আরেকটা কথা। বাবা ভালো করে কথা বলতে পারেন না।ক্যান্সার হওয়ার ৫ মাসের মাথাায় বাবার কথা বলার শক্তি কমে যায়।আমিও হাসি।কান্না হাসি আর কি।বাবা বুঝে ফেলেন উনাকে দেখে আমি কেঁদে ফেলেছি।তাই মাথায় হাত বুলান।হাত বুলানোর ইঙ্গিতে বুঝান,কাঁদতাম না।ঠিক আছেন তিনি।আমার কেনজানি আরো কান্না পেয়ে যায়।চেপে রাখি।ওড়না মুখের উপর কিছুক্ষণ ধরে রেখে নিজেকে স্বাভাবিক করি।পরক্ষণে জোরপূর্বক হেসে বাবার সাথে কথা বলতে থাকি।

ভাবলাম আমি বাাড়িতে এসে একটা উপায় বের করতে পারবো।কিন্তু উপায় বের করতে যেয়ে বুঝলাম মায়ের চেষ্টা কম ছিল না।সব জায়গায় আমিও তন্নতন্ন করে খুঁজেছি কোথাও পাইনি।গতকাল এক কাকু চড়া সুদে দেওয়ার জন্যে রাজি হয়েছিল।কিন্তু আজ গিয়েছি আর বারণ করে দিয়েছি।উনার ছেলের নাকি টিউশন ফি দিতে হবে।এখন কি করবো মাথায় কিছুই আসছে না।

“প্রিয়া?তোর কল এসেছে!আদিল মনে হয় করেছে।”

আমি মোড়া থেকে উঠে ঘরে যাই।ফোনটা হাতে নিতে আসলেই আদিল কল করেছে!রিসিভ করি,

“হ্যালো?”
“প্রিয়া?তোমার বিকাশটা একটু চেইক করো ত?টাকা এসেছে কি না?”
“কিসের টাকা?”
“আগে চেইক করো।”

আদিলের ফোন ধরে রেখেই মেসেজ অপশন চেক করি।বিকাশ থেকে মেসেজ এসেছে।তাতে লেখা “Cash in 26,0000 taka” অবাক হয় গেলাম।আওয়াজস্ত কন্ঠে বললাম,

“আপনি এটা কি করলেন?কেন টাকা দিলেন?আর আপনিতো এখনো বেতন পাননি। কোথা থেকে দিয়েছেন!”
“প্রিয়া?এত কথা বলো না। আগে রোগীকে সুস্থ করো।রাখলাম।নিজের যত্ন নিও।আর বাবার অবস্থান জানাইয়ো।”

বলেই কেঁটে দিলো আদিল।আমার কেনজানি কান্না চলে এলো।খুশির নাকি দুঃখের কান্না তাও জানি।মানুষ এতটা ভাল হয় কীভাবে!?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here