#বড়গল্প
#অবেলার_পুষ্প
#পর্ব_৮

সপ্তম পর্বের পরে…

আমি মোবাইলের গ্যালারি খুঁজে রায়হানের ভালো একটা সিঙ্গেল ছবি খুঁজে পেলাম না।
সবগুলো ছবিতেই একসাথে অনেকজন মিলে আড্ডা দিচ্ছি নয়ত লাঞ্চ করছি। একটা গ্রুপ ছবিতে তো একপাশে দাঁড়িয়ে ছবি থেকে কেটেই গেছে বেচারা। প্রায় সব ছবিতেই ঝাপ্সা দেখাচ্ছে ওকে। মুখ বোঝা যাচ্ছে না ঠিকমত।

আমি হন্যে হয়ে ছবি খুঁজে বেড়াচ্ছি। বুঝতে পারছি আমার সামনে সন্দিগ্ধচোখে শাকিল তাকিয়ে আছে। বাপরে বাপ! এত সন্দেহপ্রবণ মন এই ছেলের! যেন ধরেই নিয়েছে আমি সম্পত্তির খোঁজে লুকিয়ে চুরিয়ে তদন্ত করতে এসেছি। আমার একটা কথাও যে সে এখন বিশ্বাস করবে না, এটা কেউ না বললেও বুঝে নিতে কষ্ট হয় না।

আরও মিনিটদুয়েক খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে রায়হানের একটা ছবি পেলাম। সিঙ্গেল ছবি। যুদ্ধজয়ের ভঙ্গিতে ছবিটা এগিয়ে দিতে যাব শাকিলের দিকে, এমন সময় আমার ফোনটা বেজে উঠল।

বিরক্তমুখে ফোনের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। আরে! রায়হান ফোন করেছে! আজ সারাদিন যাকে ফোনে পেলাম না, অবশেষে তার ফোন পেয়ে আমি কেমন যেন বেকুব বনে গেলাম। আর একেই বুঝি বলে টাইমিং! এখন এই ফোন না ধরলে আমার কিছুতেই চলবে না। কারণ আমার জানতেই হবে এই নাটকের পেছনে কী কারণ লুকিয়ে আছে। আর ওদিকে এই মুহূর্তেই শাকিলকে ছবিটা না দিলেও কিছুতেই চলবে না। যেভাবে বিষচক্ষে আমার দিকে তাকিয়ে আছে তাতে আমার বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে যায় কী না তাই ভাবছি!

শেষ পর্যন্ত আমার কৌতুহলই জয়ী হলো। ‘এক্সকিউজ মি’ বলে ধরেই ফেললাম ফোনটা। আমি কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে রায়হানের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো… ‘জানি জানি আমাকে তোমার অনেককিছু বলার আছে। সব কথা শুনব। তবে সামনাসামনি বসেই শুনব। আমাকে শুধু বলো, তোমাদের আলোচনা কতদূর এগিয়েছে? সব কথা বলা হয়েছে নাকি এখনো অনেক হিসাব নিকাশ বাকি আছে?’

আমি কথা হারিয়ে ফেললাম রায়হানের কথা শুনে। কোথায় আমি জিজ্ঞেস করব এই নাটকের মানে কী, সেখানে রায়হান আমাকে কী বলছে এসব? রহস্যের ধুম্রজাল কিছুতেই যেন পিছু ছাড়ছে না! ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কোনোমতে বললাম, ‘রায়হান এসবের মানে কী? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না! তুমি কেন এভাবে আমাকে এখানে পাঠিয়েছ? তুমি কি আগে থেকেই সব কিছু জানতে?’

রায়হান ওপাশ থেকে হাসতে হাসতে বলল, ‘ওহ আচ্ছা! এখনো আমার অধ্যায় উন্মোচিত হয়নি তাহলে! বেশ! উন্মোচন হোক। আমি ততক্ষণে একটু জার্নি করি। আশাকরি আজকে রাতের মধ্যেই দেখা হচ্ছে। আল্লাহ হাফেজ!’

আমাকে আর একটা কথা বলারও সুযোগ না দিয়ে রায়হান ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে দিলো। আমি বিমূঢ় হয়ে কিছুসময় ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এসব কী বলল রায়হান? ও আসছে এখানে? তাহলে আমার সঙ্গে এলে কী ক্ষতি ছিল?
এদিকে আমাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে শাকিল তাড়া দিলো, ‘কই ছবি দেখালেন না? আপনার বন্ধু রায়হান সাহেব ফোন করেছিল বুঝি? কী বললেন উনি? এসব কেন করেছেন কিছু বলল?’

আজ দুপুরের আগে যখন অপরিচিত শাকিলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলাম তখন যে আন্তরিক ব্যবহার তার কাছ থেকে পেয়েছি, এখন আত্মীয়তার পরিচয়ে পরিচিত হয়ে সেই ব্যবহার একেবারে পুরোপুরি বদলে গেছে! শাকিল এমনভাবে কথা বলছে আমার সাথে, যেন আমি আস্ত একটা ফ্রড। আমাকে বিশ্বাস করার কিছু নাই। আমার ভেতরটা না দেখানো অব্দি সে কিছুতেই বিশ্বাস করবে না যে আমি এখানে সম্পত্তির ভাগ নিতে আসিনি। এসেছি একেবারেই কাকতালীয় ভাবে!

একটু একটু মেজাজ খারাপ হচ্ছে আমার। নিজের চাচাত ভাইকে এতদিন পরে দেখে শাকিল তো কই খুশি হয়ে উঠল না! এখন তো উল্টো আমার কাছেই মনে হচ্ছে, সম্পত্তির ভাগীদার এসে গেছে জেনেই হয়ত এই উষ্মা প্রকাশ। অন্যকিছু নিছক টালবাহানা মাত্র।

মেজাজকে নিয়ন্ত্রণে রেখে আমি কোনও কথা না বলে রায়হানের ছবিটা এগিয়ে দিলাম শাকিলের দিকে। সেই ছবির দিকে তাকিয়ে শাকিল চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘আরে! এটাই তো আমার বন্ধু সজল! ও কীভাবে রায়হান হলো? ওকে কীভাবে চেনেন আপনি? সজল কেন আপনাকে এখানে পাঠাবে? ওরই তো এখানে আসবার কথা ছিল!’
আমি অবাক হলাম না শুনে। কারণ ঘটনার পরম্পরায় আমি ততক্ষণে বুঝতে পেরেছি যে, আমার বন্ধু রায়হান আগে থেকেই এদের সাথে পরিচিত। যে সজলকে তারা হন্যে হয়ে খুঁজছে সম্ভবত সেই হচ্ছে আমার বন্ধু রায়হান। এখন কথা হচ্ছে, এক মানুষের দুটি নাম হয় কীভাবে? কার কাছে সে মিথ্যে কথা বলল? আমার কাছে নাকি শাকিলের কাছে? কিন্তু রায়হান তো আমার অফিসে চাকরিও করে! কাজেই নাম গোপন করার তো প্রশ্নই আসে না! মনে করতে চেষ্টা করলাম, ওর পুরো নাম। রায়হানুল মাসুদ। এটুকুই জানি আমি। সজল কি তবে ওর ডাক নাম? হূম! সেটা হতেই পারে!

কথাটা শাকিলকে বলতে ইচ্ছে করল না। ওর এমন অদ্ভুত আচরণে মনটা একেবারে খাট্টা হয়ে গেছে। এতদিন পরে, বলা যায় প্রথমবারের মতই… এই পরিণত বয়সে এসে নিজের চাচাত ভাইয়ের সাথে দেখা হলো। সেই ভাইয়ের আমার প্রতি এ কেমন ব্যবহার! আমি একপাশে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলাম। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না মোটেও, তবু একেবারে চুপ না করে থেকে সংক্ষেপে ছোট করে বললাম, ‘ও আসছে আজকেই। এলেই জানা যাবে এমনটা কেন করল! আমার কোনও কথা কি তুমি বিশ্বাস করবা?’

নিজের অজান্তেই শাকিলকে তুমি বলে সম্বোধন করে ফেলেছি। প্রায় সমবয়সী কাজিন আমরা। আপনি আজ্ঞে করার মানে নেই কোনো।
আমার চাচী বেশ কিছুটা সময় চুপ করে থাকার পরে নীরবতা ভাঙলেন। হয়ত আমার রাগটা তিনি বুঝতে পেরেছেন। তাই আমাকে আর পরিস্থিতিকে দুটোকেই ঠাণ্ডা করার জন্য ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন, ‘বাবা তুমি হয়ত শাকিলের কথা শুনে রাগ করেছ। আসলে দোষ ওর না। আমাদের নিজেদের বন্ধু বান্ধবদের কাছ থেকেও অনেককিছু শুনতে হয় প্রায়ই। অনেকেই মনে করে যে আমরা হয়ত এই বাড়ির হিস্যাদারদের বঞ্চিত করে সব কিছু একাই ভোগ করছি। আর তুমি নিজের পরিচয় না জানিয়ে এভাবে এসেছ দেখে ও হয়ত কিছু একটু বেশি বলে ফেলেছে। তুমি কিছু মনে করো না বাবা!’

শাকিল নিজেও হয়ত বুঝতে পেরেছে সে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। তাই কিছুটা চাপা গলায় সে এবারে বলল, ‘এমন পরিস্থিতিতে অন্যকিছু কি ভাবার সুযোগ আছে? সবাই মনে করে আমরা বুঝি অন্যদের হঠিয়ে দিয়ে সবকিছু একাই দখল করে বসে আছি! কে জানে, আমার নিজের বন্ধু সজলও এমনটাই মনে করে কী না! নইলে এই নাটক সে কেন করতে গেল কে জানে!’

আমি চুপ করে শুনছি। শাকিল থামতেই এবারে চাচী আবার বললেন, ‘বাবা তুমি জানতে চাও না সেদিন তোমার বড়ভাই ফাহাদ কেন এসেছিল?’
আমি বললাম, ‘চাচী আপনি চাইলে বলতে পারেন। তবে আমার শোনার তেমন বিশেষ কোনো তাগিদ নাই!’

‘না না শুনবে না কেন? শোনো! সবকিছু জানা থাকা ভালো। আমরা যে কাউকে ঠকাইনি এটা তোমার জানা থাকা দরকার!’ শাকিল নিজেও কোন ফাঁকে আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করে বসে আছে, সম্ভবত নিজেও বুঝতে পারেনি। আমি বুঝতে পেরে মনে মনে হাসলাম। ওর মুখে তুমি শুনতে খুব ভালো লাগল।

হয়ত আমাদের মধ্যে আসা যাওয়া থাকলে আমরা পরস্পরকে তুই বলে সম্বোধন করতাম। এক জায়গায় বড় হলে হয়ত একই স্কুলে পড়তাম, একসাথে বড় হয়ে উঠতাম দুজন।

আচ্ছা কী এমন হয়েছিল যে, আমাকে অমন একা একা বড় হতে হলো? কেন আমার চাচা চাচী কেউ আমাকে নিজের কাছে এনে বড় করলেন না? আমি তো ফাহাদ ভাইয়ের সাথে এসেছিলাম এখানে। ফাহাদ ভাই আমাকে রেখে বিদেশ চলে গেল। তারপর বোর্ডীং স্কুলে একা একা বড় হয়ে ওঠা আমার খোঁজ কি কোনোভাবে জোগাড় করা যেত না? অজানা এক অভিমানে আমার বুকটা ভারি হয়ে উঠল। মায়ের সাথে অভিমান করে ভাত না খেয়ে থাকার মতো আহ্লাদ কখনও করতে পারিনি। আজ ইচ্ছে করছে, সেরকম অভিমান করে গাল ফুলিয়ে বসে থাকি। এসব ছোটখাট আহ্লাদগুলো জীবনে কখনও না করতে পারার ভয়ানক দুঃখে আজ আমার সারাদিন কাঁদতে ইচ্ছে করছে।

চাচী আবারও মৃদু ভৎসনা করলেন শাকিলকে। আমাকে বললেন, ‘তুমি ওর কথায় কিছু মনে করো না বাবা। মেজাজটা ওর বরাবরই খুব বেশি তিরিক্ষি!’

আমি মনে মনে বললাম, ‘সেটা আর আপনাকে বলতে হবে না চাচী! আমি ইতিমধ্যেই সেটা বুঝে গেছি!’

চাচী বলতে লাগলেন, ‘সেদিন ফাহাদ এসে খুব বেশিসময় বসেনি। খুব অল্প সময় ছিল বাড়িতে। তুমি ছোটাছুটি করে এদিক সেদিক যাচ্ছিলে। ফাহাদকে তোমার চাচা বোঝানোর চেষ্টা করেছিল যে তার বাবার মানে আমার শ্বশুরের উইল মোতাবেক তোমার বাবার কোনো টাকাই পাওনা নেই। কিন্তু ফাহাদ মানতে চাইছিল না। ওর ধারণা হয়েছিল আমরা ওকে মিথ্যে কথা বলে ঠকাচ্ছি।’

এই অংশে এসে আমি একটু ধাক্কা খেলাম। জিজ্ঞেস করে বসলাম, ‘কেন কোনো টাকা পাওনা নেই কেন?’

শাকিল আবারো চুপ করে থাকতে পারল না। একটু ব্যঙ্গের হাসি দিয়ে বলল, ‘এই যে দেখো তুমি বলছিলে না যে টাকা পয়সার ব্যাপারে তোমার মাথাব্যথা নাই? অথচ দেখো, তোমার বাবার পাওনা কিছু নেই শুনেই তুমি ঠিক নিজের মনের আসল কথাটা বের করে ফেললে!’

আমার পক্ষে আর ভদ্রতা করে চুপ থাকা সম্ভব হলো না। বলেই ফেললাম, ‘তুমিও তো ম্যালাক্ষন ধরেই নিজের আসল রূপ দেখিয়েই চলেছ শাকিল! টাকা পয়সার গন্ধ নিতে এখানে এসেছি নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে, সেটা তো তোমার বন্ধু সজল এলেই প্রমাণ হয়ে যাবে তাই না? সেইটুকু সময় পর্যন্ত তুমিও তো চুপ করে থাকতে পারছ না!’

আমার চাচী এবারে দুজনকেই মৃদু ধমকের সুরে বললেন, ‘আহা! এতদিন পরে তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে দেখা হলো, এই তোমাদের আলাপের ধরণ! সবকিছু বাদ দিয়ে টাকাপয়সার চিন্তা নিয়ে পড়ে গেলা তোমরা? আর শাকিল তুই কি চুপ করে থাকতে পারবি, নাকি পারবি না বল?’

আমরা দুজনেই মাথা হেঁট করে বসে রইলাম। চাচী কিছুসময় চুপ করে থেকে আবার শুরু করলেন।

‘আমার শ্বশুর মানে তোমাদের দাদার বড়লোকের মেয়ের সাথে ছেলেদের বিয়ে দেওয়ার অদ্ভুত এক নেশায় পেয়ে বসেছিল। অবশ্য কাজটা তিনি ভেবেচিন্তেই করেছিলেন। এই বিশাল বাড়িটা ছাড়া তো তার আর কোনো সয় সম্পত্তি ছিল না। কাজেই নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে কিছু একটা উপায় তো করতে হবে তাই না? তাই তার ছয় ছেলেই ছিল সেই আয় বাড়ানোর রাস্তা।

ছেলেদের বিয়ে দিয়ে মোটা অংকের পনের টাকা আদায় করতেন আমার শ্বশুর। এছাড়া উৎসব পার্বণে ছেলেদের শ্বশুরবাড়ি থেকে নানারকম উপঢৌকন তো আসতেই থাকত। বড়ঘরের ধনীর দুলালীর বাবারা তো মেয়েকে বিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকতেন না! তারা নিজের মেয়েদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য খুশী মনেই মেয়ে আর মেয়ে জামাইকে নানারকম উপহার সামগ্রী পাঠিয়ে যেতেন। মাঝে মাঝে অর্থসম্পদও সেই উপহারের সাথে সামিল হতো। আমার বাবাও যে এই কাজ করেছেন সেটা আমি জানতে পেরেছি অনেক পরে। প্রথম থেকে জানতে পারলে আমি অন্তত আমার বাবাকে এই কাজ কিছুতেই করতে দিতাম না!

যাই হোক যা বলছিলাম। তোমার বাবা ছিলেন আমার স্বামীর বড়ভাই। নিজের বড়ছেলেকে নিয়ে বাপের মনে আশা আকাঙ্ক্ষাও তাই একটু বেশি ছিল। ছেলে সাবালক হতে না হতেই অনেকটা তার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই বিয়ে দিয়ে বসলেন আমার শ্বশুর। তোমার বাবা অর্থাৎ আমার ভাসুরের তখন বলার মতো শিক্ষা বা বয়স কোনোকিছুরই জোর ছিল না। তাই চুপচাপ বাবার এই স্বেচ্ছাচারিতা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই ঘরে তোমার বড়ভাই ফাহাদের জন্ম হলো।

তোমার বাবা ততদিনে উচ্চশিক্ষার জন্য ঘরের বাহির হয়েছিলেন। পড়াশুনায় বেশ ভালো ছিলেন তোমার বাবা। তার অন্যান্য ভাইদের তুলনায় তোমার বাবার মেধা অনেক বেশি ছিল। পড়ালেখার প্রতি ঝোঁকটাও ছিল আলাদা রকমের বেশি। কিন্তু তোমার দাদার এসব দিকে কোনরকম মাথাব্যথাই ছিল না। তার নজর ছিল শুধু নিজের এই বিশাল বাড়ি আর ব্যাংকে গচ্ছিত ধনসম্পদের পরিমাণের দিকে। তাই তোমার বাবার শিক্ষাগত যোগ্যতা তার কাছে বিশেষ কিছু মনে হয়নি কখনও।

তোমার বাবা ভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকেই তোমার সৎমায়ের সাথে তার দূরত্ব বাড়তে থাকে। আমি ততদিনে এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছি। তোমার সৎমা ছিলেন ধনীর আদরের দুলালী। লেখাপড়া বা আচার আচরণ কোনদিকেই তার আগ্রহ ছিল না। দিনরাত শুধু দামী কাপড়চোপড় গয়নাগাঁটি আর ভোগবিলাসের উপকরণের দিকেই তার পুরো মনোযোগ ডুবে ছিল। স্বামী থাকল নাকি গেল কিছুতেই তার কিছুমাত্র যেত আসত না। এমনকি ছেলেটাকেও ঠিকমত দেখাশোনা করত না।

কাজের লোকের কাছে ছেলেকে রেখে তোমার সৎমা সিনেমা ঘোরাঘুরি কেনাকাটা এসব নিয়েই মেতে থাকত। ফলে ছেলেটাও দিনকে দিন বখে যাচ্ছিল। কারও কথা শুনত না। আদব লেহাজের বালাই ছিল না একেবারেই! তোমার বাবা বাড়িতে এলে স্ত্রীর সাথে মহা গণ্ডগোল বেঁধে যেত। প্রায় প্রতিবারই একটা ভীষণরকম ঝগড়াঝাঁটি শেষে তিনি ঢাকায় ফিরতেন। আবার ছুটিতে বাড়িতে এলে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম এভাবেই চলবে হয়ত সবকিছু।
কিন্তু নিয়মের ব্যত্যয় ঘটল একবার।

পাশ করে ঢাকাতে চাকরি করছিলেন তোমার বাবা। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ই তোমার মায়ের সাথে তার আলাপ পরিচয় হয়। নিজের কোনও কথাই তোমার মায়ের কাছে গোপন করেনি তোমার বাবা। তোমার সৎমা যখন কিছুতেই নিজের স্বভাব থেকে বের হচ্ছিল না, তখন একেবারে মরিয়া হয়েই তোমার বাবা একটা শেষ চেষ্টা করলেন। চিঠিতে তার বাবাকে সব কথা খুলে বলে এই সম্পর্ক থেকে অব্যাহতি নেওয়ার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু তোমার দাদা কি আর সেই অনুমতি দিবেন? তিনি সব শুনে কড়া সমন জারি করে বললেন, সব ছেড়েছূড়ে বাড়িতে না ফিরলে তিনি ছেলেকে ত্যাজ্য করবেন।

ছেলের গায়েও তো বাপের রক্ত বইছে। তিনি কিছুই ছাড়লেন না। উল্টা একদিন বিয়ে করে নতুন বউকে নিয়ে বাড়িতে এলেন। তোমার সৎমা সেদিনই এক কাপড়ে বাড়ি থেকে চলে গেলেন। অদ্ভুত ব্যাপার কী ছিল জানো, তোমার সৎভাইকে তার মা সাথে করে নিয়ে গেল না! তার কথা ছিল, এই বাড়ির কোনো কিছুই সে সাথে করে নিয়ে যাবে না! পরে তার বাবা নানারকম ঝামেলা করেছিল তোমার দাদার সাথে।

তো যাই হোক, তোমার বাবা তো সেদিন নতুন বউকে নিয়ে বাড়িতে এলেন! কিন্তু একদিনও টিকতে পারলেন না এখানে! তাকে টিকতে দেওয়া হলো না! তোমার দাদা সাফ জানিয়ে দিলেন, হয় এই বউ বাড়িতে থাকবে নয়ত তার ছেলে। দুটো একসাথে কিছুতেই থাকতে পারবে না! আর ভবিষ্যতে কোনোদিন এই বাড়ির চৌহদ্দিতে যেন এই বউয়ের ছায়াও না দেখা যায়!

তোমার বাবা তার নিজের বাবার এই সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন। তিনি এক কাপড়ে নিজের নব পরিণীতা স্ত্রীকে সাথে নিয়ে ঘর ছাড়লেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোনোদিন আর এই বাড়িতে আসেননি!’ (ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here