#বড়গল্প
#অবেলার_পুষ্প
#পর্ব_৬
পঞ্চম পর্বের পরে…
ভদ্রমহিলা জমিয়ে বসলেন। বোঝাই যাচ্ছে উনি গল্প করতে ভালোবাসেন। তাছাড়া এত বিশাল বাড়ি দেখে আমার মতো আরও অনেকের মনেই হয়ত হাজার প্রশ্ন জমে। সেইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে উনার হয়ত ভালোরকম পূর্ব প্রস্তুতি আগে থেকেই নেওয়া আছে। শুধু একটু উস্কে দিলেই গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেন।
আমি দেখলাম উনি কাজের মেয়েকে দিয়ে একটা ছোট পানের ডিব্বা আনিয়ে নিয়েছেন। এক ঝলক তাকিয়ে দেখি, তাতে পাঁচ ছয়টি পানপাতা সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা। ছোট্ট ছোট্ট খুপুরির মতো কয়েকটা জায়গায় পানমশলা, সুপুরি, জর্দা, চুন এসব সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এটুকু জিনিসের এত সুন্দর সজ্জা দেখে মনে হলো, হয়ত এই বাড়ির অন্দরসজ্জারও মূল কারিগর তিনি। এটা আমার অনুমান মাত্র। তবু জানি না কেন, অনুমানটিকে খুব জোরদার বলেই মনে হলো।
পানের ডিব্বা থেকে একটা পান হাতে নিয়ে তাতে চুন, সুপারি আর অল্প কী জানি একটা মশলা নিয়ে গোলা বানিয়ে মুখে পুরে দিলেন ভদ্রমহিলা। তারপর মুখটাতে খুশি খুশি একটা ভাব এনে গল্প বলতে শুরু করলেন।
‘এই বাড়ি বানিয়েছিল আমার শ্বশুরের বাবা। অনেকে এই বাড়ি দেখে জমিদার বাড়ি মনে করে। না, আমার শ্বশুরের বাবা অবশ্য জমিদার ছিল না। এই অঞ্চলের জমিদারের নায়েব ছিল। তার নিয়মনিষ্ঠা আর বিশ্বস্ততা দেখে জমিদার সাহেব খুব খুশি ছিলেন। তাই পুরষ্কার হিসেবেই এই বিশাল জায়গা তাকে উপহারস্বরূপ দিয়েছিলেন। জমিদারের নায়েব মশাই অর্থাৎ আমার শ্বশুরের বাবা ছিলেন ভীষণ শৌখীন মানুষ। তিনি নিজের মনের সাধ মিটিয়ে এই বাড়ি বানিয়েছিলেন। কিন্তু এটা বানাতে গিয়ে তাকে শেষজীবনে ভীষণ অর্থকষ্টে পড়তে হয়েছিল। এত বড় বাড়ি বানিয়ে প্রায় নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। জমিদারের বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন, কিন্তু জমিদারের মৃত্যুর পরে তার ছেলেরা বাবার নায়েবকে একেবারেই সহ্য করতে পারত না। জমিদারের ছেলেদের ধারণা হয়েছিল তাদের বাবার নায়েব তাকে ঠকিয়ে আর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেক টাকাকড়ি গছিয়ে নিয়েছে। নইলে এত বড় বাড়ি কিছুতেই বানাতে পারত না।
আমার শ্বশুররা ছিল দশভাই তিনবোন। তাই এই বাড়ির এক কোনাও খালি পড়ে থাকতো না সেই সময়। পুরো বাড়ি গমগম করত সবসময়। বোনদের বিয়ের পরে তারা যার যার শ্বশুরবাড়ি চলে গেল। ছেলেরা যার যার নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কেউ কেউ এই এলাকার বাইরে পা বাড়ালো। বাড়ি ধীরে ধীরে খালি হতে শুরু করল। শেষজীবনে তাদের বাবা মারা গেল অনেকটা আত্মীয়পরিজন ছাড়াই। তিনি হয়ত জীবনে নিজের কাজ দিয়ে অনেক সুনাম কুড়িয়েছিলেন, কিন্তু ছেলেদের সেভাবে ভালোমানুষ করে বড় করতে পারেননি।
এসব কথা লোকমুখেই ছড়িয়ে পড়েছে দিনে দিনে। কারণ আমার স্বামী তো আর নিজের মুখে তার বাপ চাচাদের কুকীর্তির কথা বলতে যাবে না! তার জীবদ্দশাতেও এসব কথা আমরা কেউ নিজেদের মধ্যেও আলাপ করতে পারিনি। যদিও আমার স্বামী বা তার ভাইয়েরা কেউই নিজেদের বাবার প্রতি সন্তুষ্ট ছিল না, কিন্তু তা সত্ত্বেও বাপ বলে কথা! মানুষের কাছে কি নিজের বাপের দুর্নাম করা যায়?
আমার শ্বশুরের ভাইয়েরা একে একে প্রায় সবাই এদিকে সেদিকে ছড়িয়ে গেল। ব্যবসা বাণিজ্যের ধান্দাতেই তারা একে একে ঘর ছাড়ল। বিশাল বড় বাড়ি আঁকড়ে পড়ে না থেকে আয় রোজগার বাড়ানোর দিকেই মন দিলো সবাই। কারণ বিশাল বাড়ি বানিয়ে তাদের বাবার হাতে জমানো টাকাকড়ি আর ছিল না বললেই চলে। তাই শেষজীবনে নিজের বাপকে অবহেলা করতেও প্রাণে বাধা পায়নি কেউ।
আমার শ্বশুর কিন্তু এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও গেল না! ভাইয়েরা চলে যাওয়াতে তার মনে দুঃখও ছিল না তেমন একটা। তিনি এই বাড়ির একক দখল পেয়ে মহাখুশি হয়ে উঠলেন। মনে মনে পরিকল্পনা সাজাতে বসলেন কীভাবে এই বাড়িটাকে ঘিরেই নিজের আয় রোজগারের একটা উপায় খুঁজে নিতে পারবেন। শেষমেষ ভালোই একটা উপায় পেয়ে গিয়েছিলেন। অনেকটা মাছের তেলে মাছ ভাজার মতো উপায়। নিজের ছয়টা ছেলে, এত বড় বাড়ির দখলদারিত্ব … এটাকেই তিনি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আরও বাড়াতে লাগলেন।’
এই পর্যন্ত বলে ভদ্রমহিলা থামলেন।
আমি লক্ষ করলাম শাকিল একটু যেন উশখুশ করছে। আমার নিজেরও যে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল না তা নয়। আমি তো এত সবিস্তারে এদের পারিবারিক ইতিহাস জানতে চাইনি। আর তাছাড়া একেবারে অপরিচিত একজনের কাছে এতসব গোপন কথা বলে ফেলা কি ঠিক? আমার এত কিছু জেনে লাভটাই বা কী? বাড়িটা কে বানিয়েছিল, এত বড় বাড়িতে কে থাকত এসবই আমার জানার আগ্রহ ছিল। খুঁটিনাটি সব কিছু জেনে আমি কী করব?
আমি একটু গলা খাঁকারি দিয়ে সেই কথা বলেই ফেললাম উনাকে। ‘ইয়ে খালাম্মা, থাক এসব কথা। আপনাদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি আসলে এত বড়বাড়ি দেখে একটু বেশি কৌতূহল দেখিয়ে ফেলেছি হয়ত। যা জানার ছিল জেনে গেলাম। আপনার শ্বশুরের ভাইবোনেরা সবাই থাকলে এই বাড়ি এত শুনশান থাকতো না নিশ্চয়ই। তারা চলে গেছে দেখেই বাড়িটা এমন নিঝুম হয়ে গেছে!’
ভদ্রমহিলা কিন্তু থামলেন না। উনাকে আজ সম্ভবত কথায় পেয়েছে। বেশ উষ্মাভরে গলায় বললেন,
‘চলে গেছে নাকি কাউকে আর উনি ভিড়তে দেননি সেটা আর কে জানতে পারছে বলো! এই বাড়ি তো আর উনার একার ভোগ করার কথা ছিল না! অথচ তিনি সারাজীবন সেটাই করে গেছেন। বাড়িটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে এক অংশ দিব্যি ভাড়া দিয়ে ফেললেন। শখের যাত্রাপালার দল এসে এখানে নিজেদের ডেরা বানিয়ে ফেললো। নিজের ছেলেদের কেউ কেউ বাপের এই কাজে বাগড়া দেওয়াতে তাদেরকে ত্যাজ্যপুত্র বানাতে দেরি করলেন না! যারা মেনে নিলো, তারা টিকে গেল। ইতিমধ্যে আমার শ্বশুরের বোনদের কেউ কেউ নিজেদের বাপের অংশ বুঝে নিতে চলে এসেছে। কিন্তু ততদিনে আমার শ্বশুর তো এই বিশাল বাড়ির একচ্ছত্র মালিক! নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে এটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে তুলেছেন। তখন আর বোনদের ন্যায্য দাবি তার ভালো লাগবে কেন? কাজেই তাদেরকেও একরকম ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হলো!…’
‘আহ মা! থাক না এসব কথা! যা গেছে তা তো গেছেই!’ শাকিল এবারে মৃদু আপত্তিই করে বসল। অথচ তারপরেও শাকিলের মা থামলেন না। উনি কীসের যেন এক অক্ষম আক্রোশে কথা থামাতে পারলেন না। বলেই চললেন,
‘তুই থাম শাকিল। এসব কথা লুকিয়ে আমাদের কী লাভ? প্রকৃতির অভিশাপ নামেও একটা ব্যাপার আছে জানিস সেটা? তোর বাবা বেঁচে থাকতে চুপ করেই তো কাটিয়ে দিয়েছি। স্বামীর বিরুদ্ধাচারণ করিনি। কিন্তু এখন ভয় লাগে আমার। কে জানে… কাকে বঞ্চিত করে এই বাড়ির দখল নিয়ে বসে আছি কে বলতে পারে! আমার সন্তানদের যদি কোনও ক্ষতি হয় সেটা আমি মা হয়ে কীভাবে সহ্য করব?’
আমার ইচ্ছে করছে এখান থেকে উঠেই চলে যাই। কী কুক্ষণে যে ভদ্রমহিলাকে এসব জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিলাম আমি, কে বলতে পারে! শাকিলের দিকে তাকিয়ে নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগল। বেচারার দুইদিন পর বিয়ে। এর মধ্যে আমি ওকে কী একটা ফ্যাসাদে বুঝি ফেলে দিলাম!
শেষমেষ প্রসঙ্গ ধামাচাপা দিতে মরিয়া হয়েই বলে ফেললাম, ‘খালাম্মা, আপনাদের এই শহরে কী কী জায়গা আছে দেখার মতো? আমি এর আগে মানিকগঞ্জে আসিনি কখনও। এই সুযোগে শহরটা দেখে গেলে মন্দ হয় না। এখনো তো বেলা আছে বেশ খানিকটা। আশেপাশে কোথাও থেকে চাইলে ঘুরে আসা যেতে পারে।’
ভদ্রমহিলা এই মুহূর্তে ঠিক যেন নিজের মধ্যে নেই। উনি তখন পাপ পূণ্যের জটিল হিসাবনিকাশে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন সম্ভবত। হয়ত উনার মন খুবই নরম, তাই উত্তরাধিকারীদের বঞ্চিত করে এই বিশাল অট্টালিকা ভোগ করতে তার মন সায় দিচ্ছে না। অথবা এমনও হতে পারে, উনি কোনও কারণে তার শ্বশুরের ওপরে ভয়ানক ক্ষুব্ধ। তাই একটু খোঁচা দিতেই সেই ক্ষোভ একেবারে গলগল করে বেরিয়ে এসেছে উত্তপ্ত লাভার মতো।
আমার প্রশ্ন শুনে অন্যমনস্কভাবে জবাব দিলেন, ‘মানিকগঞ্জে ম্যালাকিছুই তো আছে দেখার মতো। বেতিলা, বালিয়াতি, তেওতা এসব জায়গাতে জমিদারবাড়ি আছে বিশাল জায়গা নিয়ে। ঘুরে দেখতে পারো। মত্তমাঠ নামে একটা ঐতিহাসিক জায়গা আছে সদরেই। এটাও ঘুরে আসতে পারো। আরও অনেক কিছুই আছে। এসেছ, দুইদিন থাকো আমাদের শহরে। শাকিলের বিয়েটা খেয়ে যাও।’
অন্যসময় হলে হয়ত প্রস্তাবটা ভেবে দেখলেও দেখা যেত। কিন্তু এখন এদের এই পারিবারিক ক্যাচালে খানিকটা ঢুকে পড়ার পরে মনে হচ্ছে, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি! বিনয়ের সাথেই তাই উনার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে দিতে বললাম, ‘খালাম্মা, আবার আসব আপনাদের বাড়িতে। খুব ভালো লাগল সবকিছু। কিন্তু এবারে তো একটু কম সময় নিয়ে এসেছিলাম। তাছাড়া খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে বন্ধুর কী হলো!’
ঠিক এমন সময় শাকিলের ফোনটা বেজে উঠল। ‘এক্সকিউজ মি’ বলে উঠে গেল শাকিল। আমিও উঠে নিজের ঘরে চলে যাওয়ার ফাঁক খুঁজছি। উঠতে যাব এমন সময় ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, ‘বাবা, তোমার কাছে অনেকদিন পরে এসব কথা খুলে বলতে পেরে হাল্কা লাগছে নিজেকে। কাউকে বলতে পারি না সবকিছু। আমার ভেতরটা মাঝে মাঝে জ্বলে যায় একেবারে। কী হবে এসব ঘরবাড়ি ধন দৌলত দিয়ে? মানুষই তো একদিন নাই হয়ে যায়। আমাকেই কী না এই যক্ষপুরী আগলে বসে থাকতে হলো!’
আমার কী বলা উচিত এই পরিস্থিতিতে একেবারেই বুঝতে পারছি না। উঠে চলে যাওয়াটাও ভীষণরকম অসমীচীন। উশখুশ করতে করতে বসেই রইলাম। তিনি বলেই চলেছেন, ‘আমার বাপের টাকাকড়ি ছিল ভালো। এই অঞ্চলে ভালোমানুষ হিসেবেও নামডাক ছিল আমার বাবার। সৎ উপায়ে ব্যবসা করে অর্থকড়ি কামিয়েছেন জীবনে। অথচ আমার শ্বশুরের কী দেখে যে বাবা এত মুগ্ধ হয়েছিল আমি জানি না। হয়ত ভেবেছিল এই পুরো বাড়ি আমার শ্বশুরের একার। মেয়ে রাজত্ব করবে বাড়ি জুড়ে। সেই রাজত্বই তো করছি! কিন্তু নিজের রাজ্যের না, অন্যদের হক মেরে আদায় করা রাজ্যের রাণী হয়ে বসেছি আমি!
দিনে দিনে বুঝেছিলাম, আমার শ্বশুর বেছে বেছে শহরের নামীদামী পয়সাওয়ালা লোকদের মেয়েকে নিজের পুত্রবধূ হিসেবে নির্বাচন করেছিল। আমার এক ভাসুর বাপের অমতে দরিদ্রঘরে বিয়ে করেছিল। তিনি নিজের ছেলেকেও ঘাড়ধাক্কা দিতে দেরি করেননি। ……’ কথার মাঝখানে শাকিল চলে আসাতে ভদ্রমহিলা আবারও চুপ করে গেলেন।
আমি কিছু একটা বলে পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে একটু হাল্কা করার তাল খুঁজছিলাম, এমন সময় আচমকাই আমার চোখ পড়ে গেল একটা ছবির দিকে। নিমেষেই আমার সারা শরীর ঝনঝন করে বেজে উঠল।
আরে! কী আশ্চর্য! এই ছবি এখানে কী করছে! (ক্রমশ)