#ভালবাসা_রং_পাল্টায়_না
সময়টা নব্বই দশকের মাঝামাঝি। একদল স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়ে মফস্বলের এক সরকারী কোয়ার্টারের মাঠে খেলা করছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই তাদের মাঝে অতি তুচ্ছ একটা বিষয়ে ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। ঝগড়ার বিষয়টা একটু পরে বলছি। ঝগড়ার শুরু রুবানা আর তানজীদের মাঝে। রুবানা আর তানজীদ এক ক্লাসে পড়ে। তারা আবার বেস্ট ফ্রেন্ড যাকে বলে তার চেয়ে বরং একটু বেশী। রুবানার দু’বছরের বড় রুমকি। রুমকি এখানে সবার বড়।
এই ছেলেমেয়েগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই মফস্বল শহরে তাদের বাবার চাকুরীসূত্রে এসে বসবাস করছে। এবং কোয়ার্টার সংলগ্ন স্কুলে পড়ার কারনে তাদের মাঝে সম্পর্কের গভীরতা বাকি আর সবার চেয়ে একটু বেশী। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে সবাই একই জায়গায় থাকার কারনে সবাই সবার সুখ দুঃখের সমান অংশীদার।
এই কিশোর কিশোরী গ্রুপের মধ্যে রুমকি সবার বড়। আর বাকি সবাই রুমকিকে আপু ডাকলেও তানজীদ কেন জানি ওকে আপু বলে না। সবার সাথে প্রচুর কথা বললেও রুমকির সাথে নেহায়েত প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেনা এবং যা বলে সেটাও ভাববাচ্যে।
আজ মূলত দু’জনের ঝগড়ার বিষয় হলো তানজীদ কেন রুমকিকে আপু ডাকে না। প্রথমটায় দুই একটা কথা কাটাকাটি হলেও পরবর্তীতে সেই ঝগড়া হাতাহাতিতে রূপান্তরিত হয়। তখন খেলা বন্ধ করে সবাই ওদের দু’জনের ঝগড়া থামাতে ব্যস্ত হয়ে পরে।
পরবর্তী দুইদিন যদিও তাদের কথাবার্তা এবং মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল কিন্তু দুইদিন পর তারা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়।
………………
সময় তার নিজ গতিতে বয়ে চলে। কারো জন্য থেমে থাকা সময়ের ধর্ম নয়। সময়ের সাথে সাথে এই মানুশগুলোর মাঝে সম্পর্ক আরো গাঢ় হতে থাকে, সেই সাথে ছেলেমেয়েগুলো বড় হতে থাকে। রুমকি এবার ক্লাস নাইনে, রুবানা আর তানজীদ ক্লাস সেভেনে। বেশ কয়দিন ধরে তানজীদের আচরণ রুমকির কাছে কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকতে লাগল।
এখন আর আগের মতো খেলা হয়না ওদের। ছেলেরা মাঠে খেলা করলেও মেয়েরা সবাই দলবেঁধে কখনো ছাদে আবার কখনও নীচে হাঁটাহাঁটি করে গল্পগুজব করে। সে সময়টায় তানজীদ কেন জানি খেলা বাদ দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে ওদের দিকেই তাকিয়ে থাকে। প্রথমটায় ব্যাপারটা আমলে না নিলেও পরে কেন জানি ব্যাপারটা রুমকির চোখে লাগতে লাগল।
একদিন স্কুল থেকে আসার পর রুবানা বেশ উৎসাহ নিয়ে বলল
-আজ কি হয়েছে জানিস আপু?
-তুই না বললে আমি কি করে জানব?
-তানজীদ কি করেছে জানিস!
তানজীদ নামটা শোনার পর রুমকির কেন যেন আর কিছু শোনার আগ্রহ হলোনা। সে উঠে চলে যেতে উদ্যত হলে রুবানা হাত ধরে টেনে বসিয়ে বলে
-আরে শোন না। তানজীদ সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে ও তোকে বিয়ে করবে।
এই বলে হাসিতে ফেটে পরল রুবানা। একথায় রুমকির রাগে গা রিরি করতে লাগল। রুবানাকে ধমক দিয়ে বলে
-খুব আনন্দ হচ্ছে না তোর! বেশরম! যেমন তোর বন্ধু তেমন তুই।
রুবানা আরও কিছু বলতে নিলে রুমকি রুম থেকে বের হয়ে যায়।
এই ঘটনার পর থেকে রুমকি যে জায়গাগুলোতে তানজীদের থাকার সম্ভাবনা আছে সেগুলো এড়িয়ে চলতে শুরু করল।
………………
রুমকি একদিন স্কুল থেকে এসে দেখে তানজীদ ওর পড়ার টেবিলে কি যেন করছে। ওকে কিছু বলতে যাবে এমন সময় দেখতে পেল তার গুণধর বোন পাশেই আছে। তাই কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে গেল। সন্ধ্যায় পড়তে বসলে বইয়ের ভেতরে একটা চিরকুট পেল। তাতে লেখা
‘আপনাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। কেন, কবে থেকে আমি বলতে পারব না। তবে যখনি আপনাকে দেখি আমি সব ভুলে যাই। কেবল আপনাকে দেখতেই ইচ্ছে করে। সারাদিন ধরেও যদি আপানাকে দেখি আমার সাধ মিটবে না।
তুলি আপুর হলুদে আপনাকে প্রথম শাড়ি পরা দেখেছি আমি কেবল আপনাকেই দেখেছি। বাসায় এসে মনে পরেছিল আমি আপনাকে দেখতে দেখতে রাতের খাবার খেতে ভুলে গিয়েছি। কিন্তু জানেন আমার একটুও খারাপ লাগেনি। আপনাকে দেখার জন্য আমি এমন অনেক বেলা না খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারব।
আপনি যখন বাম দিকে সিথি কেটে চোখে কাজল দেন কেমন অদ্ভুত সুন্দর লাগে আপনাকে আমি বলে বুঝাতে পারব না। লাল রঙয়ে আপনাকে ভীষণ সুন্দর লাগে, গোলাপীতে লাগে ভীষণ আদুরে, হলুদ আপনার মাঝে অদ্ভুত দ্যুতি ছড়ায়, আর কালো? কালোতে আপনাকে দেখলে আমার হৃদকম্প বেড়ে যায়।
আপনি কি বুঝতে পারেন আমি সারাক্ষন আপনাকেই দেখি। আমার কেন যেন মনে হয় বুঝতে পারেন। আপনাকে সরাসরি কথাগুলো বলতে পারছি না কোনভাবেই। তাই এই চিঠির আশ্রয় নিলাম।
কাল ঠিক বিকেল চারটায় আপনার জন্য ছাতিম গাছটার নীচে অপেক্ষায় থাকব। আসবেন তো? আমি কিন্তু অপেক্ষায় থাকব’।
……………
চিঠিটা দেয়ার পর থেকেই তানজীদের মাঝে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছে। কে যানে রুমকি ব্যাপারটা কি ভাবে নিবে? রুমকি কি আসবে? এসে কি করবে বা কি বলবে? আচ্ছা বকাঝকা দিলেও সমস্যা নেই। রুমকির সবকিছু তার পছন্দ। বকা দিলেও হজম করে নিবে। কিন্তু যদি না আসে? তানজীদ তখন কি করবে?
প্রচণ্ড অস্থিরতায় সারারাত ঘুমাতে পারল না, পরদিন ক্লাসে মন বসল না। মন কেবল অপেক্ষায় আছে চারটা বাজার। ইচ্ছে করছে এখনি যেয়ে ছাতিম গাছের নীচে বসে থাকে। চারটা পর্যন্ত আর তর সইল না তার। তিনটা থেকে যেয়েই বসে ছিল।
চারটা পেরিয়ে গেছে সেই কখন! কিন্তু রুমকির দেখা নেই। তানজীদের মনে দু’ধরনের চিন্তা কাজ করছে। এক রুমকি আসবে না, দুই রুমকির হয়তো দেরী হচ্ছে। প্রথমটা কেন যেন মন থেকে মানতে পারছে না তানজীদ। তার মনে দ্বিতীয় চিন্তাটাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই অপেক্ষা করতে লাগল। অপেক্ষার পালা শেষ হলো যখন পাশের মসজিদ থেকে আযানের শব্দ ভেসে এলো।
রুমকি আসেনি। এটাই সত্যি। কিন্তু সেই সত্যিটা কেন যেন এই বারো তেরো বছরের কিশোর মেনে নিতে পারছে না। তার মন বলছে একবার রুমকির সামনা সামনি গিয়ে দাঁড়ানো প্রয়োজন। আর কিছু না ভেবেই সে চলে গেল রুমকিদের বাসায়।
বেল দিতেই রুবানা এসে দরজা খুলে দিল। তানজীদের চেহারা দেখে ভীষণ রকমের ভয় পেয়ে গেল রুবানা। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই তানজীদ তাকে বলল
-রুমকি কোথায়? ওকে ডাক।
-কি হয়েছে তোর? আপুকে দিয়ে কি করবি?
-যা বলেছি তা কর।
-দেখ আব্বু আম্মু বাসায় নেই। প্লীজ কোন কিছু করিস না।
এই কথা শোনার সাথে সাথে তানজীদ আর কিছু না বলে ভেতরের দিকে চলে যায় আর রুবানা ছুটে তার পিছু পিছু। রুমে ঢুকেই দেখে রুমকি হেডফোনে গান শুনছে আর গল্পের বই পড়ছে। এটা দেখে প্রচণ্ড রাগ হলো তানজীদের। সে এদিকে অস্থির হয়ে আছে আর অপরদিকে আরেকজন রিলাক্স করছে। এক ঝটকায় রুমকির হাত ধরে টেনে তুলে ফেলল।
ঘটনার আকস্মিকতায় রুমকি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। হেডফোন থাকায় তানজীদ কখন এসেছে টের পায়নি। তানজীদকে দেখে হেডফোন সরিয়ে কিছু বলতে যাবে এমন সময় তানজীদের প্রশ্নবাণে পরল রুমকি।
-কি ব্যাপার আপনি এলেন না কেন? আমি সেই তিনটা থেকে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। আপনার কাছে কি আমার ফিলিংসের কোন মূল্য নেই?
রুমকি বেশ অবাক হলো এই ছেলের আচরণে। রাগও হচ্ছে ভীষণ। তারপরও নিজেকে সামলে বলল
-তোমাকে কি আমি প্রমিজ করেছি আমি যাব?
-না।
-তাহলে এভাবে জেরা কেন করছ তুমি?
-আপনি আসেননি কেন? আমি অপেক্ষায় ছিলাম।
-ফের এক কথা!
এবার তানজীদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল
-আমি আপনাকে ভালবাসি। ভীষণ ভালবাসি।
কথা শেষ হতে পারেনি তার আগেই রুমকি এক চড় বসিয়ে দিল তানজীদের গালে। একেতো ফর্সা তার উপর চড় খেয়ে ছেলের গাল যেন একেবারে লাল টকটকে হয়ে গেছে। তানজীদ ও এমনটা প্রত্যাশা করেনি। কেবল ফ্যালফ্যাল করে রুমকির দিকে তাকিয়ে রইল। আর রুবানা নীরব দর্শকের মতো একবার বোনের দিকে আর একবার বন্ধুর দিকে তাকাচ্ছে।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here