#ভালোবাসাটা_আমার
#রোকসানা_আক্তার
#পর্ব-০৮
লুৎফর আলীর খুশির সীমা রইলো না।মেয়ের কলটা রেখেই পেছনে তাকিয়ে উঁচু আওয়াজে নিতুর মাকে ডেকে উঠেন,
“নিতুর মা?নিতুর মা?কোথায় তুমি?”
নিতুর মা ঘরে থেকে বাইরে বেরিয়ে আসেন।উনার উঁচু আওয়াজে নিতুর ভাবী এবং ভাই বেরিয়ে আসেন।নিতুর মা বলেন,
“কি হয়েছে?এভাবে জোরে ডাকতেছো কেনো?”
“নিতু এবারের পরিক্ষায় সবার দ্বিতীয় হয়েছে!”
“কি!আলহামদুলিল্লাহ!”
নিতুর ভাই,
“আলহামদুলিল্লাহ! আমাদের নিতুকে দিয়েই হবে!”
পাশ থেকে নিতুর ভাবী বলে উঠেন,
“আমিতো সেই দুপুরেই শুনেছি নিতু যে দ্বিতীয় হইছে।”
নিতুর বাবা বলেন,
“তো তুমি আমাদের বলবা না?”
“নিতু বারণ করছে তাই বলি নাই।ও নাকি নিজেই আপনাকে বলবে তাই।”
নিতুর বাবা আর কিছু বললেন না।আরো খুশি হলেন!
২০.
পরদিন নিতু ভার্সিটিতে ক্লাস করতে গেলে কতগুলো মেয়ে পথ আগলে দাঁড়ায় নিতুর।এদের সবাইকে নিতু মোটামুটি চেনে।সিনিয়র এরা!রিহানের বিষয়টা নিয়ে এরাও হাসিঠাট্টা করেছে অনেকবার!বলে,
“শুনলাম.. তুমি তোমাদের ডিপার্টমেন্টে এই সেমিস্টারে সেকেন্ড হয়েছো?”
আরেকজন ফোঁড়ন কেঁটে বলে উঠে,
“কথাটি কি সত্যি?”
নিতু মৃদু হাসলো সিনিয়র আপুদের কথায়!তারপর বললো,
“রেজাল্ট আমাদের ডিপার্টমেন্টের সামনের দেয়ালে ঝুঁলে আছে।দয়া করে ওখান থেকে দেখে নিন।”
এই বলে ওদের পাশ কেঁটে চলে আসে নিতু।নিতুর এভাবে চলে যাওয়া দেখে সিনিয়ররা বলে উঠে,
“কতবড় ষ্টুপিড!সিনিয়রদের সম্মান করতে জানে না!”
২১.
যতগুলো ক্লাস হয় সবগুলো ক্লাসের টিচাররা ক্লাসে ঢুকেই নিতুকে অভিনন্দন জানায়!এভাবেই সামনের সেমিস্টারগুলোতেও এগিয়ে যাওয়ার প্ররোচনা দেয়!
শিক্ষকদের উপদেশে নিতু ভীষণ খুশি হয়।এতদিন টিচাররা ওর নাম জানতো না।ভালো করে চেনতোও না!একটা সেমিস্টারের রেজাল্টেই স্যাররা যেনো ওর কত আপন হয়ে গেলো।তারপর এভাবে আরো অনেকগুলো দিন কেঁটে যায় নিতুর।দিনগুলো বেশ ভালোই লাগে এখন ওর।ভার্সিটিতো আরো ভালো লাগে।তবে,ভার্সিটিতে এখনো ওর তেমন কোনো বন্ধু হয়নি।একটা মেয়ে অবশ্যি ওর পেছন পেছন কয়দিন ধরে ভুজুংভাজুং করতেছে বন্ধুত্ব করতে।কিন্তু নিতু করবে না।মেয়েটাকে নিতু চেনে!এই মেয়েটাও রিহান ভাইয়ার কথা তুলে হাসিঠাট্টা করেছিল।বান্ধবী হবে ঠিক আছে।নিতুর দরকার একটা সত্যিকারের বান্ধবী।যে সবসময় নিতুর পাশে থাকবে।ওর মনঃকষ্ট গুলো শুনবে।সে কষ্টগুলো আবার নিজেদের মাঝে ভাগও করে নেবে।ঠিক তোহার মতন।তবে তোহার মতন বান্ধবী এই শহরে হবে না নিতু জানে।
২২.
নিতুর দ্বিতীয় বর্ষের ১ম সেমিস্টার পরিক্ষা দরজার নাগালে একদম।নিতু নিজেকে ভালো মতন গুচচ্ছে পরিক্ষার জন্যে।সারা দিন-রাত উজাড় করে পড়ছে।একটুও সময় ব্যয় করতে চাচ্ছে না।প্রিয়াও এখন নিতুর সাথে তাল মিলিয়ে পড়ালেখা শুরু করেছে।প্রিয়া ইদানীং আগের থেকে অনেকটা সাবলীল হয়ে গেছে।নিতুকে আগের মতন নিচু চোখে দেখে না।নিতুর সাথে হেসে উঠে সুন্দরভাবে কথা বলে।নিতুও প্রিয়ায় সাথে এখন মোটামুটি সহজ।
এভাবে নিতুর সেমিস্টার পরিক্ষা শেষ হয়।পরিক্ষার পর ১৫ দিনের ছুটি পায় ভার্সিটি থেকে।নিতু গ্রামের বাড়িতে চলে আসে।এসে দেখে নিতুর ভাবীর অবস্থা বেসামাল!ভাবীর ডেলিভারির সময় ঘনিয়ে এসেছে।নিতু ব্যাগটা নিচে রেখে ভাবীর কাছে দৌড়ে গেলো!
“ভাবী,তোমার শরীর কেমন?”
“ভালো ই।”
“ঠিক মতন খাওয়াদাওয়া করতেছো তো?”
“করছি।”
“ডাক্তার কি বললো।কি হবে?ছেলে না মেয়ে?”
এমন সময় নিতুর ভাইয়া বেরিয়ে আসে ঘরে থেকে।নিতুকে দেখে,
“আরেহ নিতু যে!কখন এলি?”
নিতুর ভাইয়া আসাতেই নিতুর ভাবী যেনো বেঁচে গেলো।তিনি সামনে দিয়ে তরতর করে ঘরের দিকে চলে যান। নিতু ব্যাপারটায় কিছু বিব্রতবোধ হলো।তবে কিছু বললো না।ভাইয়াকে সবিনয়ে জবাব প্রদান করলো,
“মাত্র ভাইয়া।”
“ঘরে আয়?”
“পরে।মা, বাবা এবং মিতার সাথে দেখা করি নাই।”
নিতুকে দেখে সবাই খুশি হয়ে যায়।নিতুর মা তো খুশিতে নিতুকে জড়িয়ে ধরেই কেঁদে উঠেন।নিতু মাকে সান্ত্বনা দেয়।এমন সময় তোহাও এসে হাজির হয়।সে নিতুকে দেখে চওড়া একটা হাসি দেয়।বলে,
“আরেহ দোস্ত?আমার কপাল কি ভালো।এসেই তোকে পেয়ে গেলাম।”
শুরু হয় দুই বান্ধবীর কথার খোল।নিতুর মা বুঝলেন এই মেয়ে তোমাকে যেহেতু পেয়েছে ফ্রেশ হতেও ভুলে যাবে।তাই নিজেই মেয়ের ব্যাগটা তুলে নিয়ে ঘরে চলে যান!
২৩.
শ্রাবণ মাস।আকাশে সাদা মেঘের আনাগোনা।সবুজ প্রকৃতিতে ঝলমল রোদ।পাখির ডাক।মন মাতানো মৃদু বাতাস।নিতু লেখক হুমায়ুন আহমেদের “শ্রাবণের মেঘ”বইয়ের কয়েকটা পেইজ পড়ছে।উপন্যাসের পরিবেশটা বৃষ্টিবাদলাময়।কি সুন্দর করে বৃষ্টির দিনের বর্ণনা লেখা।একরকম একটা পরিবেশ এখন যদি হত।মনখুলে ঘুরা যেত!ইস যদি এখন বৃষ্টি হত?ভেবে নিতু জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো।পশ্চিমের খাল ঘেঁষে লম্বা একটা সরু রাস্তা,যেটা নিতুদের বাড়ির দিকে।সেই পথে ধরেই তোহা মাথার বেণী হেলিয়ে দুলিয়ে এদিকে আসছে।তোহাকে দেখে নিতুর মুখে হাসি ফুটে উঠলো মুহূর্তে। নিতু তরহর উপন্যাস বন্ধ করে ঘরে থেকে বেরিয়ে এগিয়ে গেলো তোহার দিকে।তোহা বলে উঠলো,
” আহা,বান্ধবী?কষ্ট করে আসার কি দরকার ছিলো?আমিই তো আসছি।”
“তোর আর সামনে এগুতে হবে না।এবার পেছনের দিকে হাঁটা ধর!”
“মানে?”
“মানে ঘুরবো!”
“কোথায় ঘুরবি?”
“চল না?”
তোহা আর কিছু বললো না।নিতুর কথামতো এগুতে থাকলো।দুজনে চুপচাপ কিছুদূর হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ নিতু বলে উঠলো,
“জানিস, তোহা?”
“কি।”
“আমি রিহান ভাইয়াকে ভুলে গিয়েছি।একদম ভুলে গিয়েছি।”
তোহা নিতুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।নিতু বলে,
“কাউকে জীবনে প্রথম ভালোবাসলাম। কয়েকদিনের ভেতর ভুলেও গেলাম।সাহস আমার দেখছিস?কে পারে তার প্রথম ভালোবাসার মানুষকে ভুলে যেতে?”
তোহা তাও কিছু বললো না।চুপচাপ তাকিয়ে থাকলো নিতুর দিকে।নিতু বলে উঠে,
“কিরে কিছু বলছিস না কেনো?”
তোহা এবার শুকনো একটু হাসে।বলে,
“কি আর বলবো!তোর মুখ বলে ভুলে গিয়েছিস।তবে তোর চোখ বলে এখনো ভুলতে পারিস নি!আর চোখের কথাই সত্য!”
“মানে?কী বলতে চাচ্ছিস তুই?”
“মানুষ যাকে ভুলে যায় তার কথা কখনো নিজ থেকে আগে বলে না।যাকে ভুলে গেলাম তার কথা আর কিই বা বলার থাকবে!কিন্তু যাকে ভুলেছি বলেও ভুলতে পারিনি।হুটহাট যেকাউকে তার কথা বলতে ইচ্ছে করবে।এই যেমন আমি জিজ্ঞেস না করা সত্ত্বেও নিজ থেকে আপনাআপনি বলে ফেললি উনার কথা।এটা উনাকে ভুলতে পারা নয়।নিজেকে ক্ষণিকের জন্যে সান্ত্বনা দেওয়া।তুই এখনো রিহান নামের ওই ছেলেকে ভুলতে পারিস নি নিতু!”
“দূর কি যে বলিস না তুই!….”
এমন সময় আকাশে জোরে একটা শব্দ করে উঠলো।বজ্রপাতের শব্দ।নিতু কথা বলার মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরে একটা উচ্ছ্বাসিত আওয়াজ করে উঠলো।
“ইয়াহু,ইয়াহু এতক্ষণ যেনো এটিরই অপেক্ষায় ছিলাম।বৃষ্টি হবে।চল দোস্ত!দুইজন বৃষ্টিতে ভিঁজবো!নদীর পাড়ে যাই।”
বলে তোহার হাত টান দিয়ে তোহাকে নিয়ে দৌড় মারলো নিতু।এক মিনিটের মাথায় গুড়মুড় করে আকাশ থেকে বৃষ্টি নামলো!নিতু পসান্তা নদীর পাড়ের কিনারে দাঁড়িয়ে নির্বিঘ্নে বৃষ্টি উপভোগ করতে থাকলো।আর তোহা পসান্তা নদীর পানি ডান হাত দিয়ে নড়ানড়ি করছে।তার থেকে কিছু পানি আবার দুষ্টমি করে নিতুর দিকে ছিটিয়ে দিচ্ছে।এমন সময় তোহার নজর পড়লো একদম নদীর দক্ষিণ প্রান্তে। যেখান থেকে খালের শেষপ্রান্ত এসে মেশে গেছে একদম নদীর সাথে।সেই অংশে নৌকায় বসে করিম ভাই কি যেনো করছে।তোহা ডেকে উঠে,
“ও করিম ভাই?কি করছেন এই বৃষ্টির মধ্যে নৌকা নিয়ে?”
করিমের এতক্ষণে তোহাকে খেয়াল হয়।সাথে নিতুকেও।করিম হেসে উঠে।বলে,
“দুই বান্দর এখানে এখন কি করস?গাঁয়ে বাঁজ পড়বো ত।”
“আপনি কি করেন?”
“মাছ ধরতে আসছি।দেখি কোনো মাছটাছ পাই কিনা।”
তোহা দাঁত বের করে হেসে দেয়।বলে,
“বিকাশের ব্যবসায়ের টাকায় পেটে মাছ যায় না?নদীর মাছও খেতে ইচ্ছে করে?এতটা কৃপণ কবে থেকে হলেন?”
নিতুও হেসে। দিলো এবার।করিম নিতুর দিকে তাকিয়ে,
“ঢাবিয়ান?তোমার তো জ্বর বিঁধবো।পরে ঢাকায় যাবা কেমনে?”
“ঢাকা যাওন অনেক দেরী।জ্বর আসলেও ভালো হয়ে যাবো।আপনি এবার এই বৃষ্টিময় পরিবেশে নৌকা দিয়ে সারা নদীতে ঘুরান।কি কস,তোহা?”
“হ হ হ হ।”
“আরেহ আমার সময় নাই।তোরা বাড়িতে চলে যা।”
তোহা বলে,
“মানমু না, ভাই।আমাদের ঘুরান লাগবোই।নাহলে এখান থেকে নুড়ি মাটি মেলাবো!আর সাথে মাছ খাওনও বুঝিয়া দিবো।নৌকা ভিড়ান এদিকে!তাড়াতাড়ি! ”
বেচারী করিম পড়ে গেলো ফান্দে!এই তোহা মেয়েটা একটু বেশিই ঝগড়াটে টাইপের।এর সাথে পারা যাবে না।তারচে মান রক্ষা করতে নৌকা টা ভিড়িয়ে এদের একটু ঘুরিয়ে বিদেয় করাই ভালো!
২৪.
বাড়িতে থাকতেই নিতু নিতুর রেজাল্ট পেয়ে গেলো
।প্রিয়া কল করে জানায়- নিতু ৪.০০ পেয়েছে।মানে সে এবার তাদের ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট হয়েছে ।আর ফার্স্ট হওয়া সেই ছেলেটা এবার সেকেন্ড হয়েছে!এমন সংবাদে নিতু মুহূর্তের জন্যে নিস্তব্ধ হয়ে যায়।আর সাথে আকাশসম খুশি!ভার্সিটি খুলেছে আজ তিনদিন হবে।কিন্তু ওই যে বৃষ্টিতে ভিঁজে জ্বর বাঁধিয়েছে তারজন্যে আর ঢাকায় ফিরতে পারে নি।আর ভার্সিটি খোলামাত্র রেজাল্টটাও পাবলিসড করে দিলো!
চলবে….