#মনের_মানুষ
#সুচন্দ্রা_চক্রবর্তী
#চতুর্থ_পর্ব
হেমন্তকে দেখলেই কেমন যেন একটা অনুভূতি হয় অস্মিতার,হেমন্তর চোখে চোখ রেখে কথাও বলতে পারে না ও,আর হেমন্তর গলা শুনলেও কেমন যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ে ও।এ বাড়িতে যতবারই এসেছে,হেমন্ত ওর সামনে এলেই কেমন যেন অস্বস্তিতে পড়ে যায় ও,আর লজ্জা লাগে,একেই কি তবে ভালোবাসা বলে?
নিজের প্রশ্নের উত্তর পায়নি অস্মিতা এখনও,তবে হেমন্ত মনের সব কথা শেয়ার করে অস্মিতার কাছে,কোনো কারণে মন খারাপ থাকলে জানাতে দ্বিধাবোধ করে না।যদিও হেমন্ত কখনো তাকে মুখ ফুটে বলেনি যে সেও অস্মিতাকে ভালোবাসে।
এইভাবেই প্রতীকবাবুর বাড়িতে বেড়ে উঠল অস্মিতা আর হেমন্ত।অস্মিতা স্কুল পাশ করে এখন কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে,আর হেমন্ত ইউনিভার্সিটি পাশ করে একটা কর্পোরেট অফিসে চাকরিতে যুক্ত হয়েছে।
এর মধ্যে হঠাৎই ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা।অস্মিতা যখন কলেজ থেকে ফিরে সুমিত্রার ঘরের দিকে যাচ্ছিল,তখনই ওর কানে কিছু কথা ভেসে এল,তাকে নিয়েই কথা হচ্ছে ভেতরে।
অস্মিতা শুনল,প্রতীকবাবু বলছেন,’হেমন্ত,তুমি চাকরি পেয়ে গেছ বাবা,আমি আর অস্মি মাকে দূরের মানুষ করে রাখতে চাই না,আমি ওকে পাকাপাকিভাবে,অর্থাৎ আইনতভাবেই ওকে বাড়ির মেয়ে হিসেবে রাখতে চাই।’
— ‘তোর বাবা একদম ঠিক বলেছেন রে,তোকে আর অস্মি মাকে পাশাপাশি বড় সুন্দর দেখায় রে,একেবারে যেন রাজযোটক!আমরা আর দেরি করতে চাই না,সামনের ফাল্গুনেই তোদের বিয়েটা দেব আমরা ঠিক করেছি।’ সুমিত্রা বললেন।
অস্মিতা বাইরে দাঁড়িয়ে সবটা শুনছিল।বিয়ের কথা শুনেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল সে,ভাবল,’যাহ্,হেমন্তদা খুব দুষ্টু।নিশ্চয়ই স্যার আর আন্টিকে ও ই বলেছে আমার সাথে বিয়ের কথা!মা-বাবাকে জানাতে পারল ভালোবাসার কথা,এদিকে আমাকেই কোনোদিন বলল না ভালোবাসি!ধ্যাৎ!’ লাজুক হেসে অস্মিতা নিজের ঘরে চলে এল।
প্রকৃতি সময়ের স্রোতে গা ভাসাতে ভাসাতে এসে পড়ল রঙিন ফাগুন মাসে।ব্যানার্জী বাড়িতে বাজল বিয়ের সানাই।লাল বেনারসির সাজে সজ্জিত অস্মিতাকে আনা হল ছাদনাতলায়।প্রিয়তম পুরুষের হাতের ছোঁয়ায় সিঁথিভর্তি সিঁদুর যেন আরও গাঢ় রক্তিম হয়ে উঠল,খোঁপায় বাঁধা পলাশ আরও রাঙা হয়ে উঠল অস্মিতার মনের কোণায় ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা প্রেমের আগুনে।সদ্য বিবাহিত বরকনেকে দেখে উপস্থিত অভ্যাগতদের মুখে একটাই কথা,’আহা একেবারে রাজযোটক!ঠিক যেন একে অপরের জন্যই তৈরী!’
বিবাহ পরবর্তী অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হল ব্যানার্জী বাড়িতে ধুমধাম করে।রিসেপশনে অন্যান্য আত্মীয়স্বজনদের সাথে উপস্থিত ছিল অস্মিতার দিদি-জামাইবাবু উর্মিলা আর দীনেশও।ওরা অনুষ্ঠানবাড়ির এককোণে দাঁড়িয়ে ছিল,অস্মিতাই গিয়ে ডেকে আনল ওদের,বলল,’দিদিভাই,দীনেশ দা,এক কোণে এভাবে মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন?লজ্জায়?’
— ‘লজ্জা কেন পেতে যাব?’ উর্মিলা মুখ বেঁকিয়ে বলল।
— ‘না মানে তোরা এক সময় আমায় বলতিস না,যে আমার মতো মেয়েকে আর কে বিয়ে করবে?ওই তোদের অরবিন্দবাবু ছাড়া নাকি আর কোনো ভালো পাত্রই জুটবে না আমার কপালে,তাই বলছিলাম আর কি!তোদের কোনো কথাই তো আর ফলল না,তাই ভাবছিলাম যে লজ্জা পেয়েছিস তোরা!’ বলেই ওয়েটারকে ডেকে ওদের দুজনের হাতে দুটো চিকেন পকোড়ার প্লেট তুলে দিয়ে বাঁকা হেসে অস্মিতা সেখান থেকে চলে গেল।
— ‘উঁহ্,বিয়ে করে হাড় হাভাতের ডানা গজিয়েছে!কেমন মুখ নেড়ে কথা বলছে তাই দেখো না!’ উর্মিলা দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলল,’বেশ!আমিও দেখব,কতদিন তোর কপালে সুখ থাকে আবাগী!’
ফুলসজ্জার রাতে বোধহয় উর্মিলার অভিশাপটাই ফলে গেল অস্মিতার জীবনে।হেমন্তর প্রিয় রঙ হলুদ,তাই লালপাড় হলুদ বেনারসি আর ফুলের গয়নায় সাজানো হয়েছে অস্মিতাকে।সুমিত্রাই অস্মিতাকে পৌঁছে দিলেন হরেকরকম ফুলে সজ্জিত বিছানায়,তারপর বিছানার পাশেই থাকা টেবিলটায় একগ্লাস দুধ রেখে গেলেন,তারপর হেসে বললেন ‘খাইয়ে দিস বরকে!’ বলেই চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ পরেই হেমন্ত ঢুকল ঘরে।অস্মিতা বিছানায় লাজুক মুখে বসে আছে চুপটি করে,নাকে আসছে রকমারি ফুলের সুবাস।হেমন্ত হাতে লাল গোলাপের তোড়া নিয়ে এগিয়ে আসছে অস্মিতার দিকে ধীর পায়ে।হেমন্ত যত এগিয়ে আসছে,অস্মিতার বুকের ধুকপুকানি ততই বাড়ছে।হেমন্ত এসে বসল বিছানায়,তারপর গোলাপের তোড়াটা এগিয়ে দিল অস্মিতার দিকে,বলল,’এটা মা দিতে বলল তোমায়!’
অস্মিতা লাজুক হেসে বলল,’আন্টি দিতে বলল তাই দিলে?তোমার এতটুকু ইচ্ছে ছিল না?’
হেমন্ত হঠাৎই অস্মিতার হাতদুটো নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল,’আমি তোমায় কিছু বলতে চাই অস্মি!’
‘যাক,বিয়ের পর অন্তত ভালোবাসার কথাটা বলবে!’ ভেবেই অস্মিতা স্মিত হেসে বলল,’বলো না,কি বলবে!এখন আমরা হাজব্যান্ড ওয়াইফ হেমন্তদা,আর কোনো কথাই গোপন থাকার উচিত নয় আমাদের মাঝে,তাই তুমি মনের কথা নির্দ্বিধায় বলো আমায়।’
— ‘আসলে অস্মি,কথাটা তোমায় কিভাবে বলব ঠিক বুঝতে পারছি না…..’
— ‘উফ হেমন্তদা,অ্যাই অ্যাম ইয়োর ওয়াইফ নাও,এত হেজিটেট করার কি আছে বলো তো?’
— ‘আসলে অস্মি,এটা ঠিক যে সামাজিকভাবে তুমি আমার বিবাহিতা স্ত্রী,কিন্তু অস্মি,আমি মনে মনে কোনোদিনও তোমায় স্ত্রী বলো,প্রেমিকা বলো,বা ভালোবাসার মানুষ বলো,সেই জায়গাটা দিতে পারিনি,আর ভবিষ্যতেও পারব না।আমি সেই কলেজ জীবন থেকে একজন মেয়েকে ভালোবাসি,তার নাম স্বরলিপি।মেয়েটিও আমায় একইভাবে ভালোবাসে।মাকে জানিয়েছিলাম ওর কথা চাকরি পাওয়ার পরে,কিন্তু মা মেনে নেননি।আসলে ওঁরা ছেলের বৌ হিসেবে তুমি ছাড়া আর কারোর কথা ভাবতেই পারেননি কখনো।তোমায় যেদিন বাবা নিয়ে এসেছিলেন পাকাপাকিভাবে পাঁচ বছর আগে এবাড়িতে,সেদিন থেকেই মা-বাবা দুজনেই চেয়েছিলেন তুমিই তাঁদের একমাত্র ছেলের বৌ হও,যাতে সারাজীবন ওঁদের কাছেই থেকে যাও তুমি।আসলে ওঁরা দুজন কোনোদিন আমার থেকে তোমায় আলাদা করে দেখেননি তো,তাই তোমায় এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করতে চাননা ওঁরা।তাই স্বরলিপিকে মা মেনে নেননি,আর বাবার ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ।মাত্র তিন-চার মাস সময় আছে ওনার হাতে।শেষ সময়টায় আর ওঁকে কষ্ট দিতে চাইনা আমরা,তাই মা বা আমি কেউই স্বরলিপির নামটাও উচ্চারণ করিনি কখনো বাবার সামনে।শুধুমাত্র বাবার শেষ ইচ্ছেটুকু রাখার জন্যই আমি তোমায় বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি অস্মি,কিন্তু এই বিয়েতে আমার একদমই মত ছিল না,বিশ্বাস করো!’
(ক্রমশ)