#মনের_মানুষ
#সুচন্দ্রা_চক্রবর্তী
#তৃতীয়_পর্ব
অরবিন্দবাবু গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন।
অন্যদিকে কান্নাকাটি,ডাকাডাকি করে অস্মিতা হাঁপিয়ে উঠল।আজ বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত অস্মিতার খাওয়া বন্ধ,বলে দিয়েছে উর্মিলা।ক্লান্ত অস্মিতা কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে কাঁদতে কাঁদতে,খেয়ালই নেই তার।সন্ধ্যে নামল,উর্মিলার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙল তার।নাবালিকার বিয়ে,তাই উৎসব অনুষ্ঠান হচ্ছে,তবে লোকচক্ষুর আড়ালে।কাউকে সেভাবে নেমন্তন্নও করা হয়নি কয়েকজন বিশ্বস্ত বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজন ছাড়া।যে কয়েকজন চেনাজানা মহিলা আর পুরুষ আনা হয়েছিল বিয়েতে বাড়ি সাজানো,আর রান্নাবান্না করার জন্য,তাদেরই তাড়া দিচ্ছে উর্মিলা,’বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হল,কাজকর্মগুলো একটু তাড়াতাড়ি করো হাত চালিয়ে!বর এলে তারপর সব আয়োজন করবে নাকি তোমরা!’
উর্মিলার এই কর্কশ কন্ঠ শুনে ঘুম ভেঙে গেল অস্মিতার।ক্ষীণকন্ঠে ও একটু জল চাইল,আর উর্মিলা দরজা খুলে এক গ্লাস জল মেঝেতে রেখে দিয়ে দরজাটা আবার লক করে কোথায় যেন চলে গেল।
জল খেতে খেতে অস্মিতা নিজের মনটাকে শক্ত করার চেষ্টা করছিল,কারণ ও ধরেই নিয়েছিল বিয়েটা হচ্ছেই,কোনোভাবেই বিয়েটা বন্ধ হওয়ার আশা নেই। মৃত বাবা-মাকে মনে করছিল সে,আর প্রার্থনা করছিল সামনে যে ঝড় আসতে চলেছে তার জীবনে,সেই ঝড় সামলানোর সাহস যেন সে যুগিয়ে উঠতে পারে।
ক্রমে বাইরের অন্ধকার গাঢ় হতে লাগল।দিনের শেষ আলোটুকুও নিভে এল।উর্মিলা আর কয়েকজন মহিলা মিলে সাজাতে বসল বিধ্বস্ত অস্মিতাকে।অস্মিতা কোনো বাধা দিল না,একটা কাঠের পুতুলের মতোই চুপচাপ মেনে নিতে থাকল সবটা।
বিয়ের লগ্ন রাত আটটায়।ঘড়ির কাঁটা সাড়ে সাতটা পেরোতে না পেরোতেই গাড়ি হাঁকিয়ে বরবেশে হাজির অরবিন্দবাবু।
দীনেশ আর উর্মিলা খুব খুশিমনে তাঁকে বরণ করে নিয়ে এল ছাদনাতলায়।শেষ মুহূর্তেও পালানোর চেষ্টা করেছিল কনের সাজে সজ্জিত অস্মিতা,কিন্তু দরজার বাইরে কড়া পাহারা বসানো ছিল,তাই আর সাহস পায়নি সে।
অস্মিতাকে নিয়ে আসা হল ছাদনাতলায়।অরবিন্দবাবু অস্মিতার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিলেন,ঠিক যেমন পছন্দের খাবারের দিকে লালায়িত দৃষ্টিতে তাকায় সকলে।আর মাত্র কিছুটা ঘন্টা,তারপর পাকাপাকিভাবে অস্মিতা হয়ে উঠবে অরবিন্দবাবুর খাদ্যবস্তু।গলা বুজে আসছিল স্কুলপড়ুয়া অস্মিতার।
— ‘কি অত ভাবছ শ্যালিকা,স্যারের গলায় মালাটা পরিয়ে দাও!’ দীনেশ ঠাট্টার সুরে বলল।
অস্মিতা রোবটের মতো মালাটা নিজের গলা থেকে খুলে পরিয়ে দিতে যাচ্ছিল অরবিন্দবাবুর গলায়,হঠাৎ একটা চেনা গলা শুনে সম্বিৎ ফিরল অস্মিতার।অস্মিতা ফিরে দেখে ত্রিয়া এসেছে,সাথে এসেছে ওর মা বাবাও,সেই সাথে ওদের স্কুলের প্রতীক স্যার,এই মানুষটিকে অস্মিতার মনে হয় একেবারে যেন বাবার মতো,আর সেই সাথে পুলিশও এসেছে।ত্রিয়া বলল, ‘অনেক হয়েছে,তুই কাল থেকে যথেষ্ট সয়েছিস,আর না!উঠে আয় মন্ডপ থেকে,আয় বলছি!’
অস্মিতার হঠাৎ মনে হল স্বপ্ন দেখছে না তো ও!কিন্তু প্রতীক স্যারের কথায় সেই ভুল ভাঙল ওর,শুনল তিনি বলছেন, ‘আয় মা,উঠে আয়,তোকে জোর করে বিয়েটা দেওয়া হচ্ছে,আমরা সবাই বুঝতে পেরেছি সেটা।’
পুলিশ ইনস্পেকটর বললেন, ‘একদমই তাই,তোমার ভয়ের কোনো কারণ নেই,উঠে এস!’
অস্মিতা এক ছুটে চলে এল মন্ডপ থেকে,তারপর ত্রিয়াকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল ও।ত্রিয়া ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,’তুই ফোন করে কাল রাতে জানানোর পরও আমরা না এসে পারি বল্?’
— ‘হ্যাঁ রে অস্মি,’ ত্রিয়ার মা বললেন,’ত্রিয়ার বাবা আজ সকাল থেকেই সবটা নজরে রাখছিল,তারপর প্রতীকবাবুকেও জানাই আমরা সবটা।আমরা ঠিক করেই নিয়েছিলাম,বিয়ের সময়েই আসব আমরা পুলিশ নিয়ে,কারণ আগে এলে হয়ত তোর দিদি-জামাইবাবু পুরো ঘটনাটা অস্বীকার করত,আর তুইও বিপদে পড়তিস।’
উর্মিলা রাগতস্বরে বলল,’বিয়েটা ভেঙে দিলেন যে,ওই অপয়া মেয়েটাকে কে আর রাখবে বাড়িতে?আমি কিন্তু রাখব না ওকে!’
— ‘একদমই তাই!’ দীনেশ বলতে লাগল,’ওর জন্য আর একটা গাঁটের কড়িও খরচ করতে রাজি নই আমি!’
অন্যদিকে পরিস্থিতি কঠিন বুঝে অরবিন্দবাবু কেটে পড়লেন।
— ‘হ্যাঁ হ্যাঁ জানি জানি,সে আর বলতে!তোমাদের মতো চামার খুব কম দেখেছি আমি জীবনে’,প্রতীকবাবু বলতে লাগলেন, ‘অস্মি মা আজ আমার সাথে যাবে আমার বাড়িতে,আমার মেয়ে হয়ে থাকবে ও,ওর যাবতীয় দায়িত্ব আমার।’
প্রতীকবাবুর সাথে দিদি-জামাইবাবুর বাড়ি ছাড়ল অস্মিতা,উঠল প্রতীকবাবুর বাড়িতে গিয়ে।প্রতীকবাবুর বাড়িতে তিনটি প্রাণী থাকেন,প্রতীকবাবু,ওঁর স্ত্রী সুমিত্রা আর ওঁদের কলেজপড়ুয়া ছেলে হেমন্ত।সুমিত্রা সবটাই জানতেন,অস্মিতা আসতেই ওকে নিয়ে গেলেন নিজের ঘরে।তারপর বললেন,’এসব সাজগোজ খুলে ফেল্ তো মা!তোর মাস্টারমশাই তোর জন্য অনেকগুলো জামা এনেছেন নতুন,ওই দেখ বিছানায় রাখা আছে,যেকোনো একটা পরে নে পছন্দমতো।’
অস্মিতা একটা জামা পরে চলে এল ডাইনিং-এ।সেখানে টেবিলে একটা প্লেটে লুচি,আলুর দম আর একটা বাটিতে পায়েস নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন সুমিত্রা।
এই বাড়িতে আগেও অনেকবার এসেছে অস্মিতা।প্রতীকবাবুর মতো সুমিত্রাও বড্ড ভালোবাসেন অস্মিতাকে,সে যখনই এ বাড়িতে আসে কখনও লুচি,কখনও ফ্রাইড রাইস,কখনও বিরিয়ানি আবার কখনও বা ঝালমুড়ি খাওয়ান তিনি অস্মিতাকে।অস্মিতা খেয়ে বলে,’আন্টি,তোমার হাতে যাদু আছে গো,কি সুন্দর বানিয়েছ।’
সুমিত্রা অস্মিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,’আর নিবি মা?’
সুমিত্রা অস্মিতার অনুপস্থিতিতে বলেন,’আহা বেচারি মা বাবা দুজনকেই হারিয়েছে এত কম বয়সে!’
আজও অস্মিতা খেতে বসেছিল টেবিলে,আর সুমিত্রা তাকে আজ নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছিলেন।হেমন্ত বলল,’অস্মি,এটা কিন্তু তোমার নিজের বাড়ি কেমন,কোনো সংকোচ করবে না,আর পড়া বুঝতে অসুবিধা হলে সবসময় বাবাকে জিজ্ঞেস না করে আমার কাছেও আসতে পারো,আমি খুব একটা খারাপ বোঝাই না!’
সুমিত্রা হেসে উঠলেন।অস্মিতা লাজুক হেসে বলল,’হ্যাঁ হেমন্তদা,নিশ্চয়ই যাব!’
(ক্রমশ)
(চতুর্থ পর্ব আসবে আগামীকাল এই পেজে)