#মনের_মানুষ
#দ্বিতীয়_পর্ব
#সুচন্দ্রা_চক্রবর্তী

অস্মিতা যা ভেবেছিল ঠিক তাই।দরজাটা খুলে ঘরে ঢুকল উর্মিলা,তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে এল অস্মিতার দিকে।তারপর অস্মিতার কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,’বোকা মেয়ে একটা!সোনার আংটি আবার ব্যাঁকা হয় নাকি?যার এত সম্পত্তি,তার সাথে তোর বিয়ে হচ্ছে কাল,এ কি কম আনন্দের কথা রে?তোর জামাইবাবুটাও যদি এরকম পয়সাওয়ালা হত….যাক ওসব কথা আর এখন ভেবে কি লাভ!ভালো করে ঘুমো,কাল তো আবার ভোর ভোর উঠে পড়তে হবে!’
অস্মিতার বুকটা দুরুদুরু করছিল ভীষণ,ভাবছিল যদি কোনোভাবে দিদিভাই বুঝে যায় যে ও জেগে আছে?
কিন্তু উর্মিলা কিছুই বুঝতে পারেনি।ঘর থেকে যখন ও বেরোতে যাবে তখনই হঠাৎ ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠল।ভীষণ ভয় পেয়ে গেল অস্মিতা,ত্রিয়া কল ব্যাক করল না তো?তখন তো ত্রিয়াকে সবটা খুলে বলাও হয়নি তার!ইস কেন যে ত্রিয়াকে কল করতে গেল ও!এবার যদি দিদিভাই সবটা বুঝে যায় তাহলে আর রক্ষে নেই!
উর্মিলা বিরক্তমুখে বলল, ‘ধুর!রাতবিরেতে আবার কে ফোন করল?’ বলেই ফোনের রিসিভারটা তুলে কানে দিল ও।অস্মিতার মনে হচ্ছিল হার্টটা খুলে বুঝি হাতে চলে আসবে।
উর্মিলা ফোনটা রিসিভ করে বারকয়েক হ্যালো বলল,কিন্তু ওপার থেকে কোনো শব্দ এল না।বিরক্ত হয়ে রিসিভারটা নামিয়ে রাখল ও,তারপর বলল, ‘কে না কে রাতবিরেতে রংনাম্বার ডায়াল করেছে,দিয়ে মুখে কোনো কথা নেই!যত্তসব!’
উর্মিলা চলে গেল,আর যাওয়ার সময় দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করল না আর।
অস্মিতা চোখ বন্ধ করে ছিল,কিন্তু সবটাই বুঝতে পারল ও।ফোনের ওপার থেকে কেউ কথা বলেনি শুনে যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল ওর,আর সেই সাথে একটা আশার আলোও খুঁজে পেল ও,কারণ উর্মিলা দরজাটা শুধু ভেজিয়েই চলে গেছে।অস্মিতা মনে মনে ঠিক করল,ভোরের আলো ফুটলেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে ও,তারপর ত্রিয়াদের বাড়িতে গিয়ে উঠবে।একবার ত্রিয়ার বাড়ি চলে গেলে আর কিচ্ছু করতে পারবে না দিদি-জামাইবাবু,কারণ ত্রিয়ার মা-বাবা অস্মিতাকে সন্তানের মতোই স্নেহ করেন।
যেমন ভাবা তেমন কাজ।ভোরের আলো ফুটতেই স্কুলব্যাগে কিছু জামাকাপড় আর বইপত্র ভরে নিয়ে সবার অলক্ষ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় চলে এল ও,দেখল কেউ কোত্থাও নেই।বাড়ির মেন গেটটা খোলা ছিল,তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল ও।এখান থেকে ত্রিয়ার বাড়ি যেতে হবে অটোতে,তাই তাড়াতাড়ি অটোস্ট্যান্ডের দিকে হেঁটে যেতে লাগল অস্মিতা।কিন্তু রাস্তায় হঠাৎ মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল জামাইবাবুর সাথে।

— ‘আরিব্বাস,শ্যালিকারাণী যে!’ অবাকচোখে তাকিয়ে দীনেশ বলল,’কি ব্যাপার অস্মিতারাণী?বড়োলোক বরের বাড়ি যাবে বলে আর তর সইছে না বুঝি?জামাইবাবুর মধ্যবিত্ত বাড়ি আর পোষালো না বুঝি?’ দীনেশ নিচু গলায় বলল, ‘নাকি পালিয়ে টালিয়ে যাচ্ছ?দেখেছ,ভাগ্যিস আজ সকাল সকাল বেরিয়েছিলাম দধিমঙ্গলার জিনিসপত্র কিনব বলে,নইলে তো পাখি ফুরুৎ হয়ে যেত!’ বলেই ক্রূর হাসি হাসল দীনেশ।
অস্মিতা হঠাৎ উল্টোমুখে ছুটতে শুরু করল।এখন যেভাবেই হোক জামাইবাবুর হাত থেকে বাঁচতে হবে তাকে।দীনেশও ছুটতে লাগল ওর পেছনে,চেঁচিয়ে বলল, ‘দুদিনের মেয়ে,দীনেশ স্যান্যালের সাথে ছুটে পারবি?’
ছুটতে ছুটতে অস্মিতা এসে পড়ল একটা ফাঁকা মাঠে,তারপর মাঠ ছাড়িয়ে ছুটতে ছুটতে এসে পড়ল বড়ো রাস্তায়।অস্মিতার কোনো হুঁশ নেই,যেভাবেই হোক জামাইবাবুর হাত থেকে বাঁচতে হবে তাকে।ছুটতে ছুটতে অস্মিতা এসে পড়ল একটা বড়ো গাড়ির সামনে।ভাগ্যিস গাড়ির ড্রাইভার ব্রেক কষল সঠিক সময়ে,নইলে হয়ত অস্মিতা চাপাই পড়ে যেত।অস্মিতা মাটিতে পড়ে গিয়েছিল,পড়ে গিয়ে হাত ছড়ে রক্তও বেরোচ্ছিল কিছুটা।হঠাৎই এক চেনা গলা শোনা গেল,’কি গো মামণি,এত সকালে কোথায় পড়তে যাচ্ছিলে?বিয়ের দিন আবার কিসের পড়া গো অস্মিতা রাণী?’
অস্মিতা আশঙ্কিত মুখে তাকিয়ে দেখে,অরবিন্দবাবু।তিনিই ড্রাইভ করছিলেন গাড়িটা।অস্মিতা তাঁকে দেখে এতটাই হকচকিয়ে গেল যে বাক্যহারা হয়ে গেল,আর অরবিন্দবাবু অস্মিতাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলেন গাড়িতে,তারপর চললেন দীনেশের বাড়ির দিকে।ঘটনাটা এতটাই আকস্মিকভাবে ঘটে গেল যে হতভম্ব অস্মিতা প্রতিবাদ করতেও ভুলে গেল।
দীনেশের বাড়িতে তখন হুলুস্থুল কান্ড।দীনেশ রাগারাগি করছে প্রচন্ড,আর উর্মিলাকে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলছে,’কি আক্কেল দেখো মেয়ের!বোনকে এতই বিশ্বাস যে দরজাটা শুধু ভেজিয়েই চলে গেছে!কোন্ দিন দেখব তোমার জন্য আমায় খুন হয়ে যেতে হবে!’
উর্মিলাও রাগী গলায় বলতে থাকে,’অনামুখো মেয়ের পেটে পেটে এত,তা কেন জানত?এমন শান্ত হয়ে ছিল কাল যে ভেবেছিলাম বিয়েতে মত আছে আবাগীর!’
— ‘দেখলে তো,এইজন্যই বলে মেয়েমানুষের বুদ্ধি হাঁটুর নীচে!তোমার অর্ধেক বয়সী মেয়েটা নাকের ডগা দিয়ে পালাল,ধরতেই পারলে না!’

সেই সময়েই হঠাৎ প্রবেশ অরবিন্দবাবুর,তাঁর বজ্রমুষ্ঠিতে বন্দি কিশোরী অস্মিতার নরম হাত।তিনি ঢুকেই বলতে লাগলেন, ‘নিজেদের মধ্যে ঝগড়া না করে আমার বৌ টাকে আগলে রাখলে তো কাজে দিত নাকি!অতগুলো টাকা দিয়েছি কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোনোর জন্য!’
বলেই অস্মিতাকে ঠেলে দিলেন তিনি,পিঠে ব্যাগসুদ্ধু অস্মিতা ছিটকে পড়ল উঠোনে।উর্মিলা গিয়ে চুলের মুঠি ধরল অস্মিতার,রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘জানোয়ার মেয়ে,যে জামাইবাবু খাওয়ায়-পড়ায়,তার নাক কাটার ব্যবস্থা করতে গিয়েছিলি?’
— ‘দীনেশ দা ও তো আমার মত নেয়নি একবারও দিদি!’ নীচের দিকে তাকিয়ে ভীত কন্ঠে বলল অস্মিতা।
— ‘চোপ!অন্যায় করে আবার মুখে মুখে চোপা!আজ তোরই একদিন কি আমারই!’ উর্মিলা অস্মিতার চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল ঘরে,তারপর বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে তালা ঝুলিয়ে দিল ঘরে,’মতি ফিরেছে ভেবে একটু ছেড়েছিলাম কি ছাড়িনি,অমনি তিনি পালিয়ে গেছেন!ভেবেছেন বিয়ে করবেন না!শোন্ অস্মিতা,তোর বিয়ে আজকেই হবে,আর অরবিন্দবাবুর সাথেই হবে,কেউ আটকাতে পারবে না!’
উর্মিলা চলে গেল।অস্মিতা কাঁদতে কাঁদতে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল,’দিদিভাই,তোর পায়ে পড়ি,প্লিজ খুলে দে দরজাটা!’
কিন্তু অস্মিতার কথায় কেউ কর্ণপাত করল না।
দীনেশ অরবিন্দবাবুকে বলল, ‘আপনি রাগ করবেন না স্যার,আসুন না বাড়ির ভেতরে বসবেন।কি গো উর্মি,মানুষটাকে একটু জল মিষ্টি দেবে না নাকি গো?’
— ‘আরে না না না দীনেশ,আমি জল মিষ্টি খেতে আসিনি,আর বসতেও আসিনি,শুধু আমার বৌটাকে কিছুক্ষণের জন্য তোমাদের কাছে গচ্ছা রেখে গেলাম,দেখো যেন আবার হাত ফসকে না পালায়!আমি এখন চলে যাচ্ছি,সন্ধ্যেবেলা আসব টোপর মাথায়,তখনই বিয়ে করে মিষ্টি খাব,আর যদি বিয়ে না করতে পারি তাহলে তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর কোমরে দড়ি পরিয়ে সব টাকা উসুল করে নেব,আর তোমারও চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে দীনেশ,মনে রেখো!’

(তৃতীয় পর্ব আসবে আগামীকাল এই পেজে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here