আকাশে অনেক তারা – ২

————
”বাহ্, বাহাদুর শাহ্ পার্কে বসে রাজা বাহাদুরের মতো সিগারেটে ফুঁকছিস! এই দৃশ্য দেখিয়ে আমাকে ধন্য করার জন্যই বুঝি এই সকাল সকাল জরুরি তলব?”

মেয়েটার চোখে মুখে তীব্র বিরক্তি। কি শান্তির ঘুমটা ত্রিশ সেকেন্ডের একটা রিংটোন শেষ করে দিল। সে ভেবেছিল কি-না কি হয়েছে! কল দিয়ে নেতিয়ে পড়া বলেছিল,

‘টুকি ভার্সিটিতে চলে আয়তো! এক্ষুণি! এদিক সেদিক খুঁজিস না। আমি বাহাদুর শাহ পার্কে আছি। দ্রুত আসবি টুকি!’

সে ভয় পেয়েছিল খুব! এমন সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথা সচরাচর বলে না মুহিব। তড়িঘড়ি মুখ ধুয়েমুছে ড্রেস পাল্টে ছুটেছিল। কিন্তু, কে জানতো এই হারামি বিনা কারনে ডেকেছে! ভার্সিটিতে আজ দুটো ক্লাস আছে। প্রথমটা বারোটায়। ভেবেছিল দশটায় ঘুম থেকে উঠে ধীরে সুস্থে আসবে। বাস না পেলে রিকশায় আরামসে আসবে। নিজের ভাবনার মাঝেই সে মুহিবের কথা শুনতে পেল,

”এমনিই ডাকিনি টুকি!”

”তাহলে কেন ডেকেছিস?”

”দরকার তাই ডেকেছি!”

তাকাল মেয়েটা সন্দিহান চাহনিতে ছেলেটার দিকে। সে তৎক্ষণাৎ জবাব না দিয়ে মেয়েটার দিকে এক পলক তাকিয়ে হাতে থাকা সিগারেটের জ্বলন্ত অংশটা পিষে নিভাল বেঞ্চের গদিতে নিঃশব্দে। আগুনহীন অর্ধপুড়ন্ত সিগারেটটা হাতে ধরে আছে সে। মেয়েটা ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ চাহনিতে দেখছে তাকে। অবশেষে নিরবতা সহ্য না হওয়ায় সে জিজ্ঞেস করলো,

”কি দরকার ছিল?”

মুহিব মেয়েটার মুখে চাহনি নিক্ষেপ করে মুচকি হেসে বলল,

”ছিল না, এখনো শেষ হয়নি। মানে রয়েছে।”

বিরক্ত হচ্ছে মেয়েটা। মুহিব সেটা উপলব্ধি করে বিস্তৃত হেসে হেলেদুলে দাঁড়িয়ে ডাকল,

”লেখা!”

”কিহ?”

”আমি নাস্তা করিনি। একা খেতে ইচ্ছে করছিল না। তোর সঙ্গে একসঙ্গে নাস্তা করবো সেজন্য ডেকেছি!”

একুটু বলেই থেমে কি চিন্তা করে মুহিব ফের বলে উঠল,

”এই টুকি টাকা আছে তো তোর কাছে? আমার কাছে কিন্তু কোনো টাকা নেই আজ। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় নিয়ে আসিনি। পকেটে যা খুচরা ছিল সেটা দিয়ে ভাড়া দিয়েছি আসার সময়।”

মেয়েটার মুখ হা হয়ে রইল বিস্ময়ে। দিনদিন কি ছেলেটা মানসিকভাবে সিক হচ্ছে। পাবনা মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করানো দরকার তাকে। মেয়েটার বিস্ময়েও কোনো বিকার নেই ছেলেটার। সে বেশ নির্ববকার চাহনিতে কিছুদূরে দাঁড়িয়ে থাকা চায়ের হকারকে দেখছে। কয়েক মূহুর্ত মুহিবের দিকে সুক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে থেকে আকস্মিক জিজ্ঞেস করে বসল,

”বাসায় কিছু হয়েছে?”

মুহিব চাহনি লেখার দিকে ঘুরাল। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জবাব দিল,

”কি হবে? সবসময়ের মতই রয়েছে।”

”সত্যিটা বল নাহয় আমি যাচ্ছি!”

লেখা সত্যি সত্যিই উল্টোদিকে ঘুরে যাচ্ছিল মুহিব দ্রুত হাত ধরে আঁটকাল তাকে। লেখার চাহনি শক্ত।
সে মোচড়ামুচড়ি করে হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইছে। মুহিব অসহায় চোখে তাকাল। লেখার কোনো বিকার নেই। ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে মুহিব নিচুশব্দে বলল,

”কাল আবার দু’জনে ঝগড়া করেছে!”

চট করে লেখা মুহিবের মুখে তাকায়। সে দৃষ্টি নামিয়ে রেখেছে। কেমন উদাসীন চাহনি। লেখার খারাপ লাগে
তবে, সে মনে মনে পুরোটা জানতে কৌতূহলী হয়।

”কি নিয়ে?”

”সেই পুরোনো জিনিস। বলতে ইচ্ছে করছে না লেখা!”

দু’জনেই আর কোনো কথা বলে না। পাশ থেকে হকারের চিল্লানি কানে ভেসে আসছে। মুহিব দুজনের মধ্যকার নিরবতা ছিন্ন করে,

”চল!”

”একটু অপেক্ষা কর!”

”কেন?”

”দিবা আসছে!”

মুহিব চোখমুখ কুঁচকায়। বিরক্ত স্বরে বলে,

”ঐ ঢংগিকে কেন ডেকেছিস আবার?”

লেখা চাহনি তীর্যক করে। জবাব দেয়,

”যেভাবে কল দিয়েছিলি, ভয় পেয়ে গেছিলাম। মনে করেছি গুরুতর কিছু হয়েছে! তাই, জরুরি অবস্থায় সাহায্যের জন্যই ডেকেছি! তুই এখন ঢং করবি না বলে দিলাম!”

”ডেকেই যখন ফেলেছিস তখন কি বলব! কোথায় তিনি? কতক্ষণ অপেক্ষা করব?”

মুহিব কথা শেষ করার আগেই দিবা এসে উপস্থিত হয়েছে। সে হাঁপাচ্ছে। মুহিব ব্যঙ্গ করে একগাল হেসে বলল,

”মহারানী এসে গেছে। এবার যেতে পারি কি?”

লেখা সজোরে একটা চড় বসাল মুহিবের বাহুতে।

”বদ ছেলে মজা করিস! দেখিস না দিবা হাঁপাচ্ছে। তোর জন্যই সে এসেছে। নয়তো বারোটায় ক্লাস এখন এত সকালে সে আসবে। ভুতে পেয়েছে নাকি তাঁকে।”

”আমি খিদায় মরে যাই তারপর আজিমপুর গোরস্থানে সসম্মানে কবর দিয়ে আছিস!”

কথাটা দিবা তাকাল মুহিবের দিকে। লেখা জিজ্ঞেস করল,

”কাল রাতে খাসনি!”

”না!” একশব্দে জবাব দিল মুহিব।

”কেন? নিষেধ করেছি না নিজের প্রতি অবহেলা করতে!”

সামনে এগিয়ে বাসস্ট্যন্ডের দিকে যেতে যেতে মুহিব বলল,

”গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম। ব্রেকাপ করে করে বেরিয়ে গেছি। বাড়ি গিয়ে আরেক ঝামেলা। সবমিলিয়ে, কিছু খাওয়া হয়নি।”

দিবা, লেখা দু’জনেই হতবাক। এতভাব ভালোবাসা শেষ। ব্রেকাপ করে ফেলেছে। লেখা কথাটা মনে পুষে না রেখে জিজ্ঞেস করে ফেলল। মুহিব পেছনে না ঘুরেই হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিল,

”বেশি ছিনাল স্বভাবী! তাই, ব্রেকাপ করে ফেলেছি।”

দিবা বিরবির করল,

‘নিজে কি?’

”তুমি কি কিছু বললে মেয়ে?”

দিবা তড়িঘড়ি উত্তর দিল,

”না, না!”

বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে মুহিবকে ধানমন্ডির বাসে উঠতে দেখে ভ্রু কুঁচকাল লেখা।

”ধানমন্ডির বাসে উঠছিস কেন?”

”নতুন একটা রেস্টুরেন্ট হয়েছে। ফেসবুকে রিভিউ দেখলাম। খাবার বেশ ভালো। ফিফটি পার্শেন্ট ডিসকাউন্ট চলছে। দেরি করিস না। উঠ। উঠে পড়।”

”মাথা খারাপ তোর? নাস্তা খেতে সদরঘাট থেকে ধানমন্ডি যাবো!”

দোনোমনা করেও শেষে বাসে উঠতে হল তাদেরকে। পেছনের দিকে সিট পাওয়া গেল দু’টো। দু সিটে দিবা আর লেখা বসল। দাঁড়িয়ে রইল মুহিব। দিবা মুখটিপে হেসে লেখার কানে কানে ফিসফিস করে বলল,

‘বেশ হয়েছে। সামান্য নাস্তা খেতে এতদূর যেতে হবে! দাঁড়িয়ে যাক এবার!’

মাঝরাস্তায় সিট পেল মুহিব। ওদের এক সিট সামনে। নতুন যারা উঠেছে সকলেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। দিবা খেয়াল করল তার বাহুতে কিসের স্পর্শ লাগছে। সে প্রথমে আমলে না নিলেও ধীরে ধীরে বুঝতে পারল কিসের স্পর্শ। সে চেপে গেল লেখার দিকে। ধীরে ধীরে স্পর্শটা যেন বাড়ছে। সমস্ত পিঠে ছড়াচ্ছে। সে চোখমুখ বন্ধ করে দোয়া করছে পথটা যেন দ্রুত শেষ হয়। আকস্মিক সে কারো হুংকারের শব্দে হকচকিয়ে উঠল। বাসের মধ্যেও সকল যাত্রীর অভিন্ন অবস্থা। মুহিব রোগা পাতলা গোছের একজনকে কলারে ধরে ইচ্ছে মতো ঘুষি মারছে। দিবা ভয়ার্ত চাহনিতে চারপাশ দেখছে। লেখা হাসছে। লেখার মুখে হাসি দেখে দিবা বিস্মিত হয়। আশপাশের লোকজন মুহিবকে থামাতে এল। দুজনকে আলাদা করার পূর্বে মুহিব লোকটাকে আরো ক ঘা বসিয়েছে কান বরাবর। হাতটাও মুচড়ে ধরেছে।

”জানোয়ারের বাচ্চা, মেয়ে দেখলেই হাত নিশপিশ করে খালি! ছুঁতে মন চায়! হাতটাই ভেঙ্গে দেব তোর!”

সকলে মারার কারন জানতে চাইলে মুহিব স্পষ্ট জানাল লোকটা দিবাকে বাজে ভাবে স্পর্শ করছিল তার পাশে দাঁড়িয়ে। দিবাকে জিজ্ঞেস করা হলে সে থ হয়ে থাকে। কি জবাব দেবে ভেবে পায়না। লেখার ধাক্কায় সম্বিত ফিরে। সবটা শুনে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলে একসিট আগে বসে মুহিব কি করে এই কান্ড দেখল ভিড়ের মাঝে। তখন খোলাসা হল লেখা টেক্সট করেছে তাকে। বাস থেকে নেমে কুঁকড়ে রইল দিবা। তবে, যখনই সে মুহিবের দিকে তাকাচ্ছে তার চাহনিতে কৃতজ্ঞতার প্রতিচ্ছবি ফুঁটে উঠছে। আসলেই লেখার ভাষ্যমতে, ‘মুহিব নিজেকে দেখায় খারাপ কিন্তু মন থেকে সে ভীষণ ভালো।’ মেনে নিল নিজে আজ দিবা। কোনো দ্বিধা নেই আর। মুচকি হাসি ফুঁটে উঠল তার ঠোঁটের কোণে।

__________________________________

সাড়ে ছয় কাঠা জমির উপর তৈরি দোতলা প্রধানীয়া ভিলা। অবশ্য মূল দালানটা পাঁচ কাঠা জায়গার উপর দাঁড়িয়ে। বাকি দেড় কাঠায় বাগান করেছেন মোতালেব সাহেব। এসবে আবার ওনার ভীষণ শখ। বাড়িতে মানুষ গিজগিজ করছে মেজ মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে। কাল মেহেন্দি অনুষ্ঠান ছিল। অনেকে এসেছে অনেকে আসেনি। আজ আসবে। সকাল থেকেই ভীষণ ব্যস্ত নাহার। মন খারাপটা আড়াল করে রান্নাঘরে ছোটাছুটি করছেন দু’জন কাজের মানুষ, আঁখি আর তার মা’কে নিয়ে। ছোট মেয়েও একটু আধটু হাত লাগাচ্ছে। বড় মেয়ে মেজ বোনকে নিয়ে আছে। কাছের কাউকে তো তাকে সময় দিতেই হবে। বাহিরের কাজগুলো জু্বায়ের আর বড় মেয়ের জামাই দেখছে। সুযোগ বুঝে বেশি প্রয়োজনে মোতালেব সাহেব-ও হাত বাটাচ্ছেন। তাছাড়া সবকিছু ঠিকঠাক করে দেওয়ার কাজ তো তিনিই করেছেন। দেখাশোনার কাজ যা ছেলে আর মেয়েজামাই করছে।

নাস্তা খেতে বসে অনেকে হতভম্ব। নাস্তা দেওয়া হচ্ছে না ওনাদেরকে। বেশ অপমানিত বোধ করে কয়েকজন কিছু না বলে বাড়ি থেকে নিশ্চুপে বেরিয়ে গেছেন। কেউ কেউ ঢিট হয়ে পড়ে থেকে মোতালেব সাহেবের কাছে এই হটকারিতার জবাব চেয়েছেন। তিনি কোনো ভনিতা না করে সরাসরি জবাব দিয়েছেন,

”কেউ নামাজ না পড়লে প্রধানীয়া ভিলায় তাকে খাবার দেওয়া হয়না! যে বেলা নামাজ পড়বেনা সে বেলা সে অভুক্ত থাকবে।”

সকলে হতবাক। কিসব বলছে মোতালেব সাহেব। বিয়ে বাড়িতে দাওয়াত করে এনে খেতে দিচ্ছে না। কারন হিসেবে বলছে নামাজ পড়েনি তাই। এমন আজব কারবার জীবনে কোনোদিন কেউ দেখেনি।
সকলের রূঢ় আচরন, ভাষায়-ও মোতালেব সাহেবের তেমন কোনো ভাবান্তর নেই। তিনি ভাবলেশশূণ্য। যে যা বলার বলে যাক। যে চলে যাবার চলে যাক। বেশি খাবার বেঁচে গেলে তিনি পথশিশুদের দিয়ে আসবেন নিজে গিয়ে।

কাল রাতে অনুষ্ঠান শেষ হতে তিনি যখন ঘরে গেছেন তার কিছুক্ষণ পরে ছোট মেয়ে ওখানে গিয়ে হাজির হয়। উনি হাসেন মেয়েকে দেখে। আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করেন,

”কি চাই ছোট আম্মা?”

ছোট মেয়েটা বেশ ভঙ্গিমা করতে জানে। তবে, কাল কোনো ভঙ্গিমা করেনি সে। বলেছিল,

”যারা এসেছে তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি মানুষ এশার নামাজ পড়েনি। কিন্তু, রাতের খাবার ঠিকই পেয়েছে।
কিন্তু, তুমি নিয়ম করেছিলে, প্রধানীয়া ভিলায় যতদিন মোতালেব প্রধানীয়া বেঁচে থাকবে ততদিন বিনা কারনে এক ওয়াক্ত নামাজ বাদ দিয়ে কেউ খাবার পাবে না। সে যেই হোক না কেন! তুমি দুলাভাইকেও একদিন খেতে দাওনি। বেচারা কাযা নামায পড়ে শেষে খাবার পেয়েছিল। তুমি, তোমার নিয়ম ভঙ্গ করছ বাবা। আর আমার কেমন জানি মনে হচ্ছে তুমি বেঁচে নেই আর। সেকারণে তোমার তৈরি নিয়মের অনিয়ম হচ্ছে।”

মেয়েটা কেঁদে ফেলেছিল শেষ কথা বলতে বলতে। ছোট মেয়েটার সবথেকে বেশি মায়া বাবার প্রতিই।
তার বাবা একদিকে আর পুরো দুনিয়া একদিকে।
মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়েছেন তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে। মেয়েকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে বিষয়টা ভেবেছেন।
শেষে আজ সকালে দেখেছেন কে কে নামাজ পড়েছে আর কে পড়েনি। সে হিসাবে একটা লিস্ট করেছেন। স্ত্রীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে নির্দেশ দিয়েছেন কাকে খাবার দেবে আর কাকে দেবেনা।

কয়েকজন এই তীব্র অপমানে লাল হয়ে রাগারাগি করে ব্যগপত্র নিয়ে বেরিয়ে গেছেন প্রধানীয়া ভিলা ছেড়ে। নাহার চিন্তাগ্রস্ত হয়ে স্বামীকে দেখছেন। কি করছেন তিনি এসব? আবারও সকলের সঙ্গে একটা ঝামেলা বাঁধিয়ে দিলেন। মোতালেব সাহেব বাঁধা দেননি কাউকেই বরং মিটিমিটি হেসেছেন তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে। এই মানুষগুলো থেকেই কি করবে? খাবে দাবে চলে যাবে। শেষ। কোনো দোয়াই দেবে না ওনার মেয়েকে। যারা সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেদের জন্যই রহমত প্রার্থনা করে না অন্যদের জন্য কি করবে! তাদের প্রস্থানই উত্তম।

_________________________________

জুবায়েরের কানে পৌঁছে গেছে বাপের কর্মকান্ডের খবর। শুনে সে প্রতিক্রিয়াসরূপ মিটিমিটি হেসেছে। শেষে বোন-জামাইয়ের সঙ্গে শরীর কাঁপিয়ে হেসেছে তাল মিলিয়ে। তার বাবা সত্যিই এক্সেপশন! একটু বিরতি পেয়েছে সে কাজে। সকাল থেকে বাড়ির বাহিরেই ছিল। খাবার সময় পায়নি। নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে। মা’কে বলে গেছে খাবার ঘরে পাঠিয়ে দিতে। এটাও বলে গেছে, চিন্তা নেই সে সকালে নামাজ আদায় করেছে মসজিদে গিয়ে। মিটিমিটি হাসি মুখে ঝুলানো। ফ্রেশ হতে তোয়ালে হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল সে। মা নিশ্চয়ই এরমধ্যে খাবার পাঠিয়ে দেবেন।
________________________________

জুবায়েরের ঘরে খাবার দেওয়ার দায়িত্ব পড়েছে আঁখির উপর। সে একটু উশখুশ করছিল। নাহারের ধমকে বাধ্য হয়ে খাবার প্লেট হাতে নিয়ে জুবায়েরের ঘরের দিকে এগিয়েছে সে। তার রুমে ঢুকে ভীষণ অবাক হল সে। একটা মেয়ে বিছানায় পা দুলিয়ে বসে আছে। মেয়েটাকে সে চেনে। চেনে বলতে আগে দু-তিন বার দেখেছিল। গত দু’বছর আর দেখেনি। তখন তো জুবায়েরের সঙ্গে বেশ ভাব ছিল। যদিও সেটা ভালো চোখে নিতেন না নাহার। আঁখিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেয়েটা উঠে দাঁড়ায়। বেশ ভাব নিয়ে বলে,

”দাঁড়িয়ে আছ কেন? খাবারটা রেখে রুম থেকে বেরিয়ে যাও!”

জুবায়েরের রুমে মেয়েটাকে দেখেছে থেকেই আঁখির মাঝে একটা খারাপ লাগা কাজ করছে। এখন সেটা আরোবেশি পরিসরে বর্ধণ হল। সে জিজ্ঞেস করল,

”ভাইয়া কোথায়?”

মেয়েটা বিরক্ত ভঙ্গিতে জবাব দিল,

”কাজের মেয়ের মনিবের খবর জেনে এত কি কাজ! খাবার দিতে এসেছ, দিয়ে বেরিয়ে যাও!”

আঁখির শরীরে মৃদু কম্পন সৃষ্টি হয়। সে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে খাবারটা রেখে।
_________________________________

জুবায়ের ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে নিজের ঘরের দৃশ্য দেখে থ। তার নিত্য দুঃস্বপ্নের কারন তার ঘরে তার বিছানায় পা দুলিয়ে বসে বসে তার ভাগের খাবার মনের আনন্দে খাচ্ছে। দ্রুতপায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে এগিয়ে এসে সে বাঁজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠল,

”তোকে নিষেধ করেছি না আমার সামনে আসবি না?
কোন সাহসে এসেছিস তুই?”

মেয়েটা নির্বিকার ভঙ্গিতে খেতে খেতে জবাব দেয়,

”খিদে পেয়েছিল। নামাজ পড়িনি। তোমার বাপ তো খাবার দেয়নি। দেখলাম তোমার ঘরে খাবার দিচ্ছে, খেতে এসেছি! তুমি তো ভালো করেই জানো আমার খিদে সহ্য হয় না একেবারে!”

তার শরীর নাড়ানোর ভঙ্গিমা বেশ রসণীয়। নিজের দৈহিক সৌন্দর্য জুবায়েরের সামনে উপস্থাপণের এক নিঁখুত চেষ্টা। জুবায়ের দাঁত কিড়মিড় করে অন্যদিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। কাল রাতে সে পইপই করে নিষেধ করে দিয়েছে মেয়েটাকে। দু’বছর আগেই সব শেষ।
তার ঘরে যেন না আসে সে। বেহায়া মেয়ে শোনেনি।
নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে এক ঝটকায় মেয়েটার হাত ধরে টেনে নিয়ে নিজের ঘরের বাহিরে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল সে। অগোছালো কদমে এগিয়ে এসে বিছানায় বসে দু’হাতে মুখ চেপে ধরল। এখনো সে কেন দুর্বল বোধ করে? কেন?

মিনিট দুয়েক বাদে নিজেকে সামলে নিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। খাবার প্লেটের দিকে নজর যেতেই দেখে আঁধ খাওয়া। সে প্লেটটা তুলে নিচে ছুঁড়ে ফেলল। বিছানার চাদরটাও একটানে তুলে ফেলল। এরমধ্যে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল। সে শ্লেষ গলায় বলল,

”কে?”

”আমি! দরজা খোল!”

মায়ের কণ্ঠ শুনে দ্রুত দরজার দিকে যায় সে। নিচে ফ্লোরে পড়ে থাকা খাবারের দিকে চেয়ে শুকনো ঢোক গিলে। মা’কে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রাখা যাবে না। এসব মায়ের থেকে লুকানোও যাবে না। সে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। উনি তীক্ষ্ণ নজরে ছেলের দিকে একবার তাকিয়ে রুমের ভেতরে নজর ফেলে। ফ্লোরে দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হতেই চোয়াল শক্ত হয়। ছেলেকে ঠেলে তিনি ভেতরে প্রবেশ করেন।

”দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে আয়!”

জুবায়ের মায়ের কথানুরূপ কাজ করে মায়ের সামনে মাথা নুইয়ে রেখে দাঁড়ায়। উনি প্রথমেই কোনো কথা না বলে খাবারটা প্লেটে তুলেন। বেশ অনেক্ক্ষণ অতিক্রম হয়। ছেলের দিকে তিনি তাকাননি। জুবায়েরের কিছু বলার অপেক্ষায় ছিলেন। সে কিছু বলছেনা দেখে তিনি বেরিয়ে যেতে উদ্যত হতেই জুবায়েরের অসহায় কণ্ঠ কর্ণকূহরে প্রতিধ্বনিত হয়।

”মা!”

উনি পিছু ঘুরেন। জিজ্ঞেস করেন,

”কি বলবি?”

জুবায়ের নিঃশ্বাস ফেলে।

”মা, রাগ উঠে গিয়েছিল তাই..”

”রাগ উঠে গিয়েছিল? কেন? একটা থার্ডক্লাস মেয়ের জন্য?”

মায়ের স্বরে বিদ্রুপ। জুবায়ের হাত দু’টো মুঠো করে রেখেছে। সে সাফাই সরূপ বলতে চাইল,

”মা আমি জানতাম না সুলতানা এ ঘরে আসবে। সে যে বিয়েতে আসবে সেটাও আমি জানতাম না!”

”না জানায় আফসোস হচ্ছে খুব বুঝি?”

”মা!”

”আঁখির আচরনে অস্বাভাবিকতা দেখেই বুঝেছি তোর ঘরে কিছু ঘটছে। নাহলে, তুই যে ভেতর থেকে নিজেকে এখনো বদলাসনি সেটা জানতেই পারতাম না।”

জুবায়ের অনেককিছু বলতে চাইল। মুখে যেন সিল করে দেওয়া হয়েছে। সে উচ্চারণ করতে পারল না।

খাবার প্লেটটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে তিনি ছেলেকে সতর্কবার্তা দিলেন,

”তোর আগের কিছুই তোর বাপকে বলিনি। আজ তুই সেই পুরোনো কারনকে কেন্দ্র খাবার ছুঁড়ে ফেলেছিস সেটাও বলব না। কেন বলব না জানিস? কারন, আজ আমার মেয়ের বিয়ে। কোনো দুর্ঘটনা, বিশৃঙ্খলা আমি চাইনা। তুই সুধরে যা নাহলে এরপরে আর কোনো সুযোগ আমি তোকে দেব না। তৈরি হয়ে নিচে আয়, খেয়ে দেয়ে কাজে লেগে পড়বি! কাজে কোনো গাফিলতি চাই না।”

জুবায়ের মায়ের প্রস্থানের দিকে অসহায় চাহনিত তাকিয়ে রইল। তার তো কোনো দোষ ছিল না এখানে আজ। সে স্বীকার করে, খাবার ছুঁড়ে ফেলে সে চরম অন্যায় করেছে। কত হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ খেতে পায়না। অনাহারে মরে।
_______________________________________

রেস্টুরেন্টে আছে মুহিব, লেখা আর দিবা। খাবার অর্ডার দিয়েছে। এখনো আসেনি। তৈরি হচ্ছে। লেখা একটু দূরে সরে ফোনে কথা বলছে। দিবা আর মুহিব বসে আছে। মুহিব ক্ষানিক বাদে বাদে দিবার দিকে দেখছে। আকস্মিক ফোন কেটে দিয়ে লেখা এসে জানাল,

”তিনদিন হয়তো ভার্সিটিতে আসতে পারব না রে!”

”কেন দোস্ত?”

দিবা জিজ্ঞেস করল। মুখটা ব্যথিত করে সে জবাব দিল,

”বিয়েতে যাব। আজ বিকেলেই রওয়ানা দিব।”

”এত সেন্টি হওয়ার কি আছে। না গেলেই হয়।”

মুহিবের কথার জবাবে লেখা হতাশ ভঙ্গিতে বলল,

”না গেলে আমার বাপ বলে দিয়েছে এক মাসের হাত খরচ দেবে না।”

মাঝ থেকে দিবা বলে উঠল,

”এজন্যই বলি দু’একটা টিউশন কর! নিজের হাত খরচ হয়।”

”আসছে আমার জ্ঞানদাতা। চুপ করো তুমি। কার বিয়ে রে টুকি?”

”বাবার কোন ভাইয়ের মেয়ের কে জানে!”

”সমস্যা কি! যা গিয়ে ঘুরে আয়। অনেকদিন কোনো অনুষ্ঠানে যাসনি।”

খাবার দিয়ে দেখে ইতোমধ্যে। মুহিব তিনজনের খাবার সুন্দরকরে পরিবেশেন করে দিল।

”খাওয়া শুরু কর টুকি!”

”খাব না। ভাল্লাগছে না।”

”কেন? খিদা লাগে নাই?”

”লাগছিল এখন নাই!”

দিবা খাবার মুখে পুরে দুজনের কথা শুনছে নিরব দর্শকরূপে। মুহিব বলল,

”কথা প্যাচাচ্ছিস তুই টুকি।”

টেবিলে হাত রেখে তার উপর মাথা ফেলে লেখা। মুহিবের দিকে তাকিয়ে বলে,

”তুই বলছিস অনুুষ্ঠানে যেতে। ওটা কোনো সাধারন অনুষ্ঠান বাড়ি না! মহা প্যারার কারখানা!”

”মানে?”

হাতের উপরেই মাথা রেখে নিরাশভাবে জবাব দেয়,

”সুলতানা আপু ফোন দিল। সে তো গেছে। সকালে নাকি যারা ফজরের নামাজ পড়েছিল তারাই শুধু খাবার পেয়েছে। বাকিরা পায়নি। অনেকে নাকি রাগারাগি করে বিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে।”

ইতোমধ্যে দিবার হাসির শব্দ শোনা গেলো। সে হাসতে হাসতে যেন লুটিয়ে পড়ছে। হাসি না থামিয়েই সে বলে উঠল,

”দোস্ত তাহলে তো তুই একবেলাও খাবার পাবি না।”

মুহিব চোখ পাকালো দিবাকে। দিবা চুপসে গেল। সে নিজে বলল,

”খুব ইন্টারেস্টিং ফ্যমিলি তো টুকি। আঙ্কেলকে বলে দেখিস তো আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যাবে কিনা!”

লেখা বেশ বুঝল তাকে নিয়ে মজা করা হচ্ছে। মাথা গরম হয়ে আছে৷ সে সামনে থাকা জুসের গ্লাসটা হাতে উঠিয়ে দিকবেদিক চিন্তা না করে ঢেলে দিল মুহিবের মাথায়। রেস্টুরেন্টের বাকি সকলে হতভম্ব। শুধুমাত্র নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে দিবা। মুহিবেরও তেমন কোনো বিকার নেই। সকলকে অবাক করে দিয়ে সে-ও দিবার সামনে থাকা জুসটা হাতে নিয়ে লেখার মাথায় ঢেলে দিল। ইতোমধ্যে তাদের কান্ডকারখানা দেখে কয়েকজন হাসতে শুরু করেছে। দিবাও হাতে মুখ ঢেকে মুচকি মুচকি হাসছে। সকলের সাথে দিবাকে হাসতে দেখে লেখার রাগটা আরোবেশি চড়ে গেল। সে মুহিবের সামনে থেকে জুসের গ্লাসটা উঠিয়ে দিবার মাথায় ঢেলে দিল। যারা এতক্ষণ হাসছিল সকলে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে তাদের দিকে। কি সার্কাস শুরু করেছে তিনজনে। এবারে মুহিব আর লেখার মুখে হাসি।

___________________________________

®সামিয়া বিনতে আলম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here