#ত্রিমোহনী
(২)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
____________________________

ঝলমলে রোশনাই জ্বলজ্বল করছে উঠোনের প্রতিটি কোণা। নয়ন আর তার মা ছাড়া পরিবারের কেউ আসেনি। রুপশ্রী একনজর এদিক ওদিক দেখলো নাহ, নয়ন সাহেবের বাবা আসেননি।স্বস্তি নামলো মনে যেন নয়নের পরিবারের প্রধান মানুষটি না আসায়। বিয়ের আলোচনা তবে আরও একটু পিছিয়ে যাবে। বিয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার এখনও অনেক বাকি তার। চওড়া ঘেরওয়ালা সাদা রঙের জামা পরনে, চুলগুলো চুড়ো করে বাঁধা ঠোঁটরাঙা তার গাঢ় লালে, কানে হীরের ছোট্ট এক জোড়া দুল।হাত দুটি তার ফাঁকাই ছিলো। কোথা থেকে রুপের মা এসে এক গাছি চুড়ি পড়িয়ে দিলেন জোর করে। তনুশ্রী আর শ্রেয়সীও সেজেছে আজ বড় বোনের মত করেই। আজকে কার জন্মদিন এ নিয়ে যেন ভ্রম হতে লাগলো সবার। তিনজনই তো একই সাজে সেজে আছে।তিনজনই দেখতে নজরকাঁড়া রুপবতী।

আবহাওয়া আজ বড়ই মনোরম। আকাশে থালার মত এক মস্ত চাঁদ, প্রকৃতিতে হালকা বাতাস তিরতিরিয়ে কাঁপছে বাগানের ফুল গাছ গুলো। বৈদ্যুতিক আলোর তীব্রতাও যেন আজ চাঁদের আলোকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। অষ্টাদশী কন্যার মত জেদী আলো মাটি ছুঁয়েছে আকাশ থেকেই; নয়ন মুহূর্ত খানেক অপলক তাকিয়েছিলো রুপশ্রীর মায়াবী শ্যামলা মুখপানে । দূর থেকেও তা টের পেয়ে রুপশ্রী যেম অস্বস্তিতে পড়ল । বাবার ডাকে স্বস্তি ফিরলো তার।

‘মা জননী কেকটা কাটো জলদি মেহমানরা সবাই চলে এসেছে।’ রুপশ্রীর বাবা রাফসান দেওয়ান মেয়েকে বললেন কথাটা। এক পলক এদিক ওদিক তাকিয়ে শ্রেয়সী বলল, ‘বড় চাচু এখনও সবাই আসেনি।’

চমকে উঠলো তনু আর কে আসার বাকি! মনে মনে ভয়ে জমলো সে। বুদ্ধিমতী তনুশ্রী জানে এখানে নয়নের পরিবার আছে। এই পরিবার শুধু পরিচিতই নয় দুদিন বাদে আত্মীয় হবেন রুপশ্রীর মাধ্যমেই। তাই এখানে এমন কোন কথা বা কারো কথা বলা যাবে না যা পরে রুপশ্রীর জীবনে কোন ঝামেলার না সৃষ্টি হয়! রুপের বাবা জানতে চাইলেন, ‘ আর কে বাকি আছে ছোট মা জননী?’

-কেন? ইকব,,,,,, শ্রেয়সী কথা সম্পূর্ণ করার আগেই তনুশ্রী বলল, ‘ ইকরা,,,, আমার বান্ধবী ইকরাকে দাওয়াত করেছিলাম। ও আসতে পারবে না বলেছে শ্রেয় তো জানে না তাই বলছে।’ তনুশ্রী কথাটা বলার সময়ই শ্রেয়সীর হাত চেপে ধরেছিলো যার অর্থ চুপ হয়ে যা। শ্রেয়সী সত্যিই চুপ হয়েছে এবং রুপশ্রীর বাবাও কিছু টের পান নি। কিন্তু এই যে দুবোন কিছু একটা চুপিসারে লুকিয়ে গেল তা চোখ এড়ালো না একজনের। কিছুক্ষণ আগের আবহাওয়াটাও বদলে গেল ধীরে ধীরে।

কেক কাটা হয়ে যেতেই নয়নের মা এগিয়ে এলেন রুপশ্রীর মায়ের কাছে। বাড়িভর্তি মেহমানদের সবাই যখন খাওয়া দাওয়ায় মনযোগী নয়ন তখন মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে কথা বলার।
-‘ভাবী আপনারা এখনও খাওয়াই শুরু করেননি দেখছি। আসুন ভাবী এই টেবিলে,, ‘ অতি আন্তরিকতার সাথেই বললেন রুপশ্রীর মা।চল্লিশ বছর বয়সী রুপশ্রীর মা শাইরিন দেওয়ান চমৎকার মানুষ।দেখতে ঠিক নাদুসনুদুস আর খুব সুন্দরী। চল্লিশের কোঠায় পরা এই মহিলা যথেষ্ট হেলদী হলেও বয়সটা তার শরীরভর্তি মেদের ভাঁজেই ঢাকা পড়েছে। তাকে আর রুপশ্রীকে দেখলেই বোঝা যায় মেয়ে তার মায়ের মত একটুও হয়নি। নয়নের মা কয়েকবার তনুশ্রীর দিকে তাকালেন চোরাচোখে। ওই মেয়েটাকে তার শুরু থেকেই খুব মনে ধরেছিলো কিন্তু ছেলের পছন্দ ধেরধেরে লম্বা রোগা মতন রুপশ্রীকেই। নয়ন বোধহয় খেয়াল করলো তার মায়ের দৃষ্টি তাই একটুখানি কেশেই বুঝি সংকেত দিলো। ছেলের অমন গলা ঝেরে কাশির অর্থ বুঝেই তিনি বললেন, ‘ ভাবী খাবো পরে তার আগে একটা কথা বলতে চাই।’

‘হ্যাঁ ভাবী বলুন না কি বলবেন?’ হাসি হাসি মুখে বললেন শাইরিন দেওয়ান।

রুপশ্রীর বাবা আর দুই চাচা মিলে ছোট্ট একটা আলোচনা পর্ব সেরে নিয়েছেন৷ একটু পরেই রুপশ্রী আর নয়নের আংটিবদল হবে। একটু আগেই নয়নের মা জানিয়েছেন নয়ন আগামী সপ্তাহে ইন্ডিয়া যাবে। ডাক্তারদের কি এক পরীক্ষা হবে সেজন্য। রুপশ্রী অবশ্য মাস খানেক আগে একবার শুনেছিলো নয়ন ক্যান্সার এর চিকিৎসা নিয়ে কোন কাজ করছে। হয়তো তার সে কাজেই কোন পরীক্ষা হবে! আর তাই নয়ন চায় যাওয়ার আগেই রুপের সাথে আংটিবদল করতে। বলা যায় অফিশিয়াল এক অধিকার তৈরি করতে। দুরুদুরু বুকে রুপশ্রী দু বোনকে জড়িয়ে বসেছিলো নিজের ঘরে। হুট করেই কেন আংটি বদল হবে! সে তো কোন ভাবেই প্রস্তুত নয় বাগদানের জন্য । নয়ন সাহেব দেখতে খারাপ নয় আবার একেবারে অচেনাও নন। তবুও তো আর কটা দিন পরে হলেই বেশ হতো৷ হঠাৎ করেই উনি পরিচিত থেকে বাগদত্তা হয়ে যাবেন তার ওপর অধিকার খাটানোর একটা সুযোগও পাবেন৷ সহজ হওয়া মুশকিল লাগছে রুপশ্রীর কিন্তু এদিকে থমথমে মুখ করে আছে তনুশ্রী। শ্রেয়সী বেশিক্ষণ চুপচাপ থাকাটা একদম সহ্য করতে পারে না। দু বোনের পেঁচার মত মুখ করে বসে থাকাটা পছন্দ নয় বলেই হয়তো শ্রেয়সী ফোনে গান প্লে করে দিলো। সর্বোচ্চ সাউন্ডে গান চলতে শুরু করলো মিনারের কন্ঠে। তনুশ্রীর গম্ভীরতা ভেঙে গেল সেই গানের শব্দে রুপশ্রী তখন ভয়ে সেঁদিয়ে আছে তনুশ্রীর কাঁধে।

– ‘কি হচ্ছেটা কি শ্রেয়! এত সাউন্ডে গান ছেড়েছিস কেন?’ রাগত স্বরে প্রশ্ন তনুশ্রীর।

‘কি করবো? তোমরা দুজন এমন মুখ করে বসে আছো যেন আংটি নয় গলায় ফাঁসি পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে নয়ন ভাইয়ার মা। আর তুমি নিজেকে দেখো, মনে হচ্ছে বাগদান আপুর না তোমারই হবে?’ শেষের বাক্যটা শ্রেয়সী তনুর উদ্দেশ্যে বলল।

‘যা বুঝিস না তা নিয়ে কথা বলিস না’ গমগমে গলায় বলল তনুশ্রী । এবার রুপশ্রীও অবাক হলো বেশ৷ সত্যিই তো আংটি বদল হবে তার তনুশ্রী কেন এত রেগে যাচ্ছে! রুপশ্রীর বড়সড় বেডরুমটার চার কোণা যেন আচমকা দূর্যোগগ্রস্থ হয়ে গেল। তিন বোনই কেমন থমথমে মুখ করে আবার চুপ রইলো। রুপশ্রী অজানা এক অনুভূতিতে যার অর্থ তার জানা নেই, তনুশ্রী মুখভার করে রইলো কোন এক আগাম বিষন্নতার আভাস পেয়ে আর শ্রেয়সী মন খারাপ করে রইলো তনুশ্রীর একটু আগে ধমকানোতে। তনুশ্রীর মায়ের গলা পাওয়া গেল রুপশ্রীর ঘরের সামনে, ‘রুপ দরজা খোল তো মা।’

রুপ উঠে দরজা খুলল। তনুর মা একটা শাড়ি এগিয়ে দিলেন রুপশ্রীকে বললেন, ‘এটা পড়ে উঠোনে এসো একটু পরই আংটিবদল হবে।’

রুপশ্রী কোন কথা না বলে শাড়িটা নিলো। তনুশ্রী বসে ছিলো বিছানায় সে উঠে পড়লো। এক পা দু পা করে করে এগিয়ে গেল রুপশ্রীর ঘরের বারান্দাটায়। বাইরে তখন অন্ধকারের পর্দা গভীর হয়ে গেছে। বারান্দা থেকে পাশের বাড়ির সেই ঘর আর দরজাটা চোখে পড়ছে। এখনও সেখানে এক মানবমূর্তি তবে এখন আর সে দাঁড়িয়ে নেই। দরজার পাশেই একটা আমগাছ তার গোড়ায় পা ছড়িয়ে বসে আছে। কালিলেপা অন্ধকারেও যেন জ্বলজ্বল করছে সেই মূর্তির চোখদুটো। তৃষ্ণার্ত সেই চোখ কিছু কি খুঁজছে এই বারান্দাতে? বিকেলেও মানুষটা দাঁড়িয়ে ছিলো এখানটায়। এত কি খোঁজে এ বারান্দায় এত কেন তার চোখে মুখে তৃষ্ণা? কাপুরুষের মতো লুকিয়ে তৃষ্ণা মেটায় কেন ওই মানুষটা কেন আসে না সামনে? কেন বলতে পারে না মুখ ফুটে, ‘আমার হও!’

-‘ তনুশ্রী এদিকে আয় তো।খোঁপা করে দে একটা গাজরা লাগাবো।’ রুপশ্রীর ডাকে খেয়াল হয় তনুর সে কেমন করে ওদিকে তাকিয়ে আছে। কি ভাবছে ওই লোকটা ছিঃ

কালো শাড়ি,চোখভর্তি কাজল আঁকা, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, খোপায় সাদা আর্টিফিশিয়াল গাজরা,হাতভর্তি চুড়ি৷ কোথাও যেন কিছুর কমতি নেই উজ্জ্বল লাবন্যময়ী মুখটাতে। মরা মাছের মত ফ্যাকাশে চোখে চেয়ে রইলো তনুশ্রী বোনের দিকে।এই প্রথম তার মনে হলো বড় বোনটি তার শুধু দেখতেই রোগা। কিন্তু রোগা দূর্বল মানুষটার মুখ জুড়ে ছড়িয়ে আছে একশো তারার ঝলমলে আলো। পবিত্রতায় ভাসমান এক সদ্যফোটা পদ্ম। অনিন্দ্য সুন্দর মুখখানাতে চোখের তারা আটকে যায় কোন এক তীব্র নেশায়। নজর ফেরানো যেন দায় হয়ে পড়েছে তনুশ্রীর।

‘কি দেখছিস এমন করে?’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো রুপশ্রী।

‘তোমাকে দেখছি আপু।’

রাত দশটার মধ্যেই আংটিবদল হয়ে গেল রুপশ্রী আর নয়নের।আংটি পরানোর উদ্দ্যেশে নয়ন আগেই আংটি কিনে রেখেছিলো। কিন্তু সমস্যায় পড়লো মেয়ে বাড়ির মানুষ। হুট করেই আংটি আনা সম্ভব নয় বলে নিজেরই এক পুরনো আংটি পরালেন হবু জামাতাকে।

পরদিন, কাকডাকা ভোরে ঘুম ভেঙে গেল তনুশ্রীর। বছর দুই হলো তার নিজের আলাদা ঘর নিয়েছে সে। তার আগ পর্যন্ত তিন বোন এক ঘরেই ঘুমাতো। নিজেদের আলাদা ঘর থাকা সত্ত্বেও তারা এক ঘরে এক বিছানায় ঘুমিয়ে সুখ পেত। কিন্তু রুপশ্রী ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই কেমন যেন গানের প্রতি আসক্ত হয়ে গেল। দিনরাত সারাক্ষণ গান শুনতো। তনুশ্রী নিরিবিলি পড়ায় স্বচ্ছন্দ বোধ করতো আর তাই বাধ্য হয়েই কলেজে উঠার পর নিজের ঘরেই ঘুমাতে লাগলো। শুধু ঘরখানিই তাদের আলাদা আত্মায় তারা বরাবরই এক। মুখ হাত ধুয়ে সে উঠোনে কিছুক্ষণ পায়চারী করলো। নাশতার টেবিলে যেতেই দেখলো শ্রেয়সী সবে স্কুল ড্রেস পড়েছে৷ এখনও তার চুল বাঁধা ব্যাগ গোছানো সবটাই বাকি। রুপশ্রী আজও ঘুম থেকে উঠবে ভর দুপুরে। ক্লাস নেই হয়তো কোন প্রোগ্রামও নেই বন্ধুদের সাথে। ফ্যাকাশে মুখে বসার ঘরটার এপাশ ওপাশ সবটা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তনুশ্রী। সে কী বদলে যাচ্ছে খুব!

চলবে

(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। সকলের মন্তব্যের অপেক্ষায়)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here