#মেঘফুল_১০
#লেখনীতে_উম্মে_সুমাইয়া_আক্তার
__________________________________

বৈকাল বেলা নীলু ফোন করে বললো, তার মা রাবেয়া ভীষণ অসুস্থ। হুট করেই এমন কি হয়ে গেলো যে, তিনি বিছানা থেকেই উঠতে পারছেন না! খবরটা শুনে জান্নাত কেঁদে ফেললো। এই একটা মানুষ ছাড়া তাকে কেউ বোঝে না। তার কিছু হলে সে কিভাবে বাঁচবে? বাবার বাড়িতে যাওয়ার জন্য তার মনটা ছটফট করে উঠলো। কিন্তু চাইলেই কি সে যেতে পারবে? স্বামীর অনুমতি ছাড়া তো যাওয়া যাবে না। অশান্ত মনটাকে শান্ত করে, মনে মনে বললো,” তিনি বাসায় আসলে অনুমতি নিয়ে রাত হলেও মায়ের কাছে যাবো। তার আগে আমার শাশুড়ীর সাথে একবার কথা বলা দরকার।”

মনে হাজারো বিষন্নতা নিয়ে সে রান্না ঘরে ঢুকলো। হাতে কোনো কাজ উঠছে না। কোনোমতে রাতের রান্নাটা শেষ করলো। তার শাশুড়ীকে গিয়ে বললো,” মা আমি বাবার বাড়িতে যাবো!”

রুবি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,” সবে তো দুই-তিন মাস হলো বাপের বাড়ি থেকে এসেছো। এখনই কেন যেতে হবে শুনি?”

“আমার মা ভীষণ অসুস্থ। তিনি বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না। মনটা ছটফট করছে তাঁকে দেখার জন্য।”

রুবি রাগত স্বরে বললেন,” বাহ্ আমার মা! তোমরা বউরা শাশুড়ীকে নিজের মা ভাবতে পারো না কেন? আর সে অসুস্থ তো কি হয়েছে? ঔষধ খাওয়াতে বলো,ঠিক হয়ে যাবে। আমিওতো অসুস্থ। আমাকে কে দেখে?”

জান্নাত কিছু বললো না। দৃষ্টি নত করে রুবির থেকে প্রস্থান নিলো। সমস্যা বাঁধলো সান্ধ্যভোজনে। মাছের তরকারিতে লবণ বেশি পরেছে। আলম আহমেদ মুখে খাবার নিয়ে বমি করে ফেললেন। রাগের ছুটে তরকারিসহ বাটি আর তার প্লেট মেঝেতে ছুঁড়ে মারলেন।
মুহুর্তেই কাচের প্লেট আর বাটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। জান্নাত তার বিকট শব্দে কেঁপে উঠলো। গলা শুকিয়ে কাঠ হলো। ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। হাত-পা ক্রমশ কাঁপছে। আলম আহমেদ জান্নাতকে উদ্দেশ্য করে বললেন,” সারাদিন ঘরে বসে কি করো? তরকারিতে লবণ ঠিকমতো হয়েছে কি না দেখবে না?” বলে তিনি রাগে গজগজ করে ডাইনিং রুম থেকে চলে গেলেন।

রুবি দাঁত কটমট করে জান্নাতকে বললেন,” রান্নাটাও ঠিকভাবে করতে পারো না তুমি। বলি বাপের বাড়িতে যাওয়ার জন্য এত পাগল হলে কি চলে? সে এখন না খেয়ে ঘুমাবে। সকল রাগ আমার উপর ঝারবে। কি জবাব দিবো আমি? অলক্ষুণে মেয়ে!”

বলে তিনি ড্রয়িং রুমে চলে গেলেন। রুবি আর আলম আহমেদের কথাগুলো শুনে জান্নাত ভীষণ কষ্ট পেলো। কেউ যেন তার হৃৎপিণ্ডে ধুম করে আঘাত করেছে।
সেই আঘাতে সে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। তার আর্তনাদ, আর্তচিৎকার সে ব্যাতীত কেউ শুনতে পেলো না। মাছের তরকারি ছাড়াও তো গরুর গোশত আর শাক ছিলো। একটাতে না-হয় লবণ একটু বেশিই হয়েছে। বাকি দুইটা তরকারিতে তো, লবণ পরিমাণ মতোই ছিলো। তা থাকা সত্ত্বেও কেন তারা এমন অদ্ভূত আচরণ করলেন?
তার উত্তর সে খুঁজে পেলো না। তবে তার মন ঠিকই একটা কথা বুঝে নিয়েছে। তার শাশুড়ী বলেছিলেন, তাকে কেন নিজের মা ভাবতে পারে না। অথচ এখন তিনি আর তার স্বামীই তার সাথে অদ্ভুৎ আচরণ করলেন। আজ যদি তারা তাকে নিজের মেয়ে ভাবতেন তাহলে বোধহয় এমন আচরণ করতেন না। বরং তার ভুল শুধরে দিতেন। এসব ভেবে চক্ষুভরা নোনা জল আর ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।

এদিকে মেঘালয় আসতে না আসতেই রুবি ইনিয়েবিনিয়ে জান্নাতের নামে তার কাছে অনেক নালিশ করলেন। যা শুনে মেঘালয়ের মাথায় রক্ত চেপে বসলো। সে রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো জান্নাত জল চকিতে বসে কাঁদছে। জান্নাতের প্রতি তার একটুও মায়া হলো না। তাকে বুঝলো না। না বুঝেই একটানে দাঁড় করিয়ে সজোড়ে জান্নাতের গালে একটা চড় মারলো। চড় খেয়ে জান্নাত দেয়ালে ছিটকে পড়লো। মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়ে নিচে বসে পড়লো। ললাট বেয়ে তরতাজা রক্ত পরলো। তাতেও স্বস্তি পেলো না। মেঘালয় তাকে এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি দিলো। কোমড়ে একটা লাথি মেরে গজগজ করে বললো,” বাপের বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি দেন নাই বলে তরকারিতে লবণ দিবি? হারাম**! তোর মাথায় এত কু-বুদ্ধি কি করে আসে? আর কখনো আমার মাকে অসম্মান করলে,কষ্ট দিলে তোকে খু ন করে ফেলবো!”

আহ্ সে কতই না অভাগী! মাইরের দাগ এর চেয়ে মেঘালয়ের কথাগুলো তার হৃৎপিণ্ড ধনুকের ন্যায় ছিদ্র করে দিয়েছে। তার শরীরের ক্ষতের চেয়ে তার অন্তরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। চাপাকান্নায়, আর আর্তচিৎকারে সে ফেটে পরলো। তার দুঃখ,কষ্ট বোঝার জন্য কি কেউ নেই? একবারও মেঘালয় তাকে জিজ্ঞেস করলো না সে কেন এমন করেছে? একবারও তাকে বুঝলো না। অসহ্য যন্ত্রণায় দমটা যেন বন্ধ হয়ে আসছে। শরীরেও প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে। চোখে সে অন্ধকার দেখছে। খুব করে উপলব্ধি করলো। পৃথিবীতে আল্লাহ ছাড়া তার কেউ নেই। আসলে একটা বিষাক্ত পোকার কামড়ের চাইতে, প্রিয় মানুষদের বলা কিছু বাক্য অনেক বেদনাদায়ক।
একটা মাইর দিলে দুইদিন পরই সেই মাইরের দাগ দূর হয়ে যায়। কিন্তু কথার আঘাত? সেটা ধনুকের ন্যায় হৃদয়টা ছিদ্র করে মুহূর্তেই ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। যা চাইলেও ভুলা যায় না। যারা ভুলে তাঁরা মহৎ! জান্নাত অবিচল ধৈর্য নিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করলো। তার কিছু কথা মনে পরে গেলো। রাসূল (সা.) হাদিসে কুদসিতে আল্লাহর কথা বর্ণনা করে বলেন,‘হে আমার বান্দা, আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও তা হারাম করেছি। অতএব তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম কোরো না।’ [১]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা সবাইকে ন্যায়পন্থার নির্দেশ দিয়েছেন। কল্যাণ ও ন্যায়পন্থা হলো মানবজীবনের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের ন্যায়পন্থা, অনুগ্রহ ও নিকটাত্মীয়দের হক প্রদানের নির্দেশ দেন এবং অশ্লীল ও নিষিদ্ধ কার্যাবলি থেকে নিষেধ করেন।’[২]

যারা মানুষের ওপর জুলুম করে এবং প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের ব্যাপারে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই যারা মানুষকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাআলা তাদের শাস্তি প্রদান করবেন।’[৩]

পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা জুলুমের ব্যাপারে মানবজাতিকে সতর্ক করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘অচিরেই জালিমরা জানতে পারবে, তাদের প্রত্যাবর্তনস্থল কোথায় হবে।’[৪]

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,‘জালিমরা কখনো সফলকাম হয় না।’[৫]

জুলুমের পরিণাম খুবই ভয়াবহ। জুলুম এমন একটি অন্যায় কাজ, যার শাস্তি আল্লাহ তাআলা ইহকালেও দিয়ে থাকেন। জালিমের বিচার শুধু কিয়ামতের দিবসেই হবে না, বরং দুনিয়া থেকেই আল্লাহ তাআলা তাদের জুলুমের প্রতিদান দেওয়া শুরু করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দুটি পাপের শাস্তি আল্লাহ তাআলা আখিরাতের পাশাপাশি দুনিয়ায়ও দিয়ে থাকেন। তা হলো, জুলুম ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার শাস্তি।’[৬]

মজলুম বা নিপীড়িতের দোয়া কখনো ব্যর্থ হয় না। তাই মজলুমের অশ্রুফোঁটা ও অন্তরের অভিশাপ পতনের অন্যতম কারণ। মজলুমের আর্তনাদের ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে জালিমদের ওপর নেমে আসে কঠিন আজাব। তাদের অধঃপতন ত্বরান্বিত হয়। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া আল্লাহর কাছ থেকে ফেরত আসে না। এক. ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া। দুই. ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া। তিন. মজলুমের দোয়া। আল্লাহ তাআলা তাদের দোয়া মেঘমালার ওপরে তুলে নেন এবং তার জন্য আসমানের দরজাগুলো খুলে দেন। মহান রব বলেন, আমার সম্মানের শপথ, কিছুটা বিলম্ব হলেও আমি তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করবো।’ [৭]

এছাড়াও রাসূল (সা.) আরো বলেন, ‘তোমরা মজলুমের দোয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকো। কেননা মহান আল্লাহ ও তার দোয়ার মাঝে কোনো পর্দা থাকে না।’[৮]

এ সমস্ত হাদিস আর কুরআনের বয়ানগুলো মনে পরতেই জান্নাত আঁতকে উঠলো। বিড়বিড় করে বললো,” নাহ আমি তাদের খারাপ চাই না। আমি আমার স্বামীকে প্রচন্ড ভালোবাসি। হতে পারে সে খারাপ তবুও সে আমার স্বামী। আল্লাহ তুমি তাদের ক্ষমা করো, তাদের হেদায়েত দাও। আমার ধৈর্য শক্তি বাড়িয়ে দাও। আমি কখনোই তাদের জন্য বদ দোয়া করতে পারবো না। যেখানে আমার রাসূল একা শুরু করলেন দাওয়াতি কার্যক্রম। তখন মক্কার কাফেরদের শত্রু হয়ে পড়লেন। যারা তাকে ‘বিশ্বাসী’ উপাধি দিয়েছিলেন, তারাই সেদিন তাকে হত্যা করতে উদ্যত হলো! এই একা মানুষটার সঙ্গীসাথী হয়ে পড়লো একনিষ্ঠ কিছু বান্দা। তিনি মক্কা ত্যাগ করলেন। তায়েফে রক্তাক্ত হলেন। কেঁদে কেঁদে মাফ করে দিলেন অত্যাচারীদের। মদীনা রাষ্ট্র গঠন করলেন। আল্লাহ’র একত্ববাদের ঘোষণা প্রকাশ্যে দিলেন। যুদ্ধ করলেন। বিজয়ী হলেন। মক্কা নিজের হাতে পেয়েও, মক্কাবাসীর উপর বিন্দুমাত্র জুলুম করলেন না। একা একজন মানুষকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা কত সুন্দর পরিকল্পনা করে,পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ বানিয়ে দিলেন। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সেখানে আজ আমি অল্পতেই কষ্ট পেয়ে একাকীত্ব -ডিপ্রেশনে নুইয়ে পড়ছি। আমার জন্য,সকল মানুষের জন্য উত্তম আদর্শ তো সেই মানুষটা, যিনি সর্বোচ্চ একা হয়েও কেবল আল্লাহ’র জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ তো সে রাসূলের সীরাত!
ফিদাকা আবী ওয়া উম্মি ইয়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

রাতে মেঘালয় জান্নাতকে খাটে শুতে দেয়নি। জান্নাত সারা রাত মেঝেতে থেকেছে। তার চোখে এক ফোঁটাও ঘুম ছিলো না। তার মায়ের জন্য বড্ড খারাপ লাগছে। মনে শান্তি পাচ্ছিলো না। তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে কিছুটা শান্ত হলো। তারপর ভোর হতেই সে নিখোঁজ হয়ে পরলো!

রেফারেন্সঃ-
[১]মুসলিম,হাদিস:৬৭৩৭
[২]সূরা নাহল,আয়াত: ৯০
[৩] মুসলিম, হাদিস:২৬১৩
[৪]সূরা শুআরা, আয়াত:২২৭
[৫]সূরা আনআম,আয়াত:৫৭
[৬]তিরমিজি,হাদিস:২৫১১
[৭]তিরমিজি, হাদিস:৩৫৯৮
[৮] বুখারি, হাদিস:১৪৯৬
—-

চলবে………

বিঃদ্রঃ ভুলক্রটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্য করার চেষ্টা করবেন। এবার নীরব পাঠকরা রেসপন্স না করলে আপনাদের সাথে অভিমান করবো।😒গল্প দেওয়া অফ করে দিবো।😔

এনিওয়ে উহিব্বুক ফিল্লাহ প্রিয় পাঠকবৃন্দ।💞

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here