মনের কোণে🥀
#পর্ব_৪
আফনান লারা
.
মুখের ভাবসাব সম্পূর্ণ অন্য ভঙ্গিতে এনে দাঁড়িয়ে আছে লিখি।ছুটে পালিয়ে যাবার পথ হাজারটা খালি পড়ে থাকলেও যেটা ছাড়া ঐ পথে পা রাখা যাবেনা ঠিক সেই জিনিসটাকেই ধরে আছে নাবিল।ওড়নাটাকে ছাড়বেইনা।সে খুব ভাল করে বুঝে গেছে ওড়না ছাড়া লিখি কোথাও যাওয়ার মেয়েনা।ওড়না থাকা মানে ওকে এক প্রকার বন্দী করে রাখা নিজের কাছে।
রিকশা একটা ডেকে ওকে উঠিয়েও নিয়েছে নাবিল।রিকশা চলছে তার গতিতে।রাস্তায় জ্যাম নেই।বাতাসে উড়ছে লিখির সেই চুল।কয়েকটা বাড়ি খাবার পরেও নাবিল চুপ করে বসে আছে ওর পাশে।দুজনের মনের ভেতর ষ্টেশন এক।নাম হলো পুলিশ ষ্টেশন।
আর হয়ত একটু গেলেই ষ্টেশন এসে পড়বে।হঠাৎ সেই ক্ষণে লিখি নড়ে বসে বললো,’আমি আপনার ফোন খুঁজে দেবো’
নাবিল যেন জানতো লিখি কথা স্বীকার করবে তাই আশ্চর্য না হয়ে সে বললো,’তবে শুনাও কোথায় আছে আমার ফোন’
লিখি রিকশাচালককে একটা ঠিকানা বলে দিয়েছে।ঠিকানাটা চন্দ্রাহাটেই।
রিকশা ঘুরে সেদিকেই চলছে।নাবিলের শুরুতে বিশ্বাস হয়নি কিন্তু পরে লিখিকে স্বাভাবিক আচরণ করতে দেখে আর সন্দেহ করেনি।চন্দ্রাহাটে নেমে এক হাতে ওড়না ধরে রেখে অন্য হাতে ভাড়াটা দিয়ে বললো,’চলো সেই জায়গায়’
লিখি ওকে একটা টিনের ঘরের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বললো,’এখানে পাবেন’
‘টিনের ঘর আর ময়লা আবর্জনার স্তুপ ছাড়া কিছুই তো দেখছিনা’
‘দরজা খুললে তো দেখবেন’
নাবিল সন্দেহসূচক চাহনি নিয়ে দরজাটাকে আলতো করে ধাক্কা দিলো।ভেতরে দশ বারোজন যুবক মাটিতে পাটি বিছিয়ে কার্ড খেলছে।সবাই নাবিলকে দেখে কোনো রিয়েকশান দেখায়নি।ওর সাথে লিখিকে দেখে একজন চিনতে পারলো।বললো,’এই খানে কি?আর এটা কে?নতুন চাকরি নাকি?’
‘ভাইয়েরা, এই ছেলে আমায় চুরি করতে দেয়না।চুরির মাল ফেরত নিতে আসছে।একটু ধুয়ে দেন তো’
নাবিল ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো।লিখি এত সহজে ফোনের হদিস দেবেনা এটা আগে জানা উচিত ছিল।ওর কথায় বিশ্বাস করে এতদূর এসে এটা দেখতে হবে সে আসলেই ভাবেনি।
লিখি ওড়না টান দিয়ে নিয়ে দূরের একটা চায়ের দোকানে বসে পড়েছে।নাবিলের আশেপাশে ঐ কটা যুবক ভীড় জমিয়ে আছে।লিখি একটা পাউরুটির প্যাকেট নিয়ে ছিঁড়ে মুখে দিয়ে মাথা ঘুরালো দেখার জন্য যে মারামারি কেমন চলছে।তখনই সামনে খয়েরী রঙের টিশার্ট পরা ছেলেটাকে হুট করে দেখে প্যাকেট রেখে দাঁড়িয়ে পড়লো সে।
নাবিল কিভাবে যে অক্ষত অবস্থায় এখানে আসতে পারলো সেটা ভেবে আশ্চর্য হয়ে লিখি ওর পেছনে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করেছে বাকিরা গেলো কোথায়।বাকিরা কোথাও নেই।যেন সবটা স্বপ্নের মতন। এখানে কেউ ছিলোইনা।নাবিল ওকে এমন উঁকিবুকি দিতে দেখে ওড়না আবারও ধরে বললো,’এইবার যদি ফোন আমার হাতেও এনে দেও তারপরেও আমি তোমায় পুলিশ ষ্টেশন নিয়ে ছাড়বো’
লিখি গাল ফুলিয়ে নাবিলের পিছু পিছু চললো।নাবিল এবার রিকশা নেয়নি।সোজা হাঁটা ধরেছে।কিছুদূর এসে নতুন ফোনটা বের করে জিপিএস অন করে চেক করছে আশেপাশে পুলিশ ষ্টেশন আছে কিনা।চেক করে কনফার্ম হয়ে ওড়না টান দিয়ে দেখলো ওড়নার অর্ধেক ওর হাতে বাকি অর্ধেক সহ লিখি গায়েব।এত কম সময়ে ওড়না অর্ধেক ছিঁড়ে গেলো কি করে তাই ভাবছে সে।পরে মনে হলো ওর কাছে তো ছুরি ছিল।
নিজেই নিজেকে দুষতে দুষতে নাবিল চললো জুনায়েদদের কাছে।লিখি ততক্ষণে হোস্টেলে ফিরে এসেছে হাঁপাতে হাঁপাতে।
হেনাকে এখনও জুনায়েদ আর রামিশ ছাড়েনি।নাবিল এদিকে আসার পর তারা ওর কাছে জানতে চাইলো হেনাকে আর কতক্ষণ ধরে রাখতে হবে।
নাবিল টুল টেনে বসে হেনাকে কিছুক্ষণ যাবত দেখলো গালে হাত দিয়ে।
চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা,এলোমেলো চুল,হাতে একটা ব্রেসলেট। গায়ের জামা ফিটফাট।দেখে মনে হয় সারাদিন পড়ার টেবিলেই শুয়ে বসে থাকে।যাকে বলে ভবিষ্যত ক্যাডার।
দেখা শেষে নাবিল প্রশ্ন করা শুরু করলো।
‘ঐ মেয়েটা কে?’
‘কোন মেয়েটা?’
‘আপনার সাথে তাহলে কি ছেলে ছিল?’
“ওহ আচ্ছা, ও তো লিখি।লিখি তৃননিকা’
‘বাসা কই?’
‘আমরা তো হোস্টেলে থাকি’
‘সেটা তো আমিও জানি,ওর বাসাও আছে তো না কি?সেটা কোথায়?’
‘আপনাকে কেন বলবো?আপনি কে হোন ওর?’
‘না জানালে চশমা কেড়ে নেবো,চশমার ধরণ দেখে তো মনে হয় এটা ছাড়া মানুষ ও দেখবেননা’
হেনা নড়েচড়ে বসে বললো,’ওর বাসা হয়তবা বরিশাল।আমি সঠিক জানিনা।আমার সাথে ওর বন্ধুত্ব দেড় বছরের।তাও হোস্টেলেই।’
‘ও চুরি করে জানেন?’
‘এটা মিথ্যা কথা।’
‘চরম সত্য।ওর নাম্বারটা দিন আমায়।আপনাকে আর প্রশ্ন করছিনা’
হেনা নাম্বারটা দিয়ে নিজের চশমা ধরে এক দৌড় মেরেছে।জীবনের চেয়েও দামি তার কাছে তার চশমা।এই চশমা হারালে সত্যি সে সামনে কিছু দেখেনা।মনে হয় বরফের টুকরোর ভেতরে মরে ভূত হয়ে আছে
—-
লিখি শুয়ে শুয়ে ফোন দেখছিল।হেনা গড়গড় করে পড়ছে।নাবিল ওকে কি জিজ্ঞেস করেছিল সেসবের কথা সব ভুলে বসে আছে।অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসায় লিখি রিসিভ করে হ্যালো বলার আগেই নাবিল বললো,’ভাল আছেন?’
‘কে আপনি?’
‘আপনার শত্রু’
‘ফোনওয়ালা লোকটা?’
‘ঠিক ধরলেন।এখন অতিরিক্ত কথা বলার মনমানসিকতা আর সময় দুটোই আমার নেই।আপনাদের হোস্টেলের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছি।হাজিরা দিয়ে য়ান।নাহলে বাপের নাম শুনিয়ে হোস্টেলে ঢোকা আমার কাছে নস্যি’
‘ঢুকেন,সমস্যা কি।মেয়েদের রুমে তো আর বাপের নাম শুনিয়ে ঢুকতে পারবেন না’
‘তখন আমার নিজের নাম যথেষ্ঠ হবে মিস তৃননিকা।চুপচাপ আসবেন নাকি আমি ঝড়-তুফান তুলে আসবো আপনাকে নিয়ে যেতে’
লিখি বিরক্তি নিয়ে বললো’আমার নাম তৃননিকা এ কথা আপনাকে কে বললো?আর কতবার বলবো আমি আপনার ফোনের খবর জানিনা।ওটা পাচার হয়ে গেছে। এখন আমি চাইলেও ফেরত নিয়ে আসতে পারবোনা’
‘বাহানা পরে দিয়েন,আগে হাজিরা দেন।আচ্ছা আমি বরং আসি।আপনাকে কষ্ট করতে হবেনা’
লিখি ফোন ছুঁড়ে মেরে পুরো রুমে পায়চারি করছে।কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছেনা।নাবিল এখানে আসা মানে সিনক্রিয়েট।এটার চেয়ে তার নিজের গেটের কাছে যাওয়া উত্তম বলে মনে করে লিখি বের হলো রুম থেকে।গেটে এসে দেখলো কেউ নেই,দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো ঘন্টা খানেক হলো কেউ আসেনি।কৌতূহল নিয়ে লিখি ফোন কানে ধরলো আবার।নাবিল হাসতে হাসতে বললো,’এসব ছোটখাটো ডিস্টার্ব আরও করবো।আজ রাখি।গেটের বাহিরে বের হলে আবার দেখা হবে,ওড়না ধরা হবে’
—
‘এই লোকটা রীতিমত ব্ল্যাকমেল করছে আমায়।আজব তো!একটা ফোনের জন্য মানুষ এমন করে?একবার জুতো নিয়ে কি না যুদ্ধ করেছিল এখন আবার ফোন।এমন ফ্যাসাদে জুড়ে যাবো জানলে জীবনেও এমন লোকের জিনিসে হাত দিতাম না।শান্তিতে দম ও ফেলতে দিচ্ছেনা।পাঁচটা তলা আমি কিসের উপরে দিয়ে নামছি আমি জানি।আর এসে জানতে পারলাম সব নাটক ছিল।এরকম ডিস্টার্ব আর কত দিন করবে কে জানে! আমার নাম্বারই বা পেলো কই সেটা মাথায় ধরেনা।’
—-
‘এসব তুমি মোটেও ঠিক করছোনা অনাবিল!’
‘আমার ছেলে,আমার ইচ্ছা আমি কি করবো আর না করবো।
তুমি মায়ের দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে পারোনি এটা তোমার অক্ষমতা। আপাতত আমার কাজে বাধা দেবেনা’
‘এভাবে ছেলের ছবি নিউজে দিয়ে নিখোঁজ ঘোষণা করলে মানুষ কি বলবে?’
‘বলবেনা,বরং টাকার লোভে বাঁদরটাকে যেখানে পাবে তুলে নিয়ে আসবে আমার সামনে।ও নিজের বাবাকে চেনে নাই।আমার লিংক কত দীর্ঘ এখন জানবে।কোথায় লুকাবে??গর্ত থেকে বের করে আনবো।মোটা অংকের টাকা পুরস্কার ঘোষণা দিয়েছি।পথঘাটে কি করে বের হয় আমিও সেটা দেখবো এবার।
চলবে♥