অপরাজিতা- ৯
বাড়ির দলিলখানা নুপুরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ফারজানা খুব খুশী।
নুপুরও কাগজগুলো উল্টে পাল্টে।দেখল।
পাশে রাখা গহনার বক্স। ত্রিশ ভরি সোনার গহনা আছে এতে।
রাজকীয় ব্যাপার স্যাপার।
অনেকটা মেঘ না চাইতেই জল পাওয়ার মত।
একটা মানুষকে ইমপ্রেসড করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট।
ফারজানা খুব খুশী। নুপুরের সাথে সে আরো গভীর ভাবে মেশার চেষ্টা করছে। করন তার প্ল্যান পুরোপুরি সফল হতে চলেছে।
পৃথিবীতে বৈষয়িক সুখকে বড় করে দেখে না এমন মানুষ খুব কম আছে। সে যতই মহান হোক না কেন।
নুপুরও তার বাইরে না।
: নুপুর গহনাগুলো খুলে দেখো? এগুলো বাইরে থেকে আনা। পাক্কা বাইশ ক্যারেটের।
: থাক। পরে দেখব।
আমার কিছু কথা ছিল আপনার সাথে।
ফারজানা সামান্য কেঁপে উঠল। মেয়েটা সাধারন ঘরের হলেও বেশ চৌকস। পরিপূর্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন।
: কি কথা?
: এই গহনা, বাড়ির দলিল এসব কেন আমাকে দিতে চাইছেন?
: তুমি সহজ বিষয়টাকে জটিল করে দেখছো, আমি ভালবেসে তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি।
নুপুর ফারজানাকে থামিয়ে দিয়ে।
: না, ভালবেসে নয়। আপনি আমায় কিনতে এসেছেন
চুক্তিতে সম্পর্ক গড়বেন বলে, কি ঠিক?
: নুপুর এভাবে কেন ভাবছো? তুমি আমার রিফাতের বিয়ে করা বউ। আমি তোমার শাশুড়ি।
এগুলো সব আমার ছেলের জন্য রেখেছিলাম। এখন তুমি চলে এসেছো তাই তোমার হাতে তুলে দিয়ে দায়মুক্ত হবো।
ফারজানা খুব আবেগ দিয়ে কথা বলছে। কারন এটাই তার এখন একমাত্র অস্ত্র। নুপুরকে বশ করার জন্য এরচেয়ে ভালো অস্ত্র আর কিছুই হতে পারে না। কিন্ত নুপুর তার আবেগকে ইগনোর করে যাচ্ছে। ফারজানা ভেতরে ভেতরে হতাশ হলেও মুখে তা প্রকাশ করছে না।
অবশ্য নুপুর খুব যুক্তি দিয়ে।কথা বলছে। সালমা সব দেখেি মেয়েকে কিছুই বলছে না। কারন সে চাইছে সব শেষ হয়ে যাক।
: খুব হাস্যকর কথা। কারন এই বিয়ে এখন আমি আর স্বীকার করি না।
: তুমি একা বললে তো হবে না।
নুপুর হেসে ফেলল।
: তাই?
ফারজানা ঘেমে যাচ্ছে। তার সাজানো পরিকল্পনা ভেঙে যাচ্ছে বলে।
: নুপুর তুমি এখনও ছোট মানুষ। আবেগ আর বাস্তবতা ভিন্ন।
তুমি আবেগী হয়ে কথা বলছো।
শোনো মাথা ঠান্ডা রাখো। এসো আমার পাশে এসে বসো।
ফারজানা নুপুরকে কাছে টানার চেষ্টা করে। মাথায় হাত রেখে আদর করল।
নুপুর ভীষন রাগ করলেও কিছু বলল না।
: শোনো জীবনে সব প্রয়োজন আছে।
: জানি। তাই বলে নিজেকে শেষ করে দিয়ে নয়। বিয়েটা তো খেলা নয়।
সালমা নুপুরকে থামাতে চেষ্টা করল।
: আহা নুপুর থাম তুই।
: কেন থামব মা? তুমি বলো কোন মেয়ে চায় তার জীবনের স্বপ্নগুলো এমন করে শেষ হয়ে যাক। বিয়ে তো একজন মানুষের নতুন জীবনের অংশ। একজন নতুন মানুষকে নিয়ে ভাবতে শেখা। যার হাত ধরে গোটা জীবনটা কাটিয়ে দেয়া যায়, তাই না মা?
সেখানে এমন একজনের সাথে আমার জীবন শুরু হল যে কিনা বিয়ে কি তার মানেই জানে না।
তুমি জানো মা ওনার ছেলে তেমন কেউ না। যার সাথে আমি একটা স্বাভাবিক জীবন কাটানোর আশ্বাস পেতে পারি।
সালমা নিরুত্তাপ রইল।
: মা আমি ঠকে গেছি। জীবন শুরু না করতেই হোঁচট খেয়েছি। আমি এখন কাউকে বিশ্বাস করি না।
ফারজানা অপমানিত হলেও চুপ থাকল। সে জানে পরিস্থিতি তার অনুকুলে নেই।
: তুমি ভুল বলছো।
: কোনটা ভুল?
বলুন?
: আপনি অনেকবার জোর দিয়ে বলেছেন আপনার ছেলে স্বাভাবিক। তাহলে এই যে আমি বাসায় চলে এলাম এক সপ্তাহ হল। এই কদিনে আপনার ছেলে একবারের জন্যও আমার খোঁজ নেয়নি কেন?
আমি তো তার বিয়ে করা বউ। অন্তত এদিক থেকে একটা দায়িত্ব সে পালন করতে পারত। আমিও অপেক্ষায় ছিলাম একটা ফোন বা ম্যাসেজের।
ফারজানার মলিন মুখে হাসি নেই।
পরাজিত মানুষের বিবর্ন চেহারাটা খুব করুন হয়।
তবুও শেষ চেষ্টা করতে দোষ কোথায়।
: নুপুর আসলে,,
: আসলে কি?
ফারজানা ইতস্তত করছে।
: নুপুর ও ভীষন লাজুক।
নুপুর হেসে ফেলল।
: আসল কথা হল এগুলো সত্য নয়।
: সত্যটা হলো আপনার ছেলে সু্স্থ নয়। তার সমস্যা অনেক। আপনি এগুলো আড়াল করেছেন। আমাকে আমার পরিবারকে বোকা বানাতে চেয়েছেন।
:নুপুর তুমি ভুল বুঝছো আমায়।
: না আমি ঠিক বুঝছি।
কেবল একটা কথা বলি। আমার জীবনটা এত ফেলনা নয় যতটা আপনি ভাবছেন। আপনার টাকা আছে বলে দুনিয়া কিনতে পারেন। কিন্ত মানুষ কেনা কঠিন। মানুষের স্বপ্ন কেনা কঠিন।
আপনি যেমন আপনার সন্তানের জন্য সব বিলিয়ে দিতে চান। তেমনি আমার মা বাবাও আমার জন্য সবচেয়ে ভালো কিছুই চাইবেন। নাকি এটাও ভুল।
ফারজানা থমকে গেছে। এই মুহুর্তে নুপুরের প্রশ্নের উত্তর দেয়া বোকামো।
নুপুর কাঁদছে। সালমা এতক্ষন কিছু না বললেও মেয়ের কান্না সহ্য করতে পারছে না।
সে ফারজানাকে দু হাতে অনুরোধ করল চলে যেতে।
: আপা, সব ভুল সব কিছুর উপরে আমার মেয়ের জীবন। যা হয়েছে তার জন্য আমরা কেউ দায়ী নই।
এটা আমাদের ভাগ্যে ছিল।
আপনি দয়া করে সব মেনে নিন। আমার মেয়েটাকে আর বিরক্ত করবেন না।
আপনার ছেলের প্রতি আমাদের কোন অভিযোগ নেই।
আমরা বরং খুব দুঃখিত। ওর জীবনটা উপরওয়ালা কেন এভাবে তৈরী করল।
ফারজানা মাথা নিচু করে আছে।
তার চোখ ভেজা। নিজেকে এই মুহুর্তে খুব ছোট লাগছে। ফেলনা কাগজের মত। একেবারেই মূল্যহীন।
জীবনের অর্জন তার কম নয়। কিন্ত আজ মনে হল সব ফাঁপা। সব শূন্য।
নুপুর কান্না থামিয়েছে। সে চোখমুখ মুছে উঠে পড়ল।
এত বাজে সিচুয়েশান আর ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে পালিয়ে যেতে পারলে ভালো হত।
ফারজানা খুব অসহায় বোধ করছে। সে নুপুরকে কিছু বলার আগেই শুনল।
: আই ওয়ান্ট ডিভোর্স।
মাথা ঝিম ঝিম করা এই শব্দগুলো শুনতে ফারজানা মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
অপরাজিতা- ১০ ও শেষপর্ব
পুরো সাতদিন পার হল। কিন্ত ফারজানা কোন ধরনের যোগাযোগ করেনি। সালমা কয়েকবার ফোন দিয়েছে। বলেছে ডিভোর্স এর পেপার পাঠিয়ে দিতে।
ফোনে খুব বেশী চাপাচাপি করা হয়নি। কেবল নিয়মমত যা বলার তা বলেছে। কিন্ত সালমা খুব অবাক হল ফারজানার চুপ থাকাতে । বাসায় এই নিয়ে শফিক বেশ ঝামেলা করল। সে খুব মনঃক্ষুণ্ণ। ডিভোর্সের পক্ষে তার মত নাই।
নানা যুক্তি দেখায়।
সব মিলিয়ে নুপুর খুব আপসেট হয়ে আছে। তিশা বোনকে সাপোর্ট দিলেও প্রায়দিন এ নিয়ে ছোট ছোট ঘটনা ঘটতে
থাকে।
শেষে সালমা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে ডিভোর্স পেপার নিজেরাই পাঠাবে।
আদিল সিলভিয়া ওদের সাথে একমত হয়।
এবং সালমা শফিককে ছাড়াই চুপচাপে কাজটা সেরে ফেলে।।
পেপার পাঠিয়ে দেয়া হয় ফারজানার বাসায়।
এর মাঝে রিফাত কোন ধরনের কল বা মেসেজ করেনি আর। তার নিস্পৃহ আচরনে বাসার সবাই যা বোঝার বুঝে গেছে।
রাতে খাবার দেয়া হয়েছে। সালমা মুখ ভার করে খাচ্ছিল। নুপুর তিশা আগেই খাওয়া শেষ করেছে।
শফিক সবে বসেছে।
: তোমরা যা শুরু করছো না, এই বাড়িতে আমার থাকা মুশকিল হয়ে যাবে।
সালমা ভার করা মুখে হা না কিছুই বলে না।
সে অনেকদিন হয় শফিকের কথার জবাবও দেয় না।
: কি করছি আমরা?
: কি করছো শুনবা? এলাকার মানুষের কাছে আমারে ছোট করছো। মানুষজন এখন আমারে দেইখা আড়ালে ফিকফিক করে, বুঝছো?
নানা কুকথা বলে। মান সন্মান আর রইল না।
: করুক। পাড়ার লোকজন কি আমাদের খাওয়ায় নাকি পরায়?
মেয়েটার জীবনের প্রশ্ন এগুলো কি মানুষ দেখবে?
: খুব বেশী বোঝো না?
: আমার মেয়ে আমি বুঝবো।
যা করার আমি করব।
: করো যা খুশী আমিও আর তোমাদের সাথে থাকব না।
: কই যাইবা?
: জানি না।
শফিক ভাত খেয়ে চলে যায়। সালমা।ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। কি অদ্ভুত মানুষ।
অদ্ভুত নয় প্রচন্ড স্বার্থপর। আপন পর যাচাই বাছাই নেই। মেয়েদের কাছে নিজেকে তুচ্ছ করে ফেলল। ছোট হয়ে গেলো।
মেয়েরা কি তাকে বাপের জায়গায় রাখতে পারবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব গুছিয়ে সালমা ঘরে আসে। শফিক ঘরে নেই।সিগারেট নিয়ে বাইরে গেছে। যাক। এখন ঘরে থাকলে আরো কথা বাড়ত। হৈ চৈ হত। রোজ রোজ এমন অশান্তি ভালো লাগে না আর।
নুপুরের রুমে দরজা খোলা দেখে সালমা ঢুকে পড়ে । তিশা ঘুমিয়ে গেছে। কিন্ত নুপুর নেই।
রাত দশটা বাজে। এই অসময়ে মেয়েটা কোথায় গেলো। কি একটা অবস্থা।
কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে দরজাটা চাপিয়ে সোজা ছাদে এল।
নিঝুম সময়। অন্ধকার পুরো ছাদ। রেলিং ঘেষে আবছা একটা ছায়া। নুপুর আকাশের দিকে মুখ করে বসে আছে।
সালমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
পেছন থেকে আলতো করে কাঁধে হাতটা রাখল। নুপুর কেমন স্থির। স্পর্শে একটুও কাঁপল না।
: তুই এত রাতে ছাদে এলি কেন?
: এমনি।
: আয় বসি।
সালমা মেয়ের সামনে বসল। ইচ্ছে করেই।
যাতে নুপুরের মুখটা দেখা যায়।
চাঁদ নেই আকাশে। আঁধারে ডুবে গেছে।
বিষন্ন এক পরিবেশ। এমন বিষন্নতায় সালমা ডুবে যাচ্ছে। সে খুব মন খারাপ নিয়ে কথা বলা শুরু করল।
: নুপুর তুই সব ভুলে যা।
: তুমি এমন করে কথা বলছো কেন মা?
মনে হয় ঘোরতর অন্যায়টা তুমিই করেছো।
সালমা নিশ্চুপ থাকে।
:করেছি তো ঘোরতর অন্যায়। নিজের মেয়েকে শাস্তি দিয়েছি।
: মা আমি এত সহজে ভেঙে পড়ি না। তুমি যা ভাবছো তা ভুল। সব মিটে গেছে এটাই সবচেয়ে বড় কথা।
: এখনও সব মিটেনি। ওরা পেপারে সাইন না করা পর্যন্ত
চিন্তাটা দূর হবে না।
: মা, আমাকে নিয়ে এত ভেবো না। জীবনকে তার মত চলতে দিও।
আধো আলোতে সালমা হঠাৎ মেয়েকে জড়িয়ে ধরল। কি মিষ্টি একটা ঘ্রান নুপুরের শরীরে। সেই ছোটবেলার মত। যতবার কোলে নিত মন ভরে যেতো। এখনও সালমার।মন ভরে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েগুলো কেন যে বড় হয়ে যায়। ছোট থাকলেই ভালো লাগে। মন ভরে আদর করা যায়।
মাকে জড়িয়ে নুপুর ফিসফিস করে কথা বলছে।
: মা তুমি এত বোকা কেন?
মেয়ের কথা শুনে তাকে ছাড়িয়ে উল্টো প্রশ্ন করে বসে।
: তুই কি বললি রে?
নুপুর হাসছে। কি সুন্দর হাসি।
: বলছি তুমি এত ভেঙে পড়ছো কেন?
: তোর জন্য। তোকে এত বড় একটা ধাক্কা সামলাতে হল। সব দোষ আমার।
সালমার হতাশ চেহারাটা দেখে নুপুর আরো হাসছে।
: মা, এটা একটা এক্সিডেন্ট। আমি মেনে নিয়েছি। তুমিও মেনে নাও।
সালমা মনে মনে সাহস বাড়াতে থাকে। মেয়েটার দুশ্চিন্তায় তার দিন রাত এক হয়ে যাচ্ছিল। অন্তত এটা থেকে তো বাঁচা গেলো।
পর পর দুইবার ফোনটা বাজল। প্রচণ্ড অনিচ্ছায় তা রিসিভ করতেই ফারজানা কলকল করে কথা বলা শুরু করল। কি যন্ত্রনা। এই মাঝ রাতে সে আবার কি চায়। নাহ এত চাপ নিতে পারছে না সে।
: নুপুর কি করছো?
কি সুন্দর করে কথাটা বলল। যেন নুপুর তার কত কাছের মানুষ। রোজই কথা হয়। তার ইচ্ছে করল ঘটাস করে লাইনটা কেটে দিতে। নিজেকে সে বহুকষ্টে সংযত করল।
: আপনি ফোন দিয়েছেন কেন?
নুপুরের কাট কাট কথা ফারজানা গায়ে মাখল না।
: হুম। বিরক্ত করে ফেললাম বোধহয়।
আসলে হয়েছে কি তোমার সাথে একটু দেখা করতে চাইছিলাম।
নুপুরের মনে হল ফোনটা কেটে দেয়া দরকার। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল।
: আপনার সাথে কোনই কথা নাই আর। সব শেষ করে দিয়েছি।
আপনি ফোনটা রাখুন।
: আহা, ওমন করে কথা বলছো কেন। তুমি প্লিজ আমায় একটু সময় দাও।
বলো কোথায় দেখা করবা?
নুপুর হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝল না।
এই মহিলা আসলেই একটা পাগল। নয়তো এমন করে কেউ পেছনে লেগে থাকে।
: আপনি বোধহয় বুঝতে ভুল করছেন। আমি ডিভোর্স এর কাগজ পাঠিয়ে দিয়েছি।
ফারজানা অনেকক্ষন চুপ থেকে বলল।
: তুমি কাউকে ভালবাসো?
: মানে? এসব কি ধরনের প্রশ্ন?
: তুমি এই কারনে কি আমার ছেলেকে ছেড়ে দিয়েছো?
: আপনার ছেলেকে নিয়ে আমার কোন কথা নাই। প্লিজ আপনি ফোনটা রাখুন আর দয়া করে কখনও আমাকে কল দিবেন না।
ফোন রেখে নুপুর বারান্দায় চলে আসে। নিচতলা বাড়ির বারান্দায় আলাদা কোন ভাব নেই। মন ভালো হবার চেয়ে মন খারাপ হয় বেশী।
কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি করে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
রাত একটা বাজে। কাল ক্যাম্পাসে যেতে হবে। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষার প্রস্তুতি তার ভালো নেই।
রিহানের কারনে পড়াশুনা ব্যাঘাত ঘটছে।
ছেলেটা বড্ড বেশী আবেগী। এমন আবেগের দাম বাস্তবে শূন্য।
নুপুর আবেগী নয়। সে জীবনের কঠিন সময়গুলোতে বুঝে গেছে খুব সহজ নয় পথচলা।
ক্যাম্পাসে আজ প্রচুর ছেলেমেয়ে।
নুপুর পা রাখতেই অহনা রাহা নিহা ছুটে এল।
ওরা একটা ফাঁকা জায়গা দেখে গোল হয়ে বসল। মুখরিত আড্ডায় একে একে আরো কয়েকজন এক হয়েছে।
পরীক্ষা নিয়ে ওদের তুমুল আলোচনা শুরু হয়। ক্লাস নোট টিচারদের পড়াগুলো নিয়ে কথা হচ্ছে। নুপুর হঠাৎ খেয়াল করল রিহান দুর থেকে এগিয়ে আসছে।
ছেলেটা কেন যে তাকে বিরক্ত করছে।
: নুপুর একটু শুনবে?
আড্ডার সব মেয়েগুলো হাসছে। নিহা সবার মাঝ থেকে উঠে এল।
: ওহো রিহান, কি অবস্থা তোমার?
: এই তো চলছে, তোমার কি খবর?
নিহা মুখ টিপে হাসে। নুপুর খেয়াল করছে রিহান তাকে চোখ ইশারায় কিছু বলছে।
ব্লু শার্ট আর জিন্সে ছেলেটাকে একবারে হিরো হিরো।লাগে। নিহা সেই শুরু থেকে ওর পেছনে লেগে আছে।
কিন্ত রিহান পাত্তা দেয় না।
: তুমি ইদানীং আমাদের বেশ এভয়েড করে চলছো।
রিহান হাসল।
: কই নাতো।
অহনা ব্যাগ হাতে উঠে আসে।
: বেশ ঘুরিয়ে কথা বলতে জানো।
ওকে। আমাদেরও এত পাত্তা দেবার সময় নাই।
অহনা কি যাবি না?
আড্ডার মাঝ থেকে সবাই চলে।গেছে। নুপুর উঠে আসতেই রিহান হাতটা ধরে ফেলল।
: প্লিজ নুপুর। যেও না।
আমি তোমার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম।
: হাতটা ছাড়ো।
: ছাড়ব যদি আমাকে সময় দাও।
: জোর করছো?
রিহান আমি খুব একটা,,
নুপুরের কথা শেষ হবার আগেই রিহান বলে ফেলল।
: আমি জানি। সব জানি।
জানি বলেই তোমাকে রিকোয়েস্ট করতে এলাম।
প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিও না।
: রিহান যতটা সহজ ভাবছো সবকিছু ততটা সহজ নয়।
তুমি যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছো সেটার ভবিষ্যৎ তোমার মা বাবা। তুমি নিজেও জানো না কতটা কঠিন হয় বাস্তবতা। ধরো তোমার মা বাবা মেনে নিলো না আমাকে তখন তুমি কি করবে?
না পারবে আমায় ছাড়তে। না পারবে বাবার কথা এড়িয়ে যেতে। দোটানায় পড়বে।
তখন সম্পর্কে চিড় ধরবে।
ভালবাসাগুলো তারপর আস্তে আস্তে মরে যায়।
কারনটা কি জানো তোমার আমার মাঝে একটা দূরত্ব আছে।
সেটা তুমি অস্বীকার করতে পারবে না।
অসম সম্পর্কগুলো বিয়ের পর সুখী হয় না।
এত ভারী ভারী কথা শুনলে কারোর ভালো লাগবে না। রিহান অনেক ধৈর্য নিয়ে শুনল।
: এতকিছু ভেবে সম্পর্কে জড়ায় না কেউ নুপুর।
নুপুর থেমে গেলো।
: হয়তো।
নুপুর জানে রিহান ইমোশনাল ছেলে। বাবার টাকা আছে। না চাইতেই সব পেয়ে বড় হয়েছে। তার কাছে চাহিদা হচ্ছে অনেকটা শখ মেটানোর মত। শখ মিটে গেলে হয়তো প্রয়োজনও ফুরায়।
নুপুরকেও হয়তো একদিন প্রয়োজন শেষে সরিয়ে দেবে।
: আমি যাবো রিহান।
নুপুরের কথা কানে ঢুকেনি রিহানের। খুব মন খারাপ করে আছে ছেলেটা।
নুপুরের মনে হল এত চমৎকার একটা ছেলেকে ওমন রাগ করলে মানায় না। সে হেসে ফেলল।
: তোমাকে রাগলে ভালো লাগে না রিহান। কেমন বোকা বোকা লাগে।
রিহান চোখ বড় বড় করে নুপুরকে দেখছে। কি মিষ্টি হাসি মেয়েটার। বড্ড নেশা লাগে দেখতে। কি আছে ওর মাঝে যা তাকে এত টানে।
: তোমার হাসিটা খুব সুন্দর।
: তাই?
: হুম।
: বাহ! বেশ তো ভালো সময় কাটাচ্ছো নুপুর?
পরিচিত গলার আওয়াজে নুপুর চমকে উঠে। আশ্চর্য তার সামনে ফারজানা দাঁড়িয়ে আছে। কি করে উনি এই ক্যাম্পাস পর্যন্ত এসেছেন।
নিজেকে সামলে নিয়ে নুপুরও কড়া উত্তর দিয়ে বসে।
: হুম। ভালো সময় তো অবশ্যই।
রিহানকে এক নজর দেখে ফারজানা নুপুরের খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে।
: আমি ঠিক ধরেছিলাম। যে তুমি এমনই একটা ঝামেলায় জড়িয়ে আছো।
নুপুর সোজা কথায় জবাব দিচ্ছে।
: আপনি কি ঠিক আছেন?
ফারজানা প্রচন্ড অপমান বোধ করল। এত ছোট একটা মেয়ে তাকে এত সহজে হেট করে দিচ্ছে। এটা মেনে নেয়া কঠিন।
: নুপুর তুমি আরেকবার ভেবে দেখো।
এত বড় সুযোগ আর কখনো পাবে না।
: আপনার ছেলেকে বলবেন যেন সাইনটা করে ফেলে।
রিহান পুরো বিষয়টা বুঝতে কিছুটা সময় নেয়। সে এগিয়ে এসে ফারজানার সামনে দাড়ায়।
ফারজানা বাঁকা নজরে রিহানকে দেখা মাত্র ভেতরে ফুসে উঠে।
: নুপুর তুমি আমাকে অনেক অপমান করে ফেললে।
আমি,,
রিহান কথা টেনে ধরে।
: সরি আন্টি। আপনি কি কারনে নুপুরকে এতগুলো কথা বলছেন বলুন তো?
ফারজানা রাগ পুষে রাখতে পারল না।
: তুমি আমাদের মাঝে কোন কথা বলবে না।
নুপুর ফারজানাকে থামিয়ে দেয়।
: আন্টি ও হচ্ছে রিহান। আমার বন্ধু। আপনি ওকে এভাবে কথা বলতে পারেন না।
: ওকে। দ্যাটস ফাইন। তবে কেমন বন্ধু জানতে পারি?
: না জানতে পারেন না। তবে বুঝতে পারছেন বোধহয়।
নুপুরের ভাবল এটাই শেষ সুযোগ। ফারজানাকে ঘায়েল করার। কনফিউজড করার। যা করার এখনই করতে হবে। সে হঠাৎ করে।রিহানের হাতটা ধরে ফেলে। মুখভর্তি হাসি তার। কিন্ত রহস্যময়।
ফারজানার মুখ কালো হয়ে গেছে। নুপুর এই ছেলেকে পছন্দ করে। এটাই স্বাভাবিক। রিফাত নয় নুপুরের পাশে এই ছেলেকেই মানায়।
ফারজানার মনে হল আজ রিফাত সু্স্থ থাকলে নুপুর ঠিক এমন করেই হয়তো তার হাতটা ধরত। পাশাপাশি হাঁটত। কিন্ত সেটয় কোনদিন হবে না।
কোন মেয়ে রিফাতকে ভালবাসবে না। তার সঙ্গী হবে না।
ছেলেটার জন্য মনটা কেমন চিনচিন করে উঠল। রোজ ছেলেটা তার জন্য অপেক্ষায় থাকে।
কারন রিফাতের জগতে ফারজানা ছাড়া আর কেউ নেই। থাকবেও না।
রিহান কেমন অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছে নুপুরের দিকে।
মেয়েরা কেমন পাল্টে যায় এক মুহুর্তে। অনেকটা জলের মত।
: রিহান চলো।
নুপুরের হাতে রিহানের হাত। মুঠোয় ধরা পুরো পৃথিবী যেন।
রিহানের মুখ হা হয়ে গেলো। কি করল নুপুর এটা।
নুপুর আড়চোখে সব দেখছে। তার মনে হল প্রেমে পড়লে ছেলেরা কি বোকার মত আচরন করে।
ঠিক রিহান যেমন করছে।
সেও কি বোকার মত আচরন করছে। মনে হয় না।
কারন প্রেমে পড়লে মেয়েরা বোকা বোকা নয় রহস্যময় আচরন করে।