অপরাজিতা- ৭
কলিংবেল বাজছেই। সালমা একরাশ বিরক্তি নিয়ে দরজাটা খুলতেই দেখে নুপুর দাঁড়িয়ে আছে। উশকো খুসকো চুল। এলোমেলো চাহনি। নিরব ভাষার চোখ দুটিতে অনেক প্রশ্ন।
মাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে। সালমা হতভম্ব হয়ে যায়। এই অসময়ে নুপুর কি করে এল। তাছাড়া রিফাত কই। তাকে তো দেখছে না
দরজা লাগাতেই নুপুর সোজা তার রুমে চলে যায়। পেছন পেছন সালমাও আসে। কিন্ত রুমে।আর ঢুকেনি। তিশা নুপুরকে দেখে লাফিয়ে উঠে।
: আপু তুই কখন এলি রে?
নুপুর মনমরা হয়ে আছে। বিমর্ষ মুখে কোনরকমে হাসিটা এনে তিশাকে আকঁড়ে ধরল।
তার কান্না পাচ্ছে খুব। কিন্ত কাঁদল না। চোখের সামনে সব ঝাপসা হতে হতে একেবারেই ঝাপসা হয়ে গেছে।
তারপর টপটপ।বৃষ্টির ফোঁটায় শ্রাবনের মেঘ ঝরতে থাকে।
: আপু কি হয়েছে, তুই ঠিক আছিস তো?
: আছি।
: জিজু কই?
: জানি না।
তিশা ঝট করে সরে গিয়ে নুপুরের মুখটা ভালো ভাবে লক্ষ্য করল।
কি ক্লান্ত বিধ্বস্ত মুখখানা।
তিশা চেচিয়ে তার মাকে ডাকে।
: মা, শুনে যাও।
সালমা ছুটে এসে দেখে।নুপুর মুখ লুকিয়ে কাঁদছে।
এতেই সালমার বুক ধড়ফড়ানি বেড়েছে।
: রিফাত আসেনি কেন রে?
: মা আমি যাবো না ঐ বাড়িতে, কিছুতেই যাবো না।
ভয়ঙ্কর কথা। সালমা বুঝে গেছে খুব খারাপ কিছু ঘটে গেছে তার সাথে। নইলে শান্ত শিষ্ট মেয়েটি এতটা বেপরোয়া কথা কখনও বলত না।
নুপুর বিয়েতে রাজী হয়েছে মা বাবার জন্য। তার মত ছিল না। এটাই কি কাল হয়ে গেলো।
দুপুর নাগাদ পুরো বাড়িতে একটা থমথমে অবস্থা।
মিটিং বসেছে নিচতলায়। সবাই বেশ চিন্তিত। সালমা পুরোপুরি থমকে আছে। তার মন অসম্ভব খারাপ। কোন কুল কিনারা দেখছে না মেয়েকে নিয়ে। বিয়ের পরদিন মেয়ে চলে এসেছে। এসব জানাজানি হয়ে গেলে এলাকায় থাকা কঠিন হয়ে যাবে। সবাই জানে নুপুরের ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছে। এখন সমস্যা হলে সব দায় নুপুরের ঘাড়ে পড়বে। কারন বিয়ে ভাঙার জন্য সব দোষ মেয়েদের হয়। ছেলের না।
সিলভিয়া খুব রেগে যাচ্ছে অল্পতে। যখন শফিক বলল নুপুর ছোট মানুষ। না বুঝে কাজটা করে ফেলেছে হয়তো। তাদের উচিত হবে ও বাড়িতে ফোন করে সব জেনে নেয়া।
: ভাইয়া আপনি শুনেছেন মেয়ে কি বলছে?
শফিক মুচকি হেসে সিলভিয়াকে থামতে বলে।
: শোন তোমারও বয়স কম। নুপুরের সাথে তুমিও অবুঝ হচ্ছো।
সালমা এক কোনায় বসেছিল। সে কিছু বলছে না।
: ভাইয়া এমনি তো আপনারা একটা খোড়া ছেলের কাছে মেয়েটাকে তুলে দিলেন। এটা খুব অন্যায় হয়েছে। তাছাড়া নুপুরের মত ছিল না এই বিয়েতে।
শফিক এসব পাত্তা দিচ্ছে না। সিলভিয়ার বকবকানি তার কানে ঢুকছে না।
সালমা বেশী রকম চুপ হয়ে আছে।
এত বড় একটা ধাক্কা মেনে নেয়া কষ্ট হবে।
সিলভিয়া উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে।
: ভাইয়া নুপুর যা বলেছে সব সত্য বলেছে।ছেলেটার অনেক সমস্যা আছে বিধায় ওরা এমন ঘরে সম্পর্ক করেছে।
সালমাকে চুপ দেখে সিলভিয়া অবাক হয়।
: ভাবী তুমি কিছু বলছো না কেন?
সালমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
: কি বলব, সবই ভাগ্য আমার। কি থেকে কি হয়ে গেলো।
এখন এলাকায় জানাজানি হলে মান সন্মান কই থাকবে বলো তো?
: ভাবী তুমি বাইরের লোক কি বলল বা বলবে সেটা ভাবছো। এদিকে তোমার মেয়ের জীবন নিয়ে কোনই ভাবনা নেই।
সালমা ভেঙে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে। নুপুরের কথায় ছেলেটার সমস্যা অনেক। মেয়েটা একটা রাত কাছ থেকে ছেলেটাকে দেখেছে।
তার জীবনের শুরুটা হয়েছে অনিশ্চিত একটা সম্পর্ক দিয়ে। মেয়েটাও তো ভেঙে পড়েছে। তাকে সাহস দিয়ে পাশে থাকা খুব দরকার।
: সিলভিয়া ও বাড়িতে একটা ফোন দাও। নুপুর না বলে চলে এসেছে। ওদের এটা বুঝিয়ে বলো আর বেশী সমস্যা হলে রিফাতকে আসতে বলে দাও।
সালমা সিলভিয়া একে অন্যের দিকে চাওয়াচাওয়ি করল।
শফিক সিগারেট হাতে বাইরে চলে যায়। ভীষন খারাপ সিচুয়েশান এখন। এলাকার লোকজনের কাছে গর্ব করে নুপুরের বিয়ের কথা বলেছিল সে। এখন ওদের কাছেই নানা কথা শুনবে।
বিয়ের রাতে মেয়ে চলে এসেছে। এই নিয়ে আলোচনা হবে। বেশীরভাগ নেগেটিভ কথাবার্তা হবে। বলবে মেয়েটাই ভালো না।
হাতে থাকা সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে শফিক হাশেমের দোকানে বসল। এলাকার সবচাইতে পুরানো দোকান এটি । চা সিগারেট পান বেচাবিক্রি হয় রাতদিন।
তিনটা বড় বড় বেঞ্চি পাতা। আজ সবগুলোই খালি। কারন এই সময়টায় ভিড় অতটা হয় না।
হাশেম ব্যস্ত মানুষ হলেও গালগপ্পে উস্তাদ। কুশলাদি জানতে চায় সবার। সুগন্ধি মশলার ঘ্রান আসছে পান থেকে। শফিকের হঠাৎ করে পান খেতে ইচ্ছে করল। রাজ্যের দুশ্চিন্তা গিজগিজ করছে মাথায়। পান খেতে খেতে ফুরফুর মেজাজে একটা সমাধানের পথ বের করা যাবে।
:হাশেম এক খিলি পান দাও।
: জর্দা দিমু?
: দাও। কি জর্দা আছে?
: হাকিমপুরী জর্দা।
শফিক পান চিবুচ্ছে। সচরাচর সে জর্দা খায় না। আজ নিয়েছে। মাথা ঘুরে তার জর্দা খেলে।টালমাটাল অবস্থা।
এই টালমাটাল মাথা থেকে সুন্দর সুন্দর বুদ্ধি বের হয়।
: ভাইজান চাও দিমু?
: দাও। তবে চিনি বেশী। কড়া লিকারের।
হাশেম চা বানাতে বানাতে লক্ষ্য করে শফিক খুব চিন্তিত। সে আনমনে পান খাচ্ছে অনেক সময় নিয়ে।
: ভাইজান কি অইছে?
: কিছু না।
একগাল হেসে হাশেম চা তুলে দেয়।
: কিছু না অইলেই বালা। তা মাইয়ার তো বিয়া দিলেন। কিছুই জানাইলেন না। হুনলাম ম্যালা বড়লোক।
তয় আমাগো মাইয়াও তো সোন্দর।
শফিক চায়ে চুমুক দিয়ে মেজাজ খিচড়ে ফেলে।
:উহু, এইটা কি চা বানাইছো?
হাশেমের মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে।
: ক্যান ভাইজান খারাপ অইছে?
: ধুর মিয়া, মেজাজটা খারাপ কইরা দিলা।
শফিক বিল মিটিয়ে উঠে পড়ে।
পেছনে হাশেম দাঁত কেলিয়ে হাসছে।
” শালা মেজাজ লইয়া আইছো আবার তেজ দেখাও আমার লগে ”
কল্যানপুরের রাস্তাটা নোংরা কুৎসিত। রাস্তার পাশে ময়লা আবর্জনার ভাগাড়। যেতে আসতে বমি হয়। তবুও এই রাস্তা ধরে হাটঁলে শান্তি লাগে। নিজের এলাকা। কেমন শান্তি শান্তি। কিন্ত আজ তার মন উচাটন। উচাটন মন নিয়ে কতক্ষনে শান্তি আসবে কে জানে।
লোকজনের ধাক্কাধাক্কি খেয়ে হাঁটা বিরক্তিকর। এই শহরটা সত্যি অদ্ভুত। সবাই খালি ছুটে বেড়ায়। কারোর গন্তব্য নিশ্চিত। কারোরটা অনিশ্চিত। তবুও ছুটে চলছে।
হাঁটতে হাঁটতে শফিকের মাথায় প্ল্যান এল। নুপুরের বিষয়টা দু রকম। রিফাতের তরফ থেকে একরকম আর নুপুরের তরফ থেকে আরেকরকম।
নুপুরের রিফাতকে পছন্দ হয়নি। হতেই পারে।
তাই বলে চলে আসতে হবে।
মিলমিশ করে থাকার নামই তো সংসার। এখন নুপুরকে বুঝিয়ে পাঠানো সবচেয়ে জরুরী।
এত বড় বংশ পয়সাওয়ালা পরিবার। ওদের সাথে সম্পর্ক করে শফিকও জাতে উঠেছে।
এখন সব ভেস্তে।যাবে।
কিন্ত এটা কি মানা যায়।
সালমা সিলভিয়ার কথা শুনলে চলবে না। কারন মেয়ে মানুষের বুদ্ধি হল ধ্বংসাত্বক বুদ্ধি। এদের কথায় চললে সব শেষ।
গরমে ঘেমে একাকার। আজ রোদ উঠেছে খুব কড়া। শফিকের মনে পড়ল রিফাতের বাবা শরাফত আহমেদ এখন এসি রুমে ঠান্ডা খাচ্ছে। তার অফিসে এসি। বাসাতেও এসি। অনেক সুখের জীবন তার।
এমন জীবনের লোভ সবারই থাকে। শফিকের একার নয়।
সে ফোনটা তুলে শরাফত আআহমেদকে কল করল।
রিং হচ্ছে।
: হ্যালো বেয়াইন কেমন আছেন?
শফিককে প্রথমে শরাফত আহমেদ চিনতে।পারেনি।
পরিচয় দেবার পর চিনেছে।
: ওহো, বলেন কেমন আছেন?
: আর থাকা ছেলেমেয়েগুলো এত অবুঝ হলে চলে বলেন?
: আমিও তাই বলছিলাম।
শফিকের চোখ চকচক করে উঠে।
এমন সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না।
: বেয়াইন আমরা একটু দেখা সাক্ষাৎ করি কি বলেন?
: ঠিক আছে। আমি আপনাকে কল দিবো।
আনন্দিত মনে শফিক হাঁটছে। লম্বা লম্বা পা ফেলে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেও এক খিলি পানের জন্য হাশেমের দোকানে যাওয়া অনেক জরুরী।
হাকিমপুরী জর্দার পানের স্বাদ কোনকিছুতে হয়ই না।
নুপুর বসেছে সালমার পাশে। সে বিছানায় আধশোয়া ছিল। সিলভিয়া ঢুকল একটু পর।
মেয়েটা আসার পর কিছুই খায়নি। সালমা ভাত মেখে নিয়ে এলেও সে খাবার তুলেনি।
পরিবেশ একদমই গুমোট।
: মা আমি আর ফিরে যাবো না।
নুপুর বেশ অস্থির অস্থির করছে।
সিলভিয়া ওর পাশে বসে হাতটা টেনে নেয়।
: তুই সত্য করে বল তো কি হয়েছে?
: চাচী রিফাত ছেলেটা এবনরমাল। ওর চাহনি ওর কথাবলা সব বাচ্চাদের মত। ও যে বিয়ে করেছে এটাই সে বুঝছে না।
সিলভিয়া বিস্মিত। চরমে।
: কি বলছিস তুই?
: চাচী ও রাতে। ল্যাপটপ নিয়ে বসে কাজ করেছে।আমার সাথে একটাও কথা বলেনি।
তারপর ল্যাপটপের কাজ শেষে বারান্দায় বসে গেমস খেলেছে।
একজন সুস্থ লোক কখনও তার বিয়ের রাতে গেমস খেলে? বলো।
সিলভিয়া চুপ। সালমা মাথা নিচু করে আছে।
নুপুর থামল এটুকু বলে।
: ওর পায়ে সমস্যা আছে।সেটা মেনে নিয়েছি। কিন্ত ওর মনের সমস্যা মেনে নিয়ে কি আমাকে থাকতে বলছো?
যে লোক বিয়ের মানে বুঝে না।,বউ কি বোঝে না, যার মধ্যে ফিলিংস বলতে কিছুই নেই তার সাথে সংসার করা মানে নিজেকে মেরে ফেলা।
আমি সব মেনে নিয়েছিলাম। কিন্ত অনুভুতিহীন একটা রোবটকে নিজের লাইফ পার্টনার করতে পারব না।
নুপুর কাঁদছে। অনেক বেশী কাঁদছে। সালমা এমন দৃশ্য মেনে নিতে পারছে না।
অনেকক্ষণ পর নুপুর কান্না থামিয়ে বলল।
: আমি ওকে ডিভোর্স দেবো।
সালমার বুকটা ধক করে উঠে। এত বড় সর্বনাশ মেয়েটার হয়ে গেলো।
এখন সবাই বলবে নুপুর ডিভোর্সী মেয়ে।
নুপুরের চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করছে। কেমন আগুন লাগা দৃষ্টি। সালমার বুক কাঁপছে।
মেয়েটাকে খুব অচেনা লাগছে তার। খুব অচেনা।
বিঃদ্র- প্রিয় পাঠক, আপনাদের অকুণ্ঠ ভালবাসায় আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ। গল্পটির জন্য আপনাদের আন্তরিকতা ভালবাসা আমার জন্য বিশেষ আনন্দের।
আজকের পর্বের পর আগামী চারদিনের বিরতি থাকছে ঈদের জন্য। চারদিন পর সবাই নতুন পর্ব পাবেন আশা করি। সেই পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।
সবাই প্লিজ অপেক্ষা করবেন ধৈর্য নিয়ে।
আবারও ভালবাসা এতো এতো।
সবাইকে অগ্রিম ঈদ মোবারক।
……. তামান্না হাসান