ঘাস ফড়িং (৯ম পর্ব)
—————
শ্রেয়ার হঠাৎ মনে হল প্রবল পানির পিপাসা পেয়েছে। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি নিয়ে এক চুমুকে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে দেয়। তবুও অস্থিরতা কমে না। দুই হাতে মুখটা ঢেকে বিছানায় উপুড় হয়। খানিকক্ষণ পরেই শরীরটা কেঁপে উঠে কান্নায়। নিজেকে প্রশ্রয় দেয় না শ্রেয়া। বিছানা থেকে আবার উঠে। প্রথমে রুমের সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়। মোবাইলে গান ছেড়ে নিজেও সুর মিলিয়ে গায়। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। নীলাভের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সে এখন দড়ি লাফ খেলবে। নিজেকে প্রবোধ দেয়। দড়ি খেলা অত্যন্ত জরুরী। দড়ি লাফ খেলতে হয়। শরীরের জন্য বড়ই উপকার। টান দিয়ে ড্রয়ার থেকে দড়ি বের করে খেলতে শুরু করে। এক, দুই, তিন…। দেয়ালে ছুড়ে মারে দড়ি। আছড়ে পড়ে মেঝেতে। নিজের সঙ্গে প্রতারণা করে পারছে না সে। কি করবে! কি করা যায়? দৌড়ে গিয়ে বালতিতে পানি নিয়ে ছাদের দিকে উঠতে থাকে। ফুল গাছগুলোতে পানি দেবে সে। আপন মনে কথা বলে। অনেক দিন হয়ে গেল পানি দেয়া হচ্ছে না বাবা। যা দিনকাল যাচ্ছে না। খেয়ালই থাকে না। তিন-চারটা গাছে পানি দেয়। আর পারে না। চোখটা ভিজে আসে। ইচ্ছে করছে পুরো পৃথিবী তছনছ করে ফেলতে। বালতিটা মাথার উপরে তুলে আছাড় মারে। হাঁটুতে দুই হাত রেখে খানিকক্ষণ ঘন ঘন শ্বাস ছেড়ে আবার ছাদ থেকে নামতে থাকে। বাথরুমে ঢুকে আয়নায় তাকায়। চোখটা লাল হয়ে গেছে কেন! মুখটা ফোলা ফোলা কেন? কিছুই তো হয়নি। শাওয়ার ছাড়ে। কান্নায় ঠোঁট কাঁপছে। সে কাঁদতে চায় না। কান্নাকে ঘৃণা করে। কান্না আই হেট ইউ। আমি তোমাকে ঘৃণা করি কান্না। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। কিন্তু পারে না। ফুলে-ফেঁপে উঠা বন্যার পানির পাড় ভাঙার মতোন ঠেলেঠুলে কান্না আসে। পুরো পৃথিবী কাঁপানো কান্না। বেদনায় আকাশ-বাতাস ভারি করা কান্না। গাছের ঢালে চুপটি করে বসে থাকা কাক আচমকা কা কা করে উড়ে যাবার মতোন চিৎকার করা কান্না। শ্রেয়া কাঁদতে কাঁদতে বারংবার নুইয়ে পড়ে। রাগে ক্ষোভে নিজের চুল টানে। হাত কামড়ে ধরে। কেউ আসবে না। কেউ-ই বাড়িতে নেই। শ্রেয়া একা। ভীষণ একা। এই জগতে কোটি কোটি মানুষ থাকতেও শ্রেয়া আজ থেকে ভীষণ একা।
নীলাভ চলে গেছে মিনুর সঙ্গে দেখা করতে। খাদিজা বেগম কোথায় গেছেন শ্রেয়া সঠিক জানে না। বুদ্ধিমতী খাদিজা কৌশলে বাইরে চলে গেছেন। একটা পলিথিনের ব্যাগে বোরখা নেকাব ভরে শ্রেয়াকে কেবল বলেছেন,

-‘বাইরে যাচ্ছি আসতে দেরি হবে।’

তারপর একটু আড়ালে গিয়ে তাড়াতাড়ি বোরখা নেকাব পরে নীলাভের পিছু নেন।

ঘড়িতে বারোটা ছুঁইছুঁই। নীলাভ চৌহাট্টা পৌঁছে কল দেয়। মিনু কাঁপা কাঁপা গলায় জানায় এক্ষুনি আসছি। আলিয়া মাদ্রাসার বাউন্ডারিতে হেলান দিয়ে নীলাভ দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ দেখতে পায় মিনু আসছে। তার মিনু। একান্ত ব্যক্তিগত নারী। প্রথম ভালবাসা। কত বদলে গেছে। বোরখা নেই। ক্লান্ত বিধ্বস্ত চেহারা। পায়ে চটি জুতো। সস্তার সুতির কামিজ৷ ওড়না গলায় পেঁচানো। এই পোশাক যেন তার গায়ে একদম মানাচ্ছে না। পোশাক লজ্জিত। মিনু চারদিকে তাকিয়ে নীলাভকে খোঁজে। ঘাস ফড়িংটার চোখের নিচে কালি পড়েছে৷ নীলাভ চুপচাপ ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায়। তারপর আচমকা পেছন থেকে মিনুর হাতটা ধরে৷ কেঁপে উঠে মিনু। হঠাৎ নীলাভকে দেখতে পেয়ে উত্তেজনায় জড়িয়ে ধরে। কাঁপতে থাকে পুরো শরীর। নীলাভের গায়ের ঘ্রাণ শুঁকে। চিরচেনা সেই ঘ্রাণ৷ যেই ঘ্রাণ তাকে মাতাল করে দেয়। বুঁদ করে রাখে। নীলাভ চারপাশে তাকায়। আশপাশের মানুষ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। খানিক পরেই মোবাইল বের করে ফটোগ্রাফি শুরু করতে পারে। তাদের বিস্ময় কাটার আগেই সরে যাওয়া জরুরী। সিলেটের অলিগলি তার বেশ চেনা। নীলাভ তাড়াতাড়ি একটা রিকশা ডাকে

—-‘শাহী ঈদগা চলেন।’

সেদিকে গিয়ে বসে গল্প করা যাবে। মিনুকে হাত ধরে রিকশায় তুলে। নীলাভ এই মুহূর্তে সবকিছু ভুলে গেছে। শ্রেয়া নামের কারও এখন তার মস্তিষ্কে স্থান নেই। তার কেবল ইচ্ছে করছে মিনুকে বুকের ভেতর কোথাও লুকিয়ে রাখতে৷ যেখান থেকে আর কখনও হারিয়ে যাবে না। মিনুর দিকে তাকায়৷ একজন আরেকজনের চোখে চোখ রাখে। হাত-পা ঘেমে যায় মিনুর। নীলাভ এভাবে তাকালে তার সব সময় অস্বস্তি লাগতো। এখনও লাগছে। অস্বস্তি কাটানোর জন্য আবার নীলাভের বুকে মুখ লুকোয়। ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদে৷ নীলাভ রসিকতা করে বলে,

– ‘তুমি জড়িয়ে ধরে কাঁদলে বাবা আমার ভয় লাগে।’

মিনু বুক থেকেই চোখ তুলে বলে কেন?
নীলাভ মুচকি হেঁসে বলে,

– ‘কাঁদলেই তোমার সর্দি আসে। নাকের আর চোখের পানি মিলে আমার শার্ট ভিজে যায়।’

শ্রেয়া বুকে মুখ গুঁজে হাসল। সেই হাসির সঙ্গে কান্নার মিশ্রণ। যেন মিনু এখন বাবার আদুরে খুকী। কথায় কথায় ন্যাকা কান্না করবে। দু’জনের কোনো পুরাতন কথা আসে না। এতোদিনের দূরত্বের কথা মনে পড়ে না। রিকশা থেকে নেমে তারা বাদাম হাতে নিয়ে বসেছে সিঁড়িতে। নীলাভ ভুলে গেছে নিজের বিবাহিত জীবন। এ কেমন আশ্চর্য প্রেম? এই প্রেম কি সেই প্রেম? যে প্রেম-ভালবাসা যুগে যুগে জগতের সমস্ত বাঁধাকে ভেঙে ঘুরিয়ে দেয়। যে প্রেম-ভালবাসা সমাজ, ধর্ম, গরীব-ধনী কোনো কিছুর ভেদাভেদ মানে না। মিনু নীলাভের প্রেম কাহিনি এমন হলে শ্রেয়ার কি হবে? এমন প্রেম তো মানুষকে স্বার্থপর বানিয়ে দেয়। বিবাহের বন্ধন নীলাভের প্রেমের কাছে বড়ই তুচ্ছ হয়ে যাবে৷ নীলাভ স্বার্থপরের মতোন মিনুকে চাইবে।
মিনু আস্তে করে বলল,

– আজ টিউশনি আর চেম্বারে যাব না৷ চলো আম্মুর সাথে তোমার দেখা করিয়ে আনি।’

নীলাভ যেন একটা ঘোরের ভেতর আছে। সে মাথা নাড়িয়ে বলে চলো। রিকশা নিয়ে তারা বস্তিতে চলে যায়। চারপাশের মসজিদে আজান হচ্ছে। স্বামীর কুকর্মের ওজনে নুইয়ে পড়া মিনুর মা জায়নামাজে আছেন। প্রতিবন্ধী ভাইটি বিছানায়। মিনু নীলাভকে ওর আলাদা একটা ছোট্ট রুমে বসতে দেয়। চুলোয় আগুন জ্বালিয়ে চা বসায়। ভীষণ সুখী সুখী লাগছে তাকে৷ নীলাভ একবার বকা দেবার জন্য বলতে গিয়েছিল এখন যদি মুখোমুখি হতে পারলে আগে কেন নয় মিনু? এসব কথা বলে সুন্দর মুহূর্ত সে নষ্ট করতে চাইল না। তাছাড়া মানুষের মন এমনই। হুট করে বাবার কুকর্মের জন্য যে লজ্জা পেয়েছিল সেটা এখন ধীরে ধীরে এভাবেই কমে যাবে। এটাই নিয়ম। মাঝখানে তার জীবন অনেক বদলে গেছে। মিনু চা আর মুড়ি নিয়ে পাশে এসে বসে। মাটিতে বিছানা। মাঝখানে রঙচটা একটা মাত্র বালিশ।
নীলাভ মাটিতে চা রেখে বলল,

– ‘এখানে তুমি থাকো?’

মিনু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। নীলাভ আয়েশ করে বিছানায় শুয়ে বালিশটায় মুখ গুঁজে৷ আহা এখনকার সবকিছুতে মিনুর ছোঁয়া। তার ঘাসফড়িং এর গন্ধ।
বালিশটাকে আদর করে কোলে নিয়ে বসে। চায়ে চুমুক দেয়। একমুঠো মুড়ি মুখে পুরে।
মিনু চেয়ে থাকে। নীলাভ রসিকতা করে বলে

– ‘তুমি এভাবে তাকিয়ে থেকো না ভয় লাগে।’

মিনু চোখ পাকিয়ে বলল,

– কেন?’

— ‘তোমার তো আবার কামড়া-কামড়ির অভ্যাস আছে।’

মিনু মুখ ঢেকে ফেলে লজ্জায়,

— ‘কামড়ের কথা তুমি এখনও ভুলতে পারো না? সব সময় এই কথা বলে লজ্জা দাও।’

নীলাভ আচমকা কেমন আবেগী হয়ে গেল। তারপর বলল,

– ‘আমার যে এই দিনগুলি সব সময় মনে পড়ে মিনু। তোমাকে জড়িয়ে ধরবো..।’

মিনু আঁটকে দিল।

– ‘মা পাশের রুমে৷ এসব কথা থাক।’

মিনুর মা নামাজ শেষ করে ডাকেন।

– ‘কে এসেছে রে মিনু?’

এভাবেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। নীলাভকে রাতে রেখে দেন মিনু আর ওর মা। বাসায় ফিরবে না নীলাভ সেটা কল দিয়ে শ্রেয়াকে জানাতে চায়। কিন্তু ফোন বাজতে বাজতে কেটে আসে।

খাদিজা বেগম রিকশা নিয়ে মিনু আর নীলাভকে সব সময় চোখে চোখে রেখেছেন। মিনুদের বস্তির সামনে থেকে তিনি ফিরে যান। রাগে থরথর করে কাঁপছেন। এসব কি হচ্ছে৷ শ্রেয়ার তাহলে কি হবে! শ্রেয়া যে নীলাভকে প্রচন্ড ভালবাসে। এর সমাধান কি?
———————–
বর্তমান

মুখোশধারীরা মিনুকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সে জানে না। বুক এবং থুতনি থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। ব্যথা করছে ভীষণ৷ কিন্ত সব ব্যাথাকে চাপিয়ে এই মূহুূর্তে প্রস্রাব করা ফরজ হয়ে পড়েছে মিনুর। মুখোশধারীদেরকে প্রস্রাব করার জন্য সে চিৎকার করে বলে যাচ্ছে৷ কিন্তু মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না। শক্ত করে বেঁধে কাপড় মুখে ঠেসে দিয়েছে ওরা।
মুখোশধারী একজন বলল,

– ‘মাগীটারে হাওরের ওই বাড়িতে নিয়া যাব বুঝলি? ম্যাডামরে বইলা দেবো কাম খালাস৷ তারপর কিছুদিন মৌজ-ফূর্তি কইরা মেরে ফেলব নে।’

বাকিরা আনন্দ-উল্লাসে হু-হু করে হেঁসে উঠে। মিনু আর প্রস্রাবের চাপ সহ্য করতে পারে না। গাড়িতেই প্রস্রাব করে ভিজিয়ে দেয়।
___চলবে___
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here