ঘাস ফড়িং (৭ম পর্ব)
—————–
রাত একটা ছুঁইছুঁই। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। বাসার সামনের মুদি দোকানটার সিঁড়িতে বসে আছে নীলাভ। দুই আঙুলের ফাঁকে বিন্দুর মতোন লাল হয়ে সিগারেট জ্বলছে। টান দিলে লাল বিন্দুটি আরও গভীর হয়। খানিক আগে বন্ধ দোকানের বারান্দায় কয়েকটা কুকুর কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ছিল৷ ক’টা কুকুর নীলাভের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘেউ ঘেউ করে পালিয়েছে৷ বোধহয় মানুষের প্রতি বিশ্বাস একেবারেই উঠে গেছে৷ তাদের ধারণা কুকুরকে কাছে পেলেই মানুষ পাছায় লাত্থি মারবে৷ দু’টা কুকুর অবশ্য ক্ষীণ ভরসা নিয়ে এখনও বারান্দায় বসে লেজ নাড়াচ্ছে। তারা সিঁড়িতে বসে থাকা মানুষটির হাবভাব বুঝার চেষ্টা করছে। পাছায় লাত্থি খাওয়ার সম্ভাবনা দেখলেই ঘেউ ঘেউ করে দৌড়ে পালাবে। নীলাভ সিগারেটে একটা দীর্ঘ টান দিয়ে দুশ্চিন্তায় মাথার চুল খানিক টানছে। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। দ্বিধান্বীত সে। বড্ড সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। শ্রেয়ার সঙ্গে তার বিয়ের প্রায় তিন মাস গত হয়েছে। প্রথমদিকে নীলাভ পাথরের মতো কেবল স্বামীর দায়িত্ব পালন করে গেলেও একটা সময় শ্রেয়ার ভালবাসা তার হৃদয় স্পর্শ করে। শ্রেয়া তাকে স্বামীর মতোই কাছে পায়। মানুষের মন নিয়ে আসলে ঠিকঠাক কিছু বলা যায় না। জগতে অসংখ্য প্রেমিকের বেকারত্বের কারণে প্রেমিকার অন্য জায়গায় বিয়ে হয়, সন্তানও হয়। তারা কি সত্যিই ভালবাসতো প্রেমিককে? যদি ভালবেসে থাকে তাহলে মনের ভেতর সেই ভালবাসা গোপন রেখে কি স্বামীকে কাছে টানেনি? না-কি সন্তান জন্ম দেবার প্রক্রিয়া পর্যন্ত তারা স্বামীর সঙ্গে ভালবাসার অভিনয় করে যায়? না-কি মানুষ এক জনমে একাধিক মানুষকে একসঙ্গে ভালবাসতে পারে? মানুষের মন নিয়ে আসলেই ঠিকঠাক কিছু বলা যায় না। তারা নিজেও হয়তো চিন্তা করে এসবের সমাধান পায় না। নীলাভও জানে না তার মনের ভেতর কি হচ্ছে। শ্রেয়াকে শত অবহেলার পরও হঠাৎ করে তার মনটা হু-হু করে কেঁদে উঠে। আহারে কত ভালবাসে মেয়েটা আমাকে। একটু আদর, ভালোবাসা, আশ্রয়, প্রশ্রয় পেলেই গলা জড়িয়ে ধরে বলে,

– ‘জীবন এত্তো সুন্দর কেন নীলাভ। এত্তো সুন্দর কেন।’

শ্রেয়ার এমন ভেঙে-ছুড়ে ভালবাসা দেখে প্রায়ই তার চোখ ভিজে যায়। ভালবেসে শ্রেয়াকে বুকে টানে। মাথায় তখন আসে মিনু তো নেই। তাহলে শ্রেয়াকে কেন কষ্ট দেবো? একটা মেয়ের জন্য তো জীবন থেমে গেলে চলবে না। এমন হাজার রকম চিন্তা যখন নীলাভকে শ্রেয়ার প্রতি ক্রমশ দূর্বল করে ফেলেছিল। তখনই সমস্যাটা বাঁধে।
সেবার তারা দু’জন কেবল শ্রীমঙ্গল বেড়াতে যায়। তখনও নীলাভ পুরোপুরি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি শ্রেয়াকে। তবুও ধীরে ধীরে শ্রেয়ার ভালবাসা আর মমতায় সে দিনকে দিন মোমের মতো গলে যাচ্ছিল।
কিন্তু শ্রীমঙ্গল থেকে আসার পর শ্রেয়াকে আর কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। আবার শ্রেয়াকে ছেড়ে স্বার্থপরের মতো মিনুর কাছে চলে যাবার কথাও ভাবতে পারে না। শ্রেয়ার জন্যও তার ভেতরের কোথাও একটা জায়গা তৈরি হয়ে আছে। যে জায়গা জুড়ে আছে মায়া। সেই মায়া এতোদিনে চারদিকে উঁচু একটা দেয়াল তুলেছে। চাইলেই সেই দেয়াল টপকানো যাবে না।
হবিগঞ্জ থেকে শ্রীমঙ্গল সেবার তারা ভোরেই রওনা দেয়। ঘন্টা কয়েক পরই শ্রীমঙ্গল শহরের প্রবেশদ্বারে তাদেরকে স্বাগত জানায় চাকন্যা ভাস্কর্য। চারদিকে চা বাগানের সারি সারি টিলা, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আর ঘন সবুজ অরণ্যের অপরূপ সৌন্দর্য। এ নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য আর সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে দু’জন মুগ্ধ। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে মাধবপুর লেক ঘুরে এসে হোটেলে উঠবে। পরেরদিন শ্রীমঙ্গলের নানান জায়গা ঘুরে দেখবে। শহরে হোটেল ঠিক করে সোজা লেকে চলে যায়।
মাধবপুর লেককে ঘিরে রয়েছে ছোট বড় পাহাড় ও টিলা। আর টিলাকে ঢেকে রেখেছে চাদরের মতোন সুদৃশ্য সবুজ চা বাগান। ন্যাশনাল টি কোম্পানির মালিকানাধীন মাধবপুর চা বাগানের ১১ নম্বর সেকশনে অবস্থিত মাধবপুর লেকের আরও বেশি শোভা বাড়িয়েছে সাদা ও নীল পদ্ম ফুল। লেকে অনেক অতিথি পাখিও দেখা যাচ্ছে। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখছে শ্রেয়া। জলাবদ্ধ সাদা ও নীল পদ্ম ঘেরা লেক পুরোপুরি উপভোগের জন্য শ্রেয়াকে নীলাভ জিজ্ঞেস করে,

-‘পাহাড়ের উপরে যাবে না-কি তুমি?’

নীলাভ এতোদিনে শ্রেয়াকে তুমি বলার অভ্যাস করে নিয়েছে। শ্রেয়া আমতা আমতা করে বলে,

– ‘কিন্তু আমি শাড়ি নিয়ে উঠবো কীভাবে?’

পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থুতনি চুলকে খানিক ভাবে নীলাভ। তারপর আলগোছে শ্রেয়ার হাতটা ধরে বলে,

– ‘আসো।’

পাহাড় কেটে ছোট ছোট সিঁড়ি উপরে উঠেছে। সিঁড়ির কাছে গিয়ে নীলাভ আলগোছে শ্রেয়াকে কোলে নেয়। আঁতকে উঠে শ্রেয়া। অবাক বিস্ময়ে দু’হাতে গলা জড়িয়ে তাকায়। নীলাভ তাকে নিজ থেকে কোলে নিল? খুশিতে চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো শ্রেয়ার। এক হাতে নীলাভের গাল বুলিয়ে ভেজা চোখে তাকায়। নীলাভ যেন কিছুই বুঝে না। জিজ্ঞেস করে,

– ‘আরে কি হলো?’

শ্রেয়া কোলে থেকেই শক্ত করে গলা জড়িয়ে ধরে গোপন কান্নায় কেঁপে উঠে। তারপর ফিসফিস করে বলে,

-‘কিছু না নীলাভ। কিছু না। শুধু একবার বলো জীবন এত্তো সুন্দর কেন। এত্তো আনন্দের কেন। এত্ত আনন্দ এত্ত সুখ আমি সইতে পারি না, কান্না আসে।’

নীলাভ মুচকি হেঁসে বলল,

-‘পাগলামি করার সময় বুঝি এখন। হঠাৎ যদি পাহাড় থেকে পড়ে যাই।’

শ্রেয়ার আচমকে ভেতর মুচড়ে উঠে৷ তাকে নিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠতে কি নীলাভের কষ্ট হচ্ছে না? ধরা গলায় বলল,

– ‘আমাকে নামাও।’

নীলাভ আবাক হয়ে বলল,

-‘কেন?’

—‘তোমার কষ্ট হচ্ছে না?’

— ‘না।’

—‘তবুও নামাও। হাত ধরে উঠতে পারবো।’

নীলাভ আলগোছে নামায়। তারপর বাঁ হাতটা ধরে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। দু’জন পাহাড়ে চূড়ায় উঠে। শ্রেয়া আচমকা দু’হাতে মুখ ঢেকে বলল,

-‘দেখব না তোমার লেক।’

নীলাভ চোখ পাকিয়ে বলে,

-‘কেন।’

—‘আমাকে ধরে পাহাড়ের একেবারে মাথায় নিয়ে যাও।’

নীলাভ মুচকি হেঁসে তাকে পাহাড়ের মাথায় নিয়ে বলল এবার তাকাও। শ্রেয়া মাথা নাড়িয়ে আপত্তি জানায়।

–‘আবার কি?’

— ‘তুমি আমার পিঠের দিকে এক হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরো।’

— ‘বুঝতে পারিনি কীভাবে ধরার কথা বলছো।’

শ্রেয়া দাঁত কটমট করে বলে,

-‘গাধা একটা।’

নিজেই নীলাভের এক হাত পেছন দিকে নিয়ে কোমরে রাখে। তারপর নিজের হাত অবিকল নীলাভের কোমরে। লেকের দিকে তাকায়। শ্রেয়া কিছুই দেখতে পারে না। চোখটা আবার জলে ভরে এসেছে। ঝাপসা লাগছে সব। সন্ধ্যার মতোন আবছা। প্রিয় মানুষের সামান্য যত্নটাও নেয়া যায় না। সুখের ব্যথায় কান্না আসে। তবুও মনটা অন্যরকম ভালো লাগাতে কানায় কানায় ভরে গেল। যেন এই জনমটা স্বার্থক। শ্রেয়ার কাঁচের মতো সচ্চ ভালোবাসা নীলাভের ভেতরও বারংবার স্পর্শ করে। তখন খানিক নিভে যায় সে৷ আবার আচমকা মিনুর স্মৃতি ঢেকুর তুলে। তখন দ্বিধায় পড়ে। জীবন জটিল লাগে। কিন্তু এই মুহূর্তে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে শ্রেয়ার জন্য তার মনটা কেমন কেমন করছে৷ সামান্য ভালবাসায় শ্রেয়ার এমন পাগলামি থাকে স্পর্শ করছে। শ্রেয়ার সুন্দর অনূভুতিগুলো অবহেলা করতে পারে না সে। নীলাভ লেকের নীল পদ্ধের দিকে তাকিয়ে শ্রেয়াকে শক্ত করে কাছে টেনে বলে,

–‘এতো ভালবাসো কেন?’

শ্রেয়া যেন আদুরে গলে গেল। মাথাটা আস্তে করে নীলাভের বুকে ফেলে বলল,

–‘জানি না।’

নীলাভ গালে হাত রেখে চোখের দিকে তাকায়। তার বুকটা কেমন শিরশির করে। এই চোখে জগতের সকল সাগর মহাসাগর সমান মায়া, মমতা, ভালবাসা বয়ে গেছে। এমন চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকানো যায় না। যেরকম করে সূর্যের দিকে তাকালে তার আলোর কাছে হার মেনে চোখ সরিয়ে মাথা নুইয়ে ফেলতে হয়।
নীলাভ আস্তে করে বলল,

– ‘অনেক সময় আছে। এখান থেকে ৫ কিলোমিটার দূরত্বে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ দেখে হোটেলে ফেরা যাবে।’

শ্রেয়া মাথা নেড়ে অসস্মতি জানায়। নীলাভ আবার জিজ্ঞেস করে তাহলে হামহাম জল প্রপাত দেখতে যাই চলো।
শ্রেয়া আবার না করে। নীলাভ ভ্রু কুঁচকে বলল,

– ‘কেন? কাল কত জায়গা এক সাথে দেখা যাবে বলো? শ্রীমঙ্গল কি কম জায়গা।’

শ্রেয়া কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তার ক্ষীণ আশা আজ হোটেলে ফিরে গেলে নীলাভ নিজ থেকেই তাকে একটু আদর করবে। যা এখনও সে পায়নি। নীলাভ আবার তাড়া দিয়ে বলল,

-‘কি হল? কিছু একটা তো বলো?’

শ্রেয়া আস্তে করে বলল,

– ‘তোমার কান দাও। ফিসফিস করে বলব।’

নীলাভ চোখ পাকিয়ে তাকায়৷ তার আজ কেমন জানি বউ বউ লাগছে শ্রেয়াকে। মাথা নুইয়ে কান পাতে। শ্রেয়া দুষ্টুমি করে ফিসফিস করে বলল,

–‘আমার আজ ভীষণ আদর পাচ্ছে। চলো না হোটেলে যাই প্লিজ।’

নীলাভ চমকে উঠে কান সরিয়ে,

-‘কিইই’ বলে তাকায়।

শ্রেয়া সঙ্গে সঙ্গে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলে লজ্জায়। শ্রেয়ার কানের কাছে নীলাভ ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

-‘আজ তোমাকে শাড়িতে অনেক সুন্দর লাগছে।’

শ্রেয়া বিস্মিত হয়ে গেল। ভালো লাগায় যেন দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই প্রথম সে নীলাভের কাছে এমন প্রশংসা শুনেছে। যে নীলাভ তাকে লাঞ্চিত করেছিল তোর প্রতি বিড়ালেরও আগ্রহ হবে না বলে। শ্রেয়ার চোখ বন্ধ অবস্থায় মনে হল দিনটা যেন নিমিষেই রাত হয়ে গেছে। একটা ভিন্ন জগত। পুরো জগত জন-মানবহীন। আকাশে চাঁদ-সূর্য কিছুই নেই।
চারপাশে যতদূর চোখ যায় ইলেকট্রনিক বাতি নেই। শুধু তারা দু’জন একটি পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে একজন আরেকজনের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। এই নেশা কাটানোর মতো মিনু নামের কারও জন্ম হয়নি এ ভুবনে৷ শ্রেয়া চুপচাপ দাঁড়ায়৷ চারপাশে এতো মানুষকে দেখে না সে। শুধু লম্বা সুদর্শন এক মানব তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষ। ঢলে পড়ে নীলাভের বুকে। কেঁপে কেঁপে উঠে কান্নায়।
‘আজ তোমাকে শাড়িতে অনেক সুন্দর লাগছে’ এর চাইতে সুমধুর কথা যেন এই জগত-সংসারে কেউ কাউকে বলিনি। শ্রেয়ার কাছে কথাটা মনে হলো অনেক সুন্দর একটা প্রেমের কবিতা কিংবা অনেক সুন্দর একটা গান।
নীলাভের অস্বস্তি লাগে। মাথায় হাত রেখে বলে,

-‘চারপাশে মানুষ৷ এমন করছো কেন?’

শ্রেয়া খানিকটা নিভে। তারপর চোখ মুছে বলে,

– ‘এই শাড়ি আর কোনোদিন আমি খুলব না।’

কথাটি শুনে নীলাভ হেঁসে ফেলে। তারপর হাত ধরে বলে চলো হোটেলে যাই। পাহাড় থেকে নেমে গেইটের বাইরে এসে তারা সিএনজি নেয়। তারপর সোজা শহরে চলে আসে। দু’জন খাওয়া-দাওয়া সেরে হোটেলে ফিরে। নীলাভ ফ্রেশ হতে বাথরুমে যায়। তখনই শ্রেয়ার ফোনটা বেজে ওঠে। অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে শ্রেয়ার। মিনু আবার কল দিয়েছে। সে ক’দিন থেকে নীলাভের বর্তমান নাম্বার চাচ্ছে কল করে। মায়ের সঙ্গে শ্রেয়া এ নিয়ে কথা বলার পর তিনি নিষেধ করেছেন নাম্বার দিতে। এমনকি নীলাভকেও যেন না জানায়। শ্রেয়া কি করবে ভেবে পায় না। কলটা কেটে দেয়। মুখটা মলিন হয়ে আছে। শ্রীমঙ্গলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্নানে মনটা একদম পবিত্র নরম সুন্দর হয়ে গিয়েছিল৷ এখন নিভে গেছে মুখের আলো। কি একটা আশঙ্কা চেপে ধরেছে তাকে৷ নীলাভ বাথরুম থেকে বের হয়ে বলে,

– ‘ফ্রেশ হয়ে নাও।’

শ্রেয়া কেমন পাথরের মতোন দাঁড়িয়ে থাকে। নীলাভ তাকায়। শ্রেয়ার পরিবর্তন চোখে লাগে ভীষণ। সে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,

-‘কি হয়েছে। হঠাৎ মন খারাপ কেন আমার পে’ত্নীটার?’

শ্রেয়ার বুক ভাঙে। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। নীলাভের সঙ্গে সে মিথ্যে বলতে পারল? নীলাভের সঙ্গে সে লুকোচুরি করল? অথচ সে নীলাভের কাছে খোলসহীন হতে চায়। তাদের মধ্যখানে কোনো আড়াল থাকতে পারে না। সে আস্তে করে নীলাভের হাত ছাড়িয়ে বাথরুমে ঢুকে। কি এক আতংকে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়ে। নিজেকে শান্ত করতে শাওয়ার ছেড়ে দেয়। খানিক আগে আবেগে বলেছিল এই শাড়ি আর জীবনে আমি খুলবো না৷ সেই শাড়ি বেয়ে শাওয়ারের পানির সঙ্গে চোখের নোনা জল পড়ছে। নিজেকে শান্ত করে বাথরুমের দরজা খুলে বলল,

– ‘ব্যাগ থেকে আমার শাড়িটা দাও নীলাভ।’

হঠাৎ করে কি হল নীলাভ বুঝতে পারছে না। তবুও বিনা বাক্যব্যয়ে সে ব্যাগ থেকে বাধ্য ছেলের মতো শাড়িটা বাড়িয়ে দেয়। শ্রেয়া নিজেকে সামলে শাড়ি পরে বের হয়। তারপর খুব স্বাভাবিক গলায় বলে,

– ‘নীলাভ আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই। জানি না বলার পর আমাদের সম্পর্কের পরিণতি কি হবে। তবুও তোমার সঙ্গে আমি লুকোচুরি করতে চাই না। আর লুকোচুরি করেও বিশেষ লাভ হবে মনে হয় না। এই সমস্যার মুখোমুখি আজ না হয় কাল দাঁড়াতেই হবে।’

নীলাভ শোয়া থেকে উঠে বসে। তাকিয়ে দেখে শ্রেয়ার চোখ লাল হয়ে আছে। মুখও খানিকটা ফোলা ফোলা। টেনে শ্রেয়াকে পাশে বসিয়ে জানতে চাইল কী বলতে চাও নির্দ্বিধায় বলো।
শ্রেয়া থুতনি বুকের সঙ্গে লাগিয়ে মাথা নীচু করে। শাড়ির আঁচল আঙুল দিয়ে নাড়তে নাড়তে বলে,

-‘তুমি একদিন বলেছিলে লাস্ট যেদিন মিনুর সঙ্গে তোমার যোগাযোগ হয় তখন আমার নাম্বার নিয়েছিল।’

নীলাভ ভেতরে ভেতরে কি একটা আশঙ্কায় ভীষণ চমকায়। দ্রুত মাথা নেড়ে বলে,

– ‘হ্যাঁ বলেছিলাম।’

শ্রেয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

-‘সেদিন আমি মিথ্যে বলেছিলাম মিনু আমাকে কল করেনি। সে আমাকে প্রায়ই কল দিয়ে তোমার খোঁজখবর নেয়। আমি সব সময় তাকে বলেছি তুমি সব ভুলে গেছো। স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছো, মন দিয়ে পড়ালেখা করছো।’

আঁতকে উঠে নীলাভ। শ্রেয়ার পিঠ থেকে হাতটা খসে পড়ে বিছানায়। নীলাভ ভালো করেই জানে শ্রেয়ার সঙ্গে কেন যোগাযোগ রেখেছে মিনু৷ কারণ সে জানে শ্রেয়া তাকে ভালবাসে। তাই নিজের স্বার্থের জন্য হলেও মিনুর সবকিছু গোপন রাখবে। কাউকে শ্রেয়া বলবে না মিনু আছে। তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়।
নীলাভের মনে হচ্ছে তার প্রেসার অনেকটা বেড়ে গেছে। ঘাড়ের রগ এমন করছে কেন? মাথা ঘেমে গেছে ভীষণ।

শ্রেয়া আবার বলতে শুরু করে,

– ‘মিনু শুধু তোমার খোঁজ-খবর নেবার জন্যই কল দিত। তোমাকে কিছু না জানাতেও অনুরোধে করেছিল। গত কিছুদিন থেকে সে তোমার ছবি দেবার জন্য অনুরোধ করে যাচ্ছিল। মায়ের সাথে কথা বলে আমি দেইনি। আমাদের বিয়ের ব্যাপারেও সে জানে না। কয়েকদিন থেকে মিনু তোমার সঙ্গেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। তোমার পুরাতন নাম্বারে কল দিয়ে বন্ধ পাচ্ছে তাই বর্তমান নাম্বার চায়। একটু আগেও সে কল দিয়েছিল। আমি কেটে দিয়েছি।’

ঘামার্ত নীলাভ রক্তচক্ষু নিয়ে শ্রেয়ার দিকে তাকায়। শ্রেয়ার গালে স্বজুড়ে থাপ্পড় মেরে হাত থেকে মোবাইলটা ছিনিয়ে নেয়।
__চলবে__
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here