ঘাস ফড়িং ( ৬ষ্ট পর্ব)
————-
ফুঁসতে থাকা সাপের মতোন আঁকাবাকা পথচলা ট্রেনটির গতি এখন কমে এসেছে। নীলাভ খানিকটা চমকায়। শ্রেয়ার কোলে মাথা রেখে সে অতীত কল্পনায় ডুব দিয়েছিল। যে অতীত জুড়ে আছে তার ঘাস ফড়িং মিনু। শ্রেয়ারও ঘোর কেটে। মনযোগী শ্রোতা হয়ে গল্প শুনছিল সে। বাইরে তাকায়। ট্রেন শায়েস্তাগঞ্জ স্টেশনে চলে এসেছে। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। এখন পুরো গল্পটা শুনবে কীভাবে? ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছার বুঝি আর সময় পেল না। নীলাভ ভাই আলগোছে মিনুর মাথাটা কোলের ওপর যে আনলেন। ঘুম থেকে উঠে মিনুর প্রতিক্রিয়া কি হবে জানতে ভীষণ ইচ্ছে করছে।
শ্রেয়া আলতো করে নীলাভের কপালে হাত দিয়ে দেখল জ্বর অনেকটাই কমে গেছে। আজ সে শাড়ি পরেনি৷ হাঁটা চলায় বেশ সুবিধা হচ্ছে। নীলাভের হাত ধরে বলল,
—‘আসো, জ্বর এখন অনেকটা কমে গেছে।’
নীলাভ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। সে কল্পনায় পুরোপুরি মিনুর কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। মিনুরও জ্বর ছিল সেদিন। তখন সে মিনুর যত্ন নিয়েছে। কোলে, বুকে, কাঁধে ঘুমাবার জায়গা করে দিয়েছে। ক’দিন থেকে শ্রেয়াও তার সেরকম যত্ন নিচ্ছে। স্টেশন থেকে বাইরে এসে তারা একটা সিএনজি নিয়ে বাসায় চলে আসে। এখানে এসে নীলাভ তার বাবাকে দেখে খানিকটা অবাকই হল। ভদ্রলোকের নাম জাবেদ মিয়া। খুবই বোকাসোকা ধরনের মানুষ। বোনকে খুবই ভালোবাসেন। বিপদে-আপদে বোনের বুদ্ধি নিয়েই চলেন। খাদিজা বেগম শ্রেয়া আর নীলাভকে চট্টগ্রাম পাঠিয়ে ভাইকে ফোন করে এনেছেন। ভাইয়ের কাছে উনার খুবই সহজ বক্তব্য৷ একটা মাত্র মেয়ে আমার। ঘরজামাই ছাড়া বিয়ে দিতে চাই না। মেয়েটা নীলাভকে খুবই ভালোবাসে। নীলাভকে শ্রেয়া থেকে কে আর বেশি ভালো রাখতে পারবে বল ভাই? এভাবে দীর্ঘ একটা বক্তব্য শোনার পর জাবেদ মিয়া হাই তুলে বললেন,
-‘আপা শ্রেয়ার লগে নীলাভের বিয়া হইলে আমিও খুশি হইব। আমাকে বুঝানোর কিছু নাই। ওরা আসুক। নীলাভকে তুমি সামনে নিয়া কথা বলবা। এখন এক কাপ চা দেও।’
খাদিজা বেগম খুবই খুশি হলেন। জাবেদ যেহেতু রাজি আছে ছেলেকে দু’জন মিলে বুঝালে অবশ্যই বিয়ে করবে। শ্রেয়াটা কি যে খুশি হবে। এটা ভাবতেই খাদিজা বেগমের চোখ আনন্দ অশ্রুতে ভরে গেল।
সিএনজি থেকে নামতেই খাদিজা বেগম ছুটে গেলেন নীলাভের কাছে। জড়িয়ে ধরে চোখে-মুখে চুমু খেলেন। মুখে হাত বুলিয়ে বললেন আহারে আবার বাবাটা অসুখে কেমন শুকিয়ে গেছে। শ্রেয়া মিটমিট করে হাসে। নীলাভকে ওর মা আদর করলে তার কি যে আনন্দ লাগে। নীলাভ এগিয়ে এসে বাবাকে সালাম করে বলল,
– ‘তুমি আবার কখন আসলে বাবা?’
— ‘এইতো আইছি তোমার ফুফুই ফোন কইরা আনলেন। কথা আছে তোমার সা..।’
থামিয়ে দিলেন খাদিজা বেগম। ভাইয়ের বোকামির জন্য রাগই হলো। তবুও স্বাভাবিকভাবে বললেন,
– ‘তুই কেমন রে জাবেদ? ছেলেটা এমনিতেই অসুস্থ। তাও এতদূর থেকে এসেছে জার্নি করে। এখনই বকবক শুরু করেছিস। চলো তো বাবা। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করে তারপর কথা।’
সন্ধ্যায় চা নাস্তা করতে করতে সবাই গল্প-গুজব করছিলেন। শ্রেয়া আর নীলাভ সোফায় বসা। খাদিজা বেগম আর জাবেদ মিয়া খাটে। খানিক পর নীলাভের পাশে এসে বসেন খাদিজা বেগম। গভীর মমতায় নীলাভের মাথায় হাত রেখে বলেন,
– ‘কার জন্য বোকার মতো কষ্ট পাচ্ছিস? কোথাকার একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করলি বল? যে মেয়ের বাপ আকাম করে ধরে পড়ে নিজেই ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করছে। তারপর মেয়েটাও উধাও। বলি প্রেম যে করেছিস তাকে রেখে উধাও হলি কীভাবে? তাহলে কিসের প্রেম? এমন মেয়ের জন্য তুই বাবা খাওয়া-ঘুম সব বাদ দিয়ে কান্নাকাটি করিস?’
শ্রেয়া নীলাভ দু’জনই আঁতকে উঠে ৷ শ্রেয়া ভাবেনি এভাবে সরাসরি মা এসব কথা বলবেন। নীলাভও অপ্রস্তুত হয়ে গেল বাবার সামনে এসব কথা শুনে। সে আমতা আমতা করে বলল,
– ‘না ফুপু এসব কিছু না। কে বলল তোমাকে আজাইরা কথা।’
খাদিজা বেগম আবার শান্ত গলায় বললেন,
– ‘লজ্জার কিছু নাই বাবা। তোমার বয়সে এমন ভুল অনেকেই করে। এই ভুল যত তাড়াতাড়ি শুধরে উঠা যায় ততই মঙ্গল। তোমার এখন শ্রেয়াকেই দরকার। শ্রেয়ার থেকে বেশি তোমাকে কেউ সুখে রাখতে পারবে না। তাই তোমার বাবা আর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি শ্রেয়ার সঙ্গে তোমার বিয়ে দিতে।’
পাশে বসে থাকা শ্রেয়ার লজ্জায় কান গরম হয়ে গেছে। সে ভাবতেই পারেনি মা তাকে না জানিয়ে আচমকা এমন একটা সারপ্রাইজ দেবেন। সে চুপচাপ এখান থেকে বের হয়ে দৌড়ে ছাদে উঠে। খুশিতে দমবন্ধ হয়ে আসছে৷ মামা রাজি? এখন কি নীলাভ ভাই বিয়েতে রাজি হবে? মিনু নিজ থেকেই হারিয়ে গেছে। শ্রেয়া ছাদের কার্ণিশ ধরে আকাশের দিকে তাকায়। সুন্দর একটা চাঁদ৷ আবার মনে হলো সত্যিই কি নীলাভকে সে আপন করে পেয়ে যাবে? এতোটাই সুখের বুঝি জগত? চারদিক এতো সুন্দর লাগছে কেন! পৃথিবী এতো সুন্দর কেন! শ্রেয়া আচমকা মুখ ঢেকে ছাদে বসে পড়ে। খুশিতে কান্না আসছে। শরীর কাঁপছে।
নীলাভ ফুফুর কথা শুনে আঁতকে উঠে। সে ভাবতেই পারেনি এমন একটা প্রস্তাব দেওয়া হবে। মাথা তুলে বাবার দিকে তাকায়৷ তিনি আয়েশ করে একটা সিগারেট টানছেন। যেন চারপাশে যা হবার তাই-ই হচ্ছে। নীলাভ আমতা আমতা করে বলল,
– ‘আমি এখনও পড়ালেখা করছি। এখনই বিয়ে কীভাবে সম্ভব।’
চতুর খাদিজা বেগমের মাথায় যেন প্রশ্নের উত্তর আগেই গুছানো। তিনি সুন্দর করে গুছানো জবান দেন,
– ‘বাবা বিয়ের পর তোমরা এখানেই থাকবে৷ দু’জন পড়ালেখা করবে। কেরিয়ার গড়বে। শুধু বিয়েটাই না হলো। সবকিছু ঠিক এখনকার মতোই চলবে৷ তুমি যখন আয় রোজগার করবে তখন শ্রেয়াকে ঘরে নিয়ো। তার আগে আমরা আছি তো।’
নীলাভ কি বলবে ভেবে পেল না। সে চুপচাপ বসে রইল।
খাদিজা বেগম আবার বললেন,
– ‘একটা মেয়ের জন্য তো আর জীবন থেমে থাকবে না বাবা। তাছাড়া মেয়েটা ইচ্ছে করে হারিয়ে গেছে। নিজ থেকেই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করছে না। করতে চাইছেও না। তাই তোমার বাবা আর আমার কথা ফেল না। আমরা তোমার ভালোই চাই।’
নীলাভ দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যায়। কি বলবে ভেবে পায় না। ফুফু যা বলছেন সবই ঠিক৷ যুক্তি দিয়ে উনাকে আটকানোর কিছু নেই। তাছাড়া মিনুকে কত খুঁজেও পায়নি। নতুনভাবে সবকিছু শুরু করলেও মন্দ হয় না। জীবন তো সত্যিই কারও জন্য থেমে থাকবার নয়। এমনই এক দ্বিধাদ্বন্দের ঘোরের ভেতর দিয়ে তাদের বিয়েটা হয়ে যায়। কেবল দুই পরিবারের লোকের উপস্থিতে উকিল ডেকে খুবই ঘরোয়া উপায়ে বিয়েটা হয়। শ্রেয়াকে যেদিন তাদের বাড়িতে বউ হিসেবে নেবে তখন শ্রেয়ার বাবা দেশে এসে অনুষ্ঠান করবেন। নীলাভ যেন এখন নদীর স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে৷ স্রোত যেদিকে নিয়ে যায় সেদিকেই যাবে। দীর্ঘ জীবনে মানুষের সঙ্গে মাঝেমধ্যে এমন হয়। স্রোতে গা ভাসানো ছাড়া তখন আর উপায় থাকে না।
বাসর ঘরে শুয়ে শুয়ে নীলাভ একের পর এক সিগারেট টানছিল। ডায়েরি পড়ার পর থেকে শ্রেয়ার সাজগোজ সব আঁটকে গেছে খয়ারী রঙের শাড়িতে। খোলা চুলে। শ্রেয়া চুপচাপ দরজা বন্ধ করে লাল টুকটুকে একটা ফুল টেবিলে রাখে। তারপর রুমের চারদিকে মোমবাতি জ্বেলে কেমন রহস্যময় একটা পরিবেশ তৈরি করে ফেলেছে। খাটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দেয়। নীলাভ ভাবলেশহীনভাবে শুয়ে আছে। শ্রেয়া আস্তে করে বলল,
– ‘নীলাভ, আমার সামনে দাঁড়াও।’
নীলাভ ভেতরে ভেতরে খানিকটা চমকায়৷ কারণ শ্রেয়া একটু আগে তার নামের সঙ্গে ভাই ডাকেনি। চুপচাপ শ্রেয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। শ্রেয়া পায়ে সালাম করার ভঙ্গিতে মাথা নীচু করে। নীলাভ নির্লিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। শ্রেয়া মাথা নুইয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে বলল,
– ‘এই, তুমি কি কোনোদিন নাটক-সিনেমায় দেখোনি? বউ মাথা নীচু করে পায়ে হাত দেবার আগেই জামাই ধরে ফেলতে হয়। তারপর বলতে হয় তোমার স্থান আমার পায়ে নয়, বুকে।’
নীলাভ হেঁসে ফেলে। শ্রেয়া আবার বলল,
– ‘ঠিকাছে ঠিকাছে, আমি আবার মাথা নীচু করছি।’
নীলাভ মুচকি হেঁসে শ্রেয়াকে টেনে বুকে আনে। সে এখন নদীর স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে৷ যে দিকে স্রোত নিয়ে যায় সেদিকেই যাবে। কিন্তু শ্রেয়ার জড়িয়ে ধরার অনূভুতিটা ঠুনকো নয়। নিবিড় ছোঁয়া, গভীর অনূভুতি৷ সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁপছে। নীলাভ অনুভূতিহীন রোবটের মতো দাঁড়িয়ে। শ্রেয়া গভীর আবেগ মাখা ঘুম ঘুম গলায় কানে ফিসফিস করে বলল,
– ‘হাত ছেড়ে আছো কেন। প্লিজ একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরো না।’
নীলাভ ধীরে ধীরে দুই হাত পিঠের দিকে নিয়ে পেঁচিয়ে ধরে। শ্রেয়ার তখন মন কেমন করা এক অন্যরকম অনূভুতিতে মনটা কানায় কানায় ভরে যায়। আস্তে করে কানে একটা চুমু খেয়ে আবার ফিসফিস করে বলে,
– ‘তোমার বুকে এভাবে একটু আশ্রয় দিয়ো, চোখে খানিক প্রশ্রয়। আর কিছু চাই না নীলাভ। তোমাকে আমি ভীষণ সুখে রাখবো৷ ভীষণ মানে, ভীষণ ভীষণ।’
—- চলবে—
লেখা: MD Jobrul Islam