বিয়ের জন্য কেনাকাটা শুরু হয়েছে। আমি কোন কালেই কেনাকাটায় পারদর্শী ছিলাম না। প্রথমে মা পরে বীথি আমার পোশাক পচ্ছন্দের ভার নিয়েছিলো। এবারও আমি বীথির উপর দায়িত্ব অর্পন করে পার পেতে চাইলেও পারলাম না। বীথি প্রতিদিন ওর সাথে আমায় বগলদাবা করে বের হয়। মাঝে মাঝে সাদমানকেও ডেকে নেয়। আমি দুদিনের মধ্যে বিরক্ত হয়ে গেছি। শপিং করা এতোটা ঝামেলার কাজ তা আগে বুঝিনি। এই ঝামেলার কাজটা মেয়েরা এতো আনন্দ নিয়ে করে কি করে সেটাই ভাবছি। আজ সাতাশ রোজা ঈদের দিন দুয়েক বাকি আর। বীথি সকালেই আমাকে বলে গেছে আজ নাকি বারোটার দিকে বেরুবে। যত রাত হোক একেবারে কাজ শেষ করে বাসায় ঢুকবে। আমি যেন সেইরকম মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে তৈরী থাকি। সত্যি বলতে এ কথা শুনেই আমার প্রচন্ড ঘুম পেয়ে গেলো। আজ কিসের শপিং হবে আল্লাহ জানে। গত দুদিন এতো কেনাকাটা তবে কার জন্য করলাম?

বসুন্ধরার লেভেল টুতে ছেলেদের পোশাকের শো-রুম আছে কিছু। লুবনান এর সামনে যেতেই দেখলাম সাদমান আর তুষার দাঁড়িয়ে। আমি দাঁড়িয়ে পরতেই বীথি হাত টান দিলো-
“আজ সব ছেলেদের কাপড় কিনবো তাই ওদের ডেকেছি। তাছাড়া দু’দিন পর যার সাথে জীবন কাটাবে তার পচ্ছন্দ অপচ্ছন্দ জানবে না? আজ সুযোগ পাচ্ছো, সেই সুযোগ হেলায় হারিয়ো না প্লিজ।”
আমি চুপ করে রইলাম। বীথি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো। দূর থেকে তুষারের মিটিমিটি হাসি টের পাচ্ছিলাম।কাছে যেতেই দেখলাম আমাকেই দেখছে, ঠোঁটের স্মিত হাসি দেখে ঠাওর করা যাচ্ছে না সেটা দুষ্ট হাসি না মিষ্টি হাসি। দু’জনে একে অপরকে হাই হ্যালো করলাম। সাদমান আর বীথি সামনে এগিয়ে লুবনানে ঢুকতেই তুষারের কথা শোনা গেলো-
“আপনি ভারী খারাপ একটা কাজ করেছেন। নিজে প্রশ্ন করে তার উপর দেননি। বেশ বুদ্ধি করে আমার কাছ থেকে উত্তরগুলো শুনে নিয়েছেন। আজ কিন্তু নিজেরটা বলতেই হবে।”
আমি হাঁটা থামিয়ে তুষারকে দেখলাম। বুঝলাম আজ আমাকে এখানে নিয়ে আসায় তার ভুমিকা আছে। কেনাকাটার চাইতে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা তার জন্য বেশি জরুরি। আমি মুচকি হেসে বলি-
“টিচার প্রশ্ন তৈরী করে কিন্তু সেই প্রশ্নে পরীক্ষা দেয় বলে কখনো শুনিনি। আপনি শুনেছেন কি?”
“না শুনলে এখন দেখবো। কালে কালে কত পরিবর্তন আসবে। এই পরিবর্তন না হয় আমাদের হাত ধরে হোক?”
তুষার হাসলো। আমি কিছু বলবো তার আগেই বীথি ডাকলো আমায়।
“বড়পা ভাইয়া, দেখেনতো এই পাঞ্জাবিটা পচ্ছন্দ হয় কিনা?”
দুজন একসাথে তাকালাম। বীথির পচ্ছন্দ বরাবরই ভালো। এ্যাশ কালারের পাঞ্জাবিতে নীল আর সিলভার সুতার কাজ আছে হালকা। তুষার খুশি খুশি গলায় বললো-
“একদম আমার মনের মতো। ভারী কিছু হলে নিতাম না। এইটা একদম পারফেক্ট। আপনি কি বলেন?”
আমি অসস্তি নিয়ে বীথিকে দেখলাম। ও ঠোঁট টিপে হাসছে। আমার পচ্ছন্দ বীথি ভালোমতোই জানে। সে উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো-
“হ্যা আপু বলো তো কেমন লাগছে?”
আমি মাথা নেড়ে হ্যা সূচক উত্তর দিলাম।
“এটা নিয়ে নিলাম তাহলে। আর ভাইয়া এবার নিজে একটা পচ্ছন্দ করুন।”
বীথির কথায় তুষার হাহা করে উঠলো-
“আরে আবার আমি কেন? তুমি তো এসব ব্যাপারে সেরা। আর সাদমান তো আছেই, ও আমার ভালোলাগা জানে। তোমরা দু’জনেই ম্যানেজ করে ফেলো।”
বলতে বলতে চোরা চোখে আমার দিকে তাকালো। বীথি আর সাদমান একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলো। আমার তো লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। এই লোক কি পাগল হয়ে গেছে? ছোট ভাই বোনের সামনে কোন লাজ লজ্জার বালাই নেই। আমি চট করে পাশের দোকানে ঢুকে গেলাম। পেছনে বীথির হাসির আওয়াজ পেলাম।

“শুনুন, আমার সাথে একটু আসবেন? একটা জরুরি কাজ ছিলো।”
ফেরার আগে আগে তুষার আমায় ডাকলো। আমি একটু বিরক্ত হলাম বলা যায়। সারাদিন বাইরে থেকে আমার মাথা ঘুরছে রীতিমতো। আমি ঠান্ডা গলায় জানতে চাইলাম-
“এখন আবার কি?”
তুষার কাচুমাচু স্বরে বলে-
“প্লিজ একটু আসুন না। বীথি সাদমান তোমরা দশমিনিট এখনেই দাঁড়াও, আমরা এই যাবো আর আসবো।”
ওরা মাথা নাড়লো। আমাকে নিয়ে তুষার চলে এলো শাড়ির দোকানে।
“আমার মা আর তিনবোনের জন্য শাড়ী কিনবো আপনার পচ্ছন্দে। প্লিজ রাগ করবেন না।”
আমি হেসে দিলাম-
“আচ্ছা আমাকে কি ভাবেন বলুনতো? সবকথা এতো ভয়ে ভয়ে বলেন কেন? আপনি তো আমার ছাত্র না যে এতো ভয় পাবেন আমাকে? মায়ের শাড়ি কেনার কথা বলতে এতো কুন্ঠা কেন?”
তুষার বড় করে শ্বাস ফেলে-
“বাঁচালেন। সবসময় যেমন টিচার লুক নিয়ে থাকেন মনেহয় যেন এখনই ধমক দেবেন। ভয় না পেয়ে উপায় কি বলুন?”
আমি কপট রাগ নিয়ে তাকাতেই তুষার ঢোক গেলে-
“না মানে আমি বলছিলাম কি আপনি চোখ বড় বড় করলেই বুকের মধ্যে কেমন যেন ধড়ফড় করে ওঠে।”
আমি তুষারের ভয় ভাঙাই না, গাম্ভীর্যের ভাব ধরে রেখে বলি-
“চলুন শাড়ি দেখি। মা কি ধরনের শাড়ি পরে?”
“আজ না হয় আপনার পচ্ছন্দ মতো কিছু দেখুন।”
“উহু, দু’জনার পচ্ছন্দের কিছু দেখি। এখন থেকে যা করবো সব দু’জনার পচ্ছন্দে, ঠিক আছে?”
আমি খুব আস্তে কথাগুলো বলতেই তুষারের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে গেলো। সে আনন্দে বিগলিত হয়ে আমার পাশে বসে একের পর এক শাড়ি নামাতে বলতে লাগলো। অনেক দেখে টেখে মোট সাতটা শাড়ি কিনলো তুষার। বীথির সাথে দেখা হতেই ওর হাতে একটা শাড়ী ধরিয়ে দিয়ে বললো-
“তোমার গিফট বীথি। অনেক কষ্ট করছো তুমি। তোমার তুলনা হয় না।”
“বাহ, এখন ভাই পর আর শালী আপন হয়ে গেলো? এই হলো আমাদের কপাল। ভাইয়া এটা কি ঠিক হলো?”
সাদমান অভিমানী কন্ঠে বলে উঠলো।
“তোর জন্য আমার একমাত্র শালীকে দিচ্ছি এর চেয়ে বড় উপহার আর কি হতে পারে?”
তুষারের কথায় সাদমান বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকলো-
“হ্যাহ! তুমি তোমার শালীকে দিচ্ছ নাকি আমি আমার বউয়ের বড় বোনকে তোমার জীবনে এনে দিলাম?”
তুষার লাজুক হাসলো। আমি খেয়াল করে দেখলাম, হাসলে তুষারকে একদম অন্যরকম লাগে। চেহারায় একটা শিশুসুলভ ভাব খেলা করে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখলাম তুষারকে।

আটাশ রোজার দিন ভাই ভাবি চলে এলে বাড়িটায় বিয়ের আমেজ লাগলো। সবচেয়ে অবাক হলাম আমার আমেরিকা প্রবাসী বড়ভাইকে দেখে। ভাইয়া প্রায় তিনবছর পরে দেশে এলেন আমার বিয়ের কথা শুনে। আমি ঘরের নরমাল সেলোয়ার কামিজ পরে ঘুরছিলাম দেখে মা ধমক দিয়ে নতুন শাড়ী পরিয়ে দিলো। আমার এবার লজ্জা লাগছে। এই বয়সে এসে এমন কনে সেজে ঘুরে বেড়াতে লাজে আধমরা হলেও বুকের কোথাও কিছুটা ভালোলাগাও ছুয়ে যাচ্ছে। ভাইবোনেরা ব্যস্ত আমার অনুস্ঠানের আয়োজন নিয়ে। উনত্রিশ রোজায় ইফতার শেষে সন্ধ্যায় খবর পেলাম আজ চাঁদ দেখা যায়নি। তারমানে আগামীকাল আমার বিয়ে। সবাই মিলে গোল হয়ে বসে আমার বিয়ের ঘরোয়া আয়োজন নিয়ে ফাইনাল আলোচনা করছিলো।দুইভাবি বলাবলি করছিলো আমাকে হলুদ লাগানোর কথা। এরমধ্যেই আচমকা তুষারের বাসার লোকজন হাজির। ওর তিনবোন, বোনজামাই, তাদের বাচ্চারা, তুষার আর ওর মা। ঈদের চাঁদ দেখা যায়নি তবুও ওদের দেখে মনে মনে অবাক হলাম। তুষারকে দেখলাম মুচকি হাসছে। হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরা তুষারকে দেখতে বেশ সুদর্শন লাগছে। ইচ্ছে করছে তাকে অনেক সময় নিয়ে দেখতে। বীথির গুতো খেয়ে নজর সামলে নিলাম। এতো মানুষ একসাথে দেখে বাবা মাও ঘাবড়ে গেলো কারন আমাদের কোন প্রস্তুতি নেই। তুষারের মা আম্মাকে দেখে একগাল হাসলো-
“আপা, ছেলেমেয়ের কাল বিয়ে হবে অথচ হলুদ হবেনা তাই কি হয়? তাই ছেলেকে নিয়েই চলে এলাম সারপ্রাইজ দিতে। দু’জনকে একসাথে বসিয়ে একটু হলুদ ছোঁয়াবো। আর খাবার নিয়ে একদম টেনশন করবেন না। আমরা খাবার অর্ডার করে এসেছি কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।”
“আপা, কি বলছেন? সবকিছু আপনারা করলে কিভাবে হবে? আমাদেরও কিছু করার সুযোগ দিন।”
মায়ের কথায় তুষারের মা আন্তরিক হাসি দিলো-
“বেয়ান, করার অনেক সময় পাবেন। আপাতত ওদের কথা ভাবি। আপনার আমার ভেবে আনন্দ মাটি করার কি দরকার? তিথী মা চট করে তৈরী হয়ে এসোতো একটু হলুদ ছোঁয়াবো তোমাদের।”
এমন কথার পরে আর কথা চলে না ভেবে মা চুপ করে গেলেন। তুষারের তিনবোন আমার নিয়ে ভেতরের ঘরে চলে এলো। ডালা খুলে একে একে ফুলের গহনা, স্যান্ডেল, শাড়ী বের করে আমার সামনে রাখলো। শাড়ীর দিয়ে নজর পড়তেই আমি চমকে গেলাম। এই শাড়ীটা গতদিন দেখছিলাম আমি। হালকা কালচে হলুদ শাড়ীটা খুব ভালো লেগেছিলো। আমার মনটা একদম রোদরোজ্জল আকাশের মতো ফকফকা হয়ে গেলো। মানুষটা এতোটা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে আমাকে? এই কালো আমি সত্যিই এতোটা ভাগ্যবতী! চোখ দুটো আনন্দের জলে টইটম্বুর করছে যখন তখন বৃষ্টি নামলো বলে।

#বাম_পাঁজরের_হাড়
#পর্ব-৩
© Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here