অতিথি
পর্ব:০৬
লেখা: মিশু মনি
.
কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিল মিশু।পথে মৈত্রিকে দেখে থমকে দাড়াল।এটা স্বপ্ন নাকি বাস্তব! কাজী সাহেব কোনো বার্তা ছাড়া ই এসে হাজির!
মিশু ছুটে মৈত্রির সামনে এসে দাড়াল।হাফাতে হাফাতে বলল,কি ব্যাপার কাজী সাহেব! আপনি!
– হুম।চলে আসলাম। তোমার চিঠি পড়ে আর ঘরে থাকা গেল না।
মিশু লজ্জা পেয়ে বলল,কি যে বলেন! চিঠি কবে পেয়েছেন?
– পরশু।
– ও আচ্ছা।একা কেন? মেজ বিড়াল আসেনি?
– না।ওর সাথে তো তোমার ঝগড়া। ও আসলে হয়ত ওর গায়ে বমি করে দিতে।তাই ও আসেনি।
মিশু হেসে বলল,বলেছি বলে ভয় পেয়ে আসল না? যাই হোক অনেক কষ্ট করে এসেছেন। হেটে যাবেন নাকি? অটোতে উঠুন।
– এইটুকু পথ তোমার সাথে হেটেই যাই।আর আমার কোনো কষ্ট হয়নি।
– বাব্বাহ! এত টা পথ এসেও এত্ত এনার্জি! গুড।
– এত টা পথ হলেও সময় বেশি লাগেনি।
– ঢপ মারা হচ্ছে?
– আরে আজিব তো! ঢপ মারবো কেন? আমার খুব বেশি সময় লাগেনি।গোসল করে বাসা থেকে বের হয়েছি।দেখো এখনো আমার চুল ভেজা।
– ইয়ার্কি করার জায়গা পান না?
– ইয়ার্কি করবো কেন?
– দেখুন আমাকে রাগাবেন না।
– রাগাচ্ছি কোথায়?
– তাছাড়া কি? আপনি ঢাকায় গোসল করে গাড়িতে উঠেছেন আর রংপুর এসে বলছেন এখনো চুল ভেজা? ফাজলামো হচ্ছে?
– কথার কথা বললাম।
– কথার কথা কেন বলবেন? কোনো দুই মাস বয়সের বাচ্চাও এটা বিশ্বাস করবে না বুঝলেন?
– মিথ্যে তো বলিনি।
মিশু রেগে বলল,এসেই এমন শুরু করেছেন?
– তুমি আমার কথা টা বোঝার চেষ্টা করো শিশু।আমি প্লেনে এসেছি।
– আচ্ছা সরি।আমি এটা ভাবিই নি যে আপনি প্লেনে আসতে পারেন।
– তুমি তো শিশু।কিছু বলার আগে ভেবে নিবা।আর রাগার আগে বুঝে নিবা।
মিশু চুপ করে গেল।বাকি টা পথ আর কোনো কথাই বলল না।
.
খেতে বসে মিশুর বাবা মিশুকে বললেন,মৈত্রি তোমাকে নিতে এসেছেন।ওর সাথে যাও।কিছুদিন ঘুরে আসো।
মিশু খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলল,সত্যি! বেড়াতে যাবো! কি মজা!
– হুম।কালই যেও।
– আর কেউ যাবেনা? আমি একা যাবো?
– হ্যা।সপ্তাহ খানেক পর আমি আর তোমার মা গিয়ে তোমায় নিয়ে আসবো।
মিশুর আনন্দ যেন আর ধরেই না।ও এমনিতেই ঘুরতে ভালবাসে।তারউপর কাজী সাহেব দের বাসায় গেলে তিন বিড়াল কেই খুব জব্দ করা যাবে।
মিশু বলল,আব্বু আমি তাহলে জামা কাপড় গুছিয়ে নিই?
– হ্যা নাও।
মিশু আর খেতেই পারল না।তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে রুমে এসে ব্যাগ গোছানো শুরু করে দিলো।
.
পরদিন সকালেই মৈত্রি মিশুকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ল। মিশু ভীষণ খুশি।ওর আনন্দ দেখে মৈত্রির ও খুব ভালো লাগছে।মৈত্রি চেয়েছিল বিমানে যেতে।কিন্তু মিশু এত কম সময়ের জার্নি চায়না।সারাদিন বাসের সিটে বসে ক্লান্ত হওয়ার মাঝেই অন্যরকম মজা।অগত্যা মৈত্রিকেও রাজি হতে হলো।
বাসে উঠে মিশু জানালার পাশে বসে পড়ল।মৈত্রি পাশে বসতেই ও বলল,এক টানা আট ঘণ্টা আপনি আমার পাশে বসে থাকবেন?
– হ্যা থাকবো।আপত্তি আছে?
– আপত্তি থাকলে কি সিট চেঞ্জ করবেন?
– হ্যা।
– থাক বাবা।তখন আবার কোন বুড়াকে আমার পাশে বসিয়ে দিবেন। দরকার নেই।
মৈত্রি হেসে বলল,কিছু কিনে নিতে হবে?
– হ্যা হবে।
– কি?
– আইসক্রিম, চিপস, চকোলেট আর চুইংগাম বিশ টা।
– বিশ টা!
– মুরগির বিষ্ঠা নয়।বিশ টি চুইংগাম।
মৈত্রি হেসে বলল,আমি কি বলেছি মুরগির বিষ্ঠা? সবসময় বেশি বুঝো।
– হ্যা বুঝবো। কারন আমি শিশু।এখন যান,এগুলা কিনে নিয়ে আসুন।ভ্যানিলা আইসক্রিম কিন্তু।
– আচ্ছা।
.
মৈত্রি পাচ প্যাকেট চিপস,দুই টা আইসক্রিম, এক বয়াম চুইংগাম,চল্লিশ টা বিভিন্ন প্রকার চকোলেট আর অনেক গুলা চাটনি নিয়ে এসে হাজির!
যাত্রীরা সকলেই অবাক হয়ে দেখছে আর হাসছে।মিশু দেখে তো একদম থ!
মৈত্রি বলল,নাও।কত খাবা খাও।
মিশু হেসে বলল,আমি তো ভেবেছিলাম হকার এসেছে!
মৈত্রি বলল,নাও এগুলা।
মিশু সবগুলা খাবার নিয়ে ব্যাগে ভরে রাখল।তারপর বলল,পুরো দোকান টাই তো কিনে এনেছেন।
– হ্যা আনলাম।
– আমিতো ভাবলাম আপনি গাড়ি তেই ব্যবসা করবেন। হকারি!
– তুমি সবসময় এমন অদ্ভুত চিন্তা ভাবনা করো কেন? আমি এখন হকারি করবো?
মিশু হেসে বলল,দারুন লাগবে।
– আচ্ছা।যখন খেতে খেতে অরুচি ধরে যাবে,তখন বিক্রি শুরু করে দিবো।
মিশু হেসে আইসক্রিম খেতে শুরু করে দিলো।
.
বাস ছেড়ে দিলো। মিশু আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে।এই প্রথম ও বাবা মা ছাড়া অন্য কারও সাথে বেড়াতে যাচ্ছে।খুব ভালো লাগছে মিশুর।
মৈত্রি হেডফোন বের করে মিশুকে দিয়ে বলল গান শোনো।
-দিন।
ইতিমধ্যেই মিশুর আইসক্রিম খাওয়া শেষ। মৈত্রি এখনো এক তৃতীয়াংশ ও খেতে পারেনি।মনে মনে ভাবছে মেয়ে টা কি আইসক্রিম খাদক নাকি? কয়েক মিনিটেই আড়াইশ টাকা খেয়ে ফেলল!
মিশু গান শুনে খুব পুলকিত। মৈত্রিকে ধন্যবাদ জানিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।
মিশু জানালায় মাথা রেখে বাইরে তাকিয়ে আছে।বাতাসে চুল উড়ে মৈত্রির মুখে পড়ছে। মিশুর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।ও একমনে গান শুনছে আর ভ্রমণ উপভোগ করছে।
এলোমেলো ভাবে চুল গুলো উড়ছে, মিশু আনমনা হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।ওকে দেখে মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে ওর মত খুশি আর কেউ নেই।মুখে প্রশান্তির ছাপ!
মৈত্রি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে মিশুর মুখের পানে! এখন মেয়েটিকে আর শিশুসুলভ লাগছে না।মনে হচ্ছে সুখী একজন তরুণী যে সবকিছু নিয়ে অনেক আনন্দিত!
মিশু হঠাত পাশ ফিরে মৈত্রিকে বলল,আর্টসেলের গান আমার ভাল্লাগেনা। চেঞ্জ করে দিন।
মৈত্রি চমকে উঠে বলল,দিচ্ছি।
– থাংকু।আর এতক্ষণ হা করে কি দেখছিলেন আমার দিকে?
মৈত্রি লজ্জা পেয়ে বলল,কই কিছু না তো।
– মিশু সব বুঝে হুম।আমার দিকে অনেকক্ষন চেয়েছিলেন।অবশ্য আপনার দোষ নেই,পাশে সুন্দরী মেয়ে থাকলে তো দেখবেন ই।
মৈত্রি কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
মিশু বলল,দেখুন।কিন্তু কাজী সাহেব কিছু ভাবার আগে এটা মনে করবেন যে,আপনি আমার তের বছরের সিনিয়র।
মৈত্রি অবাক হয়ে বলল,কি ভাব্ব? আজিব তো!
– আমি কিন্তু বড় হচ্ছি।সবই বুঝি কিন্তু।
মৈত্রি হাসল।মেয়েটি বাচ্চাদের মত হলেও অনেক পাকা পাকা কথা বলতে পারে! অদ্ভুত মেয়ে!
.
মিশু মৈত্রির হাতে একটা চুইংগাম দিয়ে বলল,নিন চিবোন।
– থ্যাংকস।
– হুম।চিবিয়ে বল ফুলান দেখি।
– বল মানে!
মিশু বাবল গাম ফুলিয়ে দেখাল।- এইভাবে বল ফুলান দেখি আমার মত।
মৈত্রি হেসে বলল,আনএবল।
– পারেন না বাবল গাম ফুলাতে?
– নাহ।
মিশু কয়েকবার দেখিয়ে দিয়ে বলল এইভাবে ফুলান।পাড়বেন।
মৈত্রি অনেক চেষ্টা করেও বল ফুলাতে পারল না।মিশু হেসে ঢলে পড়ছে।
মৈত্রি কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো।কিছুতেই হচ্ছেনা।অবশেষে মুখ থেকে চুইংগাম টা পড়েই গেল।
মিশু আবারো একটা চুইংগাম বের করে মৈত্রির হাতে দিলো।
মৈত্রি বলল,আমি পারবো না।
– আপনাকে তো ডিম পারতে বলিনি।না পারার কিছুই নেই।বিদেশ ফেরত ডিগ্রিধারি,শুধু পড়াশুনাই শিখেছে আর কিচ্ছু শেখেনি।রামগাধা কোথাকার।বল ফুলান।
মৈত্রি আবারো বাবল গাম মুখে দিয়ে জিভ দিয়ে চেষ্টা করতে লাগল।
.
মিশু বলল,আচ্ছা কাজী সাহেব একটা প্রশ্ন করি?
– হুম করো।
– জার্নি প্রিয় একজন দার্শনিক ছিলেন।যিনি ভ্রমণ করতে খুব ভালবাসতেন।কয়েকদিন পরপর ই তিনি ট্রেন, বাস,আর বিভিন্ন যানে ভ্রমন করতেন।জানালার পাশে বসে প্রকৃতি দেখতে খুব ভালবাসতেন।বিয়ে করলে বউকে জানালার পাশের সিট টা দিয়ে দিতে হবে বলে তিনি কখনো বিয়েই করেন নি।আমার প্রশ্ন হচ্ছে এই দার্শনিকের নাম কি?
মৈত্রি কিছুক্ষণ ভেবে বলল,বলতে পারছি না।
– কি জানেন তাহলে? আসলেই আপনার মাথায় সার আছে।গোবর সার।
মৈত্রি বলল,গোবর সার অনেক উপকারী। জমির উর্বরতা বাড়ায়।
– সে জন্য বুঝি আপনার মস্তিষ্ক উর্বর করতে পারেনি?
মৈত্রি হাসল।
.
মিশু আবারো জানালায় মাথা রেখে বাইরে তাকাল।
মৈত্রি ফোন বের করে ফেসবুক চালানো শুরু করল।
আবারো মিশুর চুল এসে ওর মুখে পড়ল।মেয়েটার লম্বা চুল গুলো যেন আজ বাঁধনহারা হয়েছে।
মৈত্রি কয়েকবার মিশুকে ডাকল।কিন্তু মিশু জোরে সাউন্ড দিয়ে হেডফোনে গান শুনছিল বলে শুনতে পায়নি।
মৈত্রি একটা ধাক্কা দিয়ে বলল,এই মিশু,
মিশু পাশ ফিরে তাকাল,হ্যা বলুন।
– হেডফোন টা খুলে রাখো। গল্প করি।
মিশু হেডফোন টা খুলে বলল,কি গল্প? বলুন
– তোমার চুলের গন্ধে আমার ঘুম এসে যাচ্ছে।
– হা হা।ঘুমান তাহলে।আমার বমি পেলে কিন্তু আপনার কোলে বমি করে দিবো।
– ছি ছি।এমন টা কোরোনা।ওটা তো মর্মর গায়ে করে দেয়ার কথা।
– এমনি বললাম।আমার বমি করার অভ্যাস নেই।
– আচ্ছা।ভালো মেয়ে।
মিশু একটা চিপস বের করে খাওয়া শুরু করল।একটু পরপর মৈত্রির দিকে এগিয়ে দিচ্ছে।কেবল তখন ই মৈত্রি চিপস খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।কিন্তু মৈত্রির ভীষন ভালো লাগছে।
.
– কাজী সাহেব
– হ্যা বলো
– জার্নি কেমন লাগছে?
– খুউউউউব ভালো। দারুন উপভোগ করছি।
– আপনি তো প্লেনে যেতে চেয়েছিলেন।প্লেনে গেলে কি এত্ত ভালো লাগত?
– কখনোই না।তোমাকে অসংখ্য থ্যাংকস মিশু।রিয়েলি খুব ইনজয় করছি।
– আমার গান গাইতে ইচ্ছে করছে।
– গাও…
– হুম।কিন্তু আপনাকে শুনাবো না।
.
মিশু জানালায় মাথা রেখে বাইরে তাকিয়ে আপন মনেই গান গেয়ে উঠল।গানের হালকা সুর মৈত্রির কানে ভেসে আসছে।মৈত্রি মিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।খুব ভালো লাগছে ওর।একটা বাস ভ্রমণ যে এতবেশি ভালোলাগার হতে পারে সেটা ও জানত না।হয়ত মিশুর গুনেই সেটা সম্ভব হয়েছে….
( চলবে….)