#জলছবি
#পার্ট_২২
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
শ্রেয়া, নিষাদ, সৃজন তিনজন ক্যাম্পাসে নিজেদের ভবনের সামনে বসে রইলো। শ্রেয়া রাহাতের সাথে নিচু স্বরে কথা বলছিল। নিষাদ নিশিতার সঙ্গে চ্যাটিং এ ব্যস্ত।
হঠাৎ-ই ফুঁসে উঠে বলল,
“ধুর ছাতারমাথা! কি করিস তোরা? এইখানে প্রেম-ট্রেম করার জন্য আসছিস? আমি অনাথের মতো বসে আছি চোখে দেখস না? ভালোয় ভালোয় পিরিতের আলাপ থামা কইলাম। নইলে সামনের থেইকা সর দুইটায়।”
সৃজনের হুংকারে শ্রেয়া প্রায় সাথে সাথেই ফোন কেটে দিয়ে অসহায়ের মতো করে চায়। অতি অল্পে ভয়ে ডুবে যাওয়াটাই মেয়েটার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নিষাদ নিজের কর্মকান্ডে পরিবর্তন না এনে, আগের মতো থেকেই বলে,
“কেন মনা? তোমার ইনা, মিনা, টিনারা বুঝি পাত্তা দিচ্ছে না? অবশ্য একসাথে এত লাইন মারলে কি আর পাত্তা পাওয়া যায়?”
সৃজন প্রতিবাদ করার আগেই লুবনা এসে উপস্থিত হলো। শ্রেয়ার পাশে বসতে বসতে বলল,
“ফয়সাল আসে নাই?”
সৃজন তার বিগড়ে থাকা মেজাজের ঝাজ মেটাতেই অমিষ্ট কন্ঠে বলে,
“আইছে আরেকজন ফয়সাইল্লারে খুঁজতে! ক্যান ভাই? আমাদের চোখে পড়ে না?”
ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল দৃষ্টিতে সবার দিকে একবার একবার চাইল। তারপর বিস্মিত কন্ঠে বলল,
“কিরে ভাই? এই পাগলের আবার কী হইলো? এমন করে ক্যা?”
নিষাদ চোখ দু’খানা ফোনে আবদ্ধ রেখেই বলে,
“কারন তাকে কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। মনে দুঃখে পাগল হয়ে গিয়েছে বেচারা!” চোখমুখ জুড়ে মিটিমিটি হাসি। বন্ধুকে রাগাতে পারা যেন বড় আনন্দের বিষয়।
সৃজন ক্ষেপে গিয়ে, অনেকটা হুশিয়ার দেয়াএ মতো করে বলে,
“দেখ নিষাদ? বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু….!”
“চিল ব্রো! ওদের কথা কানে নিচ্ছিস কেন? জানিস না? ভালো ছেলেদের কেউ পাত্তা দেয় না!”
সৃজনের কাঁধে হাত রেখে কথাটা বলতে বলতেই সৃজনের পাশে বসে ফয়সাল। কৃষ্ণবর্ণ মুখটা হাসিতে চকচক করছে তখন।
লুবনা ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে বলে,
“তুই কোন দলে? পাত্তা পাওয়ার নাকি না পাওয়ার।”
ফয়সাল শার্টের কলার উঁচিয়ে বলে,
“ডেফিনেটলি আমি যেহেতু ভালো মানুষ সেহেতু পাত্তা না পাওয়ার দলেই। তাই তো সৃজুর দুক্কু-টুক্কু বুঝি।”
“ওহ! রিয়েলি? তো কয়জনের সাথে ফ্লার্টিং করেছেন আর কয়জন পাত্তা দেয়নি শুনি?” লুবনার প্রশ্ন।
ফয়সাল ছন্নছাড়া ভাব নিয়ে বলে,
“কতজনই তো আছে। গুনে রাখছি নাকি?”
রাগে শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। কিছু বলবে তার আগেই ফয়সাল দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে একটু দূরের কাউকে ডাকে,
“এই দিয়া?”
সদ্য আঠারো পেরোনো ভীষণ স্মার্ট একটা মেয়ে। কারো মুখে নিজের নাম শুনে দাঁড়াল। প্রথমে চমকালেও ফয়সালকে দেখে স্বস্তি পেলো। র্যাগিং-ফ্যাগিং এর ভয় পেয়েছিল হয়তো।
ফয়সাল কাছে এসে বলে,
“কেমন আছ তুমি?”
“ভালো আছি। আপনি?”
“আলহামদুলিল্লাহ্। তো, এই কলেজে এডমিশন নিলা নাকি?”
“জ্বী ফিজিক্সে।”
ফয়সায় ভয় পাওয়ার মতো করে বলে,
“ওরে বাবা! ফিজিক্স!”
মেয়েটা মৃদু হাসে।
দূর থেকে দুজনকে বেশ হেসেখেলে কথা বলতে দেখে সামান্য হিংসে অনুভব করল লুবনা। তড়িত গতিতে এগিয়ে এসে বলল,
“ফার্স্ট ইয়ার? যাও ক্লাসে যাও। এখানে কিসের কথা? যাও যাও।”
দিয়া প্রথমে বুঝে উঠে পারেনি। যখন বুঝলো তখন কেবল একবার অসহায় দৃষ্টিতে ফয়সালের দিকে চাইল। ফয়সাল লুবনাকে বলে,
“আশ্চর্য! চলে যেতে বলছিস কেন? কথা বলছি দেখছিস না?”
লুবনা ফয়সালের কথা কোনোরূপ পাত্তা না দিয়ে পুনরায় মেয়ে টাকে বলল,
“কি হলো? যাচ্ছ না যে?”
মেয়েটা একটু কাঁচুমাচু করে চলে গেল।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে লুবনা অগ্নিদৃষ্টিতে ফয়সালের দিকে চায়। ফয়সাল মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,
“আজব তো! এমনে তাকাস ক্যান?”
লুবনা একটু ঝুকে এসে বলে,
“নেক্সট টাইম শুধু তাকাব না। জাস্ট চোখ দুটো গেলে দিবো!”
বলেই বাকিদের দিকে চায়। ফয়সাল নিচের চোখে হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
“কি সাংঘাতিক কথাবার্তা!”
তারপর কি মনে হতেই হাঁক ছেড়ে জিজ্ঞেস করে,
“এই নোলক আসে নাই এখনও? কথা ছিলো ওর সাথে!”
.
রেস্টরন্টের কৃত্রিম আলোর ঝলকানির এক অংশ এসে পরে নোলকের মিষ্টি মুখটাতে। তার মন জুড়ে অস্থিরতা। কেন ডেকেছে তিনি? নোলকের কাছে কি তার? ওর খোঁজ-ই-বা কি করে পেলো?
হাতের ঘড়িটাতে একবার চোখ বুলিয়ে উঁকি মেরে দেখল, এলো কি-না! না আসেনি।
সেদিন হোস্টেলে আদ্রর বইটা ফেরত দিতে গিয়ে, এক পলক দেখেছিল কেবল। যদিও খুব ভালো মনে নেই মুখটা তবে দেখলে চিনতে পারবে। নোলক রেস্টরন্টের অন্য লোকদের দিকে চোখ বুলাচ্ছিল ঠিক তখনই পাশ থেকে একটা কমল কন্ঠস্বর ভেসে আসলো,
“তুমি নোলক?”
নোলক হকচকিয়ে তাকায়। সিল্কের হালকা কুরুকাজ করা শাড়ি পরিহিত স্নিগ্ধ এক রমনী। মুগ্ধ হওয়ার মতো স্নিগ্ধতা সারা মুখজুরে। নোলক সায় জানিয়ে বলে,
“জ্বী। নোলক আমি।”
মেয়েটা মিষ্টি করে হাসে। নোলকের সামনাসামনি বসে। নোলকের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুমি আমার ছোটই হবে, তাই তুমি করে বলছি। কিছু মনে করো না। আমি আরশি। তুমি চিনবে না সম্ভবত।”
“অসুবিধে নেই। তবে আমি ‘আপনায় চিনি না’ কথাটি পুরোপুরি ঠিক না। আমি আপনায় একটু চিনি।”
আরশি ভ্রুকুটি করে চাইলো। অবাক হওয়ার মতো মুখ করে জানতে চাইলো,
“চিনো? আদ্র বলেছে?”
“না। তিনি বলেননি।”
“আদ্র বলেনি? কখনো কিছুই বলেনি আমায় নিয়ে?”
নোলকের মন ক্রমশ আহত হতে আরম্ভ করেছে। সে মুখে বিষন্ন হাসি এঁকে বলে,
“না বলেনি, এবং না বলাটাই স্বাভাবিক। তার সঙ্গে আমার তেমন বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই, যার যের ধরে সে তার ব্যক্তিগত কিছু শেয়ার করতে পারে। বোধকরি আপনি তার জীবনের ব্যক্তিগত কেউ। যার ব্যাপারে সে যাকে-তাকে বলে বেড়াবে না। তাই নয় কি?”
আরশির মুখের লেগে থাকা হাসি মিলিয়ে যায় এবার। উপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। খানিক বাদে বুক ভরে শ্বাঃস নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,
“ব্যক্তিগত কেউ? হ্যাঁ, ছিলাম হয়তো!”
এবার নোলকের অবাক হওয়ার পালা। জিজ্ঞেস করে,
“ছিলেন? আর এখন?”
আরশি হাসে। ব্যার্থতা মিশ্রিত হাসি। বলে,
“এখন কেউ নই।আমি তার। দু’বছর আগ অব্দি হয়তো ছিলাম কেউ একজন। একটা শান্তশিষ্ট ছেলের খুব কাছের কেউ।”
নোলকের কপালের ভাঁজ আরো বিস্তৃত হয়। চোখেমুখে প্রশ্ন খেলে। আরশি নিজ থেকে বলতে শুরু করে,
“আমাদের ডিপার্টমেন্ট একই ছিল। সেই সুবাদেই ওকে অনেকটা কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল, সখ্যতা গড়ে তোলার শুযোগ পেয়েছিলাম। ওর সবার থেকে ব্যাতিক্রমী স্বভাব। গুরুগম্ভীর ভাবটা আমায় খুব টানতে থাকে। ইশান আর দ্বীপ ছাড়া কারো সাথে খুব একটা কথা বলতেও দেখতাম না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে কেবল জবাব দিত, টুকটাক কথা বলতো। যেন ওর কথা বলার পরিধি খুব কম! আমি লক্ষ্য করতাম সব। নোটিস করতে করতে একসময় মুগ্ধ হতে শুরু করি। আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই আগ বাড়িয়ে। বিভিন্ন নোট’স, সাজেশন ওর কাছ থেকে নিতে থাকি। আদ্রও কিন্তু খুব একটা বিরক্ত হতো না। কাছে যেতে বাঁধা দিতো না। যত সময় আগালো ততো ক্লোজ হলাম। ভালো বন্ধু অতঃপর কাছের কেউ একজন। বুঝতেই পারছ? ওর মতো ইনট্রোভার্ট একটা ছেলে কখনই মন খুলে মনের কথা বলবে না। আমিই বলেছিলাম। সে বলেছিল ‘ফ্যাসিনেইশন’। আমি জোর দিয়ে বলেছিলাম, ‘নো, দিস ইজ নট ফ্যাসিনেইশন!’
এর ঠিক এক বছর পরই তার উপর থেকে মুগ্ধতা হারিয়ে অন্যকেউতে আকৃষ্ট হলাম। তখন আদ্রর কম জোরে বলা কথাটাই সঠিক বলে প্রমাণ হলো। ওর যেই স্বভাবটা আমায় আকৃষ্ট করছিলো, যেই জিনিস গুলোতে মুগ্ধ ছিলাম সেই জিনিস গুলো বিরক্ত লাগতে আরম্ভ করলো। মনে হতে লাগলো যাকে নিয়ে আমি পসেসিভ সে আমায় নিয়ে উদাসীন! এর আগে কিন্তু মনে হয়নি এসব, বরং ও এমন বলেই ভালো লেগেছিল। কিন্তু এরপর থেকে ওর এই স্বভাবই আমার অসহ্য লাগতে শুরু হলো, অসহ্য লাগতো আদ্রকে। কারন ততদিনে ওর উপর আমার মুগ্ধতা কাটতে আরম্ভ করেছিলো। উল্টো মুগ্ধতাগুলো তিক্ততায় পরিনত হচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল ওকে আমার ছেড়ে দেয়া উচিত। করলামও তাই। ছেড়ে দিলাম। ছেড়ে চলে এলাম। যেদিন তার কাছে নিজ থেকে গিয়েছিলাম সেদিনও বাঁধা দেয়নি যখন ছেড়ে চলে এলাম সেদিনও! ছেলেটা এমনই। কোনো কিছু নিয়েই তেমন রা-শব্দ করে না, মনে রাখে। এই মানুষগুলোর দুঃখের তেজ এত প্রখর হয় নোলক! তুমি কল্পনাও করতে পারবে না! চলে আসার সময় আদ্র’র সেই অদ্ভুত হাসির দুঃখ তখন বুঝিনি, এখন বুঝি।”
এতটুকু বলে থামল আরশি। নোলকের কানে প্রতিটা শব্দ বিস্ফরণের মতো ফুটতে লাগলো। সামনে বসা অসম্ভব রূপবতী মেয়েটার প্রতি ভয়ানক রাগ হচ্ছে। কি আশ্চর্য, রাগ কেন হচ্ছে?
আরশি একটু দম নিয়ে আপন মনে বলতে লাগলো,
“বিয়ে করে নিলাম সেই ছেলেটাকে, যার প্রতি মুগ্ধতা তৈরি হওয়ার পর আদ্রর প্রতি মুগ্ধতা কেটে গিয়েছিলো। সে এখন আমার হাজবেন্ড। তাকে আমি সত্যিকার অর্থে ভালোবাসি। এই দুই বছরে তার শত অবহেলার পরও তাকে ছেড়ে আসতে পারি না, কারণ সে আমার ফ্যাসিনেইশন না। চাইলেই ছাড়া যায়া না, মায়ায় জড়ানো মানুষগুলোকে। আমার কি মনেহয় জানো? আদ্রকে করা সেই দুঃখের শাস্তি স্বরূপ আমার সুখ নেই। যার প্রতি মায়ায় জড়িয়ে আদ্রকে ছেড়ে এসেছি সে আমায় প্রতিনিয়ত হেয় করে বেড়ায়। ক্ষেত্র বিশেষে কাছে আসে। বোধহয় আমার প্রতিও তার মোহ কেটে গিয়েছে।”
আরশি একটু থেমে বলে,
“আমি জানি তোমার মনে অনেক প্রশ্ন, তোমায় কেন এসব বলছি? আদ্রর সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ-ই-বা কেন করছি? তোমাকে জানলাম কি করে? সব বলবো সব। মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে আর পাড়ছি না। ঘুমাতে পারি না শান্তিমতো। শুধু অপরাধবোধ তাড়া করে বেড়ায়।”……..(চলবে)