#জলছবি
#৫ম_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
নোলক কাঁপাকাঁপা হাতের উল্টোপাশ দিয়ে কপাল থেকে গাল অব্দি তৈরি হওয়া ঘাম গুলো মুছলো।
বাহিরের লাল-নীল, সবুজ বাতির আলোয় খুব ভালো মতোই দেখা যাচ্ছে নোলকের মুখখানা। ভয়ে চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে বেশ মায়া-ই হলো আদ্র’র। সে নোলকের ভয় কাটাতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। নিজের বা’হাতটা নোলকের সম্মুখে ধরে বলে,
“একটু ছুঁয়ে দেখুন। ভয়ের কিছু নেই। রিল্যাক্স নোলক।”
নোলক বাধ্য মেয়ের মতো আদ্র’র মুষ্ঠিবদ্ধ করে রাখা হাতটায় ছুঁয়ে দিয়েই হাত সরিয়ে ফেললো। আদ্র সেই আবছা আলোতেই সুন্দর করে হেসে বলে,
“দেখলেন তো? একদমই ভয়ের কিছু নেই।”
নোলকের ভয় কেটেছে কি কাটেনি তখনও স্পষ্ট নয় আদ্র’র কাছে।
লুবনার ঘুম ভেঙে গিয়েছে ততক্ষণে। সে বিছানার থেকে নেমে রুমের লাইট জ্বালিয়ে নোলকের কাছে এসে দাঁড়ায়। রুমের লাইট জ্বালানোর পরই মনের ভয় খানিক দূর হয় নোলকের। লুবনা ঘটনা কিঞ্চিৎ অনুমান করতে পেরেও জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে? সমস্যা নোলক?”
নোলক কাপাকাপা গলায় শুধু বলে,
“পা..প..পানি খাবো। এ..একটু পানি!”
আদ্র বলে,
“আমি আনছি।”
লুবনা বাধা দিয়ে বলে,
“না ভাইয়া। রুমেই পানি আছে।”
বলেই সে নোলককে নিয়ে রুমের ভেতর যায়। গ্লাসে পানি ঢেলে পানি দেয়। নোলক ঢকঢক করে পানি পান করে। যেন কত দিনের তৃষ্ণার্ত সে। আদ্র’র সত্যিই খুব খারাপ লাগলো। নোলকের রুমের ভেতর আর না যেয়ে নিজের রুমে চলে আসে। মনে মনে ঠিক করে আর কখনোই রাতের বেলা কারো রুমের সামনে পায়চারী করবে না।
লুবনা বারবার স্যরি বলে, লাইট অফ করে ফেলার অনুতাপে। লাইট অন থাকলে সে ঘুমাতে পারে না বিধায় অফ করে দিয়েছিলো। নোলক কোনো কথাই বলে না আর। নিজের জায়গায় ঘাপটি মেরে শোয়। ঘড়ির দিকে চোখ যেতে দেখে, তিনটা চল্লিশ বাজে! লোকটা এতক্ষণ জেগে থাকলে ঘুমায় কখন?
.
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই বিয়ে বাড়ির আমেজ শুরু হয়ে গেলো। বাড়ি ভর্তি হয়ে গেলো পাড়াপড়শি দিয়ে। শাঁকের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো নোলকের। রাতের ঘটনা ভুলে গেলো ক্ষনিকের জন্য। রুম থেকে বেড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। মধ্যবয়সী মহিলাগুলো সব লাল পাইরের সাদা শাড়ি পরিহিত। হাতে শাখা-পলা, কপালে সিঁদুর। সবাই শ্রীতমাকে কেন্দ্র করে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা ঘুমুঘুমু চোখ মেয়ে তাকায়, আবার বুজে ফেলে। শ্রেয়া আর লুবনা এসে দাঁড়ায় নোলকের পাশে। প্রশ্ন করে,
“কিরে? নিচে যাবি না? তৈরি হসনি যে?”
নোলক তাকায়, দেখে দুই বান্ধবীর সুন্দর সাজ। দুজনই লাল শাড়ি পরেছে। তারও লাল শাড়ি পরার কথা।
নোলক মাথা নাঁড়িয়ে জানায় সে এখন নিচে যাবে না। একটু পর যাবে।
“আচ্ছা, এখানেই থাক তবে। আমরা যাই।”
বলেই শ্রেয়া আর লুবনা নিচে চলে আসলো।
বড় বড় মানুষগুলোকে লাল পাইড়ের সাদা শাড়ি পরতে দেখে, তারও এই সেইম শাড়ি পরতে ইচ্ছে হলো। মুখে হাসির রেখা ঝিলিক মারে। আনমনে ভাবে, ভাগ্যিস আসার সময় নবনীর শাড়িটা নিয়ে এসেছিলো।
শাড়ি পরে, দুই হাত ভর্তি চুরি, কোমরে বিছা আর পায়ে নূপুর, দুচোখ জুড়ে কাজল রেখা। এই সাজেই কি স্নিগ্ধ লাগে মেয়েটাকে।
সাজ শেষে সিড়ি দিয়ে নামতেই মুখামুখি হয় ইশানের। তার হাতের ক্যামেরা খানে পরে যেতে লাগলে নিজেকে সামলে নিয়ে ধরে ফেলে। মুগ্ধতা নিয়ে শুধু বলে,
“অগ্নিশর্মা! সত্যিকারের অগ্নিশর্মা লাগছে।”
নোলক কপাল কুঁচকে তাকায়। এই ছেলেটাকে তার একদমি ভালো লাগে না। দুই বন্ধুই বিরক্তিকর। নোলক বলে,
“দেখি সরুন, যেতে দিন আমায়।”
ইশান সরে দাঁড়ায়। নোলকের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বিরবির করে বলে,
“উফফ! জ্বালিয়ে দিলো আগুনে!”
ডেকোরেশনের লোকেরা ফুল লাগাচ্ছে। গোলাপ, গাঁদা আর রজনীগন্ধার ঘ্রানে পুরো বাড়ি সৌরভ ছড়াচ্ছে।
নোলক আলপনা দিচ্ছে। ওর পাশেই বসে আছে শ্যামা। সে আলপনা নয়, দেখছে নোলককে। শেষমেশ না পেরে বলেই ফেলে,
“দিদিমুনি, আপনে মেলা সুন্দর। সরস্বতীর মতো!”
নোলক হাসে। হাতে রং নিতে নিতে বলে,
“তোমার থেকে বেশি নই। তোমার মুখে কত মায়া জানো? যে কেউ মায়ায় পরে যাবে।”
শ্যামা অবাক হয়ে ভাবে, “এই মেয়ে বলে কী?”
.
শ্রীতমাকে মেহেদী দেয়া থেকে শুরু করে বিয়ের সাজ অব্দি সবকিছুই নোলক করেছে। মাঝেসাঝে আবার একটু-আকটু জ্ঞানও দিয়েছে। ‘বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে পড়াশোনা বন্ধ করে দিবে এমন যেন না হয়’ বলে হুশিয়ারও করে দিয়েছে। বিয়ে সম্পূর্ণ হওয়ার আগ অব্দি কেবল সে ছুটোছুটিই করেছে। যেন পুরো বিয়ে বাড়ির দায়িত্বটাই ওর উপর।
প্রথম বারের মতো আদ্র অনুভব করলো। নোলকের এইটুকু চঞ্চলতা না থাকলে বিয়ে বাড়ির আমেজটা ফুটে উঠতো না বোধহয়। এতটুকু চাঞ্চল্য নিজের মাঝে রাখাই যায়।
তার ভাবনা শেষ হতে না হতেই সিড়ি ঘর থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসলো। আদ্র উৎকন্ঠা নিয়ে এসে দেখলো, নোলক সিড়িতে বসে আছে আর তাকে ঘিরে বেশ কয়েকজন উদগ্রীব মানুষ। তাদের হায়হায়, ওহ-হো’র কারন প্রথমে ধরতে পারেনি আদ্র। নোলকের হাতের দিকে চোখ যেতেই যেন সে চমকে উঠলে। কাচের চুরিগুলো সব ভেঙে নিচে পরে আছে আর নোলকের হাত জুড়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। আদ্র ভীড় ঠেলে নোলকের কাছে এসে ওর হাত চেপে ধরে। ভীত কন্ঠে বলে,
“হায় আল্লাহ্! আপনার তো হাত কেটে গিয়েছে! এতো রক্ত!”
সামনের মানুষগুলোকে ধমকের সুরে বলে,
“ভারী অদ্ভুত তো আপনারা। এদিকে রক্তে মেয়েটার হাত ভেসে যাচ্ছে আর আপনার জাস্ট দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উৎকন্ঠা প্রকাশ করছে?”
একজন জবাব দিলো,
“আমরা কি করতাম? সে তো হাত-ই ধরতে দিতেছে না।”
আদ্র বুঝতে পারে এই মেয়ের দ্বারা সবই সম্ভব।
নিষাদ, ফয়সাল, সৃজন, লুবনা সহ সবাই এসে হাজির হয় সেখানে। এত রক্ত দেখে সবাই-ই ভয় পেয়ে যায়। নিষাদ ফাস্টএইড বক্সটা এগিয়ে দেয় আদ্র’র দিকে। আদ্র দ্রুত বক্স থেকে মেডিসিন বের করে হাতে লাগায়। চুড়ি ভেঙে হাতে ঢুকে গিয়েছে কয়েক টুকরা। সেগুলো বের করার সময় আদ্র নিজেও নিজের চোখ বন্ধ করে ফেলে। উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ব্যথা লাগছে?”
নোলক মাথা নেড়ে বলে,
“একটু।”
ফয়সাল জিজ্ঞেস করে,
“কেমনে এমন হলো?”
নোলক অপরাধী মুখ করে বলে,
“বর চলে এসেছে, সবাই দেখতে চলে গিয়েছে, তাই আমিও তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়েছি।”
বন্ধুরা সবাই সমস্বরে বিস্ময় নিয়ে বলে,
“বর দেখতে?”
কেবল ফয়সাল বলে,
“হ্যাঁ, ঠিকই আছে। তোমার কাছে এর থেকে বেশি কিছু আশা করাও সম্ভব না। পড়ে যে মাথা-টাথা ফাটাস নি এটাই অনেক। উই আর সো গ্রেইটফুল।”
নোলক কাটখোট্টা ভাবে বলে,
“তো বর দেখবো না? আশ্চর্য!”
ড্রেসিং করতে করতেই আদ্র হালকা স্বরে বলে,
“হুম, বর তো পালিয়ে যাচ্ছে। সে না দেখলে কেমন করে হবে? বর দেখতে হবে না? এটা তো খুবই মহান একটা কাজ। ফাজিল মেয়ে!”
বাকিরা মুখ টিপে হাসে। নোলক কপাল কুঁচকে তাকায়। শেষের কথাটা আদ্র আস্তে বললেও শুনতে পায় নোলক। তবে সব সময়কার মতো চেঁচামেচি না করে জিজ্ঞেস করে,
“এই যে? আপনি আমায় ফাজিল বলেছেন?”
আদ্র চশমার ফাঁকে একবার তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মন দেয়। নিষাদ এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে বলে,
“কার ঘারে কয়টা মাথা যে তোরে ফাজিল বলবে? শেষমেশ দেখা যাবে বেচারা ঘারহীন মানব হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে!”
সবাই মুখ টিপে হাসে কেবল আদ্র ব্যাতিত। ড্রেসিং শেষে সে উঠে দাঁড়ায়। সাদা পাঞ্জাবীটার বেশ কয়েক জায়গায় রক্তে লাল হয়ে আছে। তুলা দিয়ে নিজের হাতে লেগে যাওয়া রক্তগুলো মুছতে মুছতে বলে,
“একটু কেয়ারফুলি চলাফেরা করার চেষ্টা করুন। সম্ভব হয় তো সাথে একজন বডিগার্ড রেখে দিন। যে দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা প্রটেক্ট করবে। কারন মিনিটে মিনিটে তুরকালাম বাধানো তো আপনার প্যাশন।”
কথাটা বলে সে স্থান ত্যাগ করলো। নোলক তার বন্ধুদের দিকে তাকায়। কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি দেখে অবাক হওয়ার মতো করে বলে,
“কেউ কিছু বললি না ক্যান? দেখলি একটু উপকার করে কেমন খোঁচা মেরে কথা বলে গেলো? তোরা আমার বন্ধু নামে কলঙ্ক।”
কথাটুকু বলে নোলকও হনহনিয়ে চলে গেলো।
.
সকালের সাজে এক রকম লেগেছিলো রাতের সাজে অন্যরকম লাগলো নোলককে। হালকা গোলাপি রঙের লেহেঙ্গাটায় সদ্য ফুটে থাকা গোলাপের মতোই লাগছে তাকে।
এখান থেকে ওখান ছুটোছুটি করে পুরো বিয়ে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছে। প্রায় সবার সাথেই তার খাতির হয়ে গিয়েছে এই অল্প সময়ে। এমন কি ইশানের সাথেও গড়ে উঠলো সখ্যতা। যদিও এক্ষেত্রে ইশানের ভূমিকা বেশি। নোলকের ফটোসুট করলো। নোলক ছবি দেখে ইশানের ফটোগ্রাফি বেশ শুনামও করলো। গল্প করতে করতে নোলক বেশ কয়েকবার তাকালো আদ্র’র দিকে। সে দূরে একা বসে আছে। কাল রাতের ঘটনা আর সন্ধের ঘটনার পর থেকে আদ্র’র উপর থেকে অনেকখানি রাগ কমে গিয়েছে নোলকের। কিন্তু আদ্র’র এত চুপচাপ গুরুগম্ভীর স্বভাব টাই তার ভালো লাগছে না। ইশানকে একফাঁকে জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
“আপনার ঐ ফ্রেন্ডটা এমন কেন?”
ইশান পাল্টা প্রশ্ন করে,
“কেমন?”
“কেমন যেন! অদ্ভুত।”
ইশান স্মিত হেসে বলে,
“ও এমনই। একটু চুপচাপ, চাপা স্বভাবের। একা থাকতে পছন্দ করে বেশি। খুব বেশি মানুষের সঙ্গ পছন্দ করে না।”
নোলক বিস্ময় নিয়ে বলে,
“একা থাকতে কারো কি করে ভালো লাগতে পারে? আমি তো কখনোই একা থাকতে পারি না। দম বন্ধ লাগে।”
ইশান সুন্দর করে হাসে। ক্যামেরা উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে বলে,
“সবাই তো আর নোলক হয় না, তাই না? সবাই তোমার মতো এমন সুইট চঞ্চলও হয় না। তুমি ওর স্বভাবের পুরো বিপরীত স্বভাবের।”
নোলক আক্ষেপ করার মতো করে বলে,
“আমি খুব বেশি বেশি করি, না? আমার আপু বলে, আমার নাকি আরো অনেক বেশি ম্যাচিউর হওয়া উচিত। আমার আপুও আপনার বন্ধুর মতোই অনেকটা, জানেন? আমিও আমার আপুর মতো হতে চাই, কিন্তু পারি না। কত ভাবি, আর চেঁচামেচি করবো না, ঝগড়াঝাটি করবো না। ঠুসঠাস রেগে যাবো না। বাট কি থেকে যে কি হয়ে যায়, আল্লাহ মালুম!”
ইশান হো হো করে হাসে। হাসি থামিয়ে আহ্লাদ মিশ্রিত কন্ঠে বলে,
“কিন্তু আমার তো এই নোলকেই ভালো লাগে! ইনোসেন্ট লাগে। চেঞ্জ হতে হবে না। যেমন আছো, ঠিক তেমনই থাকো। তুমি চেঞ্জ হয়ে গেলে তো আমার দেয়া অগ্নিশর্মা নামটাই বৃথা হয়ে যাবে। হা হা হা!”
ইশানের সাথে সাথে নোলকও হাসে। লাল-নীল আলোতে হাসিরাও যেনো লাল-নীল দ্যূতি ছড়াচ্ছে।
ইশান আর নোলকের হাসির আওয়াজে আদ্র একবার তাকায়। সুন্দর মুখটার দিকে তাকিয়ে দ্রুতই চোখ সরিয়ে ফেলে। অস্বস্তি হয় তার। কাল রাতে নোলকের ভীত মুখটা দেখার পর থেকেই এমন হচ্ছে। কেন কে জানে!…..(চলবে)