পর্ব ৪৬
ঝুম বর্ষণ আজ আর থামবে বলে মনে হয় না। সন্ধ্যার অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আসছে চারপাশ। আকাশে ঘন কালো মেঘের আনাগোনা এতটুকুও কমে নি। বাধ্য হয়েই অম্লানের রেখে যাওয়া ছাতাটা হাতে তুলে নিতে হলো। ছাতায় অম্লানের স্পর্শ লেপ্টে আছে। ভাবলেই গা শিউরে উঠছে নীলাক্ষীর। কিন্তু, নীলাক্ষী দোয়েল চত্বরে গাছ কিনছে এটা অম্লান জানলো কী করে? সবকিছু কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন বলে বোধ হচ্ছে নীলুর।
ছাতা মাথায় দিয়ে কিছুদূর হেঁটে আসার পর একটা রিকশা নিলো সে। অম্লান নিশ্চয় নিজের বাড়িতে আছে, আর সেখানেই নীলাক্ষীর অপেক্ষায় থাকবে। ভালোই হয়েছে, নীলাক্ষী মোটেও সেখানে যাবে না। নীলু তার বাবার বাড়িতে যাবে। অম্লান সেখানে গেলেও ওকে পাবে না। কারণ, আমজাদ সাহেব নতুন বাড়ি করেছেন আর সেখানেই ওরা উঠেছে। অম্লান সেটা জানার কথা নয়। মুখ টিপে হাসলো নীলাক্ষী।
রিকশার পলিথিনে বৃষ্টির ঝাপটা এসে পড়ছে। নীলাক্ষী অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো। সেদিন শ্বশুরবাড়ি থেকে আসার পর মনটা ভীষণ অস্থির হয়ে ওঠে। বাড়ি ফিরেই নির্ঝরের সাথে খারাপ আচরণ করে বসে নীলু। নির্ঝরকে রাগারাগি করার পর বিছানায় শুয়ে গলা ছেড়ে কাঁদছিল ও। মা এসে জানতে চাইলেন কিছু হয়েছে কি না? নীলু যদিও মুখে বলেছিল, “নির্ঝরকে রাগ দেখালে আমার কষ্ট হয়”, এই কথার আড়ালে মা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন নীলাক্ষী ভালো নেই। কোথাও একটা গণ্ডগোল নিশ্চয় হয়েছে।
সেদিন রাতে মা অম্লানকে ফোন করলেন। অম্লান রিসিভ করে নি। মায়ের মনে অশান্তি শুরু হয়ে যায়। তিনি নীলাক্ষীর ফোনে ইউটিউবে কিছু দেখার নাম করে ফোন নিয়ে যান নিজের ঘরে। কল লিস্টে ঢুকে দেখেন অম্লানের সাথে কথা বলার কোনো চিহ্নই নেই। শেষ কথা হয়েছিল অনেকদিন আগে। বিছানার ওপর ধপ করে বসে পড়লেন তিনি। একমাত্র মেয়ের সংসারে অশান্তি হওয়ার ব্যাপারটা কিছুতেই সহজভাবে নিতে পারলেন না। কিছু একটা করতেই হবে।
বাদামী সংসার
লেখা- মিশু মনি
নতুন বাড়ির প্রবেশ পথটা ভীষণ পছন্দ নীলাক্ষীর। বাড়ির সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা, সেখানে মনের মতো গাছের চারা রোপণ করছে নীলু। একদিন গাছ আর লতাপাতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে ওর বাড়িটা। নতুন চারাগুলো বৃষ্টিতে ভিজছে, কী সুন্দর লাগছে দেখতে! উৎফুল্ল হয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো নীলাক্ষী। জুতা খোলার সময় এক জোড়া নতুন জুতা দেখে চমকে উঠলো। এরকম জুতা বাবার নেই, আর নির্ঝরের পা এত লম্বা নয়। তারমানে অম্লান আসে নি তো! বুক ধক করে উঠলো ওর। রিকশায় বসে কত আনন্দ নিয়েই না সে ভাবলো, এই বাড়ির ঠিকানা অম্লান জানে না। অথচ এখানেও এসে বসে আছে।
নীলাক্ষী জোরগলায় ” মা” কে ডাকতে লাগলো। ডাক শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি, “তুই এলি? যা জামাকাপড় বদলে নে।”
“মা, একটা সত্যি কথা বলো তো?”
“কী কথা?”
“কে এসেছে বাসায়?”
“কই কেউ আসে নি তো।”
“কেউ আসে নি? তুমি আমার কাছে মিথ্যা বলছো?”
“তোর কাছে মিথ্যে বলেই বা আমার লাভ কি? তুই তো তোর বাপ না।” বলেই মুখ টিপে হাসলেন তিনি।
নীলাক্ষী কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলো। নতুন ঘরের দেয়ালে এখনো রংয়ের গন্ধ শুকায় নি। ঘরে প্রবেশ করলেই এক ধরনের শান্তি শান্তি লাগে। এই বাড়িটার কাজ অনেক আগেই শেষ হতো, থমকে গিয়েছিল নীলাক্ষীর বিয়ের কারণে। বাবার স্বপ্ন ছিল নতুন বাড়ি করে তারপর সেই বাড়িতে ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দেবেন। কিন্তু পাত্রপক্ষ এত বেশী জোর করছিল যে, সময় নেয়া যায় নি কিছুতেই। নীলাক্ষী এখন বুঝতে পারছে ওরা কেন তখন অত জোর করেছিল।
ঘরের চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো নীলু। মনে হচ্ছিল অম্লান এখানেই কোথাও আছে। কিন্তু এই ঘরে তো নেই। তাহলে জুতা জোড়া কার?
নীলাক্ষী আবারও মাকে ডাকলো। এবার ধীরগলায় জানতে চাইলো, “অম্লান এসেছিল এখানে?”
মা থতমত খেয়ে বললেন, “হ্যাঁ। সকালে এসেছিল।”
“এই বাড়ির ঠিকানা ও পেয়েছে কোথায়?”
“কোথায় পেয়েছে মানে? তুই না দিয়েছিস?”
“আমি তো দেইনি” কথাটা বলতে গিয়ে চুপ করে গেল নীলাক্ষী। কারণ, মা জানে না নীলাক্ষীর সাথে অম্লানের কোনো যোগাযোগ নেই। এই ব্যাপারটা এখানেই স্থগিত করতে হলো তাকে।
নীলাক্ষী বলল, “সকালে কয়টার দিকে এসেছিল?”
“তোকে জানায় নি?”
“নাহ।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নীলাক্ষী। মেয়ের সাথে লুকোচুরি করতে দারুণ মজাই লাগছে মায়ের। তিনি মুখ টিপে হেসে বললেন, “জামাই বাবাজি সকালে এসে তোকে খুঁজল। বললো তোকে নাকি সারপ্রাইজ দিতে এসেছে। তারপর আবার চলেও গেল।”
“আর আসে নি?”
“না তো।”
“লুকাচ্ছো না তো কিছু?”
“না রে বাবা। সত্যিই আর আসে নি।”
“তাহলে তুমি বলতে চাচ্ছো অম্লান জুতা রেখেই চলে গেছে?”
“জুতা রেখে গেছে নাকি?”
নীলাক্ষী আর কথা বাড়াল না। মায়ের মুখ দেখে ওর নিজেরই হাসি পেয়ে গেল। ম্লান হেসে বলল, “আমি জামাকাপড় বদলাবো, তুমি যাও এখন।”
মা বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। ওনার আজ ভীষণ আনন্দের দিন। মেয়েটা হয়তো এখনো রেগে আছে জামাইয়ের ওপর। কিন্তু প্রতিদিন নামাজে বসে তিনি প্রার্থনা করতেন, তার আদরের মেয়েটা যেন সুখী হয়। নীলাক্ষী রাগ করে টেকনাফ থেকে চলে আসার পর প্রায়ই ওর মুখের দিকে তাকালে মা বুঝতে পারতেন, নীলাক্ষী কেঁদেছে। মেয়েরা ছোট থাকলে তাকে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করা যায়, কিন্তু বড় হয়ে গেলে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করতে সংকোচ লাগে। মা কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারেননি। যেদিন নীলাক্ষীর কল হিস্টোরি দেখে নিশ্চিত হলেন অম্লানের সাথে ওর একেবারেই যোগাযোগ নেই, সেদিন তিনি ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন। অনেক চিন্তা ভাবনা করেও কোনো কূল কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। নীলাক্ষী নিজে থেকে কিছু বলবে সেই আশায় কয়েকটা দিন অপেক্ষা করেও যখন কিছুই জানতে পারলেন না, তখন ছুটে গেলেন অম্লানের মায়ের কাছে। সেখানে গিয়ে বুঝতে পারলেন তিনি এ ব্যাপারে সামান্যতম কিছুও জানেন না। দোয়েল ওনাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, “আন্টি ওদের মাঝে ঝগড়া হয়েছে। ঝগড়া’র কারণ আমরা জানি না। মাকে বললে উনি ভীষণ কষ্ট পাবেন। প্লিজ ওনাকে এ ব্যাপারে কিছু বলবেন না।”
সেদিন তিনি ভীষণ অবাক হয়েছিলেন। এক মা কষ্ট পাবে বলে আরেক মা চুপ করে থাকবে? এ কেমন রীতি সংসারের? চুপ করে থাকলে তার মেয়ের কষ্ট একটুও কমবে না। ওনাকে কথা বলতেই হবে। তিনি দোয়েলের কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে অম্লানের মাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, “অম্লান আর নীলুর মাঝে কী হয়েছে আপনি জানেন?” তারপর…
এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। তিনি সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দরজা খুলতে চলে গেলেন। গোসল সেরে সবেমাত্র বেরিয়েছে নীলাক্ষী। বেলের শব্দ শুনে ওর কলিজায় কম্পন শুরু হয়ে গেল। অম্লান এসেছে! কান খাড়া করে রইলো নীলু। কোনো পরিচিত আওয়াজ শোনার অপেক্ষা করছে সে। কিন্তু অনেক্ষণ কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। নীলুর ইচ্ছে করছিল দরজা খুলে একবার উঁকি দিতে, কিন্তু অম্লানের সাথে মুখোমুখি হয়ে যায় কিনা সেই আশংকায় দরজা খুললো না। এখনো কোনো আওয়াজ ভেসে এলো না।
নীলাক্ষী অস্থির হয়ে বিছানায় বসে রইলো। তার ভীষণ ছটফট লাগছে। খানিক বাদে শোনা গেল পায়ের শব্দ। কেউ আসছে, হ্যাঁ এদিকেই আসছে। শব্দটা বৃষ্টির শব্দকে ছাড়িয়েও ওর কানে এসে বাজছে। কারও পায়ের আওয়াজ। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ল সে। নীলাক্ষী ঢোক গিলে চোখ বন্ধ করে ফেলল। এত দ্রুত হৃদস্পন্দন হচ্ছে কেন, বুঝতেই পারছে না। উফফ, মরেই যাবে নীলু।
ভেসে এলো একটি কণ্ঠস্বর, “দরজা খোল।”
এক ধাক্কায় সমস্ত বিভ্রম কেটে গেল। এ তো অম্লানের গলার আওয়াজ নয়। তবে! আসেনি সে?
আবারও শোনা গেল নির্ঝরের গলা, “আপু, দরজা খোল। আমার ফোন এই রুমে চার্জে আছে, ফোনটা দে।”
নীলাক্ষীর দেহের সব কাঁপুনি থেমে গেল। ধীরপায়ে উঠে চার্জ থেকে ফোন খুলে দরজা খুললো সে। নির্ঝর ফোন হাতে নিয়ে মৃদু হেসে বলল, “আপু, তোর মনে আছে তোর বিয়ে বিদায়ের সময় আমি তোকে চার্জার দিতে গিয়েছিলাম?”
হো হো করে হেসে উঠলো নির্ঝর। নীলাক্ষী নির্ঝরকে খপ করে জড়িয়ে ধরে বলল, “পাগল ভাইটা আমার। চার্জার দেবার ছলে তুই তো আমাকেই দেখতে গিয়েছিলি। এখন তো আমার প্রতি তোর একেবারেই টান কমে গেছে।”
“আমার না আপু, তোর টান কমে গেছে।”
“না, তোর কমে গেছে।”
“আমার না, তোর তোর তোর।”
“আমি বলছি তোর, তোর।”
দুই ভাই বোনে খুনসুটিময় ঝগড়া লেগে গেল। এক ফাঁকে নীলাক্ষী উঁকি দিয়ে লিভিংরুমের দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কোথাও অম্লানকে দেখা যায় কি না। ঝগড়া ইস্তফা দিয়ে নির্ঝর চলে গেলে নীলাক্ষী খাবার টেবিলে এসে নাস্তা খেতে বসলো। ওর এখন বিষণ্ণ লাগছে। এই বিষণ্ণতার কারণ কী? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে বসলো। মন উত্তর দিলো, “আমি চেয়েছিলাম অম্লান এখানে থাকুক।”
মনকে রাগ দেখিয়ে নীলাক্ষী বলল, “তোমার লজ্জা হওয়া উচিৎ। কিভাবে এতগুলো দিন কষ্টে ভুগেছো ভুলে গেছো সব?”
“কষ্ট কেন পেয়েছি তুমি জানো না? ভালোবাসি বলে কষ্ট পেয়েছি। ভালোবাসা না থাকলে তো কষ্ট পেতাম না।”
“দেখো মন, তুমি বড্ড বেশী খারাপ হয়ে গেছো।”
“আমাকে ভালো করে দাও। তুমি অম্লানের কাছে যাও। ওকে জড়িয়ে ধরো, সব দুঃখ ভুলে আবার একে অপরকে ভালোবাসো। আমি এতে ভালো থাকবো।”
অজান্তেই নিজেকে ঝাড়ি দিলো নীলাক্ষী। মা বললেন, “কিরে কী হলো তোর?”
“কিছু না। নিজের ওপর রেগে আছি।”
মা আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। নীলাক্ষী একটা জিনিস ভেবেই অবাক হয়ে যাচ্ছে, তার অবচেতন এখনো অম্লানকে ব্যকুলভাবে চায়। অথচ অম্লান বাসায় থাকলে নিশ্চিত অভিমান করে ওর সাথে কথাই বলতো না নীলাক্ষী। তবুও ইচ্ছে করছে অম্লান এখানে থাকুক। ভালোবাসার এই জটিল সমীকরণ গুলো আসলেই বোঝা যায় না।
নীলাক্ষী রান্নাঘরে গিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার জামাই কী আবার আসবে? কিছু বলেছিল?”
“না তো। কিছুই বলে নি। আচ্ছা তুই বারবার আমাকেই কেন জিজ্ঞেস করছিস? তোর জানার কথা না এসব?”
নীলাক্ষী নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইলো। মাকে এসব ব্যাপারে বিব্রত করা একেবারেই উচিৎ হচ্ছে না। অম্লান নিশ্চয়ই ওর বাড়িতেই গেছে, আর সেটাই তো স্বাভাবিক। একবার দোয়েলকে কল দিয়ে ওর শরীর কেমন সেটা জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। দোয়েল নিশ্চয়ই বলবে অম্লান সেখানে আছে।
ঘরের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে আবার নিজেকে বকা দিলো নীলাক্ষী। সে এখনো মনেপ্রাণে অম্লানের ব্যাপারে উৎসুক হয়ে আছে। নাহ, দোয়েলকে কল দেয়া যাবে না।
পুরোপুরি মনস্থির করে ঘরে প্রবেশ করলো নীলাক্ষী। দোয়েলকে কল দেয়া যাবে না। অম্লান সেখানে ইচ্ছে যাক। কথাটা ভেবে চোখ ঘোরাতেই, চক্ষু চড়কগাছ!
অম্লান বিছানার ওপর বসে আছে।
চলবে..