বাদামী সংসার
পর্ব ৪৩

অম্লান অফিস থেকে ফিরে দেখলো ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে। বুকটা ধক করে উঠলো তখনই। নীলাক্ষী কী চলে গেলো! তাকে না জানিয়েই? নিজের পকেটে থাকা অন্য আরেকটা চাবি দিয়ে তালা খুলে ঘরে প্রবেশ করলো অম্লান। সন্ধ্যার আগ-মুহুর্তে বাড়ির কাছাকাছি পাখিদের কিচিরমিচির চারপাশ মুখরিত করে তুলেছে। ওদের নীড়ে ফিরে আসার গান। অথচ আজ পাখি নীড়ে নেই, চলে গেছে দূরে, বহুদূরে..
অম্লান বেশ নিশ্চিত ভঙ্গীতে ঘরের টেবিল ও বিছানার ওপর, উল্লেখযোগ্য জায়গাগুলোতে খুঁজতে লাগলো। যদি নীলাক্ষীর কোনো চিঠি পাওয়া যেতো, সেই আশায়। অথচ কোথাও কোনো চিঠি নেই, কোনো ক্ষুদ্র মেসেজ পর্যন্ত না।
অম্লান নীলাক্ষীর নাম্বারে কল দিলো। সরু কণ্ঠের একটি মেয়ের গলা ভেসে এলো সেখানে, “আপনার কাঙ্খিত নম্বরে এই মুহুর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।”
তবে কী এটাই ওর চলে যাওয়া? এভাবে, একা ফেলে তাও কোনোকিছু না জানিয়েই কেন চলে গেলো নীলাক্ষী? প্রশ্নবোধক চাহনি নিয়ে জানালার বাইরে সন্ধ্যার আগমন দেখতে লাগল সে। নীলাক্ষী বিদায় নিয়ে না গিয়ে পালিয়ে গেলো! খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রক্তিম সূর্যটার শূন্যে বিলীন হয়ে যাওয়া দেখে হঠাৎ ই অম্লানের মনে হলো, “নীলাক্ষী পালিয়ে যায় নি। বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার সাধ্য ছিল না বলেই চুপিচুপি চলে গেছে। কারণ, ভালোবাসা।”

বাদামী সংসার
লেখা- মিশু মনি

বাসে সিটে হেলান দিয়ে সন্ধ্যার গন্ধ গায়ে মাখছে নীলু। পাহাড়ে কী সুন্দর করে সন্ধ্যা নামে! বাস জুরে উল্লাস চলছে। ছেলেমেয়েরা ফিরছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ হতে। ঢাকার বাসে বাড়ি ফিরছে ওরা। চোখে ও বুকে কত শত আনন্দময় স্মৃতি! অথচ নীলাক্ষী’র বুকে কোনো আনন্দময় স্মৃতি নেই। ব্যর্থতার বিশাল ভাড়ে নুইয়ে পড়ছে সে। এই ব্যর্থতা তো অম্লানের, সে নীলাক্ষীকে আপন করে নিতে পারেনি। তবুও নীলাক্ষীর কষ্ট হচ্ছে। নিজেকে মনে হচ্ছে অভাগী’র রাণী। স্বামীর পরম আদর যত্ন পেয়েও ধরে রাখা হলো না তার। সবকিছু কেমন যেন মিইয়ে গেল হঠাৎ ঝড়ে। নিজের কপালকে দোষী করা ছাড়া আর কিইবা করার আছে তার।
পাশের সিটে বসেছে এক অল্পবয়সী যুবক। বসার পর থেকেই মোবাইলে চ্যাটিং করছে আর থেকে থেকে প্রাণখুলে হেসে উঠছে। নীলাক্ষী পাশের সাড়ির সিটগুলোর দিকে তাকায়। ওই তো সামনেই একটা মেয়ে বসেছে, বিষণ্ণ মুখ করে সিটে হেলান দেয়া। তার পাশে নিশ্চিত বয়ফ্রেন্ড। ছেলেটা ওর মান ভাঙানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। জগতে যেমন হরেক রকম মানুষ, তেমনি সবার হরেক রকম গল্প। নিজেকে স্বান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলো নীলাক্ষী।

বাস তখন চট্টগ্রামের কাছাকাছি। খাবারের বিরতিতে বাস থেকে নেমে প্রথম কথা হলো ছেলেটার সাথে। নীলাক্ষীকে বলল, “আপনি তো পানি টানি কিছুই খেলেন না আপু।”
নীলাক্ষী বিরসমুখে উত্তর দিলো, “আমার ইচ্ছে করছে না।”
“আসুন খাবার খেয়ে আসি। সেই সন্ধ্যায় বাসে উঠেছি। আমার তো প্রচুর খিদা লেগেছিল। ভাগ্যিস পথে একবার ডিম পেয়েছি। হা হা।”

ছেলেটা আবারও প্রাণখোলা হাসি দিলো। নীলাক্ষী আর কথা না বাড়িয়ে বাসে ওঠার জন্য এগিয়ে গেলে ছেলেটা পিছন থেকে ডাকলো, “আপু, ঢাকায় পৌঁছতে অনেক সময় লাগবে। আসেন ভাত খেয়ে নেই। গরুর গোশতের দারুণ ঘ্রাণ আসতেছে।”
নীলাক্ষী পিছন ফিরে তাকালো। ছেলেটা বয়সে ওর ছোট ভাইয়ের মতোই। কী সুন্দর মায়া মায়া কণ্ঠে ডাকছে! মনে হচ্ছে নির্ঝর। হঠাৎ ভাইয়ের কথা মনে হতেই নীলাক্ষীর বুক ফাঁকা হতে শুরু করলো। বুকে জমে থাকা দুঃখগুলো উবে যাচ্ছে। এই তো স্বস্তি পাচ্ছে সে। অম্লান-ই তার জীবনের সবকিছু নয়। তার বাবা আছে, মা আছে, একটা আদরের ছোট ভাই আছে। নীলাক্ষীর কান্না নির্ঝর একেবারেই সহ্য করতে পারে না। মুহুর্তেই বুকের ভাড় কমে গেল ওর। আস্তে আস্তে ছেলেটার সাথে এগিয়ে গেল রেস্তোরাঁর ভেতরে।
সুসজ্জিত রেস্তোরাঁ। ভেতরে প্রবেশের সাথে সাথেই গরুর মাংসের তরকারির কড়া সুগন্ধি নাকে এসে লাগল। এই প্রথম নীলাক্ষী টের পেলো, তার সত্যিই ভীষণ খিদে পেয়েছে। গতকাল দুপুরে অম্লান বাসায় খেতে আসে নি। তাই তারও খাওয়া হয়নি। দুপুরের খাবারটা টেবিলেই রয়ে গেছে। আচ্ছা, অম্লান কি খেয়েছে?
অম্লানের চিন্তা মুহুর্তেই ওকে ধোঁয়ার মতো ঘিরে ফেলছিল। ছেলেটা উদ্ধার করলো ওকে। বলল, “আপু, আপনি কি কি খাবেন?”
“তেমন কিছু না। তুমি যা খাও। তোমাকে তুমি বলি কিছু মনে কোরো না। আমার একটা ছোট ভাই আছে, একদম তোমার মতো।”
“থ্যাংক ইউ আপু। আমি ভাত, গরুর গোশত আর ডাল দিতে বলি। আপনি মাছ খান?”
“হ্যাঁ। কিন্তু এখন না প্লিজ।”
“মাছ মাংস একসাথে খাওয়াটাও ঠিক না। আপনার জন্য ঠান্ডা কিছু দিতে বলি?”
“না। আমি কিছুই খাবো না।”
“কিছু না খেলে এই ভাত তরকারি অর্ডার দিয়ে লাভ কি?”
শুষ্ক ঠোঁটে হাসি ফুটলো নীলাক্ষীর। হেসে উত্তর দিলো, “ভাত খাবো শুধু।”
“আর তরকারি?”
“তুমি তো দারুণ দুষ্টু। দিতে বলো।”

ছেলেটা ওয়েটারকে ডেকে খাবার অর্ডার দিয়ে দিলো। তারপর নীলাক্ষীকে আর একটুও বিব্রত করলো না। শান্ত হয়ে বসে রইলো। কখনো টিস্যু পেপার নাড়াচাড়া তো কখনো পানির বোতল নিয়ে বারবার মুখ খোলা, এসব করেই বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল।
খাবার চলে এলে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গীতেই খেতে শুরু করলো ওরা। এক প্লেট ভাত খেয়ে দ্বিতীয়বার ভাত নেয়ার সময় নীলাক্ষী বলল, “আমার সত্যিই প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল।”
“বুঝতে পেরেছি। আমাকে ধন্যবাদ দিতে হবে না। আপু আপনি কি টেকনাফে থাকেন?”
“না। বেড়াতে গিয়েছিলাম।”
“ওহ, সেন্টমার্টিন না টেকনাফ?”
“টেকনাফেই। আমার ওখানেও একটা ঘর ছিল।”
কথাটা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো নীলাক্ষী। সেই খোলা বারান্দা, সবুজ ধানক্ষেত, শিরশির করে ভেসে আসা হাওয়া, হঠাৎ সবকিছু ভেসে উঠলো চোখের সামনে। অনেক শখ করে কিনে আনা বিছানা, ছোট ছোট হাড়ি পাতিল, একটা ছোট্ট রান্নাঘর। বুকটা হাহাকার করে উঠলো।
“ছিল মানে! এখন নেই?” প্রশ্ন করলো ছেলেটা।
“না নেই। ছেড়ে দিয়েছি।”
“চাকরি করতেন?”
“হ্যাঁ। সংসার সংসার চাকরি। তিনবেলা রান্না করা, ঘর দুয়ার পরিষ্কার করা আর ময়লা কাপড় ধোয়া। সুন্দর চাকরি।”
ক্ষণিকের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেল ছেলেটা। কয়েক মুহুর্ত নীলাক্ষী’র দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সে। তারপর মাথা নামিয়ে ফেললো, দ্বিতীয় বার কোনো প্রশ্ন করলো না আর।
খাওয়া শেষে নীলাক্ষী দুজনের বিল পরিশোধ করতে গেলেও ছেলেটা কিছু বললো না। কেবল বিল দেয়ার পর নীলাক্ষীকে বলল, “আমার বিলটা আমিই দিতাম। আপনি কেন…”
“তুমি আমার ছোট ভাইয়ের মতো। বড় বোনরা বিল দিলে কিছু হয় না।”
হনহন করে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে নীলাক্ষী বাসে গিয়ে উঠলো। নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলো একটি অপরিচিত ছেলে। তার বিষণ্ণ মনে একটা ক্ষুদ্র আক্ষেপ জন্মেছে, পৃথিবীর সব মহিলাকেই কেন এভাবে সংসার সংসার চাকরি করতে হবে? সংসার তো ছেলেদেরও। অথচ তার বাবা অনেক আগেই আরেকটা বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। কেবল মাসে মাসে মাকে টাকা পাঠায়। দুজন বিবাহযোগ্যা বড় বোন আর তাকে নিয়েই মায়ের দুঃখের সংসার। যেখানে তার কোনো লাভ নেই, শুধু মায়ার কারণে পড়ে থাকা।

নীলাক্ষী সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে। ছেলেটা বলল, “এক্সকিউজ মি আপু?”
“হ্যাঁ? ”
“এই নিন কোক খান।”
“না না। খাবো না। থ্যাংকস। ”
“খেলে ভালো লাগবে আপনার।”
“না থাক।”
ছেলেটা আর জোর করলো না। নিশ্চুপ ভঙ্গীতে বসে পড়লো। বাসের লাইট নিভিয়ে দেয়ায় মনে মনে কন্ডাকটরকে ধন্যবাদ জানালো নীলাক্ষী। অনেক্ষণ ধরেই তার কান্না পাচ্ছিল। আলোতে অচেনা মানুষের সামনে কাঁদতে পারছিল না। এখন অনেক কাঁদবে সে, অনেক।
সেদিনটার কথা খুব মনে পড়ে। অম্লান অফিস থেকে ফিরে দেখলো নীলাক্ষী ঘরে নেই। পাগলের মতো ডাকাডাকি করছিল। নীলাক্ষী ভাবির সাথে বেড়াতে গিয়েছিল পাশের বাড়িতে। মা নিজে সেখানে গিয়ে হাজির হয়ে বললেন, “আমার ছেলে তো পাগল হয়ে গেছে। তারাতাড়ি আসো বাসায়। এই সময়ে ও অফিস থেকে ফেরে জানো না? তাও বাইরে আসছো কেন?” নীলাক্ষী সেদিন ভীষণ লজ্জা পেয়েছিল। একইসাথে এক থোঁকা নব আনন্দের রেশ ছড়িয়েছিল তার দেহ মনে। মানুষটার সবটাই কি অভিনয় ছিল! ভাবলেই ভীষণ কষ্ট হয় নীলাক্ষীর। আজ বাসায় ফিরে নীলাক্ষীকে না পেয়ে তার কি সেদিনকার মতোই পাগল পাগল অবস্থা হবে? না হবে না। কারণ, সে চেয়েছিল একা থাকতে। নীলাক্ষী চলে যাওয়াতে তার ভালোই হয়েছে। চোখ মুছে নিরবে নিজের অশ্রুকে বরণ করে নিতে নিতে ঘুমিয়ে পড়ে নীলাক্ষী।

আমজাদ সাহেব প্রতিদিনের মতো নামাজ পড়ে বারান্দায় বসে আছেন। সূর্য উঠলেই একবার নীলাক্ষীকে কল দেবেন ভাবছেন। কাল সকালে একবার কথা হয়েছিল, এরপর সারাদিন মেয়েটা আর কল দেয় নি। তিনিও কেন কল দিলেন না, সেই ভেবে বকা দিচ্ছেন নিজেকে। ঠিক সে সময়েই দরজায় কলিং বেল বেজে উঠলো। চমকে উঠলেন আমজাদ সাহেব। মাথা নিচু করে বাসার নিচে তাকালেন। কিছু দেখতে না পেয়ে স্ত্রীকে ডেকে বললেন, “কে এলো এত সকালে? দেখো তো।”
“আমি কাজ করছি। তুমি গিয়ে দেখো না।”
“আমি পেপার পড়ছি তো।”
“পেপার পরে পড়া যাবে না? যাও গিয়ে দরজা খুলে দাও।”
আমজাদ সাহেব ধীরপায়ে এগিয়ে গেলেন দরজা খুলতে। লুকিং গ্লাস দিয়ে বাইরে তাকানো মাত্রই ওনার বুক ধক করে উঠলো। এত ভোরে নীলাক্ষী! কোনো ঝামেলা হয়নি তো?
দ্রুত দরজা খুলে দিলেন তিনি। নীলাক্ষী বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আনন্দে ঝলমল করতে করতে বলল, “আব্বু, কেমন আছো তুমি? কতদিন দেখিনা তোমাকে আব্বু।”
“হ্যাঁ রে মা ভালো আছি। জামাই কই?”
“ও আসে নি।”
“তুই আমাকে কিছু না জানিয়ে চলে এলি এভাবে.. ”
“সারপ্রাইজ দিলাম। আমার অফিসে কাল একটা জরুরি মিটিং আছে। আমাকে থাকতেই হবে নয়তো বড় ধরনের লস হয়ে যাবে অফিসের। তাই ভাবলাম হুট করে যাবোই যখন, তোমাকে চমকে দেই। তুমি চমকাও নি বলো?”
“হ্যাঁ অনেক চমকে গেছি।”
“আব্বু জানো আমাদের ওখানকার পেপে আর তেঁতুল অনেক ভালো। তোমার জন্য আনছি। তুমি তো তেঁতুলের শরবত খুব পছন্দ করো। মা কই? এই নির্ঝর..”
আমজাদ সাহেব নিশ্চিন্ত হলেন। দীর্ঘদিন পর মেয়ের শরীরের ঘ্রাণ, সেই আনন্দিত উচ্ছল কণ্ঠস্বর, এ ঘর ও ঘর ছুটে বেড়ানো দেখে ওনার ভীষণ আনন্দ হতে লাগলো। নীলাক্ষী লাগেজ রেখেই বাথরুমে ঢুকলো। নির্ঝরকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে ব্রাশ করতে পাঠিয়ে দিয়েছে। সবার জন্য খাবার কিনে এনেছে সে। নির্ঝরের জন্য কিনে এনেছে একটা টি শার্ট। বলেছে, টিশার্ট টা অম্লান কিনে এনেছে ওর জন্য। আর বাবা মাকে যত রকম ফল ও জিনিসপত্র দিয়েছে, সবকিছুই টেকনাফ থেকে এনেছে। এই প্রথম বাবা মা’র কাছে মিথ্যে বলতে পেরে নিজেই অপরাধবোধ ডুবে যাচ্ছিল। সে সবকিছু কিনেছে ঢাকায় পৌঁছাতে। আসলে এটা না বললে মা বাবাকে কিছুতেই বিশ্বাস করানো যেত না যে, সে অম্লানকে ছেড়ে চলে এসেছে। বাথরুমের আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে ভীষণ মায়া হল ওর। চেহারাটা কেমন সংসারী সংসারী হয়ে উঠেছে। অথচ তার আত্মাটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। সেটা কেন চেহারায় ফুটে ওঠে না? মানুষ আঘাত পেতে পেতে ভালো অভিনয় করতে শিখে যায়।
খাবার টেবিলে বসে মায়ের হাতে খাবার তুলে খাওয়ার আবদার করলো নীলাক্ষী। মা একবার বললেন, “অম্লানকে একবার ভিডিও কল দে না দেখি। ওকে কতদিন দেখি না।”
“ও তো ঘুম থেকেই ওঠেনি মা। পরে দেবো। আচ্ছা মা, তুমি বুড়ি হয়ে যাচ্ছো কেন?”
“দ্যাখো মেয়ে কি বলে। বয়স হচ্ছে না? কয়দিন পর নাতি নাতনীরা আসবে।”
“আর নাতি নাতনী। বাচ্চাকাচ্চার ক্যাচক্যাচ আমার একদমই ভালো লাগে না আম্মু।”
“এসব কি কথা? ভালো না লাগলেও তো বাচ্চা নিতেই হবে। সংসারে বাচ্চাই তো সুখ, শান্তি।”
“ধুর। আমার ভালো লাগে না। আগে সংসারটাই শিখি, তারপর বাচ্চাকাচ্চা। কি বলো আব্বু? বাচ্চা না থাকলে তোমরা লাইফটা আরও এনজয় করতে না?”
“তুই হওয়ার পর থেকেই তো সংসারে আমি মনোযোগী হয়ে গেলাম রে মা। বাচ্চা যে কী রহমত।”
“আহা রাখো এখন এই টপিক। আমি সমুদ্র দেখেছি। ছবি দেখবা?”
বাবা মাকে সমুদ্রের ছবি দেখিয়ে আরও কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে নিজের ঘরে ঘুমাতে এলো নীলাক্ষী। মনেমনে বলল, “ছোট বাচ্চাদের আমারও ভীষণ ভালো লাগে। কিন্তু সেই সৌভাগ্য আমার কখনোই আর হবে না।”
আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করলো সে। কিছুতেই ঘুম এলো না। চোখ বুজলেই মনে হচ্ছে অম্লান আর সে পাশাপাশি শুয়ে আছে। সবকিছুই আগের মতো সুন্দর, স্বাভাবিক। অথচ চোখ খুললেই সবকিছু কেমন ভেঙে গুড়ো করে যায়। সেই চেনা পরিচিত বিছানা, সেই চেনা বিছানার চাদর অথচ আজ সবকিছুকে অচেনা লাগছে। ঘরের দেয়ালে ঝুলে থাকা তার বহু পরিচিত ছবিটাও আজ অচেনা, অপরিচিত হয়ে গেছে ড্রেসিং টেবিলটাও। একসময় এগুলোই ছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গী, তার প্রিয় ঘর।
বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে নীলাক্ষী ভাবলো, “আমি আর কষ্ট পেতে দেবো না নিজেকে। সবকিছু নতুনভাবে সাজাবো। আমার সুন্দর জীবনটা আবার সুন্দর হয়ে উঠবে। আমার প্রিয় ঘর, আমার প্রিয় অফিস। সবকিছু সুন্দর।”
ক্ষণিকের জন্য নিজেকে স্বান্তনা দিলেও পরক্ষণেই নীলাক্ষীর মনে পড়ে গেলো শ্বশুরবাড়িতে তার ছোট্ট ঘরটার কথা। দাদীমার কথা, দোয়েলের কথা। কতই না সুখের ছিল তাদের দিনগুলি। জীবন এত দ্রুত পালটে যায় কেন? উত্তর খুঁজে পায় না নীলাক্ষী। কেবল বালিশের গায়ে নোনতা জল টপটপ করে গড়িয়ে পড়ে আর সিক্ত হয় ব্যথার শীতলতায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here