বাদামী সংসার
পর্ব ৪১
নীলাক্ষী স্বাভাবিক ভঙ্গীতে জগ থেকে পানি ঢাললো। ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে অম্লানকে জিজ্ঞেস করলো, ‘খাবার নিয়ে বসো আছো কেন? খাবা না?’
অম্লান চোখ তুলে তাকালো। করুণ দৃষ্টি। দুচোখ ভরা অপরাধবোধ। ভীষণ কঠিন কোনো কিছু লুকিয়ে রাখার পর সেটা যখন প্রকাশিত হয়ে যায়, মানুষকে দেখতে বোধহয় এমনই লাগে। কাতর চোখে তাকিয়ে থাকা মুখখানা দেখে মায়া লাগলো নীলাক্ষীর। অম্লানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ‘লুচি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। পরে মজা লাগবে না।’
‘খাবার গলা দিয়ে নামছে না নীলু।’
‘ওমা! কেন? আমি তো তাহলে বড় ধরনের ভুল করে ফেললাম।’
‘ভুল তুমি করোনি নীলু। ভুল তো করেছি আমি। ভুল নয়, অন্যায় করেছি। এতদিন ধরে তোমার সাথে অন্যায় করে গেছি।’
‘ধুর বাদ দাও তো ওসব। তারাতাড়ি খেয়ে নাও পুরোটা। খেয়ে উঠে বারান্দায় গিয়ে বসবো। ঝলমলে রোদ। কী যে ভালো লাগে আমার! মনে হয় আজীবন এই বাড়িতে থেকে যেতে পারলে ভালো হবে। আমরা এই বাসা চেঞ্জ করবো না ঠিকাছে?’
অম্লান কিছু না বলে হাত ধুয়ে ফেললো। নীলাক্ষী হন্তদন্ত হয়ে বললো, ‘ এ কী করলা! তোমার জন্য এত যত্ন করে রান্না করলাম আর না খেয়েই হাত ধুয়ে ফেলেছো.. সরো তো আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’
নীলাক্ষী হাঁসের মাংস ছিঁড়ে, হালকা ঝোল লাগিয়ে লুচিতে মাখিয়ে অম্লানের মুখে তুলে দিলো। অম্লান নিঃশব্দে খাচ্ছে। এইমুহুর্তে নীলাক্ষীর সামনে মাথা উঁচু করে কিছু বলার সুযোগ নেই। নীলাক্ষীকে অম্লান ভেবেছিলো খুব সাধাসিধা একটা মেয়ে। বাইরে থেকে মেয়েটাকে নিতান্তই সরল মনে হয়। সরল অবশ্যই, তবে সবকিছু বুঝতে পেরেও নীরবে দিনের পর দিন না জানার ভান করে একসাথে থাকা।
অম্লান মৃদু স্বরে বললো, ‘আমি আর খাবো না।’
‘কেন? খেতে মজা হয়নি?’
‘খুব ভালো হয়েছে।’
‘তাহলে খাও। আমার কথায় খুব কষ্ট পেয়েছো তাই না?’
অম্লান নীলাক্ষীর চোখের দিকে তাকালো। বুকের ভেতর খামচে ধরার মতো অনুভূতি হলো অম্লানের। চিনচিনে সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। নীলাক্ষীর চোখ দুটো শীতল, তবে ওই শীতলতায়ও অগ্নি জ্বলে। অম্লান মাথা নামিয়ে ফেললো।
নীলাক্ষী বললো, ‘সরি। কষ্ট দিয়ে ফেললাম। নাও খাও।’
আবারও মুখে দিলো অম্লানের। এবার অম্লান আর ‘না’ বলতে পারলো না। খাবারটা সম্পূর্ণ শেষ করে বসে রইলো। স্তব্ধ ঘরে শিরশির করে হাওয়া ঢুকছে। কিছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যা নামবে।
নীলাক্ষী বাসন মাজার ছলে রান্নাঘরে চলে গেলো। কিন্তু কোনো কাজে হাত দেয়ার সাহস কুলোয় না। হাত কাঁপছে থরথর করে। বুক ফাঁটা আর্তনাদ নিঃশব্দে যন্ত্রণা দিয়ে চলেছে ওকে। দেয়ালে হেলান দিয়ে অশান্ত মনকে শান্ত করার বৃথা প্রয়াস চালিয়ে যখন ব্যর্থ হলো, ছোট পাতিলে গরম পানি তুলে দিলো চুলায়।
দুই কাপ চা বানিয়ে ঘরে প্রবেশ করে দেখলো অম্লান জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। জানালার ওপাশে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেতের প্রান্তর। যত দূর চোখ যায়, শুধুই সবুজ। নীলাক্ষী চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো, ‘এইযে চা। সূর্যাস্ত দেখবা না? চলো বারান্দায় যাই।’
‘হুম যাবো।’
‘চা নিয়েই যাই চলো। আজকে আব্বু তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিলো। তুমি নাকি অনেকদিন ফোন দাও না? একবার সময় পেলে কল দিও।’
‘হুম।’
‘ভাবী তো তোমার ওপর রাগ করেই আছে। কত ভালোবাসে তোমাকে অথচ খোঁজ খবরও নিচ্ছো না। ভাবীকেও কল দিও। দেখো আমরা তো সমাজেরই অংশ তাইনা? দূরে এসেছো বলে সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা রাখবা সেটা…’
কথাটা বলতে গিয়ে থমকে গেলো নীলাক্ষী। বুক কেঁপে উঠলো। অম্লান বাড়ি থেকে চলে আসার পর বাবা, ভাইয়া, ভাবী এমনকি দাদীর খোঁজও নেয়নি। সকাল বিকাল দু’বার মা ফোন করলে তখন রিসিভ করে কথা বলেছে। এটা নীলাক্ষী ভালোভাবেই জানে। নীলাক্ষীর বাবার বাড়ির কাউকেই একবারও ফোন করে নি। তারমানে! অম্লান সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দূরে একা থাকার জন্যই এতদূরে বদলি নিতে চেয়েছিলো! নীলাক্ষী আর ভাবতে পারছে না। অবাক চোখে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলো। চোখে জল চলে আসবে যেকোনো মুহুর্তে-ই।
অম্লান বললো, ‘বারান্দায় যাবা না?’
নীলাক্ষী কোনো শব্দ করলো না। ধীরপায়ে বারান্দায় চলে আসে। দুজনে পাশাপাশি অনেক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো। নীলাক্ষী কোনোমতে চা শেষ করে বললো, ‘সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমি ঘরে যাই। লাইট জ্বেলে দেই।’
নীলাক্ষী দ্রুতপদে ঘরে ঢুকেই বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। বালিশে মুখ গুঁজে কান্নার শব্দ লুকানোর চেষ্টা করলো ভীষণভাবে। এই আওয়াজ যেন অম্লানের কানে কোনোভাবেই না পৌঁছায়। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো নীলাক্ষী। মুখ ঢুকিয়ে দিলো বালিশের তুলোর ভেতর। পুরো শরীর কাঁপুনি দিয়ে কান্না আসছে। এত কষ্ট কেন হচ্ছে আজ? কেন?
অম্লান ঘরে ফিরলো মিনিট দশেক পরে। বললো, ‘কারেন্ট নেই নাকি? লাইট জ্বালাও নি যে?’
অম্লান নিজে আলো জ্বেলে দিতেই বিছানায় শোয়া নীলাক্ষীর দিকে চোখ গেলো। বেশ বুঝতে পারলো নীলাক্ষী কাঁদছে। না বোঝার ভান করে অম্লান ফোন নিয়ে বসে পড়লো। কল দিলো ভাবীর নাম্বারে। ভাবীর সাথে হাসাহাসি করে কথা বলে পরিবেশ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। একসময় নীলাক্ষীকে ডেকে বললো, ‘এই নাও, ভাবী তোমার সাথে কথা বলবে।’
নীলাক্ষী ইতিমধ্যেই চোখ মুছে নিথর হয়ে গেছে। মোবাইল নিয়ে কথা বলতে বলতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। শিরশিরে বাতাসে দাঁড়িয়ে নীলাক্ষীর মুখ দিয়ে একটা কথাও বেরোলো না। সে কেবল অবাক হয়ে শুনলো দোয়েলের আনন্দিত কণ্ঠস্বর, ‘জানিস নীলু ও আমার এত কেয়ার করে। একটু আহ করে উঠলেই জিজ্ঞেস করে, কি হলো? আমি একটু শুয়ে পড়লেই বলে, শরীর খারাপ হয়েছে? ডাক্তার ডাকবো? এত কেয়ারিং একটা মানুষ কেমন করে হয় রে! বাচ্চাটা পেটে আসার পর ও যে এমন করে চেঞ্জ হয়ে যাবে আমি ভাবতেও পারি নি রে। মানুষটা যেন আজীবন এমনই থাকে। আমি ওকে প্রচন্ড ভালোবাসি। কি রে কিছু বলছিস না কেন? এই নীলু, নীলু..’
নীলাক্ষীর কণ্ঠ রুদ্ধ। চোখ বেয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে জলের বিন্দু। শুধু মৃদু স্বরে আওয়াজ করলো, ‘হুম।’
‘নীলু জানিস তোকে অম্লান যখন পাগলের মতো ভালোবাসতো আমার কী যে হিংসে হতো রে। একদিন তো দাদীকেই বিচার দিয়ে বসেছিলাম। হা হা হা। আমি এখন বুঝতে পারছি রে, একটা মেয়ের জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হচ্ছে স্বামীর ভালোবাসা। জগতের আর সমস্ত কিছুই তুচ্ছ, সবকিছু।’
নীলাক্ষী বললো, ‘হুম।’
‘আচ্ছা থাক। আমি ওয়াশরুমে যাবো। এখন বারবার ওয়াশরুমে যেতে হয়। তুই এখন এখানে থাকলে কত মজা হতো। হঠাৎ অম্লানের ট্রান্সফার হলো ভালো কথা, কত্তদূরে।’
‘আচ্ছা ভাবী তুমি যাও।’
টুপ করে ফোনটা কেটে গেলো। নীলাক্ষী ঠান্ডা বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। তারপর ঘরে প্রবেশ করলো একটা অন্য নীলাক্ষী হয়ে। যাকে দেখে মনেই হয় না, কিছুক্ষণ আগেও মানুষটা হাহাকার করে কেঁদেছে!
চলবে..