বাদামী সংসার
পর্ব ২৫
মিশু মনি

প্রফুল্ল’র প্রাণবন্ত হাসির শব্দ এখনও অম্লানের কানে বাজছে। মগজের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে একজন পুরুষের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল দুলিয়ে সেই ভুবনজয়ী হাসির দৃশ্যপট। অম্লান মনের ওপর জোর খাটিয়েও কিছুতেই দৃশ্যটাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। প্রফুল্ল রিসোর্টে বেড়াতে এসেছে তাও সাথে একজন যুবক, সে শাড়ি পরে সুন্দর করে সেজেছে। এসব তুচ্ছ বিষয়কে পাত্তা না দিলেও চলবে। কিন্তু যে বিষয়টা মনকে দোলায়িত করছে সেটা প্রফুল্ল’র হাসি। হেসে হেসে কেনই বা একজনের সাথে অমন আড্ডায় মেতে রয়েছে! তার সহিত কি সম্পর্ক প্রফুল্ল’র? এমন ছোট বড় অসংখ্য প্রশ্নে হৃদয় অস্থির হয়ে উঠলো অম্লানের।

নীলাক্ষী তার বাহু চেপে ধরে নির্বিকার ভঙ্গীতে হাঁটছে। নারকেল গাছ, সবুজ ঘাস, গাছের ছায়া, বিভিন্ন বিষয়ে গল্প জমানোর চেষ্টা করছে সে। অম্লানকে অন্যমনস্ক দেখার পর নীলাক্ষী জিজ্ঞেস করলো, ‘কি গো তুমি অমন চুপ করে গেলে কেন? কি ভাবছো?’

অম্লান দ্রুত উত্তর দেয়, ‘না তো। কিছু ভাবছি না। তোমার কথা শুনছি।’

নীলাক্ষী অম্লানের সামনে দাঁড়িয়ে তার দুই বাহুর মাঝে নিজেকে আবদ্ধ করে অম্লানের ঘাড়ে দুই হাত তুলে দিয়ে বললো, ‘তোমাকে কি বলে আমি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবো বলো তো? আমাকে শিখিয়ে দাও। এত সুন্দর একটা দিন উপহার দিয়েছো আমাকে। কি বলি বলোতো? শুধু থ্যাংক ইউ বললে কি হবে?’

অম্লান একটা নিশ্বাস ফেলে নীলাক্ষীর দিকে নিরুত্তর মুখে চেয়ে রইলো। নীলাক্ষী অম্লানের পায়ের ওপর দুই পা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। অম্লান নীলাক্ষীর হাত ধরে বললো, ‘রুমে চলো।’

আচমকা বাঁধাপ্রাপ্ত হওয়ায় লজ্জিত বোধ করে নীলাক্ষী। পেছনে দুই পা সরে দাঁড়ালো। মুখে মুহুর্তেই নেমে এলো বিষন্নতা। সে রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে জড়িয়ে ধরে, অথচ নীলাক্ষী রিসোর্টের ভেতরে তাকে একটু কাছে টানলেই কি এমন দোষ!

হনহন করে ঘরের দিকে চলে গেলো নীলাক্ষী। অম্লানের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। ও ধীরপায়ে এগোতে এগোতে এলোমেলো ভাবনায় ডুবে রইলো। প্রফুল্ল এত হাসিখুশি, এই বিষয়টাই তাকে ক্রমশ অস্থির করে তুলছে। অম্লান সবসময় চাইতো প্রফুল্ল ভালো থাকুক, সুখে থাকুক। অথচ আজকে তার হাসিখুশি মুখ দেখার পর কেন যেন সহ্য হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সে আর কারো সাথে ভালো থাকতে পারে না। একদমই পারে না। নিতান্তই ছেলেমানুষী ভাবনা নিয়ে আনমনে ঘরে এসে ঢুকলো অম্লান। নীলাক্ষী মন খারাপ করে বসে আছে সেটা খেয়ালে আসলো না। বিছানায় অর্ধশোয়া অবস্থায় বসে রইলো।

নীলাক্ষী একবার অম্লানের মুখের দিকে তাকিয়ে রিমোট নিয়ে টেলিভিশন ছেড়ে দিলো। সেও এখন কথা বলবে না। অম্লান যখন সেচ্ছায় কথা বলবে, তখন ক্যাটক্যাট করে উত্তর দেবে। সে রেগে আছে এটাও তো অম্লানের বোঝা দরকার।
কিন্তু হায়, দেখতে দেখতে রোমাঞ্চকর দুপুর গড়িয়ে বেলা পড়ে গেলো। নীলাক্ষী হঠাৎ অম্লানের দিকে তাকিয়ে দেখলো বিছানায় বসে বালিশে হেলান দিয়ে সে ঘুমুচ্ছে। মাথাটা দুদিকে নেড়ে নীলাক্ষীও অম্লানের পাশে এসে শুয়ে পড়ে। রাগটা আপাতত তোলা থাকুক। অম্লানের ক্লান্তিহীন মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো নীলাক্ষী।

প্রফুল্ল ও পাঞ্জাবী পরা যুবক বেঞ্চিতে পাশাপাশি বসে আছে। গাছের পাতার ফাঁক ফোকর দিয়ে সূর্যের সোনালী আলোর আভা এসে পড়ছে গায়ে। প্রফুল্ল’র শাড়ির আঁচলে জমছে নক্ষত্রের মতো আলোর বিন্দু। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে প্রফুল্ল বললো, ‘দেখুন দেখুন আমার আঁচলে তারা নেমে এসেছে।’
– ‘হুম। আমিই তো তারা জ্বেলে দিয়েছি।’
– ‘বাব্বাহ! আপনি কথার পিঠে কথার ভালোই উত্তর দিতে পারেন।’
– ‘পারতে হবে না বুঝি?’
– ‘আপনি কি জানেন আপনি খুব সুন্দর করে ‘বুঝি’ উচ্চারণ করেন।’
– ‘আমি প্রত্যেকটা শব্দই সুন্দর করে উচ্চারণ করি। এটা খেয়াল করেননি বুঝি?’
– ‘আপনার এই বুঝি’টা আমার বেশি ভাল্লাগছে।’
– ‘শুনে ধন্য হলাম।’
– ‘আপনি এত অল্পতেই ধন্য হোন? ধন্য হবার মতো এটলিস্ট একটা কারণ থাকতে হবে তো নাকি?’

যুবক মধুর ভঙ্গীতে হেসে বললো, ‘যে আমার জন্য শাড়ি পরে অপেক্ষা করছে, তার একটা প্রশংসনীয় বাক্যে আমি ধন্য হবো না বুঝি?’
– ‘আবারও বুঝি?’
– ‘হা হা হা।’

দুজনে হাসিমুখে পাশাপাশি বসে থাকে। প্রফুল্ল’র মনটা ভীষণ ভালো। অম্লান তাকে দেখে নিশ্চয় ভেবে নিয়েছে এই ছেলেটা তার বয়ফ্রেন্ড, প্রফুল্ল অনেক ভালো আছে। ভাবুক। যা ইচ্ছে হয় ভেবে নিক সে। প্রফুল্ল ভালো আছে, সে সত্যিই ভালো আছে। এটা দেখে অম্লান কি ভাবলো তাতে কিচ্ছু আসে যায় না তার। প্রফুল্ল একটা সময় ভাবতো অম্লানের কাছে তার খারাপ থাকার দিনগুলো প্রকাশ করলেই বোধহয় অম্লান খুশি হবে। প্রফুল্ল তাকে ছাড়া ভালো নেই, এই সত্যটা দেখে অম্লানের আনন্দ হবে। কিন্তু আজকাল আর সেই বিদঘুটে আনন্দটুকু অম্লানকে দিতে চায় না প্রফুল্ল। সে ভালো থাকতে চায়। ভালো থাকার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারপরও অম্লানের কাছে তার খারাপ থাকা প্রকাশ করা হলে, তাতে স্বার্থকতার কিছুই থাকবে না। অম্লান দেখুক, সে বিয়ে করে ভালো থাকতে পারলে প্রফুল্লও পারে।

পাঞ্জাবিওয়ালা জানতে চাইলো, ‘আপনার প্রিয় খেলোয়াড় কে?’
-‘ফুটবল না ক্রিকেট?’
পাঞ্জাবীওয়ালা মুচকি হেসে উত্তর দেয়, ‘দুনিয়াতে কি ফুটবল ক্রিকেট ছাড়া আর কোনো খেলা নেই? প্রিয় খেলোয়াড় জিজ্ঞেস করলেই কেন ক্রিকেট না ফুটবল চলে আসবে?’

প্রফুল্ল মুখ বাঁকা করে রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে রইলো। লোকটা দেখি আচ্ছা বিচ্ছু। দেখতে মার্জিত হলেও দুষ্টুর শিরোমণি বটে। প্রফুল্ল হাসি চেপে রাখতে না পেরে হেসে ফেললো। তারপর উত্তর দেয়, ‘এই দুটো খেলাই দেখি। অন্য খেলা মাঝেমাঝে চোখে পড়লেও তাদের খেলোয়াড়দের নাম আমি মনে রাখতে পারি না।’

যুবক চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে মিষ্টি মিষ্টি হাসি। বললো, ‘ওকে। তাহলে এই দুটোই শুনি।’

প্রফুল্ল উত্তর দিলো, ‘ফুটবল হলে নেইমার আর ক্রিকেট হলে অফ কোর্স সাকিব।’
যুবক মাথা দোলালো। প্রফুল্ল জানতে চায়, ‘আর আপনার?’
– ‘ঠিক উলটো। ফুটবলে মেসি আর ক্রিকেটে আশরাফুল।’
– ‘ওহ আচ্ছা। বেশ ভালো।’
– ‘দুজনের পছন্দ আলাদা। আচ্ছা দেখি আর কি কি অমিল আছে আমাদের মাঝে।’

প্রফুল্ল শাড়ির আঁচলটা সামনে এনে বেশ কয়েকবার দোল দিয়ে উত্তর দেয়, ‘এই যে আমি শাড়ি আর আপনি পাঞ্জাবী। এটাও কিন্তু অমিল। মিল থাকলে আপনিও শাড়ি পরে আসতেন।’

হো হো করে হেসে উঠলো পাঞ্জাবীওয়ালা। তার হাসির ফোয়াড়া ঝর্ণাধারার মতোই ঝিরিঝিরি বইতে লাগলো। কানে এসে লাগছে মধুর সংগীতের মতো। প্রফুল্ল অনেক্ষণ বুঁদ হয়ে সেই হাসির শব্দ শোনে। অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবে, অম্লান নিশ্চয়ই এখন মনেমনে আমাকে খুব গালাগাল করছে। হয়তো বলছে, প্রফুল্ল কয়েকদিন আগেও ফোনে কান্নাকাটি করলো। সবটাই তাহলে লোকদেখানো কান্না ছিলো। আরও কত কি যে ভাবছে কে জানে। প্রফুল্ল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

পাঞ্জাবীওয়ালা জিজ্ঞেস করলো, ‘আজকের বিকেলটা অনেক সুন্দর তাইনা?’
প্রফুল্ল সম্বিত ফিরে পায়, ‘হ্যাঁ। সত্যিই অনেক সুন্দর।’
– ‘রাতে গল্প বলার কথা আছে আপনার। ওটা কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না।’

প্রফুল্ল আত্মবিশ্বাসী গলায় বললো, ‘আমি এত সহজে কিছু ভুলি না।’
পাঞ্জাবীওয়ালা কিছুটা ঝুঁকে এসে উত্তর দেয়, ‘সেটা আপনার ব্যাপার। তবে ম্যাম, একটা কথা বলি। গল্পটা আমাকে বলার পরপরই কিন্তু আজীবনের মতো সেটা ভুলে যেতে হবে।’

প্রফুল্ল নিষ্পলক চোখে যুবকের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই লোকটা সত্যিই বিচ্ছু। কেমন অধিকার খাটাচ্ছে, বাবাহ। প্রফুল্ল আপনমনে হাসলো।

বিকেল তার অপরূপ সৌন্দর্য ছড়িয়ে সূর্যাস্তের প্রস্তুতি নেয়। প্রফুল্ল, পাঞ্জাবীওয়ালা ও রোদেলা রিসোর্টের উঠোনে সবুজ ঘাসের ওপর বসে কফি পান করে। নিঃসন্দেহে দীর্ঘ বছর পর একটি চমৎকার বিকেল কাটিয়েছে প্রফুল্ল। যুবকের সাথে মাঝেমাঝে তার চোখাচোখি হয়। কি গভীর তার দৃষ্টি। হৃদয় কাঁপানো হাসি। প্রফুল্ল বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। একটা প্রাণবন্ত বিকেল কাটিয়ে যে যার ঘরে ফিরে যায়। বিদায়ের সময় যুবক বলে দিয়েছে, রাতের খাবার খাওয়ার পর প্রফুল্ল যেন গল্প করতে যায়। এই নির্জন পরিবেশে খোলা আকাশের নিচে বসে তারা জীবনের গল্প করবে। প্রফুল্ল কাঁদবে, হাসবে, আর শোনাবে তার জীবনের এক অমোঘ প্রেমের গল্পটি। আর তারপরই তাকে সেই গল্পটি ভুলে যেতে হবে।

প্রফুল্ল ঘরে এসে নরম বিছানায় শুয়ে পড়ে। একটা বালিশ টেনে নিয়ে বুকে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে। এত আরাম বোধ হচ্ছে তার! ইচ্ছে করছে অনেকদিন এখানে থেকে যাই। আজকের দিনটা বড্ড সুন্দর ছিলো। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকার পর হঠাৎ অম্লানের মুখ ভেসে উঠলো চোখের সামনে। সে স্ত্রী’র হাত ধরে ঘুরছে। ছটফট লাগতে শুরু করে প্রফুল্ল’র। বিছানার ওপর উঠে বসলো সে।

রোদেলা জিজ্ঞেস করলো, ‘কি রে কি হলো তোর?’
– ‘অম্লান এই রিসোর্টেই আছে। ওর বউসহ।’

রোদেলা অবাক চোখে পলক ফেলতে পারে না। প্রফুল্ল’র কাছে এসে বসে। প্রফুল্ল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘যাক ওসব। পাঞ্জাবীওয়ালা মানুষটা চমৎকার না?’
– ‘হ্যাঁ রে। ছেলেটা ব্রিলিয়ান্ট। মজা করে কথা বলে।’
– ‘রাতে আমাকে ডেকেছে। উনি যতক্ষণ পাশে ছিলো আমার মনটা ভীষণ ভালো ছিলো রে। এখন আবার খারাপ লাগছে।’

রোদেলা হাসতে হাসতে বললো, ‘তাহলে ওনাকে আসতে বলি?’

প্রফুল্ল চোখ রাঙিয়ে বললো, ‘দুষ্টুমি করিস না তো। রাতে দেখা হবে। এখন আর ডাকার দরকার নেই।’

রোদেলা দুই কাপ কফি বানিয়ে এক কাপ এগিয়ে দেয় প্রফুল্ল’র দিকে। কফির মগ হাতে নিয়ে দুই বান্ধবী বসে গল্প করে। তাদের সুখ দুঃখের গল্প। সন্ধ্যা যতই পেরোচ্ছে, প্রফুল্ল উত্তেজিত হয়ে উঠছে। রাতে রিসোর্টের উঠোনে বসে পাঞ্জাবীওয়ালার সাথে গল্প করবে। মনেমনে বললো, কি জানি, বুঝতে পারছি না, আমার এত এক্সাইটেড লাগছে কেন!

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here