পর্ব ২১
দোয়েলের চোখে দীপ্তি ঝরে, চিবুকে ঝিলিক দিয়ে যায় সুখের আবেশ। প্রতিটা দিন যদি জীবনে এমন সুখময় ছন্দ বয়ে আনতো, তবে তো পৃথিবীটাই স্বর্গের মতো সুন্দর হয়ে উঠতো। ঘরে ফিরে গা থেকে শাড়ির সেফটিপিন খুলতে খুলতে আনমনা হয়ে দোয়েল এসব ভাবছিলো। পিঠের ওপর ব্লাউজের সাথে লাগানো সেফটিপিন একা খোলার সাধ্যি তার নেই।
দোয়েল অনিকের সামনে এসে বললো, ‘পিনটা খুলে দাও তো।’
অনিক বোকার মতো প্রশ্ন করলো, ‘কিসের পিন? কোথাও তো পিন দেখতে পাচ্ছি না।’
অবাক হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় দোয়েল, ‘ব্লাউজে একটা সেফটিপিন লাগানো আছে দেখতে পাচ্ছো না। এই তো আমি হাত দিয়ে ধরতে পারছি।’
‘ওহ হো। সেফটিপিন। আগে বলবা না?’
‘সেফটিপিন আর পিন হলো তো একই। তুমি এটুকু বুঝতে পারো না?’
‘না। সবকিছু বিস্তারিত না বললে বোঝা যায় না। তোমরা আজকাল শব্দকে অনেক সংক্ষিপ্ত করে ফেলেছো।’
দোয়েল ঝপ করে পেছন ফেরে। পিঠ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। তার মুখে মৃদু রাগের অভিব্যক্তি ধরা দিচ্ছে।
বললো, ‘খুলতে হবে না। আমি একাই খুলবো নয়তো টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলবো।’
– ‘এত রাগ কেন তোমার?’
– ‘হ্যাঁ আমার অনেক রাগ। আপনার আর দেখা লাগবে না আমার রাগ। আপনি যখন ফেসবুককে এফবি, গার্লফ্রেন্ড কে জিএফ, এসব বলেন তখন কোথায় থাকে আপনার এই জ্ঞান?’
দোয়েল দ্রুতপদে প্রস্থান করে সেখান থেকে। মেজাজটা হঠাৎ চড়ে গেছে তার। অনিক সবসময় কেমন যেন। উদাসীন টাইপের লোক। উদাসীনতারও একটা ধরণ থাকে। সবসময় অসহ্য ধরনের আচরণ করে। তার দেয়া উপহারটাকেও এখন ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে দোয়েলের। করিডোরে দাঁড়িয়ে মেজাজটাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলো দোয়েল। অম্লান ও নীলাক্ষীর বজ্রপাতের মতো হাসির শব্দ কানে ভেসে আসছে। দুজনে হো হো করে হেসে বোধহয় পুরো বাড়ি মাথায় তুলবে। মুহুর্তে ই ওদের রোমান্সের দৃশ্য কল্পনা করে সে। নিশ্চয় নীলাক্ষী অম্লানকে শাড়ির সেফটিপিন খুলতে বললে অম্লান ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কিংবা ওর পিঠে চুম্বনের রেখা এঁকে দেয়। অনিকের কাছ থেকে এতকিছুর আশা মোটেও করেনা দোয়েল, সে কেবল চায় অনিক ভালোবেসে কথা বলুক। সেই চাওয়াটাও নেহাত অন্যায় কিনা এটুকু আজও সে বুঝতে পারলো না। এতক্ষণ ধরে সে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, অন্যকেউ হলে তো এসে সরি বলে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতো। অথচ অনিক, দুঃস্বপ্নেও সে এখানে আসবে না।
বাদামী সংসার
লেখা- মিশু মনি
দোয়েলের কান্না আসতে চায়। ছোট ছোট বিষয়গুলো নিয়েই আজকাল মন কষাকষি হচ্ছে। এটা কখনোই ভালো দিক হতে পারে না। মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রাগ পড়ে যায় দোয়েলের। মেয়ে মানুষের জীবনটাই তো এমন। মিছেমিছি রাগ অভিমান করেই বা কি। যেটুকু প্রাপ্তি, সেটুকু নিয়েই সুখী হবার বৃথা চেষ্টা করতে হবে। আজকে সে স্বর্ণের চেইন কেন কিনলো এটা ভেবেও টেনশন করতে ইচ্ছে করে। মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে দোয়েল ঘরে ফিরে আসে।
বিছানায় শুয়ে মোবাইল নিয়ে ফেসবুকে মত্ত হয়ে পড়েছে অনিক। একটা ভিডিও দেখছে আর খিলখিল করে হাসছে। দোয়েল কাছে এসে বললো, ‘আমি রাগ করে চলে গেলাম আর তুমি ভিডিও দেখছো?’
– ‘তুমি অযথা রাগ করলে আমার কিইবা করার আছে বলো? রাগ কমলে ঠিকই ঘরে আসবা এটা তো জানি।’
দোয়েলের তর্ক করতে ইচ্ছে করে না। চুপ করে থাকে সে। একহাতে পিঠের ওপর থেকে ব্লাউজের সেফটিপিন খোলার বৃথা চেষ্টা করে। অনিক উঠে এসে বললো, ‘দাও আমি খুলে দিচ্ছি।’
– ‘লাগবে না।’
– ‘আরে দাও তো।’
অনিক হাত ধরে দোয়েলকে টেনে নিয়ে সেফটিপিন খুলে দেয়। দোয়েলের হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানির মতো হাসি পেয়ে গেলো। মুচকি হেসে বললো, ‘তুমি মাঝেমাঝে ওরকম করো কেন বলোতো? সব তো বোঝো। তাও অবুঝের মতো আচরণ করো।’
– ‘আরে বাবা বোঝার জন্য সময় দিতে হবে তো নাকি?’
– ‘সময় দিতে দিতে আমি বুড়ি হয়ে যাচ্ছি।’
– ‘আমিও বুড়া হচ্ছি। ওসব ভেবে লাভ আছে? যাও শাড়ি চেঞ্জ করে আসো। আমার মাথা ব্যথা করছে। টিপে দিও তো এসে।’
অনিক আবারও মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখে। দোয়েল এসে মোবাইলটা হাত থেকে নিয়ে বললো, ‘এটা সারাক্ষণ টিপলে তো মাথা ব্যথা করবেই।’
– ‘সারাক্ষণ কই? কেবল তো বাইরে থেকে আসলাম। একটা ভিডিও দেখতেছিলাম। মজার ভিডিও।’
– ‘আচ্ছা দশ মিনিট দেখতে পারবে। আমি আসার পর আর মোবাইল টেপা যাবে না।’
দোয়েল খুশিমনে জামাকাপড় বদলে হাতমুখ ধুয়ে নেয়। মুখে ময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে, চুল আঁচড়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে বিছানায় আসে। অনিক এখনও বিভিন্ন ভিডিও দেখার ব্যস্ত। দোয়েল বললো ‘মোবাইল রাখো। মলম এনেছি। আমি মাথা মালিশ করে দেই।’
অনিক সরে বসে। দোয়েলকে জায়গা করে দিয়ে ঘুমানোর কায়দায় শুয়ে পড়ে ও। দোয়েল তার মাথার কাছে বসে কপালে মলম লাগিয়ে মালিশ করে দিতে আরম্ভ করে। ভ্রু টিপে দেয়, মাথার চুল টেনে টেনে মালিশ করে দেয়। মনেমনে ভাবে, অনিক যেন ধীরেধীরে বদলে যায়। খুব বেশি না, একটু কেয়ার করা শিখলেই হবে। আনমনা হয়ে নানান বিষয় ভাবতে ভাবতে সুন্দরভাবে অনিকের চুল টানতে থাকে দোয়েল। মিনিট দশেক পরে ওর খেয়াল হয়। তাকিয়ে দেখে অনিক এখনও মোবাইলে ভিডিও দেখছে। দোয়েলের মনটা আবারও খারাপ হতে শুরু করেছে। কিন্তু মুখে কিছু বলে না। একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করে, ‘হয়েছে? না আরও দেবো?’
– ‘হয়েছে। থ্যাংক ইউ।’
‘থ্যাংক ইউ’ শব্দটা অনিক আনমনেই বললো। মুখে সামান্য কৃতজ্ঞতার হাসিটুকুও নেই। একবার স্ত্রীর দিকে তাকালো না অব্দি। সেই আধা ঘন্টা ধরেই তো মোবাইলে ব্যস্ত, এখন একটুখানি সময় দিলে কি হয়! দোয়েল নিঃশব্দে পাশে শুয়ে পড়ে। রাত বাড়ছে ক্রমশ। একসময় ঘুমে চোখ বুজে আসতে চায়। এখনও অনিক ফেসবুকে ব্যস্ত। আজকের বিবাহবার্ষিকীর দিনটা খারাপ গেলেও, সন্ধ্যার পর একটা উপহার, একসাথে বাইরে খাওয়া এসব নিয়েও দু একটা কথা বলা যেতো। অথচ অনিকের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। কোনো বিষয় না থাকলেও ঘুমানোর আগে স্ত্রীর সাথে দু একটা কথা তো বলা যেতেই পারে। দোয়েল শাড়ি বদলাতে যাওয়ার আগেও বলে গিয়েছিলো, আমি আসার পর আর মোবাইল টেপা যাবে না। তবুও! একটা উপহার পেয়ে মেয়েটা অনেক খুশি হয়েছিলো বটে, তবে সময় উপহাস করে বলছে, এই মানুষগুলো আজীবন এরকমই থেকে যাবে। কখনো বদলাবে না!
অনিক কে আর একবারও বিরক্ত না করে নিঃশব্দে ঘুমিয়ে পড়ে দোয়েল। যে বদলাবে না, তাকে বদলানোর বৃথা চেষ্টা আর কখনোই সে করবে না। মন মরে যায় যাক, বাকি জীবনে আর কখনো অনিকের কাছে কিছু আশা করবে না দোয়েল। বারবার শুধু একটা কথাই ওর মনে হচ্ছিলো, চেইনটা গিফট না করলেই পারতো। সারাজীবন কিচ্ছু পাইনি, ওটা দেয়ারও তো দরকার ছিলো না।
প্রফুল্ল জানালার কাঁচ সরিয়ে এক হাত বাইরে বের করে বৃষ্টি ছোঁয়ার চেষ্টা করে। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। মেঘলা দিনে আসলেই যে মনটা ঘরে থাকে না, তার প্রমাণ মিললো এবার। কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। রাতের অন্ধকার চারদিকে নির্জনতা ছাপিয়ে তুলেছে। একটু আগে আবার ঝুপ করে বৃষ্টি নামলো। এই বর্ষণে মন মাতাল হতে চায়। ছুটে বেড়াতে চায় স্বপ্নীল প্রান্তরে।
অনেক্ষণ পায়চারি করতে করতে মোবাইলটা হাতে তুলে নেয় প্রফুল্ল। কল লিস্টে মাত্র দুটো নাম্বার। একটা মায়ের, একটা বাবার। এছাড়া তাকে অদূর সময়সীমার মধ্যে কল দেবার কেউ নেই। প্রফুল্ল বেশ কিছুদিন আগের একটা নাম্বার বের করে। সেদিন রাতে খুব ডিপ্রেশনের মুহুর্তে এক আগন্তুক কল দিয়ে দু চারটা কথা বলেছিলো। সেদিন অবহেলা অনাদরে রীতিমতো রাগ দেখিয়ে কল কেটে দিয়েছিলো প্রফুল্ল। আজ আগন্তুক কে একটা কড়া করে ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছে করছে।
দুবার রিং হতেই ওপাশ থেকে একটা বিরক্তিকর কণ্ঠস্বর শোনা গেলো, ‘আপনি যে নাম্বারে ফোন করেছেন তা এই মুহুর্তে ব্যস্ত আছে।’
প্রফুল্ল মোবাইল রেখে জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে আবারও বৃষ্টি ছোঁয়ার চেষ্টা করে। এমন সময় বেজে ওঠে মোবাইলটা।
‘হ্যালো..’
‘কি খবর মিস প্রফুল্ল? মনটা কি আজকে বেশি খারাপ? নাকি বেশি ভালো?’
‘খারাপটাই আগে বলতে হলো? আপনার কি মাথাতে গেঁথে গিয়েছে যে আমি সবসময় খারাপ থাকবো?’
‘আরেব্বাহ! কন্ঠ দিয়েই তো সুখ ঝরে পড়ছে। আনন্দে ঝলমল ঝলমল করছে। আমার মোবাইলের স্ক্রিনও দেখি ঝিলিক দিচ্ছে। আপনার আনন্দের রশ্মি পাঠাচ্ছেন নাকি হুম?’
প্রফুল্ল হেসে বললো, ‘হ্যাঁ পাঠাচ্ছি। আপনি মশাই অনেক মজা করে কথা বলেন।’
‘আহা! শুনে কৃতার্থ হলাম।’
প্রফুল্ল বললো, ‘আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে ফোন করেছি। যদিও সেদিন রাগের মাথায় আচরণটা শোভনীয় হয়নি। আজকের আচরণের স্রোতে সেদিনেরটা ভেসে যাক। কি বলেন?’
– ‘হ্যাঁ। আমি এই প্রস্তাবে রাজি আছি। ভেসে যাক সমস্ত জরা, জীর্ণ আর দুঃখের ইতিহাস।’
– ‘দুঃখের ইতিহাস?’
– ‘হুম। দুঃখের ইতিহাস গুলোই তো আমাদের জীবনকে বেখাপ্পা করে তোলে। যাইহোক, এখন কি অবস্থা আপনার?’
প্রফুল্ল হেসে বললো, ‘কন্ঠ শুনে বুঝতে পারছেন না?’
‘হুম পারছি। সাউন্ডস গুড। লাইক বার্ডস মিউজিক।’
‘হা হা। হয়েছে হয়েছে। আচ্ছা আপনার পূর্ণাঙ্গ নামটা বলুন তো?’
‘অপূর্ণাঙ্গ বললে ক্ষতি কি?’
‘একটা অপূর্ণ নাম শুনেই জীবনের বারোটা বাজিয়েছি।’
‘আমি আপনার জীবনের নয়টাও বাজাতে চাই না। বারোটা তো দূরের কথা। এই ভয় না পেলেও চলবে।’
‘আমি তা বলিনি। তবে নামটা শুনতে চাই। এই ধরুন কৌতুহল।’
ওপাশের মানুষটা বললো, ‘তবে কৌতুহলটা থাকুক না। আর কখনো কথা হবে কিনা আমরা তো কেউই জানিনা। যদি হয়, ভবিষ্যতে কৌতুহলটা সুদসমেত মিটিয়ে দেবো।’
প্রফুল্ল হেসে বললো, ‘ওকে ওকে। অতটাও জোরজবরদস্তি করার মেয়ে আমি নই। ভালো থাকবেন। আর অসম পরিমাণ ধন্যবাদ। এটা গ্রহণ করলে খুশি হবো।’
ওপাশের মানুষটা সহাস্যে উত্তর দিলো, ‘স্বাগত। শুনে ধন্য হলাম। রাখছি তবে।’
প্রফুল্ল কল কেটে দিলে আপনমনে হাসলো। লোকটাকে ধন্যবাদ জানানোর পরও কমতি রয়ে যায়। দু চারটা কথার বানেই কি উপকারটা না করে ফেললো। নইলে প্রফুল্ল’র সাধ্যি ছিলো না এই মরণ ব্যাধি ডিপ্রেশন থেকে বেরিয়ে আসার। জানালা দিয়ে আসা বৃষ্টির ঝাপটা গায়ে লাগতেই মিষ্টি হাসলো প্রফুল্ল। কই জীবনটা খারাপ না তো, গোছাতে পারলে জীবনটাকে দারুণ উপভোগ্যকর বলেই মনে হয়।
চলবে..