পর্ব ৩
অম্লান নিঃশব্দে বিছানার ওপর বসে। নীলাক্ষী জড়োসড়ো, থরথর করে কাঁপছে ওর সমস্ত তনু। গলাটা শুকিয়ে আসছে। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল দেখতে গেলেও এভাবে বুক কাঁপতো না। একবার প্যারাসুটে আকাশে উড়েছিল নীলাক্ষী। উপর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে ওর উত্তেজনা আর আনন্দ হু হু করে বাড়ছিল। অথচ সেই সাহসী মেয়েটা আজ একটা হৃদয়ের কাছে সমস্ত আবেদন নিয়ে ব্যাকুল হয়ে বসে আছে। লজ্জার ধূলোয় মাখামাখি হচ্ছে ওর দেহ- মন।
অম্লান নরম স্বরে বলল, ‘তাকান আমার দিকে?’
নীলাক্ষীর পুরো শরীর যেন অসার হয়ে আসে। মাথা নিচু করতে করতে থুতনি গলার সাথে লেগে যায়। বরফে আচ্ছাদিত পথের মত লজ্জা ওকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে। এই আচ্ছাদন ভেদ করে বেরিয়ে আসা যে বড়ই দুঃসাধ্য।
অম্লান আর অপেক্ষা করতে পারে না। লজ্জার ধূলোয় সেও মাখামাখি হতে হতে একহাতে নীলাক্ষীর মুখ তুলে ধরে। রমণীর আয়ত চোখ ও লজ্জাবনত মুখ মন ভরে প্রত্যক্ষ দর্শনে অম্লানের মনে হলো, সৈকতে দাঁড়িয়ে সমুদ্র সীমান্ত ভেদ করে কৃষ্ণচূড়া রঙের টকটকে লাল সূর্য উদিত হচ্ছে।
বাদামী সংসার
লেখক- মিশু মনি
কনে বিদায়ের পর পুরো বাড়িতে এক অচীন নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। আমজাদ সাহেব তখন থেকেই চেয়ারে বসে আছেন। আর ওঠবার মত শক্তি নেই ওনার। বুকের ভেতর পুষে রাখা আদরের ছোট্ট চড়ুই পাখিটাকে কেউ ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার মত কষ্ট হচ্ছে। চারিদিকে নেমে এসেছে মরুভূমির মত শুন্যতা। প্রকৃতি এমন কঠিন নিয়ম কেন তৈরি করেছে!
আমজাদ সাহেবের স্ত্রী নীলিমা বেগম মেহমানদের ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দিয়ে গেটের বাইরে এসে দেখেন নীলাক্ষীর বাবা এখনো আগের জায়গাটায় স্থির হয়ে বসে আছে। নীলিমা কাছে এসে স্বামীর হাতের ওপর হাত রাখেন। মানুষটার চোখ দুটো উদাস, যে চোখের চাহনিতে কোনো ভাষা নেই। বড় কিছু হারিয়ে স্থবির হয়ে যাওয়া চোখ। নীলিমা বেগম কোমল গলায় বলেন, ‘আর কতক্ষণ বসে থাকবা? আসো ঘরে আসো।’
আমজাদ সাহেব নির্বিকার গলায় বললেন, ‘মেয়েটা জন্মের সময় আমি বাড়িতে ছিলাম না। ভাবছিলাম ডেলিভারি ডেট আরো অনেক দেরি। বন্ধু বান্ধব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, কক্সবাজার। আমি কতটা উদাসীন, দায়িত্বজ্ঞান হীন মানুষ ছিলাম বলো। কক্সবাজার থেকে বাড়ি ফিরে দেখি তুমি একটা ফুটফুটে বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে আছো। তোমার সেই উঁচু পেট টা আর নেই। আমার বুকে সুখের মত ব্যথা অনুভূত হয়। এই ফিলিংসের সাথে দুনিয়ার কোনোকিছুর তুলনা খাটে না। দৌড়ে এসে পাগলের মত জিজ্ঞেস করি, এটা আমার বাচ্চা? আমার বাচ্চা!’ আমার চোখেমুখে আনন্দ দেখে তুমি ছলছল চোখে অভিমানী গলায় বলেছিলে, ‘বাচ্চা আমার একার। তোমার না।’
আমি সেদিন বড়সড় একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। মেয়েকে কোলে নিয়ে দুনিয়ার জাগতিক সমস্ত বিষয় ভুলে গিয়েছিলাম। কি সুন্দর একটা ফুটফুটে বাচ্চা আমার। ছোট্ট ছোট্ট পা নাড়াচাড়া করছে। ছোট ছোট আঙুল। আমি ভয় পাচ্ছিলাম যদি আমার হাতের ফাঁক দিয়ে পড়ে যায়। সেই ভয়ে দুইদিন কোলেই নেই নাই।’
নীলিমা বেগম অতীতের সেই সময়টাতে ফিরে গেলেন। এখনো সব স্মৃতি টাটকা, স্পষ্ট। আমজাদ সাহেবের একটা সাদা ফতুয়া ছিলো। বন্ধুর দেয়া গিফট বলে সে সারাক্ষণ ওটাই পরতো। সামান্য দাগ লাগলে ফতুয়ার জন্য আফসোস করতো। অথচ বাচ্চাটা পায়খানা করে দেয়াতে আমজাদ সেদিন কি খুশি! যেন এরচেয়ে আনন্দের আর কিছু হয় না। বাবা হওয়ার অনুভূতিটা অন্যরকম।
সেই দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষটা হুট করে সব বন্ধু বান্ধবের আড্ডা থেকে দূরে সরে আসে। একটা বাচ্চার মুখ ওনার পুরো জীবনকে বদলে দিয়েছিল। প্রতিদিন অফিস শেষে বাসায় ফিরে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে থাকতেন। নীলিমা রান্না করতো। বাচ্চাটা সামান্য কান্না শুরু করলেই শুরু হয়ে যেত আমজাদের ছোটাছুটি। পুরো আঙিনা নাচানাচি করত, কবিতা, গান কত কি শোনাতো। দুদিন পরপর খেলনা কিনে আনতো। মেয়ের জামাকাপড় আর খেলনা দিয়ে একটা ঘরের অর্ধেক জায়গা বন্ধ হয়ে গেলে নীলিমা পাড়া পড়শিকে ডেকে খেলনা বিলিয়ে দিতো। নীলাক্ষী যখন প্রথম কথা বলা শেখে, আমজাদ সেদিন ওর অফিসের সব কলিগকে বাসায় দাওয়াত দিয়ে খাওয়ায়। ক্লাস ফাইভে নীলাক্ষী ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেলে নীলাক্ষীর স্কুলের সমস্ত বাচ্চাকে মিষ্টি খাইয়েছিলো আমজাদ। মানুষটা পাগল ধাচের। মেয়েটা যখন যা চাইতো, তাই এনে দিতো। প্রতি মাসের বেতন থেকে এক হাজার টাকা তোষকের নিচে ঢুকিয়ে রাখতো যদি মেয়ে হুট করে কোনো আবদার করে বসে, মেয়ের চোখে পানি আসার আগেই সেটা কিনে দিতে হবে তো। আজ থেকে কার আবদার পূরণ করবে এই পাগল বাবাটা? কার জন্য ব্যাগভর্তি করে ফল কিনে আনবে?
আমজাদের স্বভাব হচ্ছে বাজারে মৌসুমি ফল দেখলেই ব্যাগ বোঝাই করে কিনে আনা। মেয়ে খাবে। জুতার দোকানের ডিসপ্লে তে ভালো ডিজাইনের কোনো জুতা দেখলেই মেয়ের জন্য কিনে আনতেন। দুই ফিতাওয়ালা জুতা ছাড়া আর কোনো জুতাই নীলাক্ষীর পায়ে খাপ খায় না, অন্য জুতা পরলে ফোস্কা পড়ে যায়। একবার নীলাক্ষীর পায়ে ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল, আমজাদ সাহেব জুতার দোকানে গিয়ে সমস্ত জুতা ডিসপ্লে থেকে ফেলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার মেয়ের পায়ে ফোস্কা পড়বে কেন? সব জুতা ড্রেনে ফেলে দিবো।’
দোকানদার পরবর্তীতে নীলাক্ষীকে জুতা দেয়ার সময় বুঝেশুনে দিতেন। আমজাদ সাহেবের হঠাৎ মনে পড়ে, আজকে তো নীলাক্ষী নতুন জুতা পরেছে। ওর পায়ে সব জুতা খাপ খায় না। আজকেও নিশ্চয় ফোস্কা পড়েছে। বাবা আজ কাকে রাগ দেখাবেন? ওনার হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করে।
নীলিমা বেগম স্বামীকে তুলে ধরে ঘরে আসার অনুরোধ করেন। আমজাদ উঠে দাঁড়ান। ভাগ্যিস বিয়েটা আয়োজন বাসায় করেছেন। কমিউনিটি সেন্টারে প্রোগ্রাম হলে, মেয়েকে বিদায় দিয়ে বাসা পর্যন্ত আসার শক্তি আর থাকতো না ওনার।
ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস। যে মেয়েকে বুকে রেখে বড় আদর দিয়ে মানুষ করেছেন, সে এখন অন্যের বাসায় মাছ ভাজতে গিয়ে হাতে তেল ছিঁটকে আসবে। ওনার মনটা কেমন আনচান করে। কিন্তু এই তো জগতের নিয়ম। নীলিমাও তো বাবার আদরের মেয়ে, এ বাড়িতে এসে কতবার কাজ করে হাতে ফোস্কা ফেললো। তখন তো এরকম অনুভূতি হয়নি। অথচ আজ নিজের মেয়ের জন্য হচ্ছে। কথাগুলো ভেবে স্ত্রী’র জন্য বুকটা উথাল পাথাল করে। এই প্রথম ওনার মনেহয়, নীলিমাকে আরেকটু বেশি ভালোবাসা দরকার।
অম্লানের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নীলাক্ষী খেই হারিয়ে ফেললো। মানুষটাকে ওর এত আপন, এত কাছের মনে হচ্ছে! যেন হাজার বছরের চেনা। যেন কত বার দুজনে একই ছাতার নিচে পথ হেঁটেছে, যেন কতবার দুজনে পাশাপাশি বসে একে অপরের মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছে। কেন এমন লাগে নীলাক্ষীর! বিয়ের আগে ক্ষণিকের দু এক পলক দেখা। কই, আর কোনোদিনও তো দেখে নি তাকে। তবুও আজ হৃদয়ের অনুভূতিরা উচ্ছসিত হয়ে জানান দিচ্ছে, ‘এই মানুষটা আমার, শুধুই আমার।’
নীলাক্ষীর বুক ধুকধুক করছে। অম্লান বললো, ‘একটা কথা বলি? আজকের রাতটা আমাদের জীবনে আর কখনোই আসবে না। এই অনুভূতি, এই যে নতুন একজনের সাথে পরিচিত হওয়া, আপন হওয়া। সবকিছু মিলে এই রাতটার সাথে জীবনের আর কোনো রাতের তুলনা হয় না। চলুন আজকের রাতটা আমরা অনেক দীর্ঘ করে তুলি।’
নীলাক্ষী চোখ তুলে তাকায়। কিছু বলতে পারে না। ওর কেবলই বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়।
অম্লান বললো, ‘বেশিরভাগ ছেলেরা বাসর ঘরে ঢুকেই স্ত্রীর ওপর হামলে পড়ে। যেন শরীরই সব। কিন্তু আমার কাছে বাসর রাত মানে স্ত্রীর সাথে শুধু সঙ্গম নয়। আমি আমার চিন্তা চেতনায় বিশ্বাস করি। দুজন দুজনের প্রতি মায়া জন্মানোর আগে কিংবা প্রেমে পড়ার আগে যদি শারীরিক সম্পর্ক হয়, তাহলে তো বিয়ে না করে নিষিদ্ধ পল্লীতে রাত কাটানো ভালো। অর্ধাঙ্গিনী মানে শরীরের অর্ধেক অঙ্গ। জীবনের সবচেয়ে অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাকে আগে আপন করতে হবে, ভালোবাসতে হবে, তারপর অন্যকিছু। আপনি আমাকে ভয় পাবেন না। আপনার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আমি দিচ্ছি।’
নীলাক্ষীর চোখ ভিজে আসছে। পরম সুখের আবেশে ওর চোখ ছলছল করে। এমন একটা মানুষকে ভালো না বেসে কি থাকা যায়? যার ভাবনা গুলো এত নির্মল, বিশুদ্ধ। অম্লানের দিকে অনেক্ষণ মন ভরে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে ওর।
অম্লান বললো, ‘আপনার অনেক কষ্ট হইছে। আপনি প্লিজ সুন্দরভাবে একটা শাওয়ার নিয়ে আসেন। ভাল্লাগবে। তারপর আমরা অনেক গল্প করবো। আগেই কিন্তু বলেছি, আজকের রাতটাকে আমরা অনেক দীর্ঘ করে তুলবো।’
নীলাক্ষী ঠায় বসে থাকে। অম্লান উঠে ওয়াশরুম থেকে ঘুরে এসে বলে, ‘সবকিছু ঠিকঠাক আছে। আপনি যান।’
নীলাক্ষী উঠে দাঁড়ায়। ঘোমটা খুলতেই যেখানে অনেক কষ্ট হচ্ছে, সেখানে কিভাবে সব সেফটিপিন খুলবে বুঝতে পারে না। অম্লান এগিয়ে এসে হাত লাগালো নীলাক্ষীর মাথায়। হাতের সাথে হাতের স্পর্শ লাগতেই নীলাক্ষী চমকে ওঠে। অম্লান বললো, ‘আমি হেল্প করছি। আমার কাছে সংকোচ করবেন না। দেখুন সবকিছু ছেড়ে যখন চলেই এসেছেন, যত দ্রুত আমাকে আপনার আপন করে নেবেন, আপনার ততই লাভ।’
নীলাক্ষী দুম করে বললো, ‘কি লাভ?’
কথাটা বলেই ও লজ্জায় পড়ে গেলো। আসলে ও বলতে চায় নি। অজান্তেই বেরিয়ে গেছে।
অম্লান হেসে বললো, ‘সবকিছুতেই লাভ। আমি ছাড়া আর কার ঠেকা পড়েছে আপনাকে হেল্প করবে?’
– ‘আপনি বুঝি আমার ঠেকা সারবেন?’
– ‘বিয়ে যখন করেছি, সব ঠেকা তো আমারই। মানে দায়িত্ব আরকি।’
– ‘আমার বুঝি ঠেকা সামলাতে হবে না?’
– ‘হবে। আমার চেয়ে বেশি সামলাতে হবে। তাও বললাম আরকি। ভালো স্বামী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে না?’
অম্লান হেসে উঠলো। সামনের আয়নায় নীলাক্ষী অম্লানকে দেখে মুখ টিপে হাসছে। অম্লান এক এক করে মাথার সব ক্লিপ, চুলের বাঁধন, শাড়ির সেফটিপিন খুলতে সহায়তা করে।
নীলাক্ষী গোসল সেরে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখল সামনে একটা সুতা ঝুলছে। তাতে একটা ছোট কাগজে লেখা, ‘এটা টানুন।’
যথারীতি নীলাক্ষী সুতাটা ধরে টান দিতেই এক ঝাঁক ফুলের পাপড়ি উপর থেকে পড়লো ওর মাথায়। গোসলের পর বেশ সতেজ লাগছিল। এই ফুল দিয়ে বরণ করার ব্যাপারটা মনটা আরো বেশি ফুরফুরে করে দিলো।
অম্লান জামাকাপড় বদলে একটা টি শার্ট পরে বারান্দায় বসে আছে। খানিক বাদে বারান্দায় ছায়া পরলো নীলাক্ষীর। অম্লান বললো, ‘আসুন।’
নীলাক্ষী বারান্দায় এসে একটা চেয়ারে বসে। পাশাপাশি দুটো চেয়ার। বারান্দার অর্ধেক পর্যন্ত গ্রিল, বাকি অর্ধেক ফাঁকা। বিশাল বারান্দা। দুটো লম্বা চেয়ার রাখার পরও একদিকে ফুলের টব, মানিপ্লান্টের চারা, দু একটা মাটির পাত্রে কিছু গাছও আছে। দূর থেকে আলো এসে পড়েছে বারান্দায়। সামনের ঘুমন্ত বাড়িগুলোতে টিমটিমে আলো জ্বলছে। সদ্য বিবাহিত দুজন বর কনে বসে আছে পাশাপাশি। একজন আরেকজনের প্রতি অনুভব করছে প্রবল আকর্ষণ। অপর মানুষটাকে জানার জন্য আর তর সইছে না। মানুষটা কেমন করে খায়, কিভাবে হাঁটে, ঘুমানোর সময় কি মাথার নিচে একটা হাত দিয়ে ঘুমায়? বাজার করার সময় কি ব্যাগ আগে এগিয়ে দেয়, নাকি আগে টাকা? সে কি দরদাম করে জিনিস কেনে নাকি ভালো লাগলেই কিনে ফেলে। চায়ের কাপ সবসময় ডান হাত দিয়ে ধরে নাকি বাম হাত দিয়ে? আচ্ছা, সে কি শ্যাম্পুর বোতল ব্যবহার করে নাকি মিনি প্যাক? গোসলের সময় দাঁত দিয়ে কামড়ে শ্যাম্পুর প্যাকেট ছিঁড়ে। কতকিছু পরে আছে জানার!
চলবে..