পর্ব ২
অম্লানের কথামত হায়দার ভাই গাড়ি ভিন্ন রাস্তা দিয়ে ঢোকায়। গাড়ি দাঁড় করায় একটা চায়ের দোকানের সামনে। টঙের উপর বসে থাকা গুটিকয়েক জনতা উৎসুক চোখে গাড়ির দিকে তাকায়। জানালার কাঁচের ভেতর দিয়ে মাথায় পাগড়ী পরা বরকে দেখা যাচ্ছে। বর বউয়ের চেহারা দেখার জন্য তাদের মন আকুপাকু করে।
রাত খুব বেশি নয়, বড়জোর দশটা। শহরের চাঞ্চল্যতা এখনো কমেনি। পুরো শহর ঘুমঘুম চোখে জোর করে জেগে আছে। ঠিক সদ্য বিয়ে করা অম্লানের নতুন বউয়ের মত।
বাদামী সংসার
লেখক- মিশু মনি
অম্লান দোকানীকে বলে, ‘মামা দুধ চিনি বেশি করে কড়া লিকারের তিন কাপ চা দিও।’
নীলাক্ষী চোখ তুলে এদিক সেদিক তাকায়। সবকিছু আগের মত আছে। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলো, রাস্তায় গাড়ির ছুটে চলা, ফুটপাতের একপাশে বয়ে চলা ড্রেন। শুধু তাকেই আজকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। যে সাজে এই শহর আগে ওকে কখনোই দেখে নি।
টঙ থেকে তিনজন লোক উঠে বর কনে’কে জায়গা করে দেয়। সেখানে বসে অম্লান ও নীলাক্ষী। হায়দার ভাই দোকানের সামনে চেগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর পেট স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে তিন ইঞ্চি সামনে বেড়েছে। শৈল্পিক ব্রান্ডের নতুন সাদা পাঞ্জাবি আর সদ্য বেড়ে ওঠা পেট তার বয়স যেন খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। মনে হচ্ছে আজ খাওয়া একটু বেশি হয়ে গেছে। নীলাক্ষীদের গরুর মাংস রান্নাটা জম্পেশ হয়েছিলো।
দোকানী লিকারের সাথে দুধ চিনি মেশাচ্ছেন। নীলাক্ষী তাকিয়ে আছে। কাপে ঝুনঝুন করে শব্দ হচ্ছে। মনেহচ্ছে দোকানদার ঝুনঝুনি বাজাচ্ছে। চায়ের রং ধীরেধীরে লাল থেকে বাদামী হতে শুরু করেছে। নীলাক্ষীর প্রিয় রঙ।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অম্লান বললো, ‘আমার ঘনঘন চা না হলে চলে না। আমি তুখোড় চা খাই। বন্ধুরা সিগারেট খেতে জেদ ধরলে সিগারেট চায়ের কাপে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খাই। ভীষণ মজা।’
নীলাক্ষী মুখ টিপে হাসে। লোকটা দারুণ তো। মিশুক স্বভাবের মনে হচ্ছে। নীলাক্ষীর অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মুখ দিয়ে টু শব্দও বের হলো না। সংকোচ কাজ করছে। কিভাবে সহজ হবে সেই ভাবছিলো ও। অম্লান বললো, ‘আসেন গাড়ি দেখি।’
নীলাক্ষীর লজ্জা লজ্জা লাগতে শুরু করে। দোকানের সামনে বসা লোকগুলোর উৎসুক চোখ তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে তারা বর বউয়ের কর্মকাণ্ড দেখে খুব মজা পাচ্ছে। নতুন বর বউ গাড়ি থামিয়ে চা খাচ্ছে। সাথে আর কেউ নেই। । যেন এরচেয়ে মজার দৃশ্য তারা ইহজনমে দেখে নি। তাদের চোখ উপেক্ষা করে গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে নীলাক্ষীর একেবারেই ইচ্ছে করছে না। লজ্জার স্রোতে ভেসে যাবে ও। স্রোত থেকে টেনে তোলার মত সম্পর্কটা এখনো অম্লানের সাথে হয়ে ওঠে নি।
অম্লান উঠে দাঁড়ালো। পরপর দুইবার বললো, ‘আসুন?’
নীলাক্ষী লজ্জা ঠেলে ধীরপায়ে এগিয়ে যায়। নতুন জুতা পরার কারণে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। বরপক্ষের দেয়া জুতা। বোধকরি পায়ের কনিষ্ঠ আঙুল আর গোড়ালি থেকে চার ইঞ্চি উপরে সুন্দরমত দু একটা ফোস্কা ইতিমধ্যে জায়গা দখল করে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।
গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ানো মাত্র নীলাক্ষীর চোখ দুটো বিস্ময়ে গোল গোল হয়ে ওঠে। গাড়িটা সাজানো হয়েছে ঘাসফুল দিয়ে। সাদা রঙের গাড়ির উপর সবুজ ঘাস, ফাঁকে ফাঁকে মেরুন রঙের ছোট ছোট ফুল। কি চমৎকার লাগছে দেখতে! যেন কেউ খুব ভালোবাসা দিয়ে, হৃদয় থেকে সমস্ত যত্ন নিংড়ে নিয়ে সাদা মাটিতে ঘাসফুলের চাষ করছে। এটা না দেখলে ও জানতেই পারতো না ঘাসফুল দিয়েও গাড়ি সাজানো যায়।
অম্লান হায়দার ভাইকে আসতে ইশারা করলো। নীলাক্ষী কে নিশ্চুপ থাকতে দেখে অম্লান বললো, ‘ভালো লেগেছে?’
নীলাক্ষী মাথাটা উপর নিচে কয়েকবার ঝাঁকায়। মুখে কোনো উত্তর দেয় না। ও এখন উত্তেজনার সিঁড়িতে পা রাখতে শুরু করেছে। সম্পর্কটা যতই এগিয়ে যাচ্ছে, ও চরম উত্তেজনার দিকে একটু একটু করে ধাবিত হচ্ছে। হায়দার ভাই রাস্তায় চলে এলে অম্লান ওর পকেট থেকে ফোন বের করে হায়দার ভাইয়ের হাতে দিয়ে নীলাক্ষীর পাশে এসে দাঁড়ায়। মুখে কোনোকিছু বলার আগেই হায়দার ভাই ফটফট করে গাড়িসুদ্ধ নতুন বর কনে’র ছবি তুলে নেয়। নীলাক্ষীর কেবলই মনে হচ্ছিলো, ‘এত এত ক্যামেরাম্যান, এত এত ছবির ভিড়ে এই একটা ছবিই হয়তো সবচেয়ে সেরা হবে।’
ওর হঠাৎ খুব অস্থির অস্থির লাগে। দখিনা হাওয়ার শীতল বাতাসে ওর শরীরটা শিরশির করে ওঠে। নতুন কোনো অনুভূতির দোলা গায়ে লাগছে। অনুভূতিটা ঠিক সমুদ্রের ঢেউয়ের মত। নীলাক্ষীর নিজেকে মনেহয় সমুদ্র তীরের বালি। অনুভূতিরা প্রবল বেগে তীরে আছড়ে পড়ে ওকে ক্রমশই ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। জোয়ার বাড়ছে একটু একটু করে, আর একটু একটু করে সিক্ত হচ্ছে তীরের শুষ্ক বালি।
অম্লান জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার ফোন কোথায়? বাসায় কথা বলতে ইচ্ছে করলে চাইলে ফোন দিতে পারেন।’
নীলাক্ষী সৌজন্যতাসূচক হেসে বললো, ‘থ্যাংকস। এখন লাগবে না।’
চায়ের বিল মিটিয়ে ওরা আবার গাড়িতে এসে ওঠে। অম্লান কি বলবে খুঁজতে খুঁজতে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি তো অল্প একটু ভাত খেয়েছেন। খিদে লাগলে আমাকে লজ্জা না করে বলবেন। আমি খাবারের ব্যবস্থা করবো।’
নীলাক্ষী মনেমনে হাসে। ওর মনে আষাঢ়ের মেঘ এখন শরতের মেঘের রূপ নিয়েছে।
অম্লান অনেক্ষণ ধরে ভাবছে কি বলা যায়। নতুন বউকে ইমপ্রেসড করার জন্য মনোমুগ্ধকর কিছু শব্দ বাছাই করতে হবে। যেন এক ঝটকায় প্রেমে পড়ে যায়। তার মনে হোক, সে জগতের সেরা মানুষটাকে স্বামী হিসেবে পেয়েছে। কিন্তু সংকোচ তো অম্লানেরও লাগছে। হাজার হলেও সম্পূর্ণ অচেনা একজন নারী। একইসাথে উত্তেজনায় শেরোয়ানির বুক পকেট বরাবর জায়গাটায় কিছু একটা জোরে জোরে লাফালাফি করছে। যেটাকে মেডিকেলের ভাষায় লোকজন হার্টবিট বলে সম্বোধন করে।
অম্লান বললো, ‘আচ্ছা, দুধ টক হয়ে নষ্ট হয়ে গেলে এক ধরণের নরম ছানা হয়ে যায়। ওই ছানাটাকে আমি বলি দই। চিনি দিয়ে মাখিয়ে খেতে খুব মজা। খেয়েছেন কখনো?’
নীলাক্ষী অবাক হলো। লোকটা তো ভারি অদ্ভুত। অদ্ভুত সব প্রশ্ন করে। ও হেসে বললো, ‘হুম।’
– ‘অনেক মজা না খেতে?’
– ‘হুম।’
অম্লান বললো, ‘ওই কোমল ছানাটা পাতিলের গায়ে যেভাবে ছোট ছোট হয়ে লেগে থাকে। আপনার চোখেমুখে এখন সেভাবেই ছোট ছোট ঘুম লেগে আছে।’
নীলাক্ষীর একটা শিরশিরে শীতল অনুভূতি হয়। মুগ্ধ না হয়ে পারে না। কি চমৎকার উপমা। ও মনেমনে হেসে ফেলে। মুখে হাসি চেপে রাখতে গিয়ে ধরা পড়ে অম্লানের হাতে।
অম্লান বললো, ‘আপনি চাইলে দাঁত কেলিয়ে হাসতে পারেন। নতুন বিয়ে হয়েছে বলে আর্ট করে হাসতে হবে এমন কিছু নেই। আপনার হাসি যদি জগতের সবচেয়ে বিশ্রী হাসিও হয়, যেহেতু আপনি আমার বউ। এখন আমার মনেহবে মোনালিসা হাসছে। কি বলো হায়দার ভাই?’
হায়দার ভাই সমর্থন জানায় অম্লানের কথায়। নীলাক্ষীর খুব লজ্জা লাগে। ও লজ্জায় কোথায় মুখ লুকোবে জায়গা খুঁজে পায় না। মানুষটা বারবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। ইস! কি লজ্জা লজ্জা লাগে।
অম্লান সংকোচ করতে করতে অবশেষে লাজ লজ্জা ভুলে নীলাক্ষীর মাথাটা নিজের কাঁধের উপর নিয়ে নিলো। নিজের বউ তো, লজ্জা পুষিয়ে রেখে লাভ কি? হায়দার ভাইকে বললো এসি বাড়িয়ে দিতে। এরপর নীলাক্ষীকে মৃদুস্বরে বললো, ‘কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিন। ভয় পাবেন না, মুখে ছানার মত লেগে থাকা ঘুমগুলো আমি খেয়ে ফেলবো না। পেট খারাপের ভয়ে জীবনে ক্রিম দিয়ে সাজানো বার্থডে কেক খাইনি। আমি কেকের ভেতরের অংশ খাই।’
নীলাক্ষীর বুক ধুকপুক করে ওঠে। অস্থিরতা খানিকটা বেড়ে যায় ওর। অম্লানের সেন্স অব হিউমার অনেক উন্নত। মনেহচ্ছে লোকটা মেক আপের উপমা হিসেবে কেকের ক্রিমকে উল্লেখ করেছে। দারুণ দুষ্টুও আছে বটে। নীলাক্ষীর হাত, পা, সমস্ত তনু যেন থরথর করে কাঁপছে। কি লজ্জা!
হঠাৎ নীলাক্ষীর মনে একটা কোমল অনুভূতি জাগে। জীবনে প্রথমবার বাবার পরে অন্য কোনো পুরুষের কাঁধে মাথা রেখে তার মনে হয়, এই কাঁধটা এখন নির্ভরতার। কারো কাঁধে মাথা রাখাটা এত সুক্ষ্ম কোমল অনুভূতির জন্ম দিতে পারে, ওর জানা ছিল না। ক্লান্তিতে দুচোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি।
ঘুম ভাঙলো অম্লানের ডাকে। ও নরম সুরে ডাকছে, ‘এই যে উঠুন। আমরা চলে এসেছি।’
নীলাক্ষী চোখ মেলে ঘুমঘুম চোখে বাইরে তাকায়। একটা বিশাল গেট। বাড়ির গেট ও দেয়ালে চারদিকে মরিচ বাতি মিটমিট করে জ্বলছে। ও চোখ কচলে বলল, ‘সরি।’
অম্লান মুচকি হেসে ফোন বের করে মাকে কল দেয়। মা বললেন কোনোভাবেই যেন গাড়ি থেকে না নামে। মুরুব্বিরা এসে বরণ করে নেবেন। যথা আজ্ঞা। অম্লান ও নীলাক্ষী গাড়িতেই বসে রইলো। মুরুব্বিদের গাড়ি আসলো অনেক্ষণ পর। তারা ভেতরে গিয়ে আর বাইরে আসার নাম নেই। বোধহয় হাতমুখ ধুচ্ছে, হাবিজাবি রেডি করছে। অম্লান একবার বউকে নিয়ে নেমে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু প্রথমবার নিজের বাড়িতে কেউ ফুল দিয়ে বরণ করে নেবে, এই ফিলিংস তো ফেলে দেয়া যায় না। গাড়ির আশেপাশে উৎসুক জনতা (আত্মীয়রা) ঘুরঘুর করছে। গাড়ি থেকে নামালো আরো মিনিট পনের পর।
নীলাক্ষীর পা ব্যথা করছে। এত কোলাহল, লোকজন সবকিছু ডিঙিয়ে ভেতরে গিয়ে বসলো যখন, তখন রাত এগারো টা দশ।
কত আয়োজন, আনুষ্ঠানিকতা একের পর এক চলতেই লাগলো। সব আয়োজন শেষ হবার পরও নীলাক্ষীকে বসিয়ে রেখেছে বসার ঘরে। আশেপাশে অচেনা সব মহিলা, বাচ্চাকাচ্চা। নীলাক্ষী কাউকেই চেনে না। ওর চেনা পরিচিত একটা মুখও নেই। সবাই কত হাসাহাসি করছে, একজন হেসেই আরেকজনের গায়ের উপর ঢলে পড়ছে। কিন্তু নীলাক্ষী চুপচাপ, একা। শান্ত হয়ে বসে থাকা ছাড়া ওর কোনো কাজ নেই। কেউ কথা বলতে আসছে না, কেউ আদর স্নেহ করতেও আসছে না। অথচ সবাই বলছে তারা আত্মীয়, তারা স্বজন। তবুও নীলাক্ষীর এত একা একা লাগছে কেন!
নীলাক্ষী দু একবার চোখ তুলে ঘরের দিকে তাকায়। অনেক প্রশস্ত বসার ঘর। একদিকে বাঁশ, বেতের সোফা। অন্যদিকে ফোমের সোফা। অফ হোয়াইট রঙের দেয়াল। সবকিছু ওর অচেনা লাগছে। এই ঘর কোনোদিনও দেখে নি ও। বিয়ের আগে যে ঘরটা কল্পনা করেছিল, তার সাথে এর বিন্দুমাত্র মিল নেই। তবে এই বাড়িটা কল্পনার চেয়েও সুন্দর।
নীলাক্ষী বসে আছে ফোমের সোফার ওপর। ও সোফার কভারের দিকে তাকায়। হাত বুলায়। সবকিছু বড় অচেনা। সামনে রাখা টি টেবিল, টেবিলের নিচে জমানো অসংখ্য পত্রিকা। ওর মনে হচ্ছে ভুল করে অন্য কোথাও চলে এসেছে। কিংবা লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিওর ‘ইনসেপশন’ মুভির মত অন্য কারো স্বপ্নে ঢুকে পড়েছে।
আকাশের নক্ষত্র গুলো দূরে হলেও কত চেনা মনেহয়। অথচ এই মানুষ গুলো এত কাছে থেকেও অচেনা। কখনো কারো বাসায় গিয়ে একটা রাত কাটায়নি ও। আত্মীয়দের বাসাতেও গিয়েছে খুব কম। এই প্রথম কারো বাড়িতে একটা রাত কাটবে।
পাশের একটা ঘর থেকে ছেলেদের হৈ হুল্লোড় কানে ভেসে আসে। মাঝেমাঝে অম্লানের গলাও শোনা যায়। ওরা কত মজা করছে। অথচ এখানে মাথা নিচু করে হাতের মেহেদীর ডিজাইন দেখছে নীলাক্ষী।
প্রায় মিনিট বিশেক পরে বোধহয় সবার দয়া হলো। শরবত, মিষ্টি, দুধ হাবিজাবি পর্ব শেষ করে নীলাক্ষীকে নিয়ে যাওয়া হলো ওর বর্তমান ঘরে। যেখানে বাকিটা জীবন পার করতে হবে। ঘরে প্রবেশ করে প্রথমদিকে নীলাক্ষীর দম বন্ধ অনুভূতি হয়। হঠাৎ একটা মিষ্টি সুবাস এসে নাকে লাগে। চারিদিকে চোখ বুলায় ও। একদিকে দেয়ালের সাথে লাগোয়া আলমারি কেবিনেট, পাশেই একটা ড্রেসিং টেবিল। অন্যদিকে কম্পিউটার টেবিল আর পাশাপাশি রাখা দুটো সোফা। জানালায় পর্দার বদলে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে করা বেঁড়া। ঘর সাজানোয় যত্নের ছাপ।
নীলাক্ষীকে বিছানায় বসিয়ে ভাবি ও দাদীদের ঠাট্টা মশকরা শুরু হয়। চলতে থাকে মিনিট ছয়েক। সবাই যার যার দায়িত্ব শেষ করে বিদায় নেন। নীলাক্ষী এতক্ষণ পর হাফ ছেড়ে বাঁচে। এখন এই ঘরে ও একা। একদম একা।
ঘরের প্রত্যেকটা কোণায় একটা করে মাটির ফুলের টব, তাতে টাটকা হাসনাহেনা ফুল। পাতাসুদ্ধ রাখা হয়েছে। বিছানার ওপরে নতুন চাদর, নতুন বালিশ। কিন্তু কোথাও কোনো ফুল কিংবা পাপড়ি নেই। অন্যান্য বাসর ঘরের মত ফুল দিয়ে বিছানাটাকে রাজকীয়ভাবে সাজানোও হয়নি। অথচ ফুলের ঘ্রাণ আসছে। কি যে অন্যরকম লাগছে নীলাক্ষীর। এত সুন্দর আইডিয়াটা নিশ্চয় অম্লানের। সে যারই হোক, ওর খুব ভালো লাগছে। নীলাক্ষী উঠে একটা ফুলের টব থেকে নিচু হয়ে ঘ্রাণ নেয়। মনটা বড় ফুরফুরে হয়ে যায়। বিছানার পাশের ছোট্ট ল্যাম্পশেডে আলো জ্বলছে। পুরো ঘরটা একবার প্রদক্ষিণ করে এসে নীলাক্ষী বিছানায় বসে অপেক্ষা করে। বাবার কথা খুব মনে পড়ছে। এখানে পৌঁছে যখন বাবাকে কল দিলো, তখন আত্মা ফেটে কান্না আসতে চাইছিলো নীলাক্ষীর। এখন আবার কষ্টটা জেগে উঠছে।
এমন সময় ঘরে প্রবেশ করে অম্লান ও তার বন্ধুমহল। বিয়েতে একবার পরিচয় হয়েছে। অম্লান আবারও পরিচয় করিয়ে দেয়। রূপক, ফাইরুজ, কৌশিক, সাহিত্য ও কিশোর।
ফাইরুজ একটা গোলাপ ফুল এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘ভাবি ওয়েলকাম ইন ইয়োর হাজত লাইফ। আমাদের মদনাটাকে সারাজীবন মদনীর মত আগলে রাখার জন্য আশির্বাদ করছি। ঘর সাজানো পছন্দ হয়েছে?’
নীলাক্ষী মাথা ঝাঁকায়।
রূপক বলে, ‘ঘর তো কিছুই সাজাস নাই। কি পছন্দ হবে?’
– ‘পিকচার আভি বাকি হ্যায়। ভাবি, দোস্তকে এক হালি হাঁসের ডিম খাইয়েছি। আপনি এর জন্য সারাজীবন আমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন।’
অম্লান ফাইরুজের মাথায় একটা জোরে বারি দেয়। ফাইরুজ বললো, ‘মারিস কেন শ্লা? আমার ক্রেডিট গুলো ভাবিকে বলি। যাতে তোরচেয়ে বেশি আমাকে মনে রাখে আরকি। ভাবি শোনেন, আমি ঘরের চারকোণে হাসনাহেনা ফুলের ব্যবস্থা করেছি। যাতে একটা ফ্রাগরেন্সফুল বাসর রাত হয়। এরজন্য আমাকে প্রচুর খাটতে হয়েছে। ফুলের গন্ধে যেন ঘরে সাপ না আসে তার জন্য সবকটা ফুটা বন্ধ করেছি, ঘরে ক্লোরোফর্ম ছিটিয়েছি। আমার বন্ধুরাও একেকটা সাপ। ওদের চোখ, কান, দৃষ্টি কোনোটাই যেন না ঢোকে তারজন্য বিশেষ ভাবে হাইড ক্যামেরা ডিটেক্টর দিয়ে পুরো ঘর চেক করেছি। ভালো করেছি না ভাবি?’
সাহিত্য এতক্ষণ ধরে বিশাল আকারের একটা বাক্স হাতে ধরে রেখেছে। ও এবার এগিয়ে আসে বাক্সটা নিয়ে। রঙিন কাগজে মোড়ানো। বললো, ‘ভাবি আমার তরফ থেকে বিশেষ গিফট সামগ্রী।’
ফাইরুজ দুষ্টুমি করে বললো, ‘কি জিনিস আছে বল? নয়তো ভাবি আজকে খুলেই দেখবে না।’
সাহিত্য বললো, ‘ভাবি। কনফিউজড হবেন না। আজকেই খুলবেন।’
বন্ধুরা হেসে উঠলো। সবাই আরেকবার বর বন্ধু ও কনেকে অভিনন্দন জানিয়ে একসাথে একটা গানের দুটো লাইন গাইতে গাইতে বেরিয়ে গেলো। গানটা হচ্ছে, ‘ফাগুনও রজনী ফুরায়ে যায়। হায়.. হায়.. হায়.. হায়..’
অম্লান দরজা বন্ধ করে দিয়ে কবিতার মত বললো, ‘মনে হচ্ছে জানালা দিয়ে এক ফালি চাঁদের আলো আমার বিছানায় এসে পড়েছে। চাঁদের আলো এখন গোল হয়ে বসে আছে।’
চলবে..
লেখক – মিশু মনি